মাঝে মাঝে মাথাটা ধবধবে সাদা কাগজের চেয়েও ফাঁকা হয়ে যায়। ফারাক্কার প্রভাবে কৃষকের শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাওয়া ফসলের ক্ষেতের চেয়েও ভয়ানক খরার সৃষ্টি হয় মগজের ভেতর। কাগজের ওপর অনড় কলম বা কম্পিউটারের কিবোর্ডে নিষ্ক্রিয় হাত দু’টো জানান দেয় মস্তিষ্কের অলস নিদ্রার কাহিনী। আবার মাঝে মাঝে চিন্তা ভাবনা কল্পনার বৃষ্টি নামে - হাল্কা মধুর বৃষ্টি না, একেবারে ধুন্ধুমার বৃষ্টি - বন্যায় ভেসে যায় সব, কাদাপানিতে কিছুই জন্মাতে পারেনা। মাথাভর্তি গিজগিজে ভাবনার কিছুই শেষপর্যন্ত কাগজতক পৌঁছতে পারেনা। কবি হলে আক্ষেপ করতাম, জন কীটসের মত বলতাম, ‘হায়! যদি আমার সমস্ত ভাবনা, কল্পনা, মনের মাধুরি কাগজে ঢেলে সাজানোর আগে আমার মৃত্যু ঘটে!’ কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের মনের ভেতর কত কি যে আসে যায় তা জানার জন্য পৃথিবী মুখিয়ে নেই, তাই ভাবনাগুলো তার সাথে কবরে চলে গেলেও পৃথিবীর তাতে কোন লাভ ক্ষতি নেই। ফলত, আমার এই খরা বা বন্যার নিষ্ফলতায় আমার কোন আক্ষেপ নেই।

নিজেকে ব্যস্ত রাখতে ভালোবাসি। একাকিত্ব নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তা বা মনখারাপ কোনদিন অনুধাবন করতে পারিনি, কারণ আমার কল্পনার পৃথিবীটা আমাকে এতটা ব্যস্ত রাখে যে আমি ভীড়ের মাঝেও একাকীত্ব খুঁজে পাই আবার জনশূণ্যতার মাঝে ভীড়। একখানা মনের মত বই পেলে হারিয়ে যেতে পারি পৃথিবীর সব বন্ধন ছিঁড়ে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের চিন্তা ভাবনা কল্পনার মাঝে অবগাহন করে মণিমুক্তা তুলে আনার ব্যবসা হামেশাই লাভজনক প্রমাণিত হয়। তবু আমাকে পৃথিবী কাছে ডেকে নেয় বারবার। আশেপাশের মানুষগুলো হৃদয় চিরে দেখায় সেখানে কত কি লুকিয়ে আছে, আলতো হাতে পরশ বুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি, যদি তাতে ব্যাথা কিছু কমে! দু’টো কথা, একটু হাসি অনেক সময় মলমের কাজ দেয়। ভাবি এইটুকু তো আমরা সবাই সবার জন্য করতে পারি, নিখরচা এইটুকু কাজে দু’টো মিনিট সময় ব্যয় করতে কেন যে আমাদের এত অনীহা!

ছোটবেলায় ভুপেন হাজারিকার গলা শুনতে পেলেই ছুটে যেতাম, গলা মেলাতাম, “আমি এক যাযাবর!” তখন ছিলাম কাগজে কলমে যাযাবর। পৃথিবীর পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতাম বাবার সাথে। বড়বেলায় এসে আরেক দেশে যাযাবর বনে গেলাম যার অস্তিত্ব আগে কখনো এতটা ধরা দেয়নি আমার কাছে, বা হয়ত আমিই ধরা দিইনি তার কাছে। মানুষের মন এক অদ্ভুত পৃথিবী। এর কোন কোনটা রূপকথার মৃত্যুপুরীর মত ভয়ানক, কন্টকাস্তীর্ণ, পথের বেড়ে কঙ্কালের হাসি। কোন কোনটা ধুলাবালি, মাকরের জাল আর জঞ্জালে ভরা, বন্ধ দরজা জানালা দিয়ে একফোঁটা আলো প্রবেশ করতে পারেনা। কোন কোনটার ছাদ দিয়ে আকাশ দেখা যায় কিন্তু অযত্নরক্ষিত সেই ঘরে ঠিকমত আলো খেলতে পারেনা, বাতাস এসে উড়িয়ে দিতে পারেনা কোণেকোণে জমে থাকা অহেতুক জঞ্জাল। কোন কোন মনের ঘরে বাগান দেখেছি যাতে নিত্য ফোটে গোলাপ, গাঁদা, বেলী, চামেলি। আর কিছু কিছু মন দেখেছি সূর্যের মত আলোকিত।

