★ পারিবারিক সেকুলারিতা:

তখন শীতের শেষ সময়। ফজরের জামাত একটা সময় ৫:৫০ বা ৬:০০ টার দিকে থাকেনা? ঐ সময়টায়। আহলে হাদিস মসজিদে প্রায় মিনিট তিরিশেক আগে জামাত হত। আমার বাসা থেকে হানাফী আর আহলে হাদিস মসজিদের দূরত্ব সমানই। খুব সম্ভব লেখালেখির জন্যই হবে, আমি আহলে হাদিস মসজিদে যেতাম আগে আগে নামায পড়ে এসে কাজ শুরু করার জন্য। আমার বাসার সামনেই একটা দোকানঘর ভাড়া করে একজন স্যার বেশ ক'টা ছেলেমেয়ে পড়াতেন ঠিক ঐ টাইমটায়, বাচ্চাগুলো সেভেন-এইটের হবে। আমি যেতাম আর দেখতাম, ঠিক সাড়ে পাঁচটায় বাবা-মায়েরা বাচ্চাদেরকে দিয়ে যাচ্ছেন। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই সেটা আউয়াল ওয়াক্ত, এবং খুব বেশি সম্ভাবনা যে এই বাচ্চারা কেউই ফজর পড়েনি। বাবা-মায়েরা ফিরে গিয়ে পড়বেন, কিন্তু এই ১৩-১৫ বছরের বাচ্চারা আর পড়বে না। অনেকগুলো ভালো ধারণা করা যায়, কিন্তু বর্তমান সেক্যুলার ক্যারিয়ারিস্ট ফ্যামিলি কালচারের কারণে সে সুধারণা আমি করতে পারলাম না। স্যরি।

কাকডাকা ভোরে আমরা আমাদের সন্তানদের কোচিং ব্যাচের জন্য ঘুম থেকে তুলে দিই, কিন্তু আল্লাহর ফরজ হুকুম নামায তার জন্য অতটা গুরুত্বপূর্ণ না, যতটা কোচিং। নামাযে উঠলে বাচ্চার শরীর খারাপ করবে, কোচিঙে উঠলে করবে না। রমজান মাসে পড়াশুনার অজুহাতে পরীক্ষার অজুহাতে… সমস্ত কিছুর নিয়ন্তা আল্লাহর করা ফরজ রোযাকে 'আমি'… কতবড় কলিজা আমার? 'আমি' ফরজ রোযাকে নিষ্প্রয়োজন ঘোষণা করছি। সন্তানকে নাচ শেখাচ্ছি, গান শেখাচ্ছি। আমি কালচারাল মাইন্ডেড। কুরআন শেখানো? ওসব বড় হলে যদি প্রয়োজন মনে করে শিখে নেবেনে। রোযা রাখলে শরীর খারাপ করবে, ফজরে উঠলে শরীর খারাপ করবে। পড়ালেখা করে, এ প্লাস পেতে হবে। এসব করলে পিছিয়ে পড়বে। আমার আর আমার সন্তানের মাঝে আল্ল-হ কোথায়? এই আল্লাহ চাইলে আমার এই সন্তান দ্বারাই আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিতে পারেন, এই আহ্লাদের সন্তানের কারণে আমাকে সমাজে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারেন। সেই মহাশক্তিশালী আল্লাহর হুকুম 'আমি' স্থগিত করে দিচ্ছি। কে আমি? আমার কি একটুও ভয় লাগছে না? আমার পরিবার থেকে বের করে দিয়েছি আল্লাহকে। যিনি আমাকে পরিবার দিলেন তাঁকেই বের করে দিলাম। আমি এগুলো লেখার সময় কিছুটা কাঁপছি।

একবারও ভাবিনা, যিনি দিলেন, তিনি কেড়ে নিতে কতক্ষণ; যিনি চোখের মণি করেছেন, তিনি তো চোখের বালিও বানিয়ে দিতে পারেন।

পরিবারেও আমরা সেকুলারিতা প্রতিষ্ঠা করেছি। সন্তানকে ভোগবাদ শেখাই (লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে), ক্যারিয়ারিজম শেখাই (এইম ইন লাইফ রচনায়), শুধু দীন শেখাতে লজ্জা পাই। দীন শেখানোকে অপচয় মনে করি। এক বাবাকে বললাম: ছেলের তো এসএসসি শেষ, ৩ দিনের জন্য দ্যান; কিছু শিখুক। কমপক্ষে এটুকু শিখুক যে আল্লাহ কে, রসূল কে, বাপ-মা কী? শুনলাম: এই ছুটির সময়টা খুব দামী, প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নেয়া চাই। ইংলিশ স্পীকিং কোর্সে ভর্তি করিয়ে রেখেছি, এখন সময় নষ্ট করা যাবে না। সময় নষ্ট? সময় কার দেয়া? আমার বাবার? ছেলে আইলেটস-এ ৮+ স্কোর করবে, বিদেশী ভার্সিটিতে পড়বে। বিদেশে সেটেল হবে। আর বাপকে বৃদ্ধাশ্রমের খরচ পাঠাবে, কিম্বা একেলা ফ্ল্যাটে লাশ পড়ে থাকবে ৬ মাস। বিসিএস ক্যাডার হয়ে মা'কে ফেলে আসবে স্টেশনে। কিম্বা ছুরি গলায় ধরে বাপকে বলবে: কোনো মসজিদে টসজিদে জমি দেয়া চলবে না, চুপচাপ কবরে যাবেন। এগুলো সবই হয়েছে, হচ্ছে। সব হবে, বাপ-মায়ের দাম চেনা হবে না। যে ছেলে নিজের স্রষ্টাকে চেনে না, তার কাছে আপনার কী মূল্য। তার কাছে মূল্য শুধু টাকা আর পণ্যের, যা সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আপনিই।

