- "দোস্ত কোনদিন প্রেম করেছিস??"

- "না মানে ইয়ে......বিষয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনে।"

- "আরে এটা হইল গিয়ে জলের মত সহজ! খালি মাইয়ার ফোন নাম্বারটা নিবি, কিছুক্ষণ ভুজুং ভাজুং দিবি! ব্যস প্রেম হয়ে গেল!"

- "বলিস কি? এত্ত সহজ?"

- "তুই না পারলে আমারে দিস। পটাইয়া তোরে দিয়া দিমু!"

- "না মানে ইয়ে…পটাবি তুই, প্রেম হবে তোর সাথে আবার আমার কাছে আসবে কিভাবে?"

- "তুই কি মনে করিস? আজকাল পুলা মাইয়ারা যার সাথে প্রেম করে তাঁর সাথে কবুল বইলা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে থাকে? প্রেম প্রেম ভাব নিয়ে এরা একটা সঙ্গী খোঁজে! সেটা আমি হলেও যা তুই হলেও তা!"

এটা অনেক আগে এক বন্ধুর সাথে আমার আলাপচারিতা। এরপর থেকে আজ অবধি জীবনের এই ছোট পরিক্রমায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের আনাচে কানাচে বিদ্যানদের সংস্পর্শে এসে অনেককিছু জেনেছি, শুনেছি, বুঝেছি। এই ধরণের অনুভূতিনির্ভর বিষয়গুলোতে আমার চিন্তা বেশ ভালো কাজ করে কিন্তু প্রতিভার সবটুকু খরচ করেও "ভালোবাসা" নামক বিষয়টাকে কোন ব্যাকরণিক সংজ্ঞায় আনতে পারলাম না।

প্রচলিত ধারায় আমাদের চারপাশের তরুণ তরুণীদের ভাবালুতামার্কা বোধহীন আবেগের নাম যে ভালোবাসা নয় সে বিষয়ে অবশ্য আমার কোন সন্দেহ নেই। চারপাশের মানুষগুলোর ভালোবাসা নামের অতি পবিত্র বিষয়টা নিয়ে অবিশ্বাস্য রকম অর্থহীন, জঘন্য এবং জোর করে মাথায় ঢুকানো সস্তা আবেগে মিশে যাওয়া দেখে অবাক লাগে। ভালোবাসা যেখানে একটা অনুভূতির ব্যাপার সেখানে আমরা আচরণ করি রোবটের মত, অন্ধ-কানা-বোবার মত। ভোগবাদী, সেকুলার এই সমাজে অন্য সবকিছুর মতই মানুষের অন্তরের একান্ত আপন অনুভূতিও আজ যেন ফর্মালিটি মেইনটেইন করা। ভালোবাসতেই হবে, একটা বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ড লাগবেই, এই করতে হবে, সেই করতে হবে......হবে...হবে......হবেই হবে! ভালোবাসা না আসলে ভালোবাসা জোর করে আনতে হবে!

---

চা হাতে দাঁড়িয়েছি এক জায়গায়। কিছুদূর সামনে এক মেয়ে এসে দাঁড়াল। আপাদমস্তক বোরখা আর হিজাব পরা একটা মেয়ে, স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি নিশ্চয়। আশেপাশে বেশ কয়েকটা কোচিং সেন্টার, এর কোনো একটা থেকে বের হয়েছে হয়তো। হঠাৎ সামনে একটা সিএনজি এসে থামল, ভেতরে এক ছেলে, মেয়েটা ডানে বায়ে তাকিয়ে সিএনজিতে উঠে পড়ল। এই সিএনজি এদিক সেদিক ঘুরবে কিছুক্ষণ কিংবা অনেক্ষণ, তারা এই সময়টাতে নর্দন কুর্দন করবে, তারপর একসময় মেয়েটার বাসার আশেপাশে কোথাও সিএনজিটা গিয়ে থামবে, আবারও সাবধানে ডানে বায়ে তাকিয়ে মেয়েটা নেমে যাবে। যেন কিছুই হয়নি এরকম একটা ভাব নিয়ে মেয়েটা ঘরে ফিরবে, রোজ এভাবেই ফেরে। খুবই সহজ সরল গল্পের স্ক্রিপ্ট।

মেয়ের বাবা মা নিশ্চয় সবাইকে বলে বেড়ায় "জানেন, আমার মেয়ে কিন্তু আর দশজনের মত না।" যে ছেলেগুলো খদ্দের সেজে এভাবে সিএনজিতে মেয়ে তোলে, এরকম অনেক খদ্দের ছেলেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, পাঁচ ছয় বছরের ভার্সিটি লাইফে এই ছেলেগুলোকে দেখেছি "আর দশজনের মতো না" মেয়েগুলোর সাথে সেই সিএনজিতে কী কী করে এসেছে তার কুৎসিত বর্ণনা বন্ধুদের রসিয়ে রসিয়ে বলতে।

কী বুঝে আসলে??