সাইকোলজি পড়ার ইচ্ছে ছিল, পড়লাম ইংরেজী। সাহিত্য মানুষের মনের বিচ্ছুরণ। সুতরাং এতে সাইকোলজি এমনিতেই পড়া হয়ে যায়। হীথক্লিফ থেকে সিডনি কার্টন, ম্যাডাম ডিফার্জ থেকে জেন এয়ার সবার মনের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে আসা যায়। সহজেই বোঝা যায় কেউ পরিপূর্ণভাবে খারাপ বা ভাল হতে পারেনা, তবে সবারই ভাল হবার আশা আছে, এমনকি সেটা যদি হয় তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। ডিকেন্সের টেল অফ টু সিটিজ পড়ে চার্লস ডারনেকে যেমন আদর্শ মনে হয়েছিল, সিডনি কার্টনকে লেগেছিল ততটাই অসহ্য। কিন্তু সেই লোকটাই এমন একজনের জীবনরক্ষা করল যাকে সে আদতে সহ্যই করতে পারেনা। তাই তো সে মৃত্যুর মুহূর্তে বলতে পারল, “It is a far, far better thing that I do, than I have ever done; it is a far, far better rest that I go to, than I have ever known.” সুতরাং, যে কেউ জীবনের যেকোন মুহূর্তে বাজীমাত করে দিতে পারে। তাই আমি এই মনগুলোর ভেতর উঁকি দিয়ে কখনো হতাশ হবার কোন কারণ খুঁজে পাইনা। বরং আশ্চর্য হই তার প্রত্যেকটিই ভাল হতে চায়, পরিপূর্ণ হতে চায়, আলোকিত হতে চায়।

তবুও পৃথিবীর মানুষগুলো সভ্য হতে হতে কেমন যেন অসভ্য হয়ে যাচ্ছে! প্রগতি কবে কিভাবে যেন উল্টোপথে চলা শুরু করেছে অথচ মানুষগুলো টের পায়নি। আমরা কবে যেন মানুষ থেকে যন্ত্রে পরিণত হয়ে গেছি নিজেরাই বুঝতে পারিনি। এখন আমরা সার্বক্ষনিক দৌড়ের ওপর আছি, আমাদের প্রয়োজন টাকা আর টাকা। বেগম রোকেয়া যেমন দুঃখ করে বলেছিলেন, আমরা ভুলে গেছি খাওয়ার জন্য জীবন নয় জীবনের জন্য খাওয়ার প্রয়োজন; আমাকেও আক্ষেপ করতে হয়, আমরা ভুলে গেছি টাকার জন্য জীবন নয় জীবনের জন্য টাকার প্রয়োজন। আমাদের সময় নেই পরস্পরের সাথে একটু সুন্দর করে দু’টো কথা বলার, সময় নেই একটি শিশুকে কোলে নিয়ে আদর করার, সময় নেই বৃদ্ধ বাবামার সাথে বসে দু’দন্ড গল্প করার, সময় নেই স্ত্রীর সাথে বসে হাসিমস্করা করার, সময় নেই স্বামীর মনখারাপ কেন খোঁজ নেয়ার, সময় নেই ভাইবোনের সাথে বসে দু’টো উপদেশ দেয়ার, সময় নেই অভাবের তাড়নায় রাস্তায় ফুল বিক্রি করতে নামা শিশুটির দিকে একটু হাসিমুখে তাকানোর। সময় আছে শুধু টাকা কামানোর আর খরচ করার। এই জীবন আমাদের কাঙ্ক্ষিত পরিপূর্ণতার সন্ধান দিতে পারেনা। আমাদের সমস্ত চিন্তা ভাবনা কল্পনা চেতনার কেন্দ্রবিন্দু যখন আমরা নিজেই, আমাদের পৃথিবী যখন আবর্তিত হয় কেবল ‘আমি’কে ঘিরেই তখন এই ক্ষুদ্রতা বদ্ধ জলাশয়ে ব্যাঙাচির ঝাঁকের মত ব্যাধির জন্ম দেবে সেটাই তো স্বাভাবিক! তাই আমাদের মনে রোগ সৃষ্টি হয় প্রতিনিয়ত।

