[ক]

বর্তমানে ইসলামের একটা সুইট ভার্সন বাজারে আছে। সুইট মানে একদম টাংগাইলের চমচমের মত সুইট। মানসিক দৈন্যে আক্রান্ত এ ভার্সনে দেখানো হয় যে ইসলামী রাষ্ট্র বা দারুল ইসলামে কাফিররা মুসলিমদের সম-অধিকার লাভ করে জিযিয়ার বিনিময়ে! ওয়াও, awesome.

জিযিয়াকে তারা প্রকাশ করে war tax হিসেবে, এবং দেখায় যে জিযিয়া দিয়ে কাফিররা ব্যাপক ফ্যাসিলিটি লাভ করে। বলতে গেলে মুসলিমদের মতই সুবিধা ও অধিকার লাভ করে। আসলে কি তাই?

খোদ জিযিয়া দেওয়াকেই ইসলাম অবমাননাকর বানিয়েছে। কুর'আন বলছে—

"যতক্ষণ না তারা স্বহস্তে নত হয়ে জিযিয়া দেয়" [১]

তো কুর'আন বলছে যে এরা জিযিয়া দেবে নত হয়ে। কতটা নত? এর ব্যাখ্যায় ইমাম সারাখসী (রাহ.) বলছেন—

"আর একারণে যদি যিম্মী ব্যক্তি তার প্রতিনিধির মাধ্যমে জিযিয়া পাঠায় তাহলে তা গ্রহণ করা হবে না; বরং বাধ্য করা হবে সে যেন নিজে এসে দাঁড়ানো অবস্থায় জিযিয়া আদায় করে এবং জিযিয়া গ্রহণকারী বসা অবস্থায় তার কাছ থেকে তা গ্রহণ করবে।

অপর বর্ণনায় আছে, গ্রহণকারী যিম্মীর জামার বুকে ধরে হেঁচকা টান দেবে এবং তাকে খুব ঝাঁকুনি দিয়ে বলবে, এই যিম্মী জিযিয়া দে।" [২]

ইমাম বুরহানুদ্দীন ইব্রাহীম আল হালাবীর (রাহ.) ভাষায়—

"সে দাঁড়িয়ে জিযিয়া আদায় করবে আর গ্রহণকারী বসে নেবে। গ্রহণকারী যিম্মীর জামার বুক চেপে ধরবে, তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলবে এই যিম্মী জিযিয়া দে, অথবা বলবে এই আল্লাহর দুশমন জিযিয়া দে।" [৩]

এ তো গেল জিযিয়া আদায়ের নিয়মকানুন। আর সামাজিক জীবন তারা কীভাবে কাটাবে? ইমাম হালবী (রাহ.) লিখছেন—

"দারুল ইসলামে তাদের নতুন কোনো গীর্জা, মঠ, আশ্রম তৈরি করা বৈধ হবে না। ধ্বংস হয়ে যাওয়াটিকে স্থানান্তর ব্যতীত পুনঃনির্মাণ করতে পারবে। পোশাক-পরিচ্ছদ, বাহন, বাহনের জিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদেরকে আলাদা করা হবে। তারা ঘোড়ায় আরোহণ করবে না। অস্ত্র ব্যবহার করবে না কুসতীজ (পশমের তৈরি আঙুল পরিমাণ মোটা সুতা যা যিম্মীরা কাপড়ের ওপর ব্যবহার করে) প্রদর্শন করবে এবং গাধার জিনের ন্যায় (নিম্নমানের) জিন ব্যবহার করবে।

বরং সবচেয়ে ভালো হচ্ছে তাদেরকে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাহনে চড়তেই দেয়া হবে না। সেক্ষেত্রেও কোনো জমায়েত হলে তারা নেমে যাবে।

আলিম, মুত্তাকী, সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের বিশেষ পোশাক পরিধান করবে না।

