Propaganda | How they control our Minds

[ক]

জুলাই ২০, ২০১৯। যশোরের মণিরামপুরে Rab-6 'উগ্রবাদী' সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে দুজনকে গ্রেফতার করে। [1] আইন শৃঙ্খলা 'রক্ষাকারী' বাহিনী তাদের কাছ থেকে যেসকল 'উগ্রবাদী' বই উদ্ধার করে সেগুলো হচ্ছে—

❖ জিন ও ফেরেশতাদের ইতিহাস
❖ দুনিয়াবিমুখ শত মনীষী
❖ পূর্ণাঙ্গ নামাজ শিক্ষা
❖ মহিলাদের বয়ান
❖ অনিষ্ট ও প্রতিকার
❖ ফাযায়েলে আমাল
❖ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর জীবনী

পুরো বিষয়টাকে এক শব্দে বর্ণনা করতে চাইলে 'প্রোপাগান্ডা' আপনার জন্য সবচে সুইটেবল টার্ম। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার বিস্তারের সাথে তাল মিলিয়ে আজ প্রোপাগান্ডা সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম নন ক্যাথলিক সমাজে ক্যাথলিক বিলিফকে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনায় টার্মটি ব্যবহৃত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন পলিটিকাল লিডাররা প্রোপাগান্ডার বহুল ব্যবহার শুরু করেন, তখন থেকেই প্রোপাগান্ডাকে পজিটিভ ও নেগেটিভ—দুই ভাগে বিভক্ত করা শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশ প্রোপাগান্ডার বহুমাত্রিক প্রয়োগ করে। অতঃপর ১৯২৮ সালে Edward Bernays তার 'Propaganda' বইটি পাবলিশ করেন। বইটির কন্টেন্টগু‌লো এতোই অর্গানাইজড ছিল যে, এর ফলে Propagators ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের কাছে তিনি Father of Public Relations হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করেন। প্রোপাগান্ডার বর্ণনা দিতে গিয়ে বইটির শুরুতেই তিনি উল্লেখ করেন—

"The conscious and intelligent manipulation of the organized habits and opinions of the masses is an important element in democratic society. Those who manipulate this unseen mechanism of society constitute an invisible government which is the true ruling power of our country. We are governed, our minds are molded, our tastes formed, our ideas suggested, largely by men we have never heard of" [2]

প্রোপাগান্ডা মিনিং ও এপ্লিকেশন বেশ জটিল। প্রোপাগান্ডা নিয়ে গবেষণাকারী বিখ্যাত সংস্থা 'Institute for Propaganda Analysis' এর মতে প্রোপাগান্ডা হচ্ছে,

"Expression of opinion or action by individuals or group deliberately designed to influence opinions or actions of other individuals or groups with reference to predetermined ends"

সহজ ভাষায় বললে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীয় মতামত প্রভাবিত করার প্রক্রিয়াই হল প্রোপাগান্ডা। Edward Bernays ও অন্যান্য চিন্তাবিদরা প্রোপাগান্ডা প্রচারের যে অর্গানাইজড ওয়ে ক্রিয়েট করেন, পরবর্তীতে যুদ্ধ, রাজনীতি ও বিজনেস সেক্টরে এর সর্বাত্মক প্রয়োগ শুরু হয়। এমতাবস্থায় সাধারণ জনগণকে পলিটিকাল প্রোপাগান্ডার স্বরূপ অনুধাবনে সহায়তা করতে ১৯৩৭ খৃষ্টাব্দে Institute for Propaganda Analysis/IPA প্রতিষ্ঠিত হয়; তারা প্রোপাগান্ডা বিষয়ে মোট চারটি বই পাবলিশ করেন। প্রোপাগান্ডা সিরিজের এই বইগুলোর মাঝে 'The Fine Art of Propaganda' বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। New York University-এর Sociologist Dr. Alfred M. Lee এবং তার স্ত্রী Dr. Elizabeth Briant Lee বইটি সম্পাদনা করেন। বইটিতে সর্বমোট সাতটি 'Basic Propaganda Device' বা 'প্রোপাগান্ডার মৌলিক কৌশল' আলোচনা করা হয়, আজ এত বছর পর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এ যুগে এসেও প্রোপাগান্ডা চিহ্নিতকরণে সেই কৌশলগুলো সমানভাবে কার্যকর। আমরা প্রাত্যহিক জীবনে যেভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাতৃভাষা ব্যবহার করি, প্রোপাগান্ডার এই বেসিক ডিভাইসগুলো ঠিক সেভাবেই আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রোপাগান্ডার মৌলিক ডিভাইস হিসেবে IPA যে টার্মগুলো উল্লেখ করে সেগুলো হল—

  1. Name Calling
  2. Glittering Generalities
  3. Transfer
  4. Testimonial
  5. Plain Folks
  6. Card Stacking
  7. Band Wagon [3]

1. Name calling is used to make us reject and condemn the idea without examining the evidence.

কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি/গোষ্ঠী/জাতিকে বিশেষ কোন নেগেটিভ শব্দ/টার্ম/বিশেষণে বিশেষিত করার মাধ্যমে কোন প্রকার যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই তাদের অপাংক্তেয় সাব্যস্ত করা এবং ডাবল ব্লাইন্ডিং অর্থাৎ এর সাথে অন্যান্য ট্যাকটিক্স ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই বাছাই ছাড়াই তাদেরকে বাতিল প্রতীয়মান করা—এভাবে নেইম কলিং প্রসেস কাজ করে। [4-7]

ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় আমরা প্রায় প্রতিদিনই নেইম কলিং প্রোপাগান্ডার প্রয়োগ দেখতে পাই, যেমন ধরুন—জঙ্গিবাদী, উগ্রবাদী, কাঠমোল্লা, মধ্যযুগীয় শরিয়াহ, Reactive/প্রতিক্রিয়াশীল, Muslim Extremist, Radical/মৌলবাদী, Islamist, Homophobe, সশস্ত্র গ্রুপ, বিদ্রোহী গ্রুপ- এরকম অসংখ্য টার্ম প্রোপাগেটররা ব্যবহার করে থাকে।

দ্বিতীয় ইরাক যুদ্ধের সময়ে মার্কিন মিডিয়া তাদের নিজ দেশে চমৎকারভাবে নেইম কলিং প্রোপাগান্ডার ব্যবহার করে। ইরাক আক্রমণের প্রেক্ষাপট ও জনসমর্থন তৈরি করতে মার্কিন মিডিয়া "Weapons of Mass Destruction" এর মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ব্যবহার করে। ২০০১-এ তাদের এই PsyOps (Psychological Operations) এর পর ২০০২ সালে বিখ্যাত থিংক ট্যাঙ্ক Pew Research Center সাধারণ জনগণের উপর একটি জরিপ চালায়। সেখানে দেখা যায়, ৭৯ শতাংশ আমেরিকানই বিশ্বাস করে যে, সাদ্দাম হোসেন নিউক্লিয়ার বোমা আবিষ্কার করে ফেলেছেন অথবা আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। ৬০ শতাংশ আমেরিকান ভাবেন যে, ফিউচারে আসন্ন কোন টেররিস্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করতে এই আক্রমণ প্রয়োজন ছিল। [8]

এই টার্মগুলো ওয়েস্টার্ন সেকুলারিস্টদের আবিষ্কার। মুসলিমদের মাঝে যারা ওয়েস্টার্ন প্রোপাগান্ডার প্রতি এক্সপোসড, তাদেরকেও এই টার্মগুলো ব্যবহার করতে দেখা যায়, সেই সঙ্গে তারা এক ধাপ এগিয়ে মুসলিমদের সকল যুক্তি প্রমাণকে যাচাই বাছাই ছাড়াই ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে। কিছুদিন পূর্বে দেশবরেণ্য একজন শাইখকে বিশ্বখ্যাত একজন শহীদ আলেম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি সেই শহীদ আলেমকে নিয়ে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেন, অতঃপর তাঁকে "Reactive" হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সাধারণ মুসলিমরা যখন এই বিষয়টি নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়, তখন তিনি তার এই বিহেভিয়ারের ক্লেরিফিকেশন করতে গিয়ে বলেন, "এটা তো একটা বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই।" একই সঙ্গে ইতঃপূর্বে গুটিকয়েক প্রশ্নবিদ্ধ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে 'Interfaith Love' এর সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রোগ্রামে তার যোগদানের ব্যাপারটাও উঠে আসে। এর জবাবে তিনি বলেন, তিনি এই ব্যাপারে জ্ঞাত ছিলেন না, মূলত তিনি স্টাডি ট্যুরের ইনভাইটেশন পেয়েছিলেন।

দেশখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্বরাই যখন আধুনিক ওয়ার্ল্ড-এর প্রোপাগান্ডার স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞাত, তার উপর ইচ্ছায়/অনিচ্ছায় সেকুলারিস্টদের বহুল চর্চিত Name Calling Word ব্যবহার করেন, তখন সাধারণ জনগণের কী হাল সেটা সহজেই অনুমেয়।

2. Glittering generalities is used to make us accept and approve the thing without examining the evidence.

প্রোপাগান্ডার এই ডিভাইসটি বিশেষ কোন Individual/Team/Nation এর ক্ষেত্রে পজিটিভ ভার্চুয়াল ওয়ার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়, যার ফলে টার্গেট অডিয়েন্সরা কোন প্রকার যাচাই বাছাই ছাড়াই তা গ্রহণ করে নেয়। এটি মূলত নেইম কলিং প্রোপাগান্ডার রিভার্স প্রসেস। এতে ব্যবহৃত Intangible Virtual Word-গুলো 'ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে' ব্যবহার করা হয়। [9-12]

এই প্রোপাগান্ডায় বহুল ব্যবহৃত কিছু পজিটিভ ভার্চুয়াল ওয়ার্ড যেমন—Patriotism/স্বদেশপ্রেম, Unity/একতা, Democracy/গণতন্ত্র, Freedom/স্বাধীনতা, Peacekeeping/শান্তিরক্ষা, Women Freedom/নারী স্বাধীনতা, Progress/প্রগতি, সুশীল সমাজ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মঙ্গল শোভাযাত্রা ইত্যাদি প্রতিদিন খবরের পাতায় কিংবা টিভির পর্দা খুললেই চোখে পড়ে। এই টার্মগুলো ব্যবহার করেই সাম্রাজ্যবাদী আর ফ্যাসিস্ট শাসকেরা জনগণের চোখে ঠুলি পরিয়ে দেয়। "সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ"—এই স্লোগানকে পুঁজি করে পুঁজিবাদের যে ঘানি আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, সরকার নামক শোষকযন্ত্র সেই গণতন্ত্রের পারফেক্ট ইউজ করে আমাদেরকে দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেছে। [13]

মঙ্গল কামনার নামে প্যাঁচা, হাতি, মূর্তি নিয়ে নব্য আবিষ্কৃত যে "মঙ্গল" শোভাযাত্রা, তার পরতে পরতে মিশে আছে শিরকের নীল বিষ। [14] বিশ্ব শান্তিরক্ষার মিষ্টি স্লোগানের ব্যানার নিয়ে অ্যামেরিকা, জাতিসংঘ দুর্বল দেশগুলোতে যে আগ্রাসন চালায়, তথাকথিত সে শান্তির মূল্য দিতে গিয়ে নিহত হয় কোটি কোটি মানুষ, [15] জাতিসংঘের peacekeeper সৈন্যদের হাতে ধর্ষিতা হয় হাজার হাজার নিরীহ মুসলিম নারী আর শিশুরা। [16]

