স্পর্ধা ২: পুঁজিবাদ (চলছে)

গত পর্বে বলছিলাম বর্তমান পৃথিবী যে সিস্টেম/অর্ডার অনুযায়ী চলছে তা হল 'পুঁজিবাদ-ভোগবাদ' সিস্টেম। এটা এমন দীন বা জীবন-ব্যবস্থা যা গ্রহণ করে নিয়েছে কাফির-মুমিন সবাই। খুব ভেবে দেখুন, পুরো সিস্টেমটায় উপরের স্তর লাভবান হচ্ছে। এখানে:

অর্থব্যবস্থা: পুঁজিবাদ (ওয়ান-ওয়ে)। অর্থনৈতিক কাঠামোয় যে যত উপরে তার দিকে লাভের স্রোত, পুঁজির স্রোত। উৎপাদক/মজুর/শ্রমিক নিম্নতম মজুরি পায়। ভোক্তা থেকে অর্জিত লাভের বলতে গেলে কিছুই পৌঁছে না উৎপাদকের হাতে। ধনী হয় আরও ধনী, গরীব হতে থাকে আরও গরীব।

ব্যক্তিব্যবস্থা ও পরিবার-ব্যবস্থা: জানিনা শব্দটা বানালাম কিনা। সেলফ-মোটিভেশন বা সেলফ-অপারেটিং-সিস্টেম। এটা আজ 'ক্যারিয়ারিজম'। ধর্ম শব্দের অর্থ যদি (√ধৃ+অনট) হয় ধারণ করা, তবে মুমিন-কাফির নির্বিশেষে প্রত্যেকের অসাম্প্রদায়িক ধর্ম হল ক্যারিয়ারিজম। আরও উপরের স্তরের ভোক্তা হবার প্রতিযোগিতা। সবাই এই ক্যারিয়ারিজম টার্গেট রেখে ভাবে। সন্তানকে ক্যারিয়ারের জন্য বড় করে। অধিক হারে ভোক্তা তৈরি, বেশি ভোক্তা তৈরি। দুনিয়া উপভোগ/ভোগই লক্ষ্য।

সমাজ-ব্যবস্থা: ইনডিভিজুয়ালিস্টিক। সেলফ-সেন্টার্ড। অনেক প্রয়োজন সমাজ মেটাতো। সমাজের সেই ফাংশনগুলো শেষ করে দেয়া হয়েছে। পুঁজিবাদ সেগুলোর ভার নিয়েছে। ভোক্তা বাড়িয়ে নিয়েছে। যাকাতের জায়গা নিয়েছে মাইক্রোসুদ। মেহমানদারি ও পান্থশালার জায়গা নিয়েছে হোটেলব্যবসা। আত্মীয়-সংযোগের স্থান নিয়েছে ক্যাবল-টিভি। একাকী জীবন, একক পরিবার।

বিচার-ব্যবস্থা: বৃটিশ বিচার ব্যবস্থা। কোর্ট-উকিল নিয়োগ-জেল। ডেটের পর ডেট, আরও ডেট। আইনের প্যাঁচ, প্রচুর ফাঁক। পুঁজিপতিদের জন্য কোনো আইন নেই। ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবে। সিস্টেমে পড়ে যায় ফাঁসির আসামীর ক্ষমার ব্যবস্থা। বাদীর কোনো say নেই। বিস্তারিত এবং বিকল্প পরে কোনোদিন আলোচনায় আসবে হয়তো।

রাষ্ট্রব্যবস্থা: সেক্যুলার সোকল্ড 'গণ'তন্ত্র। যেখানে সরকার বসাবে পুঁজিপতিরা (গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকরা)। Government by the পুঁজিপতি, of the পুঁজিপতি, for the পুঁজিপতি। নির্বাচনের ডোনার পুঁজিপতিরা, মন্ত্রিপরিষদে পুঁজিপতিরা, পলিসি হবে তাদের পক্ষে। অর্থপাচার, ঋণখেলাপি, কালোটাকা, শেয়ার বাজারে পুঁজিলোপাট সব তারা করবে। কিন্তু তাদের পুতুল তাদের বিরুদ্ধে কিচ্ছু করবে না। ৩য় বিশ্বের পুঁজিপতিদের উপরে আছে ১ম বিশ্বের পুঁজিপতিরা (Buyerরা, সাপ্লায়াররা)। তারা বসায় তাদের সরকার।

এবার তাকান। পুরো সিস্টেমটার পুঁজির স্রোত উপরে। শ্রমিকদের নামমাত্র মজুরি দেয়া, ভোক্তাধর ঠকানো, পণ্যে ভেজাল, বেশিদিন টেকানোর জন্য বিষ দেয়া, জমিতে যথেচ্ছা সার কীটনাশক থেকে নিয়ে ঘুষ-দুর্নীতি সব কিছুর মূলে এই সিস্টেমটা। প্রতি স্তরে যে বসে আছে, সে চাচ্ছে আরও লাভ করতে, আরও পুঁজি বাড়াতে। যে করেই হোক। ব্যবসায়ী হিসেবে সে চাচ্ছে আরও পুঁজি বাড়াতে, আর একই লোক ভোক্তা হিসেবে চাচ্ছে আরও বেশি ভোগ করতে, আরও উপরের স্তরের ভোক্তা হতে।

