আমি তখন সবেমাত্র কