Peer pressure এক অদ্ভুত প্রকৃতির প্রেসার। পৃথিবীতে high pressure, low pressure এর নাম শুনেছেন কিন্তু Peer pressure এর নাম হয়ত কখনো শুনেননি। কিন্তু আমার ধারণা এটা কোন কোন সময় হাই এবং লো প্রেসারের চাইতেও বিপজ্জনক।

“C’mon. Everyone’s doing it.” So why shouldn’t you?
আরে আয়, সবাই করছে সমস্যা কি? আরে এভাবে ক্ষ্যাত মার্কা আচরণ করছিস কেন?

বন্ধুদের মধ্যে এ ধরনের কথাবার্তা হরহামেশাই শুনা যায়। আজকাল কিশোর ও যুব সমাজের মধ্যে এ জিনিসটা খুবই কমন। কেউ কোন কিছু থেকে বিরত থাকতে চাচ্ছে বা তার সেটা পছন্দ না কিন্তু তার পরও যেহেতু সব বন্ধুরা এ কাজটি করছে তখন তাদের একজন হয়ে থাকার জন্য সে কাজটি করার জন্য মনে যে তাড়নার উদ্রেক হয় তাকে Peer pressure বলে।

আজকাল মুসলিম কিশোর ও যুবক যারা ইসলামকে তাদের প্রাত্যহিক জীবনে অনুশীলন করতে চাচ্ছে তারাই সবচেয়ে বেশি এ প্রেসারটা সম্মুখীন হয়।

আপনার বন্ধুরা, সিগারেট খাচ্ছে, গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরছে, ডিজে পার্টিতে যাচ্ছে আর আপনি তাদের সাথে তাল মিলানোর জন্য হয়ত কৌতুহল বশত সিগারেটে দু একটান দিলেন, ডিজে পার্টিতে এক চুমুক হুইস্কি বিয়ার খেলেন আর বন্ধুদের সামনে কুল সাজার গোপন প্রয়াসে হয়ত গার্ল ফ্রেন্ড একটা সংগ্রহ করে নিলেন।

আড্ডার আসরে থাকতে পারবেননা এজন্য মুভি দেখা শুরু করলেন আর অল্পস্বল্প সিগারেটের প্রতি আসক্ত হওয়া শুরু হল। একজন মুসলিম কিশোর বা যুবকের পিয়ার প্রেসার তাকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে হয়ত তা চিন্তা করারও আমাদের সময় নেই।

আমি এজন্য পিয়ার প্রেসারকে হাই প্রেসার বা লো প্রেসারের চেয়ে বিপজ্জনক হিসেবে আখ্যা দিলাম কারণ এটা আপনাকে আপনার আইডেন্টিটি বিসর্জন দেয়ার জন্য উত্তম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। সোস্যাল সাইক্রিয়াটিস্ট Wendy Treynor পিয়ার প্রেসারের ফলাফল হিসেবে “the identity shift effect” কন্সেপ্টের সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেন। একজন মুসলমানের কাছে এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে? মুসলিমরা আজ এক আত্মভোলা জাতিতে পরিণত হয়েছে বলেই তাদের কিশোর আর তরুণদের এ করুণ দশা।

বিভিন্ন গবেষকরা peer pressure হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিভিন্ন রকম সমাধান দিতে চেয়েছেন। যেমন বন্ধুরা সিগারেট খেলেও কেন আপনি খাবেন না। কারণ সিগারেট খেলে বিভিন্ন রকম অসুস্থতার সম্ভাবনা আছে। ঠিক তেমনি এলকোহল খেলেও। কিন্তু একজন মুসলিম সে তো সব কিছুর আগে অন্তরে ধারণ করবে আল্লাহ ভীতিকেই। আল্লাহ এ বিষয়ে কি আদেশ দিয়েছেন। নবী (সঃ) এ বিষয়ে কি কিছু বলেছেন?