স্কুল ড্রেস পরে মামাতো/খালাতো/ফুফাতো কিংবা হাউজ টিউটর না হয় বন্ধুদের কারো সাথে বাবা মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রেম প্রেম খেলা করে বেড়ানো মেয়েটা আসলে কি বোঝে? হঠাৎ করে দেখা কোন মেয়েকে পটিয়ে গার্লফ্রেন্ড বানানোর পেছনে অকালপক্ব প্রতিভার সবটুকু খরচ করা, রাতের পর রাত জেগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলা আর অর্ধেক মাসেই বাড়িতে মাস খরচের টাকা চাওয়া ছেলেটার কাছে ভালোবাসা আসলে কি?

চারপাশের এই ছেলেমেয়েগুলো আসলে চলে ভাড়া করা মগজ দিয়ে। হিন্দি সিরিয়ালের পরকিয়া প্রেম দেখে এরা প্রেম করতে শেখে, 'আমি তুমি-তুমি আমি' গান কবিতায় এরা আবেগের রসদ খোঁজে। গল্প উপন্যাস পড়ে নিজেদেরকে নায়ক নায়িকার আসনে বসিয়ে 'কল্পনা' আর 'বাস্তবতা' গুলিয়ে জীবনে রং লাগায়। সেলুলয়েডের রঙিন পর্দায় নায়ক নায়িকাদের চিত্রনাট্যের আবেগী উপস্থাপন দেখে প্রেমের স্বরূপ বোঝে! ইমরান হাশমি-মল্লিকাদের অর্ধনগ্ন শরীরের ভাষা থেকে সহজলভ্য পর্ণগ্রাফিতে জৈবিকতার আদিম রীতিতে এরা 'ভালোবাসা'টাকে 'শরীর' দিয়ে replace করে।

এরা বোঝে শরীর শরীর খেলায় বিদ্যুৎ চমকের মত হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া ফ্যান্টাসিটুকুই ভালোবাসা! তাদের কাছে তাই ভালোবাসা মানে প্লেটোর ভাষায়, "love is a serious mental disease!!" Wrong! সিরিয়াসলি it's wrong! এই ধরণের ভাড়া করা মগজ প্রসূত ভালোবাসা কোন অন্তরের রোগ নয়, এটা প্রবৃত্তিপূজা। স্রেফ desire. ভালোবাসা মানে যদি অন্তরের সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া, বিধ্বস্ত হওয়া, কোন কাজে মন বসাতে না পারা, জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করা বোঝায় তাহলে সেটা ভালোবাসা নয়। আমরা এসবকে ভালোবাসা মনে করলেও আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরআনে এটাকে hawa বলেছেন। আর যারা এই desire কে অন্ধভাবে পূজা করে তাদেরকেই আল্লাহ্‌ বলেন,

"অতঃপর তারা যদি তোমার কথায় সাড়া না দেয় তাহলে জেনে রেখ, তারা শুধু তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আল্লাহ্‌র পথ নির্দেশ ছাড়া যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে আছে? আল্লাহ্‌ জালিম সম্প্রদায়কে সঠিক পথে পরিচালিত করেন না।" [২৮:৫০]

আমাদের প্রবৃত্তিকে মহান আল্লাহ্‌র কাছে সঁপে দেওয়ার বদলে আমরা সেই প্রবৃত্তিরই পূজা করি আর স্রষ্টার দেওয়া রহমতের একটা মাধ্যমকে পূজা করে সেখানেই রব খুঁজি! আল্লাহ্‌ বলেন,