তাদের নারীদের পথ ও গোসলখানা ভিন্ন রকমের হবে। তার ঘরে যিম্মী হওয়ার কোনো নিশানা রাখা হবে যাতে তার জন্য ইস্তিগফারের দু'আ না করা হয়, তাকে আগে সালাম না দেয়া হয়।

তার রাস্তা সংকীর্ণ করে দেয়া হবে।" [৪]

এটা হচ্ছে যিম্মীদের ব্যাপারে সেসব বিধান যা ইসলাম দিয়েছে। এর বিপরীতে বাজারে যে সুইট ইসলাম চলছে তার বিধান আল্লাহ দেননি। আল্লাহর দুশমনদের জন্য আখিরাত যেমন সংকীর্ণ তেমনি দুনিয়াও সংকীর্ণ হবে।

সে হিসেবে যারা অযিম্মী, চুক্তিবদ্ধ কাফির নয় তাদের বিধান কী হবে ভাবুন।

[১] সূরা আত তাওবাহ: ২৯
[২] ইমাম সারাখসী (রাহ.), আল মাবসুত: ১০/১৩৮
[৩] ইমাম হালাবী (রাহ.), মুলতাকাল আবহুর: ১/৪৭০
[৪] প্রাগুক্ত

[খ]

অনেকেই বোঝে, পশ্চিমা দেশে থেকে চাইলে সবকিছু সরাসরি বলা যায় না, এখানে হিকমাহ অবলম্বন করতে হয়, LGBTQ, ইন্টারফেইথ সহ নানান ইস্যুতে কিছুটা পশ্চিমা ধাঁচে কথা বলতে হয়। কিন্তু সেই একই মানুষগুলো আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেনের আলিম ওলামারা, কিংবা সেখানকার মুসলিমরা যখন পরিস্থিতি অনুযায়ী কঠিন কঠিন কথা বলে, তারা সেটা মানতে চান না। কারণ তাদের মনমগজে পশ্চিমা ধাঁচের যে ইসলাম জায়গা করে নিয়েছে, সেটার "মানদণ্ডে" দুনিয়ার বাকি সবকিছু তাদের কাছে "এক্সট্রিম", "এরা পড়াশোনা কিচ্ছু করে না", "এরা ইসলামের গভীরে কখনো যায়নি।"

আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, বনু কুরায়যার ঘটনা যদি রাসূল (সাঃ) এর উপস্থিতিতে না ঘটত, কিংবা পরবর্তী কোনো সময়ে ঘটত, তাহলে আধুনিক "ফিকহে" এই ঘটনাকে "বিচ্ছিন্ন ঘটনা" কিংবা "ভুল" হিসেবে আখ্যা দেওয়া হতো। কারণ আমরা যে সংস্করণের ইসলাম মানি, কিংবা আমরা যে জীবনটা যাপন করি, সেখানে এই ধরনের ঘটনা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।

বাংলাদেশের মতো থার্ড পার্টি জায়গায় বসে আমরা পশ্চিমা দাঈদের হিকমাহ বুঝে ফেলতে পারলেও, কাফিরদের আগ্রাসনের ভূমিগুলোতে ইসলামের যে সংস্করণ অনুসরণ করা উচিত, সেটার হিকমাহ আমরা কখনো বুঝে উঠতে পারি না। সেই ভূমিগুলোকেও আমরা আমাদের চারপাশের পরিস্থিতি নিয়ে বিবেচনা করি।

