সকালবেলা এ সময়টাতে উঠতে উঠতি বয়সের যে কারোর-ই আলসেমী লাগার কথা। তারপরেও উঠতে হয়। মিলুর মা ক্লাসের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। ঘুমোতে ইচ্ছে করছে বলে ক্লাসে যাবে না—এটা মাকে বললে উনি কি রিএকশন দেখাবেন তা কল্পনা করতেও ভয় লাগে।

একদিনের কথা। মিলুর জ্বর। খুব বেশি না হলেও একশো একের ওপর তো অবশ্যই। শুকনো মুখে মাকে সে বলল, মা আজ জ্বর জ্বর লাগছে। ক্লাসে যাব না।

মিলুর মা কপালে হাত দিয়েই মেয়েকে একটা চড় লাগিয়ে দিলেন। বললেন, তোর গা আমার চেয়ে ঠাণ্ডা। কলেজে না যাবার একটা ছুতো পেলেই হলো। যা ক্লাসে যা। কলেজ গেলে এমনিতেই জ্বর সেরে যাবে।

মিলুর অবশ্য কলেজ পর্যন্ত যেতে হলো না। তার আগেই জ্বর ভালো হয়ে গেলো। বাসা থেকে কিছুদূর যাবার পরেই মুখ ভরে বমি হলো। বমি করার পর দেখলো শরীরে আর জ্বর নেই। বেশ ফ্রেশ লাগছে।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা থেকে উঠে রেডি হতে হলো। সে ছাত্রী হিসেবে যথেষ্ট ভালো। স্কুলে থাকতে সবসময়ই ফার্স্ট হয়েছে। কলেজেও এমন কিছুই হবে। এখনো রেজাল্ট দেয়নি। কখনো পড়ালেখায় ফাঁকি দেয় না। তারপরেও কেন যে মা এমন করে! তারপরেও মাকে তার ভালোই লাগে। মিলুর জীবনে দুঃখ বলতে চেহারা নিয়ে তার মনে চাপা একটা কষ্ট আছে। যদিও সে তা কখনো প্রকাশ করে না। আল্লাহ কতো মেয়েকে বেশি সৌন্দর্য দিয়েছেন। তাদের থেকে একটু কমিয়ে তাকে দিলে কী এমন ক্ষতি হতো। মাঝে মধ্যে অবশ্য তার আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ জাগে! সত্যিই কি তিনি আছেন? থাকলে পৃথিবীতে এত কষ্ট কেন! রাস্তায় ছোট্ট মেয়েটাকে ভিক্ষা করতে দেখে যখন তার বুক ফেটে যায়, আল্লাহর কি কষ্ট লাগে না? স্কুলের ধর্ম শিক্ষার মিস বলতেন, আল্লাহ নাকি মায়ের চেয়েও বেশি মমতাময়? এ কেমন মমতা!

সকালবেলা এমন নাস্তিক-মার্কা চিন্তা আসায় তার মন খারাপ হলো। খুব একটা পাত্তা দিল না সে। শুনেছে অনেক ধার্মিক লোকও নাকি মনে মনে নাস্তিক হয়। আর সে তো ধর্মের ধ-ও পালন করে না।

বাসা থেকে বের হয়ে দুই মিনিটের মতো তাকে হাঁটতে হয়। তারপর রাস্তা পার হয়ে বাসে উঠতে হয়। বাস একদম কলেজের সামনে নামিয়ে দেয়। বাসে উঠেই মিলু কিছুটা চমকে গেল। বাস মোটামুটি ফাঁকা। অথচ সবসময় তার কলেজের ছেলেমেয়ে দিয়ে ভর্তি থাকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আসল কারণ বুঝতে পারল। আজ একটু দ্রুতই বের হয়েছে সে।