ভালো স্কুলের নামে কাফিরদের ব্রেইন-ওয়াশিং (পড়ুন মিশনারী) স্কুলে কাফেরের হাতে তুলে দিচ্ছি সন্তানের আনকোরা মগজ। স্রেফ দুনিয়ার জন্যে। আক্কেল-দানাই ব্যাংকের ভল্টে নাকি? লাজ-শরম-আকল কিছুই আর নিজের কাছে নেই জনাব? আধুনিক হবার জন্য বাপ হয়ে সোমত্ত মেয়েকে এমন পোশাক কিনে দিই, যেটা পরে আরেক মেয়ে হেঁটে গেলে নিজেই অপলক চেয়ে থাকি। নিজে মা হয়ে, যুবতী মেয়েকে তা-ই পরাই, যা নিজে পরার কথা চিন্তাও করতাম না। আমরা তো এমন ছিলাম না ভাই? আজ কীসে আমাদের এমন করলো? কে আমাদের এমন প্রতিবন্ধী, চিন্তাশক্তিহীন, ভেড়ার তোড়ে ভাসমান করে দিল?

আপনার আর আপনার সন্তানের মাঝে 'আল্লাহ' নামের একজন ছিলেন। তাঁকে চেনানো আপনার দায়িত্ব ছিল। তাঁর দিকে আমার সন্তানকে আকর্ষিত করার দায়িত্ব আমারই ছিল। আমার সন্তান আজ 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' শুনলে বলে: এটা তো ফকিরদের গান। 'ব্যা ব্যা ব্ল্যাকশীপ' পারে, পুরো 'অপরাধী' গানটা পারে; নাজাতের কালেমাটা পারেনা। বলিউড হিরোদের চেনে, ৪ খলিফাকে চেনেনা, নবীকে চেনেনা। শাইখ উমায়ের কোব্বাদি বলেছিলেন: "আমরা ভাবি, আমার মৃত্যুর পর আমার সন্তানের কী হবে। কেউ ভাবিনা, আমার সন্তানের মৃত্যুর পর তার কী হবে?" দশ বছর বয়সে নামায না পড়লে সন্তানকে প্রহারের হাদিস শুনলে আমার নাক সিঁটকে আসে? মুসলমান, আপনার এই সন্তান যখন জাহান্নামী হবে, আল্লাহকে ফরিয়াদ করবে: মালিক, আমার বাপ-মা আমাকে ফার্স্ট হতে পারিনি বলে মেরেছে, স্কুল পালিয়েছি বলে মেরেছে, এপ্লাস পাইনি বলে বকেছে। তোমার হুকুম নামাযের জন্য আমাকে বকেনি, তোমার হুকুম ভেঙেছি বলে কখনও মারেনি। আজ এই বাপমাকে আগে দোযখে দাও, তার গর্দান মাড়িয়ে আমি দোযখে যাব। (রেফারেন্স আছে, মনে পড়ছে না)

আমার ঘর সয়লাব মূর্তি আর প্রাণীর ছবিতে। প্রগতির নামে, সংস্কৃতির নামে, সজ্জার নামে মুসলিমের ড্রয়িং-রুম জন্তু-জানোয়ার, লালন-রবীন্দ্র-নজরুল, মৃত বাপ-মায়ের শোপিসে ছবিতে ভর্তি। ছবি-মূর্তিতে রহমতের ফেরেশতা ঢোকেনা। আযাবের ফেরেশতাদের কিন্তু এসবের তোয়াক্কা নেই। আরও আছে। সেকেণ্ডে ৩৬টা স্টিল পিকচার বা ৩৬ ফ্রেম গেলে নাকি তাকে বলে মুভি/ভিডিও। ঘরে সে জিনিসও আছে। থাক, বললে দীনদাররাও তেড়ে আসবেন। চেপে গেলাম। নিজেকে উদারমনা, প্রগতিমনা, ধর্মের খুটোছেঁড়া প্রমাণের কত চেষ্টা আমাদের। ভেবেছেন একবার, আধুনিক হবার নামে 'পশ্চিমা' হবার এই হিড়িক আমাদের দুনিয়াতেই কোথায় নিয়ে ফেলবে? সেকুলার-মনা হবার নামে আল্লাহকে ত্যাগ করার এই আস্পর্দা আখিরাতে আমাদের কোথায় নিয়ে ফেলবে? আফটার হল যদি আখিরাতে বিশ্বাস করেই থাকি।

এ স্পর্ধা উদাসীনতার স্পর্ধা। আমি উদাসীন, আমি ডোন্ট কেয়ার। এটাই প্রবল পরাক্রমশালী অধিকর্তা আল্লাহর তেজ, প্রাবল্য, বিক্রমের সাথে স্পর্ধা। তিনি বলছেন একটা কথা আমাকে, আর আমি উদাসীন।