"আর কোন কোন লোক এমনও আছে, যে আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্যান্যকে আল্লাহ্‌র সমকক্ষরুপে গ্রহণ করে, আল্লাহ্‌কে ভালোবাসার মত তাদের ভালোবাসে। কিন্তু যারা মুমিন, আল্লাহ্‌র সাথে তাদের ভালোবাসা প্রগাঢ় এবং কি উত্তমই হত যদি এ যালিমরা শাস্তি দেখার পর যেমন বুঝবে তা যদি এখনই বুঝত যে, সমস্ত শক্তি আল্লাহরই জন্য এবং আল্লাহ্‌ শাস্তি দানে অত্যন্ত কঠোর।" [২:১৬৫]

কারো প্রতি ভালোবাসা যদি হয় পরিবারকে ছেড়ে যাওয়া, ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া নিজেদের সম্মান, আত্মমর্যাদা, আমাদের শরীর, আমাদের দ্বীন এমনকি ত্যাগ করা সেই মহান আল্লাহ্‌কেও যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন শুন্য থেকে তাহলে we are not in 'love'. We are slaves to that 'love'.

আল্লাহ্‌ বলেন,

"তুমি কি লক্ষ্য করেছ তার প্রতি যে তার খেয়াল খুশিকে ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে?" [৪৫:২৩]

ভালোবাসার মরীচিকার আবরণে আমাদের এই কুপ্রবৃত্তির সাময়িক আনন্দ প্রকৃতপক্ষে যথার্থ স্বাধীনতা নয়—বন্দীশালা! এই বন্দিত্ব মনের, শরীরের আর আত্মার!

একটা সহজ বিষয় একেবারে ঠাণ্ডা মাথায় খেয়াল করি। মনে করুন আমি কোথাও যাচ্ছি। যাওয়ার আগে আপনার হেফাজতে আমার একটি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি যার বিষয়ে আপনি কিছুই জানেন না। আমার জিনিসটার safety হিসেবে আমি কি আপনাকে কিছু direction দিয়ে যাবনা? এটা এমন করোনা, অমন করোনা ইত্যাদি ইত্যাদি...!

তাই নয় কি? আর এই যে আপনার মনে ভাল লাগা-মন্দ লাগার অনুভূতি আছে, আপনি কাউকে পছন্দ কিংবা অপছন্দ করতে পারেন। এই অসাধারণ রহমত আল্লাহ্‌ আপনাকে দিলেন তা কোন rules and regulations ছাড়াই?? কোন security ছাড়াই? Rules and regulations ছাড়া আপনি একটা চার চাকার গাড়ি চালাতে পারেন না, একটা ছোট্ট মোবাইল চালাতে পারেন না......কিছুই করতে পারেন না আর যে মনটার খবর মহান আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কেউ জানেনা সেই মনের ভালোবাসা ধরে রাখার জন্য rules and regulations কি তিনি দেবেন না? এই ভালোবাসার কোন security কি নেই?

“আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে, তিনি তোমাদের (মানব জাতির) মধ্য থেকেই সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য (বিপরীত লিঙ্গের) জুড়ি, যাতে করে তোমরা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পারো! এ উদ্দেশ্যে তিনি তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন হৃদ্যতা- বন্ধুতা আর দয়া- অনুগ্রহ অনুকম্পা। এতে রয়েছে বিপুল নিদর্শন চিন্তাশীল লোকদের জন্য।” [৩০:২১]

সুবহানাল্লাহ! এখানে boyfriend/girlfriend এর কথা নেই, ‘তোমাকে ছাড়া বাঁচব না, মরে যাব’ ‘তুমি জীবন তুমি মরণ’ অসার বাক্যে বিলিয়ে দেওয়া ভালোবাসার অপচয় নেই, শরীর ভোগের চাটুকারিতা নেই—আছে নিরাপত্তা, প্রশান্তি আর পবিত্রতা! যে ভালোবাসা মহান আল্লাহ্‌ দিয়েছেন তিনিই ভালো জানেন কিভাবে এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। আমরা আমাদের মনটাকে purify করব। আমাদের ভালোবাসাকে নির্ধারণ করব শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র দিকে। আর গ্রহণ করব তাঁর অনুমোদিত সিস্টেমটাকে যাতে আমাদের কাছে গচ্ছিত রাখা তাঁর আমানত হেফাজতে থাকে। আমরা আল্লাহ্‌র সিদ্ধান্তে আস্থা রাখব, আমাদের কুপ্রবৃত্তির উপর নয়!