মুসলিমরা স্রোতের বিপরীতে চলাকে ভয় করেনা। বরং অত্যন্ত সাহসিকতার সাথেই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করে। কারণ তারা সেই নবীর উম্মত যিনি নবুওয়াত আসার আগে চল্লিশটা বছর সমাজের জাহিলিয়্যাতের স্রোতের বিপরীতে চলেছেন। যে সময় মক্কায় মূর্তিপূজার জোয়ার ছিল সেই সময়ই তিনি তাঁর উঁচু শিরটা নির্জীব মূর্তির সামনে নত করেননি। যেসময় আশেপাশে মদ, জুয়া, যিনা ব্যভিচারের সয়লাব ছিল সে সময় তিনি নিজেকে কখনো মদ আর জুয়ার কাছাকাছিও নিয়ে যাননি। নিজের চরিত্রকে রেখেছিলেন নির্মল পুতঃপবিত্র। যে সমাজ ঠকবাজি, মিথ্যা, প্রতিহিংসা অনাচার অবিচারের সমাজ ছিল সে সমাজে তিনি নিজেকে আমানতদার, পরম সত্যবাদী, ভাল ব্যবহারকারী এবং ন্যায়বিচারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সমাজের দুর্গন্ধযুক্ত স্রোতে নিজের গা ভাসিয়ে দেননি বরং নিজে সে স্রোতকে পরিবর্তন করে মিশকে আম্বারের গন্ধে সুভাসিত করেছিলেন।

আল্লাহু আকবার! আমরা সেই নবীর উম্মত। আমরা সেই নবীর প্রত্যেকটি পদক্ষেপ অনুসরণ করি।

মুসলিমদের ভুলে গেলে চলেবনা তারা ঘুরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়নি বরং তারা ঘুরিয়ে দেয়ার জন্যই সৃষ্ট। তারা ঢালাই হওয়ার জন্য তৈরি হয়নি বরং তারা ঢালাই করার জন্য তৈরি হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে “খায়রে উম্মাহ” বা “উত্তম জাতি” হিসেবে মনোনীত করেছেন। শুনেছি আল্লামা ইকবাল কিছু মানুষকে একত্র করে একজন একজন করে ডেকে একটা কমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন-

“ধর, এখান দিয়ে একটা স্রোতধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এ স্রোতধারার প্রতি তুমি কিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ কর?”

প্রথমজন উত্তর দিল, “আমি কম শক্তিশালী মানুষ কি আর স্রোতের সাথে পারব? তাই হয়ত আমাকে স্রোতের সাথেই যেতে হবে।”
“ভীতু মানব, তোমাকে দিয়ে হবেনা।”

দ্বিতীয়জন উত্তর দিলেন, “আমি স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করব।”
আল্লামা ইকবাল তাকেও বললেন, “ওহে বৎস, তোমাকে দিয়েও হবেনা।”

তৃতীয়জন উত্তর দিলেন, “আমি স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাব।”
“ওহে কিছুটা সাহসী মানব তোমাকে দিয়েও হবেনা।”

চতুর্থজন উত্তর দিল, “আমি স্রোতটাকেই পরিবর্তন করে দেয়ার চেষ্টা করব। স্রোত যেন আমি যেমন চাই সেভাবে প্রবাহিত হয় তার ব্যবস্থা করব।
আল্লামা ইকবাল বললেন, “তোমাকেই আমি খুঁজছিলাম।”

গল্পটি কতটুকু সত্য জানিনা, তবে এখানকার শিক্ষণীয় ব্যাপারটা আমাকে খুব আকর্ষণ করে।

মহানবী সঃ বলেছেন-

ইসলাম শুরু হয়েছিল অপরিচিত হিসেবে এবং তা যেভাবে শুরু হয়েছিল সে অবস্থায় ফিরে যাবে। সুতরাং অপরিচিতদের (আগন্তুকদের) জন্য তুবা (সুসংবাদ/তুবা হচ্ছে জান্নাতের একটি বৃক্ষ)। [সহীহ মুসলিম]

