প্রেম-ভালোবাসা এবং বিয়ে বিষয়ে আমার সাধ্যমতন কিছু অতি স্বল্প আকারে লেখা লিখেছিলাম একসময়। স্রেফ এতটুকুর কারণেই অনলাইনে এবং বাস্তব জীবনে বিভিন্ন তীর্যক তীক্ষ্ণ ভাষায় কটুক্তি ও সমালোচনা আমি শুনেছি। কিছু কথার কারণে কষ্টও পেয়েছিলাম। সে যাই হোক, আমি জানি এই বিষয়টাকে আমি কেন বারবার গুরুত্বপূর্ণ বলতে চেয়েছি। কেবল ইচ্ছে হলেই লিখতে বসিনি, অনেক সময় নিয়েই ভেবে কথাগুলো বলতে চেয়েছি কেননা আমার জীবনের বেড়ে ওঠার সময়গুলোর অভিজ্ঞতার আলোকেই কিছু কথা জানাতে চেয়েছি। হাইস্কুলের সময় সময় থেকেই আমি প্রচুর মানুষের সাথে মিশেছি সবসময় — আমার তা ভালো লাগত। আমি ভার্সিটি লাইফে কখনো হলের বাইরে কাটাইনি, মিশেছি, জেনেছি, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করেছি। আমার এই দীর্ঘ সময়ে উপলব্ধি ছিলো বেশ কিছু যার একটি হলো — তরুণ প্রজন্মের আনপ্রোডাক্টিভিটি, সময় নষ্ট করা, দ্বীন থেকে দূরে সরে যাওয়া, মেধা কমে যাওয়ার পেছনে যেই জিনিসটাকে আমার খুব বড় মনে হত তা হলো — প্রেম।

কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না, চলমান সময়টা বড্ড কঠিন। পূর্বেকার অন্য যেকোন সময়ের চাইতে কঠিন, আগামীতে আরো বেশি ফিতনাময় হবে তা বলাই যায়। এখন যারা দ্বীনের বোধসম্পন্ন মানুষ, তারা অনেক চিন্তিত থাকেন একটা সন্তানের বেড়ে ওঠা নিয়ে নিয়ে এবং আল্লাহর কাছে অনেক বেশি করে দু’আ করে সাহায্য চাইতে থাকেন; এটাই স্বাভাবিক। আমি ক্লাস এইট পেরিয়ে যেসব বিষয় ক্লাসমেটের কাছে শুনে অবিশ্বাস নিয়ে ভয়ে শিউরে উঠে রাতে ঘুমাতে পারিনি, সেসব বিষয়ে এখনকার কিন্ডারগার্টেনের ছেলেমেয়েরাই দিব্যি তা জানে। মনে পড়ে, ‘আলিফ লায়লা’ দেখবো বলে এশার সলাতে (৮:৩০/৮:৪৫) সালাম ফিরিয়ে দৌড়ে বাসায় ফিরতাম। তখন জুঁই নারিকেল তেলের অ্যাডে বলত, ‘তোমার ঘন কালো চুলে হারিয়ে যায় মন’ — এমনটা দেখেও লজ্জা পেতাম। একটা ছেলে এরকম বেশরমের মতন কথা বলছে, চিঠি লিখছে তা মানতে পারতাম না, জানতাম এটা ঠিক নয়। আল্লাহর অশেষ রাহমাতে টেলিভিশনের প্রতি ন্যূনতম ভক্তিও উঠে গিয়েছিলো ক্লাস সেভেন-এইটের সময়েই। এই জীবনে দিব্যি টিভির দর্শন ছাড়াই খুব ভালোভাবেই বেঁচে আছি আলহামদুলিল্লাহ। ক’দিন আগে পন্ডসের অ্যাডে দেখলাম বলে “এমন নরম কোমল ত্বক শুধু ছুঁতে চায় মন” — এমন টিভি কমার্শিয়াল ভাতিজি এবং ভাগ্নের সামনে বসে দেখা খুবই অস্বস্তিকর। তাও ভালো, স্যাটেলাইট চ্যানেলে ডিওডোরেন্ট স্প্রে-গুলোর টিভি কমার্শিয়াল দেখার মতন অসভ্য বিষয় দেখতে হয়নি, পানাহ চাই আল্লাহর কাছে।