অফিসে যার অধীনে চাকরি করি আমরা তার কথা শুনতে বাধ্য, তাকে সন্তুষ্ট করাই থাকে মূল লক্ষ্য। তার অধীনে থাকা অন্য কারো কথা শুনলে ফায়দা কিছু নেই। ঠিক তেমনি আমাদের প্রতিটি ভালোলাগা, মন্দলাগা, আবেগ অনুভূতির কেন্দ্র যেন হয় মহান আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি। তিনি তার সন্তুষ্টি অর্জনের যে মাধ্যমগুলো দিয়েছেন সেই মাধ্যমকে ভালোবেসে দুনিয়ায় হয়ত কিছু সময়য়ের সস্তা আবেগের মাখামাখি সম্ভব কিন্তু আত্মার কোন সন্তুষ্টি এতে নেই। দোকানে সিডি কিনতে গেলে আমরা সিলভার ডিস্ক এর সন্ধান করি প্রিন্ট যেন ভালো হয়। সেই একই ছবি অতি সস্তা পাইরেটেড সিডি কিনে দেখা যায় কিন্তু তাতে সন্তুষ্টি থাকে না।

মহান আল্লাহ্-‌কে এবং তাঁর জন্য কাউকে ভালোবেসেই আমরা পাব যথার্থ সন্তুষ্টি।

আর নোংরা সমাজের এই নাটুকেপনা আবেগ, সস্তা লোকদেখানো মেকি সুখ সুখ ভাবের প্রেম, নারী পুরুষের শরীর ভোগের এই জঘন্য 'বিশ্বাসযোগ্যতা’ ফুটপাতের পাইরেটেড সিডির মত! চাকচিক্য দেখে মনে হবে ‘পাইলাম ইহাকে পাইলাম’, কিন্তু মোড়ক খুললেই বেরিয়ে আসে ঝাপসা-বিবর্ণ জীবনের এক সস্তা চিত্রনাট্য। আর তাই ভালোবাসা হবে আল্লাহ্‌র জন্য, নফস এর জন্য নয়। তাকেই ভালোবাসব যাকে মহান আল্লাহ্‌ ভালোবাসেন, তাকে ভালোবাসবো না যাকে আল্লাহও ভালোবাসে না!

আল্লাহর জন্য যে ভালোবাসার সূত্রপাত হয় সেই ভালোবাসা নিজের স্বার্থে কখনো অগ্রাহ্য করা যায়না! আমাদের মা রা কেন আমাদের এতোটা ভালোবাসে?? কেন অপরিচিত দুইজন নারীপুরুষ হঠাৎ একদিন বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একে অপরকে এতো বেশি ভালোবাসতে পারে?? কারণ এই সম্পর্কগুলোতে আল্লাহ প্রদত্ত রহমত থাকে! ঠিক সেভাবেই একজন মানুষ যখন আরেকজন মানুষকে আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে (অবশ্য এই ছেলেমেয়েগুলো কি জানে, আল্লাহ্‌র জন্য কাউকে ভালোবাসতে হয় কিভাবে?), তখন সেই ভালোবাসার সবটুকু জুড়ে থাকে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আন্তরিকতা, সহমর্মিতা! শুধুমাত্র এই কারণেই একজন বয়ফ্রেন্ড আর গার্লফ্রেন্ড যতো সহজে "break up" শেষে "new relationship" শুরু করতে পারে, একজন স্বামী তার স্ত্রীকে কিংবা স্ত্রী তার স্বামীকে অত সহজে জীবন থেকে বাদ দিতে পারেনা, যেভাবে পারেনা মা তার সন্তানকে ছাড়তে!! শুধুমাত্র এই কারণে একজোড়া কপোত কপোতী যতো সহজে অন্ধকার ঝোপ-ঝাড় কিংবা রিকশা সিএনজির সুযোগ নেয় একজন স্বামী আর স্ত্রীর কাছে তা এতো সহজ নয়! কারণ একজন স্বামী জানে তার স্ত্রীর সম্মান তারও সম্মান যেভাবে একজন স্ত্রী জানে তার স্বামীর ভালোবাসা শুধুই তার, এটা রাস্তা ঘাঁটে দেখানোর বিষয় নয়!!