‘মিলু, স্কুলে যাচ্ছ নাকি?’—পেছন থেকে এক মধ্যবয়স্ক লোক বলল। মিলু তাকিয়েই চিনতে পারল। তার আগের স্কুলের ইংলিশের টিচার। আবুল আজাদ স্যার। সবাই ডাকে ‘আবুল স্যার’। টানা এক বছর তার কাছে পড়েছে সে। তার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। ক্লীন শেইভ করে, চুলে কলপ দিয়ে, তরুণদের মতো পোষাক পরে উনি তার বয়স লুকানোর চেষ্টা করেন। লাভ হয় না, ভাঙ্গা চোয়াল ঠিকই বয়সটা জানান দেয়।

মুখ শক্ত করে মিলু জবাব দিল, স্কুলে না কলেজে যাচ্ছি।

আবুল স্যার হাসিমুখে বললেন, ওহ হো! তাই তো। কলেজে উঠে গেছ। বড়ো হয়ে গেছ। মনেই থাকে না। আমাকে এখনো তোমাকে ক্লাস এইটের মিলু মনে হয়। দাঁড়িয়ে না থেকে চলো না একসাথে বসে গল্প করতে যাই।

মিলু আগের চেয়েও কড়া গলায় বলল, বাস তো খালিই আছে। একসাথে বসার প্রয়োজন নেই।

একজন শিক্ষকের জন্য যথেষ্ট অপমানসূচক কথা। কিন্তু আবুল স্যার তা নিয়ে মাথা ঘামালেন না। মিলুর সাথে একই সারিতে পাশাপাশি না বসে অন্য সারিতে পাশাপাশি বসলেন। পুরোটা রাস্তা মিলু অন্যদিকে তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও তার সাথে ক্রমাগত বকবক করে গেলেন। যাওয়ার আগে হাসিমুখে বললেন, আজ গেলাম। সময় করে একদিন রুমে এসো, কেমন?

শেষ কথাটাতে মিলুর মাথা ঝনঝন করে উঠল। মনে হলো পুরো পৃথিবীটা তার সামনে দুলে উঠছে। সে কোনো জবাব দিল না।

ক্লাসের মনোযোগী মেয়ে মিলু আজ অবশ্য কোনো পড়াতেই মন দিতে পারল না। ফিজিক্সের টিচার বেশ আগ্রহ নিয়ে কাজ কী বোঝাচ্ছেন—কাজ মানে শুধু যে বল প্রয়োগ তা না, কাজ হতে হলে বল প্রয়োগে বস্তুর সরণও হতে হবে। কেউ খুব ভারী একটা বস্তু তিন তালা থেকে নীচে নামাল আবার নীচ থেকে ওপরে উঠাল—আমরা বলব সে অনেক কাজ করেছে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় সে কোনো কাজ করেনি। তার কৃতকাজ শূণ্য। তাহলে বলো তো, ক্রিকেট খেলায় একজন ব্যাটসম্যান দুই রান নিলো। তার কৃতকাজ কতো?

মিলুর মাথায় সাথে সাথেই উত্তরটা চলে এসেছিল। বলতে ইচ্ছে করছিল না। জগতের সকল কাজ শুণ্য হলেও তার কিচ্ছু যায় আসে না। এ মুহূর্তে তার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। কিচ্ছু না।

বাসায় ফেরার সময়ে বাস আগের মতো ফাঁকা পেলো না। লোকজন গিজগিজ করছে। উপায় নেই। উঠতে হবে। এ ধরনের বাসে উঠার অভিজ্ঞতা অবশ্য ভালো হয় না। পুরুষলোকের হাত নানা জায়গায় চলে যায়। কোনটা ইচ্ছায় আর কোনটা অনিচ্ছায় সেটা যে কোনো মেয়েই বেশ ভালোমত জানে। আগে সে প্রতিবাদ করত। প্রতিবাদ করতে যেয়ে তাকে উল্টো হেনেস্থা হতে হয়েছিল। বুড়ো মতো একলোক বলেছিল, মাইয়ার জামা-কাপড়ের ঠিক নাই, আবার চ্যাটং-চ্যাটং কইরা কথা কয়। বেত্তমিজ!

তার খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, জামাকাপড়ের কারণে সব হলে চার-পাঁচ বছরের মেয়েদের সাথে এমন হয় কেন? ওরা তাহলে কী করবে?

