[Owner আল্লাহর সাথে আমাদের স্পর্ধার কথা লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমাদের সেকুলারিতার (আল্লাহমুক্ত-করণ) দুইটা পর্ব (১১/১২) পরে দিব ইনশাআল্লাহ। পারিবারিক জীবন থেকে কীভাবে আমরা আল্লাহকে বের করে দিলাম। আর বোনেরা কীভাবে আল্লাহকে নিজেদের জীবন থেকে বের করে দিল, সেটা নিয়ে দুটো পর্ব হবে। 'আল্লাহকে বের করে দেয়া' কথাটা খুব খারাপ শোনাচ্ছে, না? জি, এতোটা দম্ভ আর অহংকারই আমরা দেখিয়েছি আমাদের রব্বের সাথে, আমাদের পালনকর্তা দয়াময় আল্লাহর সাথে। আজ চলে যাচ্ছি আমাদের দ্বিতীয় সামষ্টিক স্পর্ধায়। ]

২য় স্পর্ধা: পুঁজিবাদ
-----------------------------------

পুঁজিবাদ একটা জীবনব্যবস্থা (দীন)। ইসলাম যেমন জীবনের প্রতিক্ষেত্রে নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখে। ইসলাম ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ-বাজার-আদালত-রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, সুস্পষ্ট নীতিমালা দেয়। তেমনি পুঁজিবাদকে যদিও আমরা 'অর্থব্যবস্থা' হিসেবে পড়ি, কিন্তু ফাংশনালি এটা একটা দীন। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করে, নীতিমালা গড়ে দেয়। আজ আমরা নীতিমালা হিসেবে সর্বক্ষেত্রে পুঁজিবাদকে গ্রহণ করেছি, মানে আমাদের দীন পুঁজিবাদ। ইন্নাদ্দীনা ইনদাল্ল-হিল ইসলাম। আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র দীনকে ছেড়ে দিয়েছি আমরা। এটা আমাদের দ্বিতীয় স্পর্ধা। এটার আলোচনা হয়ত সামনের পর্বেও গড়াবে।

একটু ইতিহাস দেখে নিই। শিল্পবিপ্লবের আগে সারা দুনিয়া চলত কুটিরশিল্পে বা ক্ষুদ্রশিল্পে। যখন ইনজিন আবিষ্কার হল, তৈরি হল বৃহৎ শিল্প। একব্যক্তির পক্ষে বড় বড় কারখানা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা কঠিন হত, কারণ একজনের হাতে এত পুঁজি/মূলধন থাকে না। ডেভলপ হল ব্যাংক-ব্যবস্থা, যেখানে সমাজের সবাই টাকা রাখত। সমাজের সকলের পুঁজি একত্রিত হয়ে চলে যেত ঐ পুঁজিপতির হাতে ঋণ হিসেবে, যাতে সে বড় কারখানা বানাতে পারে। কারখানা থেকে এদের প্রচুর লাভ করতে হবে।

ব্যাংকের সুদ, শ্রমিকের মজুরি দিয়ে থুয়ে তাকে আরও লাভ করতে হবে যাতে সে আরও মেশিন কিনতে পারে, ব্যবসা আরও বড় করতে পারে। এই ক্রমাগত পুঁজি বৃদ্ধির প্রবণতা থেকে পুঁজিবাদ (Capital-ism) শব্দের উদ্ভব। কিন্তু বর্তমানে পুঁজিবাদ কেবল ব্যবসায়িক প্রবণতায় সীমাবদ্ধ নয়। পুঁজি বৃদ্ধির প্রবণতা আজ প্রতিটি মানুষের শিরায় শিরায় প্রবহমান। যেকোনোমূল্যে 'পুঁজির আমদানি' আজ আমাদের আরাধ্য দেবতা। Money is the second god.

ইসলাম ও পুঁজিবাদের পার্থক্যটা বুঝতে হবে আমাদের। বিশ্বের একক হচ্ছে মানুষ। মানুষের সংজ্ঞা কেমন, তার উপর নির্ভর করবে পুরো সিস্টেমটা কেমন। ইসলামের মতে মানুষ একটি আধ্যাত্মিক (spiritual) জীব। মানুষের উন্নতি মানে তার আধ্যাত্মিক উন্নতি। একজন মানুষ যত আধ্যাত্মিক ভাবে উন্নত হতে থাকবে তত সে তার অস্তিত্বের পূর্ণতায় পৌঁছবে। তার অস্তিত্বই 'আবদ' হিসেবে (দাস/বান্দা)। "আমি জীন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদাতের (দাসত্বের) জন্য"। অর্থাৎ একজন 'আবদ' হিসেবে আপনি যত পারফেকশনের দিকে যাবেন, তত আপনি আপনার সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেন, মানবজনম তত সার্থক হতে থাকবে। ইবনে আব্বাস রা. 'ইবাদাতের জন্য' অংশটুকুর অর্থ করেছেন 'লিয়া'রিফুন' (চেনার জন্য)। আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাঁকে চেনার জন্য। যত চেনা হবে, তত আমার আবদিয়্যাত (দাসত্ব) পরিপূর্ণ হবে, আধ্যাত্মিকভাবে আমার উন্নতি হবে। মানুষ-এর এই সংজ্ঞাটুকুর উপর ইসলামের পুরো সিস্টেমটা দাঁড়ানো।