ছেলেদের দিকে তাকালেই বুঝা যায়, অধিকাংশ বয়ফ্রেন্ডের কাছে তার গার্লফ্রেন্ড যেন দোকান থেকে কেনা আইসক্রিম! সে জানে আইসক্রিমটা তার কিন্তু খুব অল্প সময়ের জন্য একটু পরেই সেটা পানি হয়ে যাবে!! আর তাই একজন বয়ফ্রেন্ডের মনে তার গার্লফ্রেন্ডের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আন্তরিকতা, সহমর্মিতার চেয়ে বেশি থাকে শরীরকেন্দ্রিক ভোগবাদী ক্ষণস্থায়ী আবেগ যেটা কঠিন বরফ থেকে খুব সহজেই পানি হয়ে যায় দোকান থেকে সদ্য কেনা আইসক্রিমটার মত!! সুবহানাল্লাহ! ইসলাম মানুষকে সেই সম্পর্করেই অনুমতি দিয়েছে যেখানে একে অন্যের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থাকবে, সহানুভূতি থাকবে, শ্রদ্ধাবোধ থাকবে আর থাকবে একে অন্যের সাথে সুখ-দুঃখ গুলো একেবারে নিজেদের মত করে ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ!! আর তাই একজন মুসলিমের কাছে বিয়ে মানেই একটা বউ আর কয়েকটা বাচ্চা-কাচ্চা নয়!

বিয়ে মানে অনেক কিছু……অনেক কিছুর মাঝে ঠিক কয়েকটা লাইনে বোঝানো যায়না এমন কিছু হয়তো!!

আর কয়দিন পর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নামের এক গাঁজাখুরি দিবস আমাদের সবার কাছে ভালোবাসা বিসর্জনের উপলক্ষ্য হয়ে আসবে প্রতি বছরের মতই। আধুনিক শরীরে বিকৃত মস্তিষ্ক নিয়ে গর্বের সাথে বেড়ে উঠা আমাদের তরুণ তরুণী প্রস্তুত এই দিনটির জন্য। কিছু অতি উৎসাহী কিংবা চালাক পুরুষ তৈরি নিজেদের পরিকল্পনা নিয়ে। কিছু বোকা নারী প্রস্তুত ভালোবাসার মোড়কে ব্যবহৃত হতে। সারা পৃথিবী জুড়েই এদিন নষ্টামির চূড়ান্ত হবে। ভালোবাসা দিবসের নামে এই ভোগ দিবসে আমাদের অনেক বোনই জীবনের অনেক কিছু হারিয়ে নোংরা সমাজ থেকে বুঝতে শিখবে 'this is love.' ধর্ষকদের বৃহস্পতি যখন তুঙ্গে তখন এই দিনে ধর্ষণও পাবে এক নতুন মাত্রা! লাল নীল রঙিন স্বপ্ন, টকটকে লাল গোলাপ, হাজারো মিথ্যে প্রতিশ্রুতি-অঙ্গীকার সাথে স্বপ্ন ভাঙ্গার অশ্লীল আনন্দ সবকিছু ছাপিয়ে শুন্য জীবনের আধ্যাত্মিক পরাজয়ে এই মানুষগুলো কোনদিনও জানতে পারবেনা ভালোবাসা আসলেই কি!!

'ভালোবাসা' কে 'শরীর' দিয়ে relpace করা মানুষগুলোর জন্য প্রথম আলোর মত স্বীকৃত প্লাটফর্মও আছে। অমুককে ভালোবাসতাম...কথা হল...দেখা হল...ফিজিক্যাল রিলেশন হল......ব্রেক আপ হল.........এখন আমি কি করব?? এই ধরণের চটি প্রশ্নগুলো মানুষ যতটা গর্বের সাথে করে ততটা গর্বের সাথেই উত্তর আসে এই চটি গল্পগুলোকে সাহস যোগানো আমাদের অপদার্থ সুশীলদের কাছ থেকে। এ যেন আর্টসেলের গানের মতই "তোমরা কেউ কি দিতে পার প্রেমিকার ভালোবাসা" দিয়ে শুরু, মাঝখানে "দেবে কি জীবনে কেউ উষ্ণতার সত্য আশা", আর শেষমেশ "ও আমায় বোঝে নি, অতল এ ভালোবাসা সে তলিয়ে দেখে নি", সান্ত্বনায় আবার "তোমরা কেউ কি দিতে পার প্রেমিকার ভালোবাসা......!!" অন্ধ ভালোবাসার পূজারী মানুষগুলোর কাছে ছবির ডায়লগের মতই "ভালোবাসা জাত ধর্ম বর্ণের ঊর্ধে" যেন এক মুখস্থ ছবক!