নারী স্বাধীনতার নামে নারীদের ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসে চাকরিক্ষেত্রে 'চাকর'-এর যোগান বাড়ানোর যে 'অধিকার আন্দোলন', সেই আন্দোলনে পশ্চিমা নারীরা আজ প্রকৃতই 'স্বাধীন' হয়ে উঠেছে, ধর্ষণ আজ পশ্চিমা সমাজের কুঁড়েঘর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত স্বাভাবিক একটি বিষয়। আজ তারা জনে জনে তাদের সতীত্ব বিলি করে বেড়াচ্ছেন, এটাই তাদের প্রকৃত 'মুক্তি' দিয়েছে। এমনকি ক্ষমতার প্রতীক সেনাবাহিনীতে গিয়েও তাদের রক্ষা হয় না, কলিগ আর বসদের কাছেই যৌনতার পাঠ নেয় 'শক্তিশালী' 'আধুনিকমনা' নারীরা। [17] আমাদের ভূখণ্ডে যারা এই ওয়ার্ডগুলো ব্যবহার করে, তারা মূলত পশ্চিমাদের কাছ থেকে ধার করে এনে এখানে সেগুলো এপ্লাই করে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে তারা নতুন এক এজেন্ডা হাতে নিয়েছে, তারা 'পিরিয়ড' এর ট্যাবু ভেঙে দিতে চায়। [18] পিরিয়ডের ট্যাবু ভাঙলে তাদের কী লাভ? লাভের অঙ্ক বিশাল, দীর্ঘমেয়াদি আর জটিল, তবে সমাজে এর প্রভাব হবে অত্যন্ত নেতিবাচক। আজ তারা পিরিয়ডের ট্যাবু ভাঙতে চাচ্ছে, মা ছেলে বসে পিরিয়ডের রসালো আলোচনা করছে, কাল তারা যৌনতার ট্যাবু ভাঙ্গার দাবি তুলবে, কাল তারা দাবী করবে, 'মায়ের কাছেই হোক ছেলের প্রথম যৌন শিক্ষা।' শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই বাস্তবতা। এই প্রসেসের সর্বশেষ যে স্টেজ, তার বাস্তব উদাহরণ হিসেবে আপনাদের সামনে বর্তমান পশ্চিমা সমাজ উপস্থিত রয়েছে। সেখানে প্রতিটি মিনিটে নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়, বিবাহ বহির্ভূত যৌনতার হিসেব তো ইতোমধ্যেই হিসেবের বাইরে চলে গেছে, বরং সেখানে শারীরিক সম্পর্কের জন্য বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাই বিরল। আজকের পশ্চিমা বিশ্ব গড়ে উঠছে জারজ সন্তানদের দ্বারা। [19] তাদের নারী স্বাধীনতার উদাহরণ দেখা যায় নীল ছবি আর 'Free Nipple' আন্দোলনে (Don't search it!)। [20] পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা ভাইরাসে আক্রান্ত বঙ্গ দেশীয় এ জম্বিগুলো আমাদের দেশকেও সেই স্তরে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। শত বছরের এ এজেন্ডায় ইতোমধ্যেই তারা অনেকটা সফল, ৬০ এর দশকেও যেখানে মহিলারা রিকশায় চড়ে সমগ্র রিকশাকে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে পর্দা করত, সেখানে আজ বঙ্গীয় নারীবাদীরা সব বিলিয়ে দাবি তুলেছে, "সতীত্ব শরীরের হয় না, সতীত্ব হয় মনের।" [21]

প্রোপাগান্ডার এ শব্দখেলা আজ আমাদের প্রতিটি ঘরে তার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছে, আর আমরা কখনো বা তার শিকার হচ্ছি, অথবা নিজেই প্রোপাগান্ডা চালিয়ে অন্যদেরকে তার শিকারে পরিণত করছি। চারপাশের মানুষগুলোর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালে আপনি নিজেই অনুধাবন করতে পারবেন, প্রোপাগান্ডার শব্দজাল তাদেরকে কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। প্রোপাগান্ডার এই Word Game অনুধাবন করতে আজ আমাদের প্রত্যেককে Critical Thinker আর Skeptical হিসেবে নিজেকে গঠন করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ না করুক, নতুবা ক্ষমতাসীন আর ভোগবাদীদের প্রোপাগান্ডার পুতুল হয়েই হয়তো মূল্যবান জীবন নিঃশেষিত হবে।

[খ]

3. প্রোপাগান্ডার তৃতীয় বেসিক ডিভাইসটি হচ্ছে Transfer Propaganda Device

"Transfer carries the authority, sanction and prestige of something respected and revered over to something else to make the latter acceptable"

অর্থাৎ, প্রোপাগান্ডার এই কৌশলটির মাধ্যমে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য, সম্মানের দাবিদার একটি বিষয়ের সাথে অন্য একটি বস্তু বা বিষয়কে সংযুক্ত করে প্রথম বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতাকে কাঙ্ক্ষিত পরবর্তী বস্তু/বিষয়ের মাঝে ট্র্যান্সফার করা হয়। [22-24]