আমি জানিনা কয়টা পরিবার আদৌ ‘ডিশের লাইন’ ছাড়া টেলিভিশন কল্পনা করতে পারেন। তবে, আমি জানি, আমি এবং আমাদের ভাই-বোনদের টেলিভিশনের তেমন কোন উপস্থিতি ছাড়াই দিব্যি জীবন কেটে গেছে, এবং তা অবশ্যই চাপিয়ে দেয়া ছিলো না, এগুলোর প্রতি আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত বিরক্তিবোধ থেকেই তা হয়েছিলো। ক্রমাগত লজ্জাহীনতা দেখতে থাকলে, একসময় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে, অথচ এসব স্বাভাবিক না। ‘টম এন্ড জেরি’ কার্টুনে টম কোন বিড়াল পেলেই যেই অঙ্গভঙ্গি করে এগিয়ে যায়, তা বোধকরি হলিউডের বড়দের ‘এজ রেটের’ ফিল্মগুলোর সাথেই মানায়, এতে মেয়ে বিড়াল অথবা নারী কারোই পোশাক গ্রহণযোগ্য নয়। প্রায় কার্টুনগুলোই এমন। আমাদের কি মনে হয় শিশুরা এসব বুঝেনা বা শিখেনা? তাদের ‘অবজার্ভেশন পাওয়ার’ অত্যন্ত বেশি সেটা মা-বাবা মাত্রই জানেন। সিনডারেলা, মিনি এবং মিকি মাউসের মূল চরিত্রগুলোতে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ বা শিক্ষণীয় বিষয় কতখানি ভেবে দেখি আমরা? ইসলামের চোখে এই নির্লজ্জ এবং আদবহীন বিষয়গুলোর প্রসার করা তো সম্পূর্ণ নিষেধ। সন্তানদের কাছে এই পথগুলো খুলে দিলে একসময় তারা ‘ডিসেনসিটাইজড’ হয়ে যাবে। তাদের সামনে আদর্শের অভাব হয় কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবাদের সেরা চরিত্র তাদের কল্পনায় আর গল্পে জীবন্ত থাকছে না। কিন্তু ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আমরা তাদের দিয়ে রাখি কম্পিউটার বা টেলিভিশন পর্দায় চরিত্রহীনতার প্রদর্শনীতে। ওতেই ভয়, কেননা যখন ‘খারাপ/অস্বাভাবিক’ বিষয়গুলো ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে প্রকাশ পাবে ছোটদের কাছে, তখন তার প্রতি ওদের অপছন্দ ও ঘৃণা তৈরি হবে না। ভবিষ্যত চরিত্রে তার প্রভাব থাকবে। আমাদের দ্বীনে ‘হায়া’ বা লজ্জা অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ, যা কেবল উপলব্ধিরই নয় বরং সময়ের সাথে সাথে তাকে গড়ে তোলারও।

কলেজ জীবনে এসে খেয়াল করতাম যেই কোচিং সেন্টারে মেয়ে থাকত, সেটাতে অনেকেই পড়তে যেতে চাইত। এখন তো ফেসবুকেই অনেক ফ্রেন্ড বানিয়ে, ইনবক্সের আলাপে, ফটো কমেন্টে কতকিছু হয় যা কেউ ভাবেনি আগে!! সেই সময়ের এই রোমান্সের মূলে ছিলো হিন্দি মুভিগুলো, অথবা হলিউডি মুভি। বন্ধুরা অনেকেই উল্টাপাল্টা প্রেম করতে গেলে যদি দু’কথা বলতাম তখন শাহরুখের ‘কাল হো না হো’ দেখে শেখা একটা ডায়লোগ দিতো — ‘ছাও, মুসকো রাও, কেয়া বাতাও, কাল হো না হো’… এত চিন্তা করে আর কী হবে ক’দিনের এই জীবনে? ভালো কথা, মনে পড়লো যে সেই সময়ের প্রেমিক হৃদয়ের কেউ কেউ বিয়ে করে ডিভোর্সও হয়ে গেছে তাদের বনিবনা হয়নি বলে। চিন্তা করতে শেখার আগেই বড় সিদ্ধান্ত আবেগের বশে নিলে মানিয়ে নেয়া হবে কী করে? এমন কিছু ক্ষতি তো আছেই অপরিণত ‘প্রেম করাই লাগবে’ রোগের। কলেজে পড়ি তখন, একবার এক বন্ধুর বাসায় ঈদের দিন দাওয়াতে গিয়েছি। বলাই বাহুল্য, উপস্থিত ক্লাসমেটদের প্রায় সবারই ‘গার্লফ্রেন্ড’ ছিলো। বন্ধুর বড় বোন হঠাৎ হাজির হয়ে সবার ‘ইয়ের’ খোঁজ নিচ্ছিলেন, আমি অস্বস্তিতে মাথা নিচু করে খাচ্ছিলাম। একসময় আমার কাছে প্রশ্ন এলে আমি কিছু না বললেও বন্ধুরাই বললো। আমাকে তিনি বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার কোন ফোন ফ্রেন্ডও নাই?!!” সে অনেক বছর আগের কথা। সেদিন উনার অবাক হওয়া দেখে আমি যেন বিষণ্ণ হয়ে গেলাম, এই ‘ফোন ফ্রেন্ড’ জিনিসটা আমি পরে অন্যদের জিজ্ঞাসা করে বুঝেছিলাম। এটা হলো — ফোনে আলাপ হবে, মজা হবে, খোঁজখবর নেয়া হবে… !! কী অদ্ভুত সব আবিষ্কার শয়তানী বুদ্ধির লোকেদের।