বাবার মতো বয়েসী এক লোক তাকে হাতের ইশারায় চুপ হতে বলেছিল। সে আর জবাব দেয়নি।

এখন সে চুপ করে থাকা শিখে গেছে। কখনো কখনো এসব লম্পটদের প্রতি তার করুণাই জাগে। তার ধারণা, এভাবে সব জায়গায় মেয়েদের চোখ দিয়ে গিলে খাওয়া পুরুষগুলো সংসার জীবনে খুব অসুখী হয়। তাদের সবসময় নতুন কিছু প্রয়োজন।

বাস থেকে নেমেই দেখতে পেল তার আগের স্কুলের মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ক্লাস শেষ। ছেলেদের ক্লাস শুরু হবে একটু পরে। এই স্কুলেই কিশোরী বয়সে একটা ছেলের প্রেমে পরেছিল সে। ছেলেটা পুরোই ভ্যাবদা টাইপের ছিল। না দেখতে হ্যান্ডসাম, না আহামরি মেধাবী। একদম শুকনা। দেখলে মনে হতো সবসময় বুঝি ওর জন্ডিস লেগে থাকে। তারপরেও কেন যে ওই আহাম্মকটাকে ভালো লাগত! তার এই ভালোলাগা অন্য কেউ না ধরলেও আবুল স্যার ঠিক ধরে ফেলেছিলেন। তাকে না শাসিয়ে তিনি অদ্ভুত একটা কাজ করা শুরু করলেন। ক্লাসে সবসময় কারণে-অকারণে ছেলেটাকে অপদস্থ করতেন তিনি। মিলু পরে অবশ্য তার এই অদ্ভুত আচরণের ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছিল।

আজ রোদটা খুব বেশি পড়েছে। মাথাটা চিড়চিড় করছে। বাসায় যেয়ে ভালো করে গোসল দিতে হবে। এই একটা কাজ করতেই মিলুর প্রচণ্ড ভালো লাগে। মনে হয়—এই গোসলেই তার শরীরে যত কদর্য চাহনি পড়েছে, যত নোংরা স্পর্শ লেগেছে—সব ধুয়ে ফেলা যায়।

অবশ্য, একটা স্পর্শ সে কিছুতেই মুছতে পারে না। ওটার কথা অবশ্য সে কক্ষণো ভুলবে না। দিনটা আজকের মতোই ছিল। প্রচণ্ড রোদ। আবুল স্যার একদিন বলেছিলেন—মিলু, তোমাদের পড়ানোর রুমটা বড্ড নোংরা হয়েছে। একদিন পরিষ্কার করে দিতে পারবে? পারলে, সময় করে একদিন রুমে এসো, কেমন?

ঠিক আজকে যেমন বাসের মধ্যে বলেছিলেন। একদম অবিকল একই ভাবে। একই স্বরে।

সে পরিষ্কার করে দিতেই গিয়েছিল। একা একা কতক্ষণ কাজ করেছিল জানে না। হুট করে সে আবিষ্কার করল আবুল স্যার তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এতোদিনের চেনা মানুষটাকে হঠাৎ করেই অচেনা লাগছে। চেহারায় অন্যরকম দৃষ্টি। এ দৃষ্টির সাথে সে পরিচিত।

বাসে বহুবার পুরুষ জাতির চোখে এ চাহনি দেখেছে সে।


রাসূল (সা) বলেছেন, “কোন পুরুষই মাহরাম ছাড়া কোন নারীর সাথে একা থাকবে না।” [সহীহ মুসলিম, হাদিস নংঃ ১৩৪১]

রাসূল (সা) বলেছেন, “যে নারী আল্লাহ্‌ ও শেষ দিনের ওপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন মাহরাম ছাড়া ভ্রমণ না করে।” [সহীহ বুখারি, হাদীস নংঃ ১০৮৮]

“কোন পুরুষের জন্য সরাসরি কোন মেয়েকে শিক্ষা দেয়া বৈধ না। এটা বিপদ ডেকে আনতে পারে। এর ফল হতে পারে খুবই ভয়াবহ।” [ফতওয়াউল লাজনাহ, ১২/১৪৯]