এই ধরণের প্রোপাগান্ডা প্রতিদিনই আমাদের চোখে ধরা পড়ে, কিন্তু এই বিষয়ে কোন ধারণা না থাকায় বেশির ভাগ মানুষই ধোঁকায় পড়ে যায়। বর্তমানে বেশিরভাগ কমার্শিয়াল বিজ্ঞাপনেই কোন না কোন উপায়ে প্রোডাক্টটির সাথে দেশপ্রেমের একটা সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। চায়ের কাপ থেকে দেশপ্রেমের 'নিদর্শন' ক্রিকেট খেলা পর্যন্ত—সব জায়গায় একই চিত্র, একই প্রচেষ্টা; দেখলে মনে হবে আমাদের চেয়ে দেশপ্রেমিক জাতি বিশ্বে আর কোথাও নেই। দিন রাত এইসব ফালতু বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে আমাদের মনে অবচেতনভাবে ঐ বস্তুর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে যায়, আর সেটাই এই প্রোপাগান্ডার সফলতা।

যেকোনো সাধারণ মুসলিম মাত্রই ইসলামপ্রিয়, আপনি কাউকে একটি থাপ্পড় কিংবা গালি দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারেন, কিন্তু আল্লাহ, রাসূলুল্লাহ (সা) কিংবা ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত কোন বিষয় নিয়ে গালি দিয়ে দেখুন, আপনার প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। এই যে আমাদের ইসলামপ্রিয়তা, এটা শিক্ষিত-মূর্খ সবার জন্যই প্রযোজ্য, বরং বলা যায় ইসলামের ব্যাপারে যারা জানে না, তাদের আবেগ আরও বেশি কাজ করে। আমাদের সেই আবেগকে পুঁজি করে বর্তমানে গণতন্ত্রকে ইসলামী রূপদান করতে "ইসলামী গণতন্ত্র" নামক একটি নিকৃষ্ট জাহিলি পরিভাষা সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান, ক্ষমতাশীল মানুষ হোক বা সাধারণ জনগণ—ইসলামের কোন অকাট্য বিষয়ে রদবদল করার অধিকার কারো নেই। সেই ইসলামের সাথে পশ্চিমা ভোগবাদীদের আবিষ্কৃত "গণতন্ত্র" নামের কুফরি ব্যবস্থার [25] নাম জুড়ে দেয়ার মাধ্যমে ইসলামের যে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা, সেটাকে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারিরা নিজেদের "হালালকরণ" প্রক্রিয়ায় কাজে লাগাচ্ছে। তারা আমাদের বলছে, "ভোট আমাদের আমানত।" এই প্রোপাগান্ডার সাথে বুঝে/না বুঝে যুক্ত হয়েছে কিছু দ্বীন বিক্রয়কারী ব্যক্তি। এর ফলে ইসলাম সম্পর্কে একেবারেই জ্ঞান না রাখা জেনারেল লাইনের শিক্ষার্থীরা চরমভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছে, কারণ জেনারেল লাইনের সিলেবাসে কুফরি সংবিধান সম্পর্কে কোন ধারণা দেয়া হয়না। এর ফলে বর্তমানে গোটা একটি প্রজন্ম হালাল হারামের ন্যূনতম নলেজ ছাড়া বেড়ে উঠেছে, দিন দিন তারা ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়ে কুফরি জীবনব্যবস্থাকেই নিজেদের জন্য কল্যাণকর ও ইসলামী পন্থা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে, সফল হয়েছে তাদের নিরবিচ্ছিন্ন অধ্যবসায়ী প্রোপাগান্ডা।

4. প্রোপাগান্ডার পরবর্তী কৌশলটি হচ্ছে Testimonial প্রোপাগান্ডা। IPA এর দেয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী—

Testimonial consists in having some respected or hated person say that a given idea/program/product/person is good or bad.

অর্থাৎ, বিখ্যাত/কুখ্যাত কোন ব্যক্তির মাধ্যমে Propagandist-দের টার্গেটকৃত কোন আইডিয়া/প্রোডাক্ট/ব্যক্তি/গোষ্ঠীকে গ্রহণযোগ্য/বাতিল সাব্যস্ত করা। [26-27]

এই ধরণের প্রোপাগান্ডা চালানোর জন্য খ্যাতিমান ব্যক্তিটির অনুমতির দরকার নেই; এমনকি কাল্পনিক চরিত্র দিয়েও এই ধরণের প্রচারণা চালানো যায়। যেমনঃ WWI এ অ্যামেরিকা তাদের কমিক ক্যারেক্টার ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা-কে ব্যবহার করে যুদ্ধে সহযোগিতা করার পোস্টার তৈরি করত। লক্ষ লক্ষ মানুষ খুনের ফান্ডিং এর জন্য ব্যবহৃত সেই ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকার মুভি দেখে আমরা আবেগে আপ্লুত হই।

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৩। বাংলাদেশ ক্রিকেট টীমের সবার ভালবাসার "মুক্তিযোদ্ধা"রা মোমবাতি প্রজ্বলিত করে গণজাগরণ মঞ্চের সাথে "যুদ্ধাপরাধী"দের ফাসির দাবিতে একাত্মতা ঘোষণা করেন। দেশব্যাপী তাদের যে জনপ্রিয়তা, তাকে ব্যবহার করে তৎকালীন সরকারযন্ত্র তাদের "International" কোয়ালিটির বিচারের Legitimacy আদায় করার চেষ্টা করেছে। [28]