প্রথম আলোর নকশায় (১ জানুয়ারি ২০১৩) এক মেয়ে অন্য ধর্মের এক ছেলের প্রেমে পড়েছে। সে বলছে ধর্ম পরিবার ত্যাগ করে তারা একে অপরকে বিয়ে করতে পারবে না। তার প্রশ্নের একটা অংশ হুবুহু দিচ্ছি, "সে বলে ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি যেন বর্তমান সম্পর্কের এই সুন্দর সময়টা নষ্ট না করি। সে চায় আমি অন্য কাউকে বিয়ে করার আগ পর্যন্ত তার সাথে সম্পর্ক রাখি।" আর এতে জনাবা সারা যাকের কি সুন্দর সাহস দিলেন, "যত দিন চলছে চলুক এই মনোভাব নিয়ে চললে ক্ষতি বৈ লাভ কিছু হবেনা। তুমি নিজে বিবেচনা করে দেখ তুমি কোনদিকে যেতে চাও। অনেক ক্ষেত্রে গভীর ভালোবাসা যেকোনো বাধা অতিক্রমও করতে পারে। বিষয়টা ভেবে দেখ।" এই মাথামোটা মেয়েগুলা "গভীর ভালোবাসা যেকোনো বাধা অতিক্রমও করতে পারে" আশ্বাসে নিজেদের ভালোবাসার গভীরতা যাচাই করতে ঘর ছেড়ে পালাবে না তো কি করবে??? আমরা কবে বুঝব এসব ভালোবাসা নয়—desire! ভয়ংকর desire! কত গর্বের সাথে আমরা ভালোবাসার মোড়কে নোংরা গল্পগুলো বলে বেড়াই। কত নির্লজ্জভাবে boyfriend/girlfriend এর সাথে নিত্যদিনের লীলা গল্প সবাইকে জানিয়ে বেড়াই।

আমি জানি এই ছেলেমেয়েগুলো একদিন ঠিকই অন্য কারো সাথে কবুল বলে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। ফেসবুকে 'in a relationship' দিয়ে যার বাহুডোরে সুখ সুখ ভাব নিয়ে প্রোফাইল পিক আপলোড হয় একদিন এই প্রোফাইল পিকে হয়তো সন্তান কোলে ছবি থাকবে—শুধু বাবা ভিন্ন!! দুইজনের হাসিমুখের ছবি বাসর ঘরের ছবির ফ্রেমে টাঙ্গানো হবে। কিন্তু এই মেয়েটি কি তার পাশের মানুষটিকে কোনদিন বলতে পারবে—আমি পবিত্র, আমি শুধু তোমার জন্য পবিত্র ছিলাম! কোনদিনও কি বলতে পারবে জীবনে কারো গোলাপ আমি হাতে নেইনি, কারো হাতে হাত রেখে আমি ভালোবাসা ভালোবাসা খেলা খেলিনি, আমি শুধু আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করেছি একজন ভালো মানুষের হাতে হাত রাখার জন্য। এই ছেলেটি কি কোনদিনও বলতে পারবে—আমি আমার চোখকে সংযত করেছি শুধু তোমার জন্য! কোনদিনও কি বলতে পারবে? কোনদিনও পারবে না! কোনদিনও পারবে না বলে এরা জানতেও পারবে না ভালোবাসা আসলে কী!! পারবেনা বলে প্রবৃত্তিপূজা ছাপিয়ে এরা কোনদিন আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসতে পারবেনা। ভালোবাসার নামে "অসহ্য যন্ত্রণার কিট" নিয়ে এরা এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ভান করে যাবে।

একদিন রাতে ক্যাম্পাসে একা একা হাঁটছিলাম। হঠাৎ এক ছেলে পেছনে মোবাইল ফোনে চিৎকার করে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করল। সে তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপটা তাহলে করেই ফেলছে। সেই চিৎকার করে রাস্তার মানুষের সামনে বলা কথাগুলোর একটা শব্দও এখানে লিখতে পারলাম না। কিছুদিন আগেই হয়তো কুসুম কুসুম প্রেমের শেখানো বুলি দিয়ে এরা রঙিন রঙিন ভালোবাসার গল্প শুরু করেছিল । অর্থহীন সেই আবেগের কি বীভৎস সমাপ্তি আরেকটি রঙিন গল্প শুরুর আগে! আমাদের হিজাবি, দাড়ি- টুপির দ্বীনী ভাইবোনদের শয়তানি হিকমার 'দ্বীনী রিলেশন' এর কথা বলে মনটা খারাপ করতে চাইনা আর লেখাটাও দীর্ঘ করতে চাইনা।