মানুষের সাথে আল্লাহর এই আধ্যাত্মিক সম্পর্ক 'ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র'-র ইসলামী সংজ্ঞা দেয়। আমার প্রতিটি সম্পর্কের মাঝে আল্লাহ আছেন। রাষ্ট্র-প্রজা, বিচারক-বাদী, ক্রেতা-বিক্রেতা, সেবাদাতা-গ্রহীতা, উৎপাদক-ভোক্তা, চুক্তির দুইপক্ষ, পড়শী-পড়শী, কাফির-মুসলিম, আত্মীয়-আত্মীয়, স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র, ভাই-বোন, এমনকি বাথরুমে/ একেলা বাসায় একাকী আমি। প্রতিটি সম্পর্কের মাঝে আল্লাহ রয়েছেন, এই বোধের জন্ম দেয় আবদিয়্যাত/ দাসত্বানুভূতি। ফলে প্রতিটি সম্পর্কের মাঝে এক আশ্চর্য জবাবদিহিতা-সংযম-পরোপকার এবং ওহীভিত্তিক নীতিমালা মেনে চলার প্রবণতা ব্যক্তিকে জীবনের প্রতি কদমে ন্যায় প্রতিষ্ঠার তাড়না যোগায়। কেননা তাকে তো আবদিয়্যাতের পূর্ণতা দ্বারা আধ্যাত্মিক উন্নতি করে রব্বকে খুশি করতে হবে। এটা একটা সফটওয়্যার যা বাথরুম থেকে রাষ্ট্র সবখানে তাকে জুলম করতে বাধা দিবে, ইনসাফ ও কল্যাণ সাধনে তাড়িয়ে নেবে।

পুঁজিবাদের চোখে মানুষ কেবল একজন 'ভোক্তা'। তার ভোগের চাহিদা সীমাহীন। অর্থনীতির সংজ্ঞা কী পড়েছিলাম, মনে আছে? অসীম চাহিদা ও সীমিত সম্পদের মাঝে ব্যালেন্স। পুঁজিবাদ প্রোডাক্ট বানাবে, আর বিক্রি করে মুনাফা কামাবে, তার পুঁজি বাড়বে। তার চোখে মানুষ একজন ভোক্তা (consumer/customer), আপনি যত ভোগ করতে আগ্রহী হবেন, তার প্রোডাক্ট তত বিক্রি হবে। অতএব তার কাছে মানবজনমের সার্থকতা হল ভোগে।

'YOLO= you only live once', 'জী ভারকে জীও, কাল হো না হো'- মিডিয়া, বিনোদনের নামে এগুলো শেখানো

নাস্তিকতা-বিবর্তন-নারীবাদ-মানবতাবাদ ইত্যাদি দিয়ে ধর্ম/আধ্যাত্মিকতাকে বাতিল করা পুঁজিবাদের কাজ। তাকে টিকে থাকতে হলে মানুষকে পরিপূর্ণ ভোক্তা বানাতে হবে, সংযমের সব বেড়া উঠিয়ে দিতে হবে। পুঁজিবাদ আপনার মধ্যে ভোক্তা হবার অনুপ্রেরণা দেয়, আপনার ভোক্তা হওয়াকে যারা বাধা দেয় (ধর্ম), যাদের ভিলিফাই নালিফাই করে। তার চোখে আপনি যত বড় ভোক্তা, আপনার তত উন্নতি হয়েছে। গাড়ি-বাড়ি-ফোন-পোশাক-গগলস-খাবার। যত দামী যত ফ্যাশনেবল, যত বেশী তত আপনি সার্থক জীবনে। সমস্ত হাতিয়ার (মিডিয়া, এডুকেশন) ইউয করে এমনভাবে আপনার মাথায় পুঁজিবাদ ঢুকেছে, আপনিও একজন উন্নত ভোক্তা হবার চেষ্টায় দৌড়োচ্ছেন।

যেকোনমূল্যে আপনাকে একজন পাক্কা ভোক্তা হতে হবে, এজন্য চাই প্রচুর টাকা।

আপনার বাবা যে লেভেলের ভোক্তা ছিলেন, তার চেয়ে আপনাকে উপরের লেভেলের ভোক্তা হতে হবে। সুদ-ঘুষ-দুর্নীতি-ভূমিদস্যুতা-খুন-প্রতিজ্ঞাভঙ্গ-অর্থনৈতিক সব অপরাধ করে হলেও ভোগের তাড়না মেটানো চাই।

এখানে ব্যক্তি পুঁজিবাদী (ভোগের তাড়না, ক্যারিয়ারিস্টিক, অপরাধপ্রবণ)

পরিবার পুঁজিবাদী (চাকরিজীবী মা; সন্তানের চোখে 'লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে')

সমাজ পুঁজিবাদী (অপরাধ ও কলহপ্রবণ, আত্মকেন্দ্রিক)

বাজার পুঁজিবাদী (মাপে কম, মজুতদারি, সিণ্ডিকেট, প্রতারণা)

অর্থনীতি পুঁজিবাদী (সুদী, খেলাপী, একমুখী প্রবাহ, পাচার)

রাষ্ট্র পুঁজিবাদী (পুঁজিপতি নিয়ন্ত্রিত সরকার, পুঁজিপতিরাই মন্ত্রী, পুঁজিপতি-বান্ধব পলিসি)

প্রতিটি মানুষ পুঁজিবাদী। যেকোনো মূল্যে পুঁজি বাড়ানো চাই। দুটো সিস্টেমের কনট্রাস্ট দেখেন। একটা জুলুম করতে বাধা দিচ্ছিল। আরেকটা জুলুম করতে উৎসাহিত করছে। ফলে আবশ্যিকভাবে প্রতিটি মানুষ কিছু কিছু না কিছু জুলুম করছে। এই পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে আমরা দীন হিসেবে নিয়েছি। টাকা আমাদের আরাধ্য দেবতা। লা ইলাহা ইল্লাল মাল। এ এক আজব দীন, যেখানে মজলুম নিজেও জালেম। জালেম নিজেও মজলুম।

কীভাবে তা জানতে আরেকটা পর্ব আমাদের লাগবে।