ভার্সিটি হলে যখন থাকি, তুমুল প্রেমের বন্যা চারপাশে। ক্লাসের শেষে, বিকালে রিকসায় করে কোথাও অনেকেই ঘুরে। একটু রাত হলেই ফোন কানে নিয়ে ছেলেরা হলের বারান্দার দেয়ালে উঠে কথা বলতে শুরু করে। রাত গভীর হয়, ফোনওয়ালার সংখ্যা ও আনাগোনাও বাড়ে। এই সময়ে নিজেকে প্রতিদিন উত্তর দিতে হত, কেন আমি ওদের মতন হতে চাইনা। এটাই মনে হয় সবার হয়, নিজেকে প্রশ্ন করা, উত্তর পাওয়া নিজের ভিতর থেকেই। এমন নয় যে মনের কথা বলা, আলাপচারিতা আর খুনসুটি করার ইচ্ছা কারো হয় না — এ আবেগ সাধারণ, সবার। বেশিরভাগ পরিবারে বিবাহপূর্ব সম্পর্ক প্রেম গ্রহণীয় থাকে না — সেটা ধর্মীয় কারণেই হোক বা পারিবারিক অন্য কারণেই হোক। অথচ ছেলেমেয়েরা অনেকে লুকিয়ে প্রেম করে শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত করে। ৬-৭ বছর পেরিয়ে যায় অথচ বাবা-মা জানতে পারেন না দিব্যি তারা প্রতিদিন কত যোগাযোগ করে। এভাবেই কেউ সম্পর্ক ভাঙ্গে, নতুন সম্পর্ক গড়ে। আর, বিয়ে? সে ত বহুদূর… প্রশ্ন করলে তাদের অনেকের কাছে উত্তর পাবেন, “এখনো আমরা এতটা ভাবছিনা, আরো কিছুদিন যাক। বিয়ে অনেক খরচ আর দায়িত্বের ব্যাপার”… কী যাবে? কতদূর? কেন? দায়িত্ব কী ভীতিকর? আর দায়িত্বহীন আনন্দ? তা কেন নিচ্ছ??

ভার্সিটির হলগুলোতে বহু কম্পিউটারেই পর্ণগ্রাফি পাওয়া যাবে। অনেকগুলো ভার্সিটির কথা আমি জানি, বন্ধু-ছোটভাই-বড়ভাইদের কাছে শুনেছি। এটাও জানি, হলের নেটওয়ার্কে ঢুঁ দিলে শত গিগাবাইটের পর্ণোগ্রাফির মুভিওয়ালা ছেলেরাও দিব্যি ফেসবুকে বসে বসে ‘নারীমুক্তির’ গান গায়। নারীর প্রতি এদের ধারণা তারা নারী নিয়ে আলাপ করার সময় যা বলে, তা থেকেই সহজে অনুমেয়। হলের টিভিরুমে ‘চিয়ার গার্ল’ অথবা ‘সুন্দরী মডেল’ দেখালে যারা সর্বপ্রথম কিছু রগড়গে মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়, এই ‘মুক্তমনারা’ সে দলেই পড়ে। সাইবার ক্যাফে তে অনেক আগে যেতাম, যখন নিজের মডেম ছিলো না — সেখানে ‘ব্রাউজারের হিস্টরি’ ঘাঁটতে হত না, অ্যাড্রেসবারে কিছু চাপলেই ভীতিকর হয়ে বেরিয়ে আসত। প্রকৌশলবিদ্যার ছাত্র হবার কারণেই হয়ত, একটা কম্পিউটারে বসে কয়েক সেকেন্ডের মাঝে অনেক কিছু বুঝে ফেলতে পারি। মনে আছে, আগের অফিসে থাকতে ‘প্রভার ভিডিও’ বের হবার পরে “সকল বিবাহিতরা” দৌড়ে অপর বিবাহিতের কম্পিউটারে দেখতে গিয়েছিলো। কেউ দেখাচ্ছে, কেউ দেখতে যাচ্ছে। তারাই আবার ‘ছি ছি’ করলো পরে। এমন নির্লজ্জতা সহ্য করা কঠিন! কিন্তু এমনটাই মনে হয় বাস্তবতা। বছরের পর বছর ধরেই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেক বয়স্করা অফিসের ইন্টারনেট ইউজ করে এসব ডাউনলোড করেন — তারা সন্তানের জনক। জানতে পেলে লজ্জা পাই, উনাদের হয়না। এক বাসায় গিয়ে ল্যাপটপে একটা কাজ করে দিতে ধরতেই দেখলাম এর আগেই কিছু পর্ণ সাইটে ঢুঁ দেয়া হয়েছে। এমন অভিজ্ঞতা অজস্রবার হয়েছে নানান জায়গায়…

