বিক্রি হয়ে যায়। পুরোপুরি বিক্রি হয়ে যায় মেয়েটার শরীর। চওড়া দামে বিক্রি হয় তার চুল, নখ, চোখ, চোখের চাহনী, গায়ের সাদা মাংস, ঠোঁট; শরীরের প্রতিটা ইঞ্চি ইঞ্চি রোমকূপ। সমাজের উঁচু চেয়ার দখল করে বসে থাকা কর্পোরেট গুরুদের চাই তার সব সঅঅব কিছু। তার উপরে, নিচে, ডানে, বাঁয়ে সবদিক থেকে প্রস্তুত সতর্ক ক্যামেরা। চারপাশে চোখ ধাঁধাঁনো উজ্জল আলোর ঝলকানি। যতটা কাছ থেকে পারা যায় তুলতে হবে সাবজেক্টের ছবি। সাবজেক্টের কোন কিছুকেই বাদ দেওয়া যাবে না। যেভাবেই হোক ফুটিয়ে তুলতে হবে সাবজেক্টের শরীরের প্রতিটা ইঞ্চি ইঞ্চি রোমকূপের সৌন্দর্য্য, কোমলতা। সে ছবিতে ব্যবসা হবে, ব্যবসা হবে কোটি টাকার।

হাঁটে ওঠা গরুর মতো খদ্দেররা তাকে যাচাই করে। সামনে, পেছনে, ডানে, বায়ে সবদিকে থেকে সে হেঁটে দেখায় সে খদ্দেরদের। নেচে, গেয়ে যতভাবে সম্ভব সে নিজেকে মেলে ধরে। মোবাইলের এসএমএসে হাঁকা হয় তার দাম। যার ঝুলিতে যত বেশি এসএমএস তার দাম তত বেশি এই হাঁটে। বাজারে দাম বাড়াবার প্রতিযোগিতায় বাধ্য মেয়েটা নেমে পড়ে অসুস্থ এক প্রতিযোগিতায়। জয়ী হওয়ার বাসনা তার অন্তরে। জয়ী হওয়ার প্রবল বাসনা থেকে সে তার সবকিছুকে উজাড় করে দিতে চায়। জিততে যে তাকে হবেই। তার ঘরের কোণের বোকা বাক্সটা ছোটবেলা থেকেই তাকে শিখিয়েছে—সৌন্দর্য ছাড়া সে মূল্যহীন। সে কখনোই প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না, ভালো চাকরি, বিয়ে—কিছুই হবে না। এসব কিছুকেই সম্ভব করতে পারে কেবল তার রুপের চোখ ধাঁধানো ঝলকানি।

দিনের পর দিন দালালগুলো যাদের ভদ্র সমাজে আদর করে কর্পোরেট গুরু ডাকা হয় তারা বেশ সফলভাবে, পরম মমতায় মেয়েটার মাথায় প্রোগ্রামিং করে দিয়েছে ভাবনাগুলো। তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে ট্রেইনড করে তুলেছে কী করে নিজেকে বিক্রি করতে হয়। কী করে গালে, ঠোঁটে রঙ মেখে ভাঁড় সেজে কোটি কোটি মানুষের সামনে বলতে হয়—আমাকে যদি আপনাদের ভালো লাগে টাইপ করুন xxxx xxxx। সে হয়তো কখনো জানতে পারে না কর্পোরেট গুরুদের ভাষায় সে কেবলই একটি 'প্রোডাক্ট'। খোলা বাজারে তার শরীরের সাদা চামড়া বিক্রি করে তাদের ঘরে চাল হয়। সে হয়তো জানতে পারে না, তার শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি ইঞ্চি অংশ চোখ দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ খায়। চেটেপুটে খায়। যার যেভাবে খুশি সেভাবে খায়। তাকে একজন মানুষ হিসেবে কোনদিন সম্মান করা হয় না। তাকে দেখা হয় কেবলমাত্র একটি ভোগের, বিনোদনের বস্তু হিসেবে।

আদর করে তাকে হয়তো সুপারস্টার খেতাবটা দেওয়া হয়। সাথে থাকে অর্থ, যশ, খ্যাতি আর হাততালি। কিন্তু দিনশেষে কেউ প্রোডাক্ট, কেউ 'মাল' আবার কেউ ‘কঠঠিন জিনিস’ বলেই সম্বোধন করে। মাঝে মাঝে হয়তো তার খুব কষ্টও হয়, ঘেন্না হয়। নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে ইচ্ছে হয় খুব করে। কিন্তু ততদিনে খুব বেশি দেরি হয়ে যায়। সে তখন জানে কেবল একটিমাত্র অনুভূতি প্রকাশ করতে। ''ট্রেইনড হাসির'' অনুভূতি। তাকে ট্রেনিং দিয়ে শেখানো হয়েছে মুখটা কত ডিগ্রি এঙ্গেলে, ঠোঁটটা ঠিক কতটুকু কাত করে হাসলে খুব করে হাততালি পড়বে। মানুষ খুব খুশি হবে। তার সে মাপা হাসির নিচে চাপা পড়ে যায় তার শত শত অনুভূতি, শত শত ইচ্ছে, স্বপ্নগুলো। আজ আর তার নিজের বলে কিছু নেই, কেউ নেই। তার কোন স্বকীয়তা নেই। সে এখন বিক্রি হয়ে গেছে। পুরোপুরি বিক্রি!


9 February 2015 at 21:17