আজকে যাদেরকে খারেজী বলা হয়, তাদের বক্তব্যগুলো আমাদের কাছে কঠোর মনে হয় কেন জানেন? কারণ তারা এমন একটা পরিস্থিতি, এমন একটা ভূমিতে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছে যা আমরা কখনো ফেস করিনি। পশ্চিমে এক দাঈ বসে আমাদের রাসূলের সুন্নাহ শেখাচ্ছে, নবিজি (সাঃ) ইহুদির লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় উঠে দাঁড়িয়েছেন। পশ্চিমের পরিস্থিতিতে এধরনের সুন্নাহর প্রচার 'তাদের সংস্করণে' উপযুক্ত। কিন্তু যে ভূমিগুলোতে মুসলিমরা কাফিরদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছে, তারা যদি এখন সেই রাসূলেরই সুন্নাহর কথা বলে, বনু কুরায়যার মতো কোনো কাজ করে, কিংবা বদরের যুদ্ধবন্দীদের হত্যা না করে মুক্তিপণ নেওয়ায় স্বয়ং নবিকে আল্লাহর তিরস্কার করার কথা মনে করিয়ে দেয়, এখন আর আমাদের ভালো লাগবে না। আমরা সবাই মিলে ইসলামের ইমেজ উদ্ধারে নেমে পড়ব। কারণ এসব আমাদের "কমফোর্ট জোন" এর সাথে যাচ্ছে না।

[গ]

বর্তমানের খৃষ্টানরা আহলে কিতাব নাকি নয় এটা একটা ইখতিলাফি মাস'আলা। বহু প্রসিদ্ধ আলিম মত দিয়েছেন যে এরা আহলে কিতাব নয়। তো যারা বিপক্ষ মত দেয় তারা রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জামানার উদাহরণ আনেন। আসলে সে সময় সাহাবারা খৃষ্টানদের আহলে কিতাব ভাবতেন কি না এটাও জানা দরকার।

ইমাম বাইহাক্বী রাহ. তাঁর আস সুনানুল কুবরায় একটা অধ্যায় এনেছে بَابُ مَا جَاءَ فِي ذَبَائِحِ نَصَارَى بَنِي تَغْلِبَ নামে অর্থাৎ বনু তাগলিবের খৃষ্টানদের জবাইকৃত পশুর ব্যাপারে যা এসেছে সে বিষয়ক অধ্যায়।

এই অধ্যায়ে ১৮৭৯৮ নং হাদিসে উমর রা. এর বক্তব্য এসেছে যে—

"আরবের খৃষ্টানরা আহলে কিতাব নয়। তাদের যবাইকৃত পশু খাওয়া আমাদের জন্য জায়েয নয়। তারা যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ না করছে কিংবা আমি তাদের ঘাড়ে আঘাত না করছি ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাদের ছাড়বো না।"

১৮৭৯৯ নং রেওয়ায়েতে আলী (রা.) থেকেও অনুরূপ বর্ণিত আছে—

উবাইদাহ (রাহ.) বলেন, আমি আলী (রা.) কে বনু তাগলিবের খৃষ্টানদের জবাই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, তা খেও না, কেননা তারা তাদের দ্বীনে মদ খাওয়া ব্যতীত অন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখেনি।"

তো বোঝাই গেল যে সে যুগের খৃষ্টানদেরই খুলাফায়ে ইসলাম আহলে কিতাব মনে করতেন না। তাই ইমাম বাইহাক্বী রাহ. এ প্রসঙ্গে ইমাম শাফিঈর রাহ. উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন যে উমরের রা. কথা যদি এটাই হয় তাহলে খৃষ্টান মেয়েদের বিয়ে করাও হালাল হবে না।

অনেকেই প্রশ্ন করেন যে সে যুগে খৃষ্টানরা আহলে কিতাব বিবেচ্য হলে এ যুগে এসে কেন হবে না? আসলে সে যুগেও সাহাবারা তাদের আহলে কিতাব মনে করেন নি, কাজেই এ যুগে এসে এদের আহলে কিতাব ভাবা, এদের যবাই খাওয়া, এদের মেয়েদের বিয়ে করা তো দূর কি বাত। এরা নামেই খৃষ্টান কাজে আহলে কিতাব নয়।

[ঘ]