এমন একটা ভয়াবহতাময় কঠিন সমাজেই আমাদের বসবাস। এখানে বাস্তবতাগুলো জেনে, বুঝেও এই নোংরা আর ধ্বংসের স্রোতের বিপরীতে যারা জীবনধারণ করতে চান, তারা স্বপ্নবাজ মানুষ। তারা অন্তরে আলো জ্বেলে সেই আলো ছড়িয়ে দিতে চান। তারা সচ্চরিত্র হতে চান, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তারা মানুষ নন। ইসলামের সবখানেই বিয়েকে সর্বাগ্রে রাখা হয়েছে। যেই ছেলেরা দ্বীনকে আঁকড়ে ধরতে চায়, চরিত্র রক্ষা করতে চায়, চোখকে সংযত রেখে পথ চলে, জীবনকে সাজায় — সে কি তা বছরের পর বছর ধরে করবে? এখানে পরিবারগুলোর চিন্তা করা প্রয়োজন আন্তরিকভাবে। জীবনকে যাপন মানে নিজেরা পরীক্ষাকে জটিল করে ফেলা নয়, যেখানে সহজ সমাধান শেখায় সুন্নাহ, আমাদের সেরা মানুষদের রেখে যাওয়া জীবনাদর্শ। আমাদের আগের প্রজন্মের বাবারা খুব অল্পই ৩০ পেরিয়েছিলেন, মায়ের অল্পই ২৫ পেরিয়েছিলেন। সেই অভিভাবকদের অনেকেই অনেক কিছুর দোহাই দিয়ে সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যত চান বিধায় বিয়েকে পিছিয়ে পিছিয়ে তিরিশের ওপারে নিয়ে গেছেন। নিঃসন্দেহে তাদের নিয়াত সুন্দর, কিন্তু বোধের সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু এই সন্তানরা কেমন সময় অতিক্রান্ত করছে? সন্তানদের নিয়েও কি তারা এই শহরের প্রায় নগ্ন নারীদের বিলবোর্ড, টেলিভিশন কমার্শিয়াল দেখছেন না? বিষয়টা চিন্তা করার। খুব বড় বিষয়, অবশ্যই ভাবতে হবে বিপদ থেকে বাঁচতে।

আমার এক ছোট ভাই, ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। সুন্দর চরিত্রের এই ছেলেটি নানান রকম ফিতনাহর যন্ত্রণায় জর্জরিত। সামনে কমপক্ষে চার বছরের নীলনদ সাঁতরাতে হবে, এরপর রয়েছে চাকরির বাজারের যুদ্ধ। বাসায় নির্লিপ্ত তো বটেই। শুধু ক্রমাগত রোজা রাখা আর বাসায় আন্তরিকভাবে জানানো ছাড়া সমাধান দিতে পারলাম না। আরো ৬-৭ বছর আগে শারীরিকভাবে যোগ্য হওয়া ছেলেটার হালাল সমাধান যে সূদুরপরাহত সে তো আমি ২৮-২৯ চলতে থাকা মানুষদের দিকে তাকিয়েই জানি! অথচ ইসলাম বলেছে এই সীমানা প্রাপ্তবয়স্ক হলেই হবে। সে তো অনেক আগেই। যে নিজের মনটাকে পবিত্র রাখতে চাইছে, তার জীবনসঙ্গী/সঙ্গিনী এলে টের পেত এই পবিত্রতা কত সুন্দর আর দারুণ। তারা দু’জনে দু’জনের দুর্গের মতন হয়। পবিত্র জীবনসঙ্গিনী একজন মু’মিনের জন্য দুর্গস্বরূপ, তাকে অশ্লীলতা, অন্যায় থেকে রক্ষা করবে। একজন মুসলিমাহ তার জীবনসঙ্গীকেও অমন করেই পাবেন। তাদের জীবনের কঠিন সময়ে পরস্পরকে সঙ্গী করে পেয়ে তাদের বন্ধন যে আরো সুদৃঢ় হবেই ইনশা আল্লাহ, তা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধি লাগে না। কত সুন্দরই না সমাধান। আর্থিক সমস্যা কখনই অত বেশি মুখ্য নয়, আর সেই সমস্যা কেউ এড়াতেও পারবে না। দু’জনে মিলে সেই জীবনের পথে এগিয়ে গেলেই বরং কল্যাণকর…