এটি সেই গণজাগরণ মঞ্চ, যাতে নেতৃত্ব দিত সব শাতিমে রাসূল। সেই মঞ্চকে ব্যবহার করে তারা ইসলাম বিদ্বেষ আর রাসূলুল্লাহ (সা) ও উম্মুল মুমিনীনদের নিয়ে সর্বনিকৃষ্ট অশ্লীল গালি, নোংরা ছবি আর চরম পর্যায়ের মিথ্যাচার ছড়াতে থাকে, আর তাদের সেইসব কর্মকাণ্ডের ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য সরকারপক্ষ তৎকালীন সময়ে দেশের সবচে বড় ঈদগা শোলাকিয়ার ইমাম সাহেবকে সেখানে উপস্থিত করে। যথারীতি তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন, শাতিমদের গুণগান গাইলেন, শাতিমদের বিরুদ্ধে তোলা সুস্পষ্ট প্রমাণ ও অভিযোগকে মিথ্যাচার ও হলুদ মিডিয়ার কারসাজি হিসেবে দাবি করলেন। এত বড় একজন ব্যক্তিত্বের প্রভাবে দেশের সাধারণ জনগণ দিশেহারা হয়ে গেল। এর সাথে মিডিয়া নামক প্রোপাগান্ডা মেশিন তো রয়েছেই। আরও একটি মিথ্যা প্রোপাগান্ডা সফল।

জেনারেল সিস্টেমের প্রতিটি স্টুডেন্টই ক্লাস নাইনের 'ইসলাম শিক্ষা' বইতে একটা সেন্টেন্স পড়েছে, "ঊমার রাঃ ছিলেন গণতন্ত্রমনা।" মজলিসে শূরাকে গণতন্ত্রের সাথে তুলনা করার মত স্পর্ধা কোন নিকৃষ্ট ব্যক্তির—তা আমার জানা নেই। এই নির্জলা মিথ্যা কথাটি এখনো ক্লাস নাইন টেনে পড়ানো হয়। হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদিনের একজন খলিফার নামকে আব্রাহাম লিংকনি মানহাজের গণতন্ত্রের সাথে জুড়ে দিয়ে তারা তরুণদের হৃদয়ে গণতন্ত্রের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টির সূক্ষ্ম প্রোপাগান্ডা পরিচালিত করছে, আর আমরা তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছি। উদাহরণ? জেনারেল লাইনের গুটিকয়েক ছাত্রছাত্রী ছাড়া বাকি সব স্টুডেন্ট।

উপরোক্ত প্রোপাগান্ডা দুটি কখনো কখনো একই সাথে ব্যবহৃত হয়। বর্তমান পশ্চিমা মুসলিম কমিউনিটিতে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ দেখা যায়। LGBTQ কমিউনিটিগুলো পশ্চিমা সমাজের প্রতিটি স্তরে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও এক্সেসিবিলিটি বাড়ানোর জন্য প্রকাশ্যে/গোপনে নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু পশ্চিমা 'স্কলার' নিজেদেরকে মুসলিম আখ্যা দিয়ে বলছে, "LGBT কমিউনিটি-ও যেহেতু 'নির্যাতিত', তাই মুসলিমদের উচিত নিজেদের 'রাজনৈতিক' অধিকার আদায়ে 'মযলুম' LGBT কমিউনিটির সাথে যোগদান করা এবং তাদের সাথে কোয়ালিশন গঠন করা। এসব 'স্কলার'রা সেখানকার মসজিদের ভিতর LGBT কমিউনিটির সমর্থনে প্রোগ্রামের পর প্রোগ্রাম করছে, LGBT কমিউনিটির প্রোগ্রামে উপস্থিত হয়ে "We are determined to cry together, to pray together, to stand together—straight, gay, Floridan and Texan" অর্থাৎ, "আমরা একই সাথে কাঁদব, একই সঙ্গে ইবাদত করব(!), একসাথে দাঁড়াব—স্ট্রেইট (যারা বিপরীত জেন্ডারেকে বিয়ে করে), গে, ফ্লোরিডান ও টেক্সান।" "স্বাধীনতা এখানে রয়েছে—এই অ্যামেরিকায়", "তাকিয়ে দেখুন, এখানে কোন ধর্মান্ধ ও সন্ত্রাসী নেই।" [29]

অতঃপর অন্য একটি সাক্ষাৎকারে সেই একই 'স্কলার' দাবি করেন—

"Gay Muslims exist, and they are a part of our community. It depends on the mosques they are going to, whether the mosques are going to accept them or not. A lot of that has to do with how american those mosques are, how acclimated they are to the country they are in"

অর্থাৎ, "এখানে গে মুসলিম রয়েছে, তারা আমাদেরই একটি অংশ। তারা যেসব মসজিদে যাবে, সেসব মসজিদের উপর নির্ভর করে যে, মসজিদগুলো তাদের মেনে নিবে কি না। এসব মসজিদ কতটা 'আমেরিকান', মসজিদগুলো নিজেদেরকে দেশের সাথে কতটা খাপ খাইয়ে নিতে পারে, এসব বিষয়ে অনেক কাজ করতে হবে।" [30]

আল্লাহ তাআলার ঘর মসজিদকে ব্যবহার করে কওমে লুতের আপডেটেড ভার্সনকে মুসলিমদের মাঝে প্রোমোট করে এই ঘৃণ্য সম্প্রদায়ের এই প্রচেষ্টায় তারা নিজেদের 'সেলেব্রিটি' 'কম্পেশনেট ইমাম' ইমেজকে সর্বোত্তম পন্থায় ব্যবহার করছে। Pew Research Centre এর পাবলিক পোলের রেজাল্টে তাদের এই প্রোপাগান্ডার ফলাফল ফুটে উঠেছে, সেই পাবলিক অপিনিয়নে দেখা যায়, বর্তমানে অর্ধেকের বেশি মুসলিম এই LGBT কমিউনিটিকে নৈতিকভাবে মেনে নিয়েছে।