হুদাইবিয়ার সন্ধি। দফায় দফায় আলোচনার পর শেষমেশ সন্ধির ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌছানো গেছে। মুসলিমদের পক্ষ থেকে চুক্তি করছেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), ক্বুরাইশের পক্ষ সন্ধিতে সাক্ষর করছে সূহায়ল ইবন আমর।

মুসলিমদের পক্ষ থেকে সাক্ষী হিসেবে আছেন আবু বাকর আস-সিদ্দিক, উমার ইবনুল খাত্তাব, আবদুর রাহমান ইবন আওফ, আব্দুল্লাহ ইবন সূহায়ল ইবন আমর এবং সা’দ ইবন আবূ ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন।

ক্বুরাইশদের পক্ষ থেকে সাক্ষী, মাহমূদ ইবন মাসলামা এবং মুকরিয ইবন হাফস। চুক্তিপত্রটি লিখছেন আলি ইবন আবু তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।

চুক্তিপত্র লেখার সময় সূহায়ল ইবন আমরের পুত্র আবু জান্দাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সামনে এসে উপস্থিত হল। এসময় আবু জান্দাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর পায়ে ছিল লোহার বেড়ি।

ক্বুরাইশ ইসলাম গ্রহণের অপরাধে তাকে বন্দী করে রেখেছিল।

আজো এই একই “অপরাধে” লোহার বেড়ি পরিয়ে রাখা হচ্ছে অনেককে। শাসকদের কাছে আজো অপরাধের সংজ্ঞা বদলায় নি।

রাগে কাঁপতে কাঁপতে সূহায়ল আবু জান্দাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর জামা টেনে ধরলেন। বললেন—

“হে মুহাম্মাদ! এর আগমনের পূর্বেই আপনার ও আমার সন্ধিশর্ত চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে।“

হুদাইবিয়ার সন্ধির একটি শর্ত ছিল “ক্বুরাইশের কোন লোক অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মুসলিমদের নিকট আসলে, মুসলিমরা তাকে ফেরত পাঠাবে। কিন্তু মুসলিমদের কেউ ক্বুরাইশের কাছে চলে আসলে তারা তাকে ফেরত দেবে না।“

সূহায়ল এই শর্তের ভিত্তিতে আবু জান্দাল (রাদ্বিয়ালাহু আনহু) কে ফেরত নিয়ে যেতে চাইলো। যদিও চুক্তি তখনো সাক্ষরিত হয় নি। তার দাবি মানা না হলে সে আলোচনা বাতিল করে দেয়ার হুমকি দিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)—সূহায়লের দাবি মেনে নিলেন।

সূহায়ল লোহার বেড়ি পরা আবু জান্দাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আবু জান্দাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ফরিয়াদ করছেন।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন —
হে আবু জান্দাল! ধৈর্যধারণ কর আর সাওয়াবের আশা পোষণ কর। কারণ আল্লাহ্‌ তোমার জন্য তোমার অন্যান্য দুর্বল সঙ্গীদের মুক্তির ব্যবস্থা করে দেবেন।“

সাহাবারা সবাই স্তব্ধ হয়ে দেখছেন। উমার ইবনুল খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ছুটে গিয়ে আবু জান্দাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলেন। উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর কোমরে ছিলো তলোয়ার। তিনি তার তলোয়ারের দিকে ইঙ্গিত করছিলেন আর আবু জান্দালকে বলছিলেন—

“এরাতো মুশরিক, এদের রক্ত কুকুরের রক্ত।“ [মুসনাদ আহমাদ ও বায়হাকী]

“উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ ঘটনার ব্যাপারে বলেছিলেন, আমি আশা করছিলাম আবু জান্দাল আমার তলোয়ার নিয়ে তার পিতার গর্দানে মারবেন। (যাতে করে আবু জান্দাল পালিয়ে যেতে পারেন, এবং চুক্তিও ভঙ্গ না হয়)।