পুর্বেকার প্রজন্মের সাথে আমাদের বড় ক্ষতি বিয়ের বয়স পিছিয়ে যাওয়া। এখন তো যারা প্রেম করছে, তারা বিয়ে করবে বলে তা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে, তারাও বিয়ের আগে বছরের পর বছর এই হারাম সম্পর্ক এগিয়ে চলেছে। প্রতিদিনই তারা যিনার পাপে নিজেদেরকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। শেখাবে কে তাদের? আল্লাহর নির্দেশ তো এমন নয়। এখন তো যেন ছেলেরা সবই পারে — ইতরামি, ফাইজলামি, গার্লফ্রেন্ড পালা, ফাস্টফুডে আর পার্কে নষ্টামি, রিকশায় হুড তুলে বেহায়াপনা; শুধু বুঝি পারে না বউয়ের দায়িত্ব নেয়ার হিম্মত নিতে। এখন তো পারিবারিক পরিবেশগুলোও আলাদা। মেয়েদের পরিবার চায় অনেক টাকাওয়ালা ছেলে, এতে মেয়ের ভবিষ্যত ‘নিশ্চিত’ হবে। অথচ আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বীনদারীকে সর্বাগ্রে দেখতে বলেছেন, আল্লাহ নিশ্চয়তা দিয়েছেন চরিত্র রক্ষায় বিয়ে করলে তার অভাবকে তিনি মুক্ত করবেন। অন্যদিকে ছেলেরাও দ্বীনদার মেয়ে ভুলে সুন্দরী চায়। অথচ রূপের চটক আর চমক কারো খুব বেশিদিন থাকে না। কিন্তু দু’জন ছেলে-মেয়ে পারস্পরিক চরিত্র রক্ষায় বিয়ের বন্ধনে জড়ালে ইনশাআল্লাহ জান্নাতে তারা অপরূপ হয়ে একে অপরের কাছে ধরা দিবেন। দুনিয়ার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধতা আর সেখানে থাকবে না। এই পৃথিবীতে চরিত্র রক্ষার আশায় পরস্পরের ‘চাদরস্বরূপ’ হয়ে, অন্যের জন্য হালাল ইবাদাত হয়ে ধরে দিলে ইনশাআল্লাহ আগামী প্রজন্মও আসবে সুন্দর ও সুনিপুণ চরিত্রের।

রিযিকের মালিক তো কেবলই আল্লাহ — তিনি তো যাকে ইচ্ছা বেহিসাব দেন। চরিত্রের জন্য বিয়ে করা দম্পতির রিযিককে তিনি প্রশস্ত করে দিবেন, তা তিনি জানিয়েই দিয়েছেন। ভাইয়েরা যেন একজন দ্বীনদার মেয়েকেই খুঁজেন, টেলিভিশনের নায়িকাদের সাথে তুলনা করে স্ত্রী খুঁজতে না যান। সত্যি কথা হলো, আমরা যদি ইসলামিক উপায়ে দৃষ্টি অবনত করে চলতাম, তাহলে যাকেই জীবনসঙ্গী পেতাম — তাকেই আমাদের অপরূপা মনে হত। একজন মুসলিমাহর জীবন অনর্থক সৌন্দর্যচর্চা করে সময় নষ্টের জন্য নয়। মুসলিম ভাইও স্ত্রীকে পার্লারে গিয়ে তার সময়-অর্থ-মানসিকতাকে নষ্ট করতে দিতে চাইতে পারেন না। মুসলিম হিসেবে আমাদের কাজ অনেক বড়। আমাদের উদ্দেশ্য তো সেই নূরকে ধারণ করে চারপাশে ছড়িয়ে দেয়া যেই আলো আমাদের রবের ভালোবাসায় প্রজ্বলিত। আমরা তো ক্ষুদ্র দুনিয়াবী, তুচ্ছ, অর্থহীন বিষয়ে ডুবে থাকতে পারিনা কেননা জানি এই দুনিয়ার জীবন অল্প ক’দিনের। আমাদের লক্ষ্য তো সেই রবের সন্তুষ্টি যিনি সাজিয়ে রেখেছেন অনন্তকালের জীবন –তার প্রিয় বান্দাদের জন্য।