পশ্চিমাদের মত আমাদের দেশেও একই রকম কাজ চলছে, ইসলাম ও ইমাম শ্রেণীকে নিকৃষ্ট কাজে ব্যবহার করার শত শত উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে, কিন্তু মূর্খতার চশমা পরে থাকায় সেসব আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়না। আপনারা প্রত্যেকেই পুতুল নাচের নাম শুনেছেন, প্রোপাগান্ডার প্রতিটি কৌশল এক একটি সুতার কাজ করছে, আর আমরা হয়ে গেছি তাদের হাতের পুতুল। দৃষ্টির আড়ালে থাকা কিছু মানুষ সুতোগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে, আর আমরা হয়ে গেছি পুতুল মানব। তারা যা বলে, আমরা তাই করি; তারা যেদিকে চালায়, আমরা সেদিকে চলি। এই যে মানসিকতার এক অদৃশ্য কারাগারে আমরা বন্দি হয়ে আছি, এ থেকে বাঁচবার একমাত্র উপায়—এইসব অদৃশ্য শৃঙ্খলের স্বরূপ চেনার যোগ্যতা অর্জন করা। যতদিন আমরা এই নির্মম সত্য অনুধাবন করতে না পারব, ততদিন এই মানসিক কারাগারের বন্দিদশা থেকে আমাদের মুক্তি নেই।

[গ]

❖ পৃথিবীর সবচে শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তিনি, একজনকে সাথে নিয়ে হঠাৎ করেই রাস্তার পাশের মিডল ক্লাস কোয়ালিটির একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লেন। সেখানে সাধারণ মানুষের সাথে বসে একটি নর্মাল পিজ্জা অর্ডার করলেন। কখনো বা বরশি হাতে মাছ ধরতে লেকের পাড়ে বসে পড়েন; কিংবা প্রিয় কুকুরকে সাথে নিয়ে পার্কে কয়েক চক্কর ঘুরে আসেন।

এই ঘটনাগুলো দেখে অনেকেই হাহুতাশ শুরু করে দেন, আহা! আমাদের দেশে যদি বারাক ওবামা আর জাস্টিন "বিবার" এর মত প্রেসিডেন্ট থাকতো। পশ্চিমা দেশগুলোতে এধরণের ঘটনা নতুন কোন বিষয় নয়। তারা প্রায়ই জনগণের সঙ্গে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়ে বসেন। পলিটিশিয়ানদের মাঝে জনগণের সাথে মিশে যাওয়ার এই যে এক প্রবণতা কিংবা Act, প্রোপাগান্ডিস্টদের ভাষায় একে প্লেইন ফোকস (Plain Folks) প্রোপাগান্ডা কৌশল/ডিভাইস বলা হয়।

5. IPA এর দেয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী Plain Folks Device হচ্ছে,

"The method by which a speaker attempts to convince his audience that he and his idea are good because they are 'off the people', the 'plain folks'"

অর্থাৎ, এই কৌশলের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি/লিডার তার টার্গেট দর্শক/শ্রোতা/পাঠককে এটি উপলব্ধি করাতে চেষ্টা করে যে, সে 'তাদেরই অন্তর্ভুক্ত' একজন 'সাধারণ মানুষ'; সাধারণ মানুষের সাথে তার চাওয়া পাওয়ার কোন পার্থক্য নেই। [31-33]

এই ধরণের প্রোপাগান্ডা এপ্লাই করতে চাইলে আপনাকে কিছু কায়দা কানুন রপ্ত করতে হবে। যখন যে পরিবেশে, যাদেরকে টার্গেট করে 'মাঠে' নামবেন, তখন সেই পরিবেশে তাদের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট বা পিএমরা প্রায়ই গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করেন, বাইবেল হাতে নিয়ে ছবি তোলেন। আবার যখন মুসলিমদের সাথে রাজনৈতিক প্রয়োজনে একাত্মতা ঘোষণা করার দরকার পড়ে, তখন সেখানকার নারী শাসকরা মুসলিম নারীদের মত মাথায় কাপড় দেন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমাদের দেশেও এই কৌশল চর্চার বহু নজির রয়েছে। কখনো দেখা যায়, জাতির লিডার ভ্যান গাড়িতে চড়ছেন, আবার কখনো দেখা যায়, তৃণমূল নেতারা হঠাৎ করে কাস্তে হাতে মাঠে নেমে কৃষককে ধান কাটায় সহযোগিতা করতে গিয়ে (ক্যামেরাম্যান সহ) কাঁচা পাকা ধান কেটে মাঠ সাবাড় করে দিয়েছেন। অথচ জাতির বড় বড় প্রতিটি চুরি কিংবা ডাকাতির পিছনে এইসব জনদরদি নেতানেত্রীদের সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে তারা এই কৌশলটা পশ্চিমা দেশগুলো থেকে শিখেছে। পশ্চিমা লিডাররা প্রায় ১০০ বছর ধরেই এই ধরণের কৌশল ব্যবহার করে আসছেন, যা বর্তমানে এক্সপোর্ট কোয়ালিটি বজায় রেখে এ দেশে আমদানি করা হয়েছে।

এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে মুসলিম শাসকরাও কি জনগণকে বোকা বানাতে এই ধরণের কৌশল ব্যবহার করতেন? তারাও তো খুবই সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। এর উত্তরঅতঃপর অন্য একটি সাক্ষাৎকারে সেই একই 'স্কলার' দাবি করেন— না। আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসূল (সা) আমাদেরকে ক্ষমতার বড়াই করার শিক্ষা দেননি, তাই অগ্রগামী সলফে সালেহীনদের সাথে এই ধরণের কৌশলের সংযোগ খুঁজতে যাওয়াটা হবে বোকামির পরিচয়।

তবে বর্তমানে বেশির ভাগ শাসকরাই পাবলিক রিলেশন এক্সপার্ট রাখেন, তারা জনগণের 'মন জয়' করতে প্রতিনিয়তই শাসকদের বিভিন্ন 'টিপস' দিয়ে থাকেন, সেই অনুযায়ী তারা তাদের সেলেক্টিভ আচার আচরণ জনগণের সামনে উন্মুক্ত করেন, যা এক প্রকার ভণ্ডামি। তাই, তাদের ক্ষেত্রে উপরের 'ব্যতিক্রমী উদাহরণ' খাটবে না।