আবু জান্দাল পিতার প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করেন, তাই চুক্তিটি কার্যকর হয়ে যায়।” [সূত্রঃ ইবন কাসীর, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩১৫,৩১৬]

মুসলিমের সামনে কুকুরের রক্তের কোন দাম নেই।

[ঙ]

সবসময়েই চিন্তা করি লেখাটা শুরু করবো এইভাবে—

"মরু সূর্য্য তখন মাথার উপর আগুন ছড়াচ্ছে। সাহাবীরা তারপরেও থামছেন না। ৬০০ থেকে ৭০০ জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে হবে। দম নেয়ার মত এক মুহূর্তও হাতে নেই। তরবারির কোপে ৬০০ থেকে ৭০০ জনের শিরচ্ছেদ করা, সময় আর শ্রম দুটোরই ব্যাপার। যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে সুখবরটা মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে নিয়ে যেতে হবে।"

লেখাটা হবে বানু কুরায়জা গোত্রের সমস্ত পুরুষদেরকে (নারী আর শিশুদের বাদ দিয়ে), মুসলমানদের সাথে চুক্তিভঙ্গ করে শত্রুর সাথে হাত মিলানোর বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনায় যে বিচার করা হয়েছিলো তার ঘটনাটা নিয়ে আমার একটা ফ্যাক্টচুয়াল রিইমাজিনেশন।

এই লেখাটা লেখার প্রয়োজনীয়তা আমি প্রতিবারই অনুভব করি যখনই দেখি মুহাম্মদ (সাঃ) এর ক্ষমার গল্পগুলার ডোজ আমাদের উপর বেশি হয়ে গেছে।

ইসলাম শব্দটার মানেই শান্তি, মুহাম্মদ (সাঃ) দুষ্ট বুড়ির বেছানো পথের কাঁটা সরিয়ে নিতেন—এই দুইটা জিনিস শুনলেই বুঝি লেখক বা বক্তা নবম/দশম শ্রেণির 'ইসলাম ধর্ম শিক্ষা' বইটার বাইরে জীবনে ইসলামের সম্বন্ধে কোন বই ছুঁয়েও দেখেনি। আর ইদানিং এই দুই কথা আমাদের কালচারে এমনভাবে মিশে গেছে যে এই দুইটা আর এখন ধর্ম শিক্ষা বই পড়ে শিখতে হয়না। এই শিক্ষা এখন আমাদের ছোটবেলাতেই সামাজিকভাবে শেখানো হয়। এমনকি বাংলাদেশের অমুসলিম লোকেরাও এই দুইটা জিনিস সময়মতো উদ্ধৃতি করতে জানে।

এইসব মুসলিমরা এইটাও মাথায় রাখেনা যে 'ক্ষমা'র গল্প যদি শুনাতেই হয়, তাহলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ক্ষমার গল্প হচ্ছে যখন মক্কা বিজয়ের পর যে মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কাবাসীদের ক্ষমা করলেন সেই গল্পটা। গুটিকয়েক নাটের গুরু বাদে, ঢালাওভাবে সবাইকে।

চিন্তা করুন। যাদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন, যাদের হাতে অত্যাচারিত হয়েছেন, যাদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে দেশান্তর হয়েছেন। তারপরেও শেষ না। বারে বারে যারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, বছরের পর বছর সাধনার পর একদিন তিনি পরাজিত শত্রুর সামনে বিজয়ের বেশে গিয়ে দাঁড়ালেন। যারা তাঁর জীবনের মিশনের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিলো, সেদিন তাদেরকে তিনি কী করলেন? বললেন, "যাও, তোমরা মুক্ত!"