ইসলাম যখন মক্কায় প্রথমে এসেছিল তখন তা পুরোপুরি অপরিচিত ছিল। কারণ তারা যা বিশ্বাস করত বা যে সকল ধ্যান ধারণা তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল ইসলাম সবকিছুকে প্রত্যাখ্যান করে সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু চিন্তা চেতনা বিশ্বাস নিয়ে এসেছিল। আজকাল আমাদের সমাজেও ইসলামের শিক্ষাকে যেভাবে অবজ্ঞা করা হচ্ছে কাউকে যদি কোরআন এবং মুহাম্মদ (সঃ) এর সুন্নাহ এর দিকে ফিরে যেতে দেখা যায় তাকে অপরিচিতই মনে হয়।

আজকের এ সমাজে মদ, সুদ, পরকীয়া, লিভ টুগেদার নিষিদ্ধ? কি আজিব কথা!
এখনো মধ্য যুগেই রয়ে গেলি। বর্বর আরব প্রথা ছাড়তে পারলিনা।

মহানবী (সঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কারা এই (গুরাবা) অপরিচিত?
তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “যারা ভাল কাজ করে যেখানে অন্যরা খারাপ কাজ করে।”
অন্য এক জায়গায় গুরাবার (আগন্তুকদের) পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “যারা ইসলামের জন্যই তাদের সমাজের লোকজনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।”

সমাজের লোকজন যেখানে প্রবৃত্তির দাসত্বে ব্যস্ত সেখানে এসকল আগন্তুকরা কেবল আল্লাহর দাসত্বই করবে।

মুসলিম কিশোর যুবকদের মধ্যে কোথায় সেই “Trend setter”-রা,
কোথায় ওসামা বিন যায়েদ (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাঃ কিংবা ইবনে আব্বাসরা।

মুসলিমরা তাদের রং ভুলে গেছে। কোন রং-য়ে রঞ্জিত হওয়ার জন্য তাদের আগমন সে জ্ঞান হারাতে বসেছে বলে তারা আজ ধ্বংস খাদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে।

মুসলিমদের কেমন হওয়া উচিৎ সে বিষয়ে বলতে গিয়ে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম চিন্তাবিদ বলেছেন-

আল্লাহর বিধান ভীরু কাপুরুষদের জন্য অবতীর্ণ হয়নি। নফসের দাস ও দুনিয়া গোলামদের জন্যে নাযিল হয়নি। বাতাসে উড়ে চলা খড়কুটো, পানির স্রোতে ভেসে চলা কীটপতঙ্গ এবং প্রতি রঙ্গে রঙ্গিন হওয়া রং হীনদের জন্য অবতীর্ণ হয়নি। এমন দুঃসাহসী নর শার্দুলের জন্যে অবতীর্ণ হয়েছে যারা বাতাসের গতি বদলে দেবার দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করে, যারা নদীর তরঙ্গের সাথে লড়তে এবং তার স্রোতধারা ঘুরিয়ে দেবার মতো সৎ সাহস রাখে। যারা আল্লাহর রংকে দুনিয়ার সকল রঙ্গের চাইতে বেশি ভালবাসে এবং সে রঙে যারা গোটা দুনিয়াকে রাঙ্গিয়ে তুলবার আগ্রহ প্রকাশ করে। যে ব্যক্তি মুসলমান তাকে নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়ার জন্য পয়দা করা হয়নি। তার সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হলো জীবন নদীকে তার ঈমান ও প্রত্যয় নির্দেশিত সোজা ও সরল পথে চালিত করা।

সত্যি তাই। মুসলমানদের সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হলো জীবন নদীকে তার ঈমান ও প্রত্যয় নির্দেশিত সোজা ও সরল পথে চালিত করা।

মুসলিমরা এ কাজে উদাসীনতা দেখানোর মনোভাব বন্ধ না করলে তাদের মার খাওয়ার ধারাবাহিকতা চলবেই।

আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।