❖ বাংলাদেশে টকশো বেশ জনপ্রিয় একটি বিষয়, অনেকেই রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য জানতে টকশো দেখেন। কখনো কখনো দেখা যায়, কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা বা বিতর্কের জন্য প্রতিটি পক্ষের একজন বা দুজন করে আলোচককে এক টেবিলে নিয়ে আসা হয়। তবে, এ ব্যাপারটা অনেকেই হয়ত খেয়াল করেন না যে, ইসলামের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যখন আলোচনা করা হয়, তখন দেখা যায় তিনজন সেকুলার 'বুদ্ধিজীবী' বা 'গবেষক'-এর বিপরীতে একজন আলেম উপস্থিত হয়েছেন। সেই সাথে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঞ্চালকও থাকেন সেকুলার, যদিও তারা চাতুরতার সঙ্গে সে কথা গোপন করেন। অতঃপর সবাই মিলে বাঘের মত সেই আলেমের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাকে নাস্তানাবুদ করে, উপস্থিত আলেমের কথার মাঝখানে তাকে চুপ করিয়ে সঞ্চালক অন্য একজনকে কথা বলতে অনুরোধ করেন। ম্যাচ শেষে ফলাফলঃ 'দ্বিপাক্ষিক' আলোচনার নামে সেকুলারদের নিজস্ব মতবাদের সফল প্রচার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, সে বিষয়ে সাধারণ জনগণ তেমন একটা ধারণা রাখেন না। ফলে সঠিক ইনফো জানার বদলে তারা সেকুলারদের বলা কথাগুলোই বিশ্বাস করে বসেন।

6. Institute for Propaganda Analysis-এর মতে একে বলা হয় Card Stacking Propaganda Device

"Card stacking involves the selection and use of facts or falsehood, illustrations or distortions, and logical or illogical statements in order to give the best of the worst possible case for an idea, program, person or product"

অর্থাৎ, কার্ড স্ট্যাকিং প্রসেসের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি, বস্তু বা আইডিয়ার ব্যাপারে সত্য/মিথ্যা, যৌক্তিক/অযৌক্তিক সব তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে সে ব্যাপারে খুবই ভাল বা খারাপ ধারণা সৃষ্টি করা হয়। [34-36]

কার্ড স্ট্যাকিং প্রোপাগান্ডা এতটাই ব্যাপক আর বিস্তৃত যে, আমরা প্রায় সকলেই এর ফাঁদে পড়ে যাই। কোন প্রোডাক্টের গায়ে ১০-৯০% ছাড় কিংবা ৪০% লো ফ্যাট, 'তাজা আমের রস' ইত্যাদি লেখা দেখে আমরা প্রায়ই ঐ প্রোডাক্টের প্রতি আকৃষ্ট হই। কিন্তু যখন আপনি বিষয়টি যাচাই করে দেখতে চাইবেন, তখন হয়তো দেখতে পাবেন যে পণ্যের দাম স্বাভাবিক মূল্যের দ্বিগুন করে ৫০% ছাড় দেয়া হয়েছে; কিংবা আমের বদলে তারা ব্যবহার করেছে অ্যাডেড ফ্লেভার, সেটা স্টার মার্ক দিয়ে একেবারে নিচে ছোট্ট করে লিখে দেয়া হয়েছে।

আরও ব্রড সেন্সে চিন্তা করলে, সেকুলাররা আমাদের সবাইকেই এসব '৫০% ছাড়' এর আশা দেখিয়ে আমাদের জীবন থেকে ইসলামকে কেড়ে নিয়ে নগদ লাভের লোভ দেখিয়ে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে ভোগবাদী জীবনের সিলেবাস। সেই সিলেবাসে দ্বীন শিক্ষার পরিবর্তে দুনিয়া অর্জনের শতাধিক ফায়দা দেখে আমরা সন্তানকে কুরআন শিখাই না, ঘুম থেকে উঠিয়ে ভোর বেলাতেই কিন্ডারগার্টেনে পাঠিয়ে দেই। দ্বীন রেখে দুনিয়া অর্জনের এত এত 'ফায়দা'র কার্ড দেখে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি, সে কথার সাক্ষী আমি, আপনি, আমরা সবাই।

7. "The Fine Art of Propaganda" বইটিতে উল্লিখিত সর্বশেষ প্রোপাগান্ডা ডিভাইসটি হল Band Wagon Propaganda Device.

IPA এর দেয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী Band Wagon-এর থিম হলো, "Everybody-at least all of us doing it." অর্থাৎ, "প্রত্যেক ব্যক্তি হোক বা না হোক, অন্তত আমাদের কমিউনিটির সবাই তো এটা করছে"—তাই আমাদেরকেও "জনতার স্রোতে গা ভাসিয়ে" দিতে হবে। সবাই যেদিকে যাচ্ছে, আমাদেরকেও সেদিকে চলা উচিত, এত ভাল মন্দ যাচাই করে লাভ নেই। [37-39]

ব্যান্ড ওয়াগন প্রোপাগান্ডার পিছনে সাইকোলজিকাল ভিত্তিও রয়েছে। মানুষের বৈশিষ্ট্যই এটা যে, সে সব সময় বিজয়ী দলে থাকতে চায়। বেশিরভাগ পলিটিসিয়ানই এই বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে তাদের বিজয় নিশ্চিত করতে চান। প্রতিটি নির্বাচনের পূর্বেই দেখা যায়, সব প্রতিযোগীই নিজেদের সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে প্রচার করছেন। কারণ, বেশিরভাগ ব্যক্তিই পরাজিত প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিজের ভোটকে অপচয় করতে অনিচ্ছুক।