পরিবারগুলোতে সচেতনতা প্রয়োজন। এই সময়ের নষ্ট স্রোতে তরুণ ভাই ও বোনদের দরকার নিজেদের ভেসে যেতে না দেয়া, বরং এই স্রোতকে উলটে দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়া। আমরা তো জানি আমাদের লক্ষ্য কী! আমরা তো অযথা ভেসে যেতে পৃথিবীতে আসিনি। আমরা সেই আল্লাহর দাসত্ব করি, যিনি সৃষ্টি করেছেন জগতের প্রতিটি বস্তু, বানিয়েছেন আমাদের, তার রাহমাতের বর্ষণে আবিষ্ট রেখেছেন আমাদেরকে। আমরা অসহায় আর দুনিয়ার তুচ্ছতায় ডুবে থাকা মানুষদের জন্য নিজেদের বিলিয়ে দেব — এমনটাই হবে আমাদের স্বপ্ন, হৃদয়ের চাওয়া। আমাদের সামনে আদর্শ তো সেই মানুষটি যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, যিনি সর্বোত্তম আদর্শ; যিনি এই সৃষ্টিজগতের প্রতি রাহমাতস্বরূপ ছিলেন। তার পথ অনুকরণ করে আমরা হবো সমাজের, পরিবারের জন্য রাহমাত। এই ভ্রষ্ট-নষ্ট প্রবাহ নিয়ে ধৈর্যহারা হওয়া যাবে না।

নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের জন্য এই সমাজটাই ঠিক করে রেখেছিলেন, এটাই আমাদের পরীক্ষা, এটাকে বদলাতে হবে, অন্যায়কে সরিয়ে ন্যায়কে, অশ্লীলতার জায়গায় লজ্জাকে, অসুন্দরকে সরিয়ে সুন্দরকে স্থাপন করতে হবে। আমাদের সবর করতে হবে, লেগে থাকতে হবে কাজে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুন্দর একটা সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক-সাংস্কৃতিক শিক্ষার পরিমন্ডল তৈরি করতে হবে। প্রতিটি ভালো কাজের বিনিময় আমরা সাদকায়ে জারিয়াহ হিসেবে পেতে থাকবো ইনশাআল্লাহ কবরের অন্ধকারে আলো হিসেবে। সময়টা সচেতনতার, দু’আ করার, আন্তরিকভাবে কাজ করে যাওয়ার। এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মূর্খতা জায়গা করে নিয়েছে। নিজেদেরকে দিয়েই তার পরিবর্তনে কাজ করতে হবে। আল্লাহর জন্য যে প্রাণ কাজ করে, সেইই তো সফল। আমরা এই সমাজে ‘গুরাবা’, আগন্তুক; আমরা ব্যতিক্রম, ভিন্ন, আমাদের প্রিয় মানুষটি আমাদের কথাই তো বলে গিয়েছিলেন। আমাদের মতন অপর গুরাবাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিন — সাহায্যের, সহমর্মিতার, ভালোবাসার। সাহায্য করুন দুনিয়া নামের বিভ্রমের জায়গায় ধৈর্যধারণ করার উপদেশ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে আর স্বপ্ন জাগিয়ে রেখে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের শক্তি দিন, সবর করার, যোগ্যতা দিন যেন দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি নিজ জীবনে, পরিবারে আর আমাদের সমাজে। নিশ্চয়ই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য আল্লাহকে খুশি করা, তার ইবাদাত করা এবং লক্ষ্য আমাদের জান্নাতের বাগান, যা কেবল শান্তিই শান্তি, যে পরম আনন্দের উদ্যান কেবল মুত্তাকীদের জন্যই। আল্লাহ আমাদের সেখানে যাবার যোগ্য করে দিন।