ফলে প্রতিটি ব্যক্তি নিজে নিচের স্তরে জুলুম করছে পুঁজি বাড়ানোর জন্য। আর উপরের স্তরের কাছে সেই ব্যক্তিটিই মজলুম হচ্ছে ভোক্তা হিসেবে। পুরো সিস্টেমটাই নষ্ট। যে মাছওয়ালা আমাকে ১০০ গ্রাম কম দিল কেজিতে, সেও পাইকারের কাছে মণে ৩ কেজি কম পেয়েছে। বেশি লাভ সবাই করতে চাচ্ছে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে। যে অফিসার আজ আমার থেকে ১০,০০০ টাকা ঘুষ নিল, ঐ চেয়ারে থাকতে তাকেও কোথায়ও ঢেলে আসতে হচ্ছে মাসে কিছু। একটা সিস্টেম। উন্নত বিশ্ব হয়ত এভাবে নিচ্ছে না, কিন্তু ভিন্ন কোনোভাবে এই পুঁজির একমুখী স্রোত চালু রেখেছে।

দুটো উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। আমি সবার সাথে খুব গল্প করি। ইমার্জেন্সিতে রুগী না থাকলে ওয়ার্ডবয় থেকে নিয়ে স্থানীয় পরিচিতমুখ সবার সাথে। তো রাতে অন ডিউটি পুলিশ কনস্টেবল এস-আই, ওনাদর সাথেও খুব খাতির গপসপ করতাম। একদিন একজন কনস্টেবল এসে দুঃখের কথা শোনালেন: স্যার, আসামী ধরতে অনেকগুলো সোর্স পালি। তাদের টাকা না দিলে ইনফো দেবে না। আবার এদের পালার জন্য বরাদ্দ পাই না। কিংবা বরাদ্দ থাকে, সিনিয়ররা নিয়ে নেয়। ওদিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ আসামী ধরতে না পারলে প্রোমোশনের স্কোর তুলতে পারবো না। বেতনও বাড়বে না, জিনিসপত্রের যা দাম। তো কী আর করব, নিরপরাধ লোক ধরে থানায় দিতে হয়, যাতে আমার কোটা পূরণ হয়। প্রোমোশন যেন পাই। দেখেন সিস্টেমে পড়ে বেচারা জুলুম করতে বাধ্য হচ্ছে নিরপরাধের উপর, সে নিজেও মজলুম।

শেষ উদাহরণ। আমার চেম্বার। রুগী এসেছে। লাইপোমা জাতীয় টিউমার। অনেকগুলো, একটা আবার ব্যথা, দ্রুত বড় হচ্ছে। আমি দেখে টেখে বললাম: ব্যথা না হলে সমস্যা ছিল না। যেহেতু ব্যথা, আর বড় হচ্ছে, অপারেশন করাতে হবে বড় ডাক্তার দিয়ে। অপারেশনের পর আবার বায়োপসি করতে হবে খারাপ কিছু কিনা বুঝতে। আপনি কুষ্টিয়া মেডিকেলে যাবেন, যত দ্রুত সম্ভব। আর কিছু ব্যথার ওষুধ লিখে দিলাম। ৩০০ টাকা ভিজিট দিল, বের হয়ে বাইরে গিয়ে বসলো। যে ডায়গনোস্টিকে বসি, তার মালিক এসে বললো: স্যার, রুগীটাকে পাঠিয়েছে পল্লীচিকিৎসক, তাকেও একটা পার্সেন্টেজ দেয়া লাগে। আপনি যদি টেস্ট না দেন, তাহলে ওকে ওর পার্সেন্টেজ দেব কোত্থেকে? পকেট থেকে? সে রুগীটাকে আবার পাঠালো ভিতরে, অশিক্ষিত গ্রাম্য কৃষক। খচখচ করে লিখলাম রক্ত পরীক্ষা আর প্রস্রাব পরীক্ষা। আর আমার ভিজিটটা দিলাম ফিরিয়ে। সিস্টেম।

পুলিশ-ডাক্তারদের সবাই গালি দেয়। দোষ করলে তো দিবেই। কিন্তু সিস্টেমটাকে কেউ গালি দেয়না। সিস্টেমটাকে কেউ বদলাতে চায় না। সিস্টেমের কর্তারা এসে ঠ্যাঙাবে বলে? প্রতিটা পুলিশ-ডাক্তার-শিক্ষক সেবার ব্রত পোষণ করে। মনের গভীরে। কিন্তু এই লোভী সিস্টেম তাকে করে তোলে লোভী-কঠোর। যে সিস্টেম ঘুষখোর তৈরি করে, কসাই তৈরি করে, ফাঁকিবাজ তৈরি করে। সে সিস্টেমের বিরুদ্ধে কেউ বলেন না। সমাধান ইসলাম নিয়ে এসেছিল, হুজুরদের কথাটা একবার বসে শোনেন। একবার বসেন। কী অর্থনীতি, বিচার-ব্যবস্থা, রাষ্ট্রপদ্ধতির কথা তারা বলে, একটাবার শোনেন। নাকি জানেন? জানেন বলেই শোনেন না? কার স্বার্থে? জুলুম করা যাবে না আর, তাই?

কত মজলুমের চোখের পানি আজ করোনা ডেকে এনেছে, আমফান ডেকে এনেছে, সেটা কেউ বলবেনা। সবাই বলবে নিম্নচাপ হয়ে আমফান এসেছে। মুমিন এটা বলবে না। মুমিন বলবে, 'মজলুমের দুআ আল্লাহর দরবারে কবুল, এমনকি মজলুম কাফের হলেও'। কত মজুরের বেদামী ঘাম, কত কয়েদীর উতলা মন, কত সর্বস্বান্ত বাদীর দীর্ঘশ্বাস, কত সেবাগ্রহীতার তিতে মন, কত চোখের পানি এই সিস্টেমের কারণে আল্লাহর দরবারে নালিশ করেছে বছরের পর বছর। পুরো দুনিয়ায়। আল্লাহর ক্রোধ না আসার কোনো কারণই তো আমি খুঁজে পাইনা। আপনারা কীভাবে এত নিশ্চিন্ত, এত প্রশান্ত?