অর্থনীতিতে এই প্রোপাগান্ডা কাজ করার পিছনের কারণটা একটু ভিন্ন, যে কোন প্রোডাক্টের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য যে শ্রম আর সময় প্রয়োজন, সবাই সেই কষ্ট স্বীকারে আগ্রহী নয়। তাই, অপরের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যেই তারা নির্ভর করতে পছন্দ করে। এই ইফেক্টের সাথে Conspicuous Consumption-এরও একটি যোগসূত্র রয়েছে। কন্সপিকিউয়াস কনসাম্পশন বলতে শুধু সামাজিক 'স্ট্যাটাস' বজায় রাখতে একজন ভোক্তার মূল্যবান সব ভোগ্যপণ্য ক্রয় করাকে বোঝানো হয়।

আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও ব্যান্ড ওয়াগন প্রোপাগান্ডার প্রভাবের ভুরিভুরি উদাহরণ রয়েছে। ভার্সিটির ছেলেপুলেরা পেপসি বা কোক ছাড়া অন্য ড্রিংকস পান করে না, এতে নাকি তাদের 'স্ট্যাটাস' থাকে না। অনেক ছেলেই শুধু এ কথা ভেবে দাড়ি রাখেনা যে, "বেশিরভাগ মানুষেরই তো দাড়ি নেই।" বর্তমানে বেশিরভাগ মেয়ে শুধু এ কথা ভেবে পর্দা করে না যে, "আমার আত্মীয় স্বজন কেউই তো পর্দা করে না।" অনেক বাপ মা শুধু এ কারণে মেয়েকে মাস্টার্স পাসের পূর্বে বিয়ে দেন না যে, "সব বাবা মা-ই তো মেয়েদেরকে পড়াচ্ছে, আমি বিয়ে দিলে মানুষ কী বলবে।"

উদাহরণ দিতে গেলে হাজারো উদাহরণ দেয়া যাবে। প্রকৃত কথা হচ্ছে, প্রায় একশ বছর ধরে এসব প্রোপাগান্ডা চলে আসলেও সাধারণ মানুষ এসব বিষয়ে সচেতন নয়, 'ওদের' নিজেদের স্বার্থেই ওরা জনগণকে এসব বিষয়ে সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। ক্ষুদ্র একটি অংশ ছাড়া বাদ বাকি কেউই ক্রিটিকাল থিঙ্কিং-এ অভ্যস্ত নয়; তাই শাসক, মিডিয়া ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাদের প্রোপাগান্ডাগুলো চালিয়ে এসেছে। এসব বিষয়ে তারা সাইকোলজি ও সাইন্সের অন্যান্য ডিভিশন থেকে উৎসারিত ইনফোর সাহায্য নিয়ে তাদের প্রোপাগান্ডা ডিভাইসগুলোকে সর্বদা আপডেটেড রাখছে। আর তাদের ছোড়া সেসব প্রোপাগান্ডার জালে আমরা আটকা পড়ে যাই ছোট্ট পুঁটি মাছের মত, তারপর নিজের জীবন থেকে সরলতা আর ইসলাম ছুড়ে ফেলে মেতে উঠি দুনিয়াবি ভোগবাদীতার প্রতিযোগিতায়।

ইনফরমেশন ডিসইনফরমেশন, প্রোপাগান্ডা, থিওরি কিংবা ফ্যাক্টস—যে কোন ফিল্ডে আধিপত্য অর্জন/বজায় রাখতে অর্থের যোগানের পাশাপাশি চাই নিরবিচ্ছিন্ন রিসার্চ ও প্রজেক্ট। এই দুরূহ কাজের জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন স্পেশালাইজড অর্গানাইজেশন, যারা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট এক/একাধিক বিষয়ে তাদের রিসার্চ অব্যাহত রাখবে। বর্তমান বিশ্বে পশ্চিমা দেশগুলো—বিশেষ করে অ্যামেরিকা সবার উপর যেভাবে ছড়ি ঘুরাচ্ছে, তার পিছনে তাদের মিলিটারি সেক্টর ও ইকনোমিক সেক্টরের পাশাপাশি ইন্টেলেকচুয়াল সুপারম্যাসি আর ডমিনেশনের প্রভাব অনস্বীকার্য। গোটা বিংশ শতাব্দী জুড়েই তারা সে কথার প্রমাণ দিয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই তারা জনগণের চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য ইন্টেলেকচুয়াল সেক্টরের ডেভেলপমেন্টের জন্য অর্গানাইজড ওয়েতে কাজ শুরু করেছিল। আজকের পৃথিবীতে অ্যামেরিকা ইন্টেলেকচুয়ালি সবার চেয়ে ঢের এগিয়ে, এর পিছনে সবচে বেশি অবদান কার?

এই কোয়েশ্চেনের সবচে পারফেক্ট উত্তরঃ

"THINK TANK"


[চলবে ইনশাআল্লাহ্‌]


[1] [2] [3] [4] [5] [6] [7] [8] [9] [10] [11] [12] [13] [14-1] [14-2] [15]
[16-1] [16-2] [17-1] [17-2] [18] [19] [19-2] [20] [21] [22] [23] [24] [25] [26] [27] [28] [29] [30] [31] [32] [33-1] [33-2] [34] [35] [36] [37] [38] [39]

এছাড়াও পশ্চিমা 'স্কলার'দের হাস্যকর ও দুঃখজনক 'ইজতিহাদ' এখানে দেখতে পারেন, https://muslimskeptic.com/2020/04/20/yaqeen-institute-review/