আল্লাহ্‌ তায়ালা সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতে যেখানে নারীদেরকে জন জন করে তাদের মাহরাম কারা তা বলে নন মাহরাম থেকে বিরত থাকতে বলেছেন সেখানে দ্বীনী লেভেলের শয়তানগুলোর কাছে পিরিতির বাকবাকুম "ওহ! এ কিছু না!" অনেকের কাছেই আবার অতি কমন শয়তানি সান্ত্বনা—আরে বিয়ে তো করবই! যেন "বিয়ে তো করবই" এটা সবকিছু হালাল করার সার্টিফিকেট! আমাদের কাছে বিয়েটা যেন সবকিছুর একটা ফুলস্টপ! গল্প শেষ......সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল! তারপর আবার গল্প শুরু হবে জান্নাতের হুর দিয়ে! এত সহজ?? বরং বিয়ে দিয়েই প্রত্যেকের পরীক্ষা শুরু আসলেই ভালোবাসাটা আল্লাহ্‌র জন্য কিনা! ঈমানের পরীক্ষা এখান থেকেই শুরু। আবার অনেকে মনে করে যা কিছু করার করে নিই তারপর আল্লাহ্‌র কাছে তাওবা করে বিয়ে করে ফেলব! অথচ এরা যে তাওবার অর্থটাই বোঝে নি। ইসলামটা একটা সিস্টেম। One way road, এই সিস্টেমে হারাম দিয়ে enter করে হালাল দিয়ে exit করা যায়না। অবৈধ প্রেমের হারাম enter করে যারা হারামটাকে হালাল বানিয়ে এই সিস্টেম থেকে exit করতে চেয়েছে চারপাশে তাদের জীবনের গল্পগুলো পড়ে দেখুন! এই হারাম আপনাদের জীবন থেকে আপনাদের সন্তান হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছড়িয়ে যাবে। বিষ নির্মূল করতে না পারলে তা পুরো শরীরকেই বিষিয়ে তোলে! ভালোবাসার জন্য যারা ভালবেসেছিল, যারা আল্লাহ্‌ এবং আল্লাহ্‌র জন্যই ভালবেসেছিলেন। পেয়ছিলেন আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি, আমরা তাদের কাছেই ভালোবাসা শিখব, সমাজের এই নোংরামি থেকে নয়।

ভালোবাসা—যখন হযরত খাদিজা (রাঃ) সমস্ত সম্পত্তি দ্বীনের পথে কুরবান করেছিলেন যে মানুষটিকে তিনি ভালবেসেছিলেন তার হাতে!

ভালোবাসা—যখন রাসুল (সাঃ) হযরত আয়িশা (রাঃ) এর পান করা পানির গ্লাস তোলে নিয়ে তার চুমুক দেওয়া জায়গাতেই চুমুক দিয়েছেন।

ভালোবাসা—যখন হযরত আয়িশা (রাঃ) কে দৌড় প্রতিযোগিতায় হারিয়ে তার সাথে কৌতুক করেছিলেন।

ভালোবাসা—যখন কেউ শুধুমাত্র মহান আল্লাহ্‌কে ভালোবেসে আধুনিকা গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ড/হারাম সম্পর্ক ডাস্টবিনে ছুড়ে মারতে পারে।

ভালোবাসা—যখন প্রিয় স্ত্রীকে রেখে রহমতের বান্দা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে যায় আর প্রতিশ্রুতি দেয় জান্নাতে তার জন্য অপেক্ষা করবে।

ভালোবাসা—রাতের আঁধারে ক্রন্দনরত যুবকের চোখের পানিতে মহান আল্লাহ্‌র কাছে একজন সচ্চরিত্রের সঙ্গিনীর প্রার্থনা!

এই ভালোবাসা কি কেউ কখনো অনুভব করেছে? কখনো মেপে দেখছে কত ওজন এই ভালোবাসার??

এটা মাপা যায়না—অনুভব করা যায়। এই ভালোবাসায় কোন ব্যক্তিস্বার্থ নেই, কোন ঘৃণা নেই। ভালোবাসা আর ঘৃণা দুইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়! কিন্তু দুইটার মাঝে কেমন একটা মিল খুঁজে পেলাম! আপনি যা সত্যিকার অর্থে ভালোবাসেন তা কখনোই ঘৃণা করতে পারবেন না! আর সত্যিকার অর্থে ঘৃণা করা কাউকে পারবেননা ভালোবাসতে!