এই গল্প থাকতে আপনি যখন বুড়ির কাঁটার গল্প শুনান তখন মনে রাখবেন, মুখের উপর না বললেও অনেকেই আপনার মূর্খতায় মনে মনে হাসে। বাই দ্যা ওয়ে, তার উপর একটু কষ্ট পাবেন যখন একটু খোঁজ নিলেই দেখবেন বুড়ির গল্পটার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। মুহাম্মদ (সাঃ) জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বা শিক্ষনীয় ঘটনাগুলি ভেরিফাই করে নথিবদ্ধ করা আছে 'সীরাহ' আর 'হাদীস' এর মাধ্যমে। বুড়ির গল্পটার এখন পর্যন্ত কোনো রেফারেন্স নেই। তবে শুনতে কিন্তু দারুন শুনায়। শক্তিহীন বুড়ি যাকে কাবু করা কোনো ব্যাপারই না, পথের কাঁটা—পুরাই 'লিটারালি সিম্বলিক' গল্প।

এইসব মুসলিমের পরের আরেকটা লেভেল আছে যাদের একটু কমন সেন্স আছে। তারা বুঝে মক্কার ক্ষমার মতো গল্প থাকতে বুড়ির গল্প কোন পাগলে ব্যবহার করে! তো তারা মক্কার ক্ষমার গল্প শুনিয়ে ইসলাম আর মুহাম্মদ (সাঃ) মানেই যে ক্ষমা সেই আর্জি পেশ করেন।

কিন্তু তাদের ধারণাই নাই মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের ১০০ টার মত উল্লেখযোগ্য সামরিক অভিযানের কথা ইতিহাসে সংরক্ষিত আছে। যার মধ্যে ২৭ টাতে তিনি অংশগ্রহণ করছেন আর ৭৩ টা তাঁর নির্দেশে পরিচালিত হয়েছে। সামরিক অভিযান বলতে আমি বদর, উহুদ এর যুদ্ধ থেকে শুরু করে তথ্য সংগ্রহের জন্য গুপ্তচর পাঠানোর 'সিক্রেট সার্ভিস' মিশন ইত্যাদি কভার করছি।

যুদ্ধের মাঠে উনি ফুল গাছে পানি দিতে যেতেন না, যুদ্ধ করতেই যেতেন। আর সেই যুদ্ধ ফোমের লাঠি দিয়ে হতো না, ঢাল তরবারী আর বর্শা দিয়ে হতো। আর উনি বেশ ভালো যোদ্ধা ছিলেন। তীরন্দাজ আর কুস্তি ছিল তাঁর প্রিয় স্পোর্টস, ক্রিকেট এর মত "সভ্য" স্পোর্টস না।

এসব কথা এভাবে বলতে হতোনা যদি না আমাদের সামাজিকভাবে 'ক্ষমার' গল্পের ওভারডোজ করা হতো। উনি পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামের দৃষ্টান্ত। স্টোরি থেকে বায়াস্ড ভাবে সিলেক্টিভ চ্যাপ্টার তুলে নিয়ে, যেই ইসলামের গল্প দাঁড়াবে, সেটা সত্যিকারের ইসলাম না। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ—সেখান থেকে কিছু বাদ দিয়ে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ রাখা যাবেনা।

ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে ন্যায়। মুহাম্মদ (সাঃ) আমাদের ন্যায় বিচারের দৃষ্টান্ত শিখিয়ে গেছেন। শুধু 'ক্ষমা' না, উনি 'শাস্তি', 'প্রতিশোধ', 'ঘৃণা' সবই ইসলামের অনুসারে দৃষ্টান্ত দিয়ে গেছেন।

টয়লেট করা থেকে শুরু করে একটা ইসলামিক সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন সবই আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তিনি। সময় মত ক্ষমা করেছেন আর সময় মত ৭০০ মাথা ঘাড় থেকে কেটে নেয়ার প্রজেক্ট পরিচালনা করছেন।

তো পরের বার ইসলামের শান্তি আর ক্ষমা শিখানোর আগে মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনী বইয়ের অন্তত সূচিপত্রটা একটু পড়াশুনা করে নিয়েন আরকি…


Original Content Links—[গ] [ঘ]