এই রোগ থেকে মুক্তির জন্য অন্তর্চক্ষু খুলে তাকানোর কোন বিকল্প নেই, স্পিরিচুয়ালিটির কোন বিকল্প নেই। এপিকিউরিয়ানদের মত কিছু কিছু মানুষ কেবল জান্তব লেভেলে বাঁচে, তাদের স্পিরিচুয়ালিটির কোন প্রয়োজন বা বালাই নেই, খেয়েদেয়ে ফূর্তি করে একদিন হুট করে মরে যায়। তারা একরকম ভালই আছে, অতীত বর্তমান ভবিষ্যত কিছুই নেই তাদের। আর কিছু মানুষ ধর্মচর্চা করে কিন্তু ধর্ম বোঝেনা। ধর্মীয় বিধিনিষেধগুলো তো আসলে মানুষের মাঝে ধর্মবোধ জাগ্রত করার একটা মাধ্যম। আমরা যদি সারাজীবন ধর্মচর্চা করলাম কিন্তু মনের দরজা জানালাগুলো খুলে আলোর সন্ধান পাবার পর্যায়ে পৌঁছতে না পারলাম তার চেয়ে হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডি বোধ করি গ্রীক ট্র্যাজেডির মাস্টার ইস্কাইলাসও লিখতে পারেননি। পরিপূর্ণতা তখনই সম্ভব যখন ধর্মীয় চর্চা এবং ধর্মবোধ আমাদের মাঝে পরিমিতি এবং জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারবে। তখন আমরা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডি পেরিয়ে অন্যকে প্রাধান্য দিতে পারব, নিজেদের চাহিদাকে লাগাম দিয়ে অন্যের চাহিদা পূরণ করতে পারব, নিজের আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে অন্যের আবেগের মূল্যায়ন করতে পারব… কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়, চাই শুধু নিজেকে উজ্জীবিত করা। তাই বুঝি ব্রাউনিং বলেছিলেন, “Ah, but a man’s reach should exceed his grasp, or what’s a heaven for?”

সবাই যদি নিজ নিজ বেহেস্তের সন্ধানে পথ চলত, পৃথিবীটা হত স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর! এই সুন্দরের কল্পনায় দিন কেটে যায় সোনালী পাখায় ভর করে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে জাগে সুন্দর স্বপ্নগুলোর কথা সবাইকে বলতে, সবাই মিলে স্বপ্ন দেখতে… তারপর আবার ভাবি, কি হবে জানিয়ে? যাদের প্রশংসা করার অভ্যাস তারা বলবে, ‘বাহ, বাহ! ভাল কথা!’; যাদের মনের পরতে পরতে বিদ্বেষের আস্তরণ জমে কালশিটে পড়ে গেছে তারা বলবে, ‘তুমি নিজে কেমন আগে তাই দেখ বাপু!’ একসময় প্রশংসা আর সমালোচনা দুটোই হারিয়ে যাবে কালের গহীন আবর্তে, তারপর আবার পৃথিবী ফিরে যাবে তার সনাতন ধারায়; আমার, আমাদের স্বপ্নগুলো অর্থহীন হয়ে পড়ে থাকবে পথের ধুলোয়। আমার এই চিন্তা ভাবনা কাউকে সাময়িক স্পর্শ করলেও আমি শেলি, ব্রাউনিং বা জেন অস্টেন নই যে দীর্ঘস্থায়ী কোন ফলাফল রেখে যাওয়া যাবে। তাই ভাবি, লিখব? লিখে কি হবে? তার চেয়ে থাকনা আমার সুন্দর কল্পনাগুলো মনের গোপন কুঠুরীতে, লোকচক্ষুর অন্তরালে, নিরাপদ, পবিত্র এক স্বপ্ন হয়ে!