তুমি জীবন, তুমি মরণ, স্বপনে তুমি, জাগরণে তুমি টাইপ কথায় ভালোবাসার স্বরূপ বুঝতে চাওয়া বোকামি! আমি-তুমি টাইপ কবিতা আর কিছু লাভ-মেসেজ ভালোবাসা হলে কেউ তার প্রিয় মানুষটাকে না পাওয়ার ভয়ে জবাই করতে পারত না, পারত না ২৬ টুকরা করে রক্তের হোলি খেলতে! এসবে ভালোবাসা নামক মানুষের অনেক গভীরের বিষয়টা থাকে না! থাকে সমাজ থেকে জোর করে মাথায় নেওয়া মনুষ্যত্ব বিসর্জনের কিছু জঘন্য মাদকতা! প্রিয় মানুষটার কোন দোষত্রুটি কিংবা দুর্বল কোন বিষয়কে আয়না করে তার সামনে দাঁড়িয়ে দেখুনতো!! এখনো কি ভালোবাসেন তাকে?? নাকি অন্তরে ঘৃণা জমছে??

যদি ছোট্ট কোন দুর্বলতার জন্য প্রিয় মানুষটার প্রতি ঘৃণা আনতে পারেন তাহলে আপনি তাকে কখনোই ভালোবাসতে পারেন নি! ভালোবাসা সবসময় পাশে থাকা!

ভুলকে মেনে তা শোধরানোর চেষ্টা করা! দিকভ্রান্ত পথ থেকে সঠিক পথের মশাল দেখিয়ে বলা — সখি হাতটা ধর…একসাথে জান্নাতের পথে হাঁটি!!

শেষকথাঃ ভাবালুতা আর নোংরামিতে মিশে যাওয়া আমার মুসলিম ভাই বোনেরা ভুলে গেছে এখানেও ইসলামের say আছে। কিন্তু আমি জানি যাদের উদ্দেশ্য করে এই লেখাটা লেখা তারা কেউ এটা পড়বে না। যে কয়জন সমমনা বন্ধু এটা পড়বে তাদের না পড়লেও হয়। তারপরও ছোট্ট আশা যাদের জন্য এই লেখা তাদের কেউ একজন একদিন……কোন একদিন এই লেখাটা পড়ে দেখবে। হঠাৎ করে হয়তো নিজের মিথ্যে ভালোবাসাটাকে purify করার তাড়না পাবে।

অনেক অনেক পরের প্রজন্মের কেউ একজন এই সমাজের নোংরামিতে ভালোবাসা খোঁজার আগে আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসতে শিখবে। এরকম হলে এই লেখাটা সেই কয়েকজনের জন্য থাক। তারপরও অনেকের কাছেই এই লেখা হাস্যকর মনে হবে। আমাকে ছাগু ছাগু মনে হবে। তাদের জন্য দোয়া থাকল আল্লাহ্‌ যেন সবাইকে হেদায়াত দেন। কিন্তু মনে রাখিস……একদিন এই অবুঝের কথাগুলো জীবনের পাতায় পাতায় মিলিয়ে দেখিস। যেদিন ভালোবাসাহীন জীবনে নিজেকে দেওয়ার মতও এতটুকু ভালোবাসা থাকবে না, যেদিন অন্তরাত্মা শুকিয়ে কঙ্কালসার শরীরে নিজেরই ঘৃণা জমবে সেদিন এই অবুঝের কথাগুলো মিলিয়ে দেখিস! ভালোবাসার মোড়কে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে আত্মসম্মানের শেষ বিন্দুটুকুও বিসর্জন দিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলে পড়ার আগে এই অবুঝের কথাগুলো বুঝে নিস! জীবনের ওপারে আল্লাহ্‌র জন্য কারো ভালোবাসা যদি পেতে চাস তবে এপারে আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসতে শিখিস! মনে রাখিস ধুঁকে ধুঁকে ক্ষয়ে যাওয়া তোর জীবনে আর কেউ না থাকুক অসীম রহমতের আঁধার মহান আল্লাহ্‌ তোকে কোনদিনও নিরাশ করবেনা। অনেক অনেক দোয়া থাকল সবার জন্য।

ভালোবাসা সবার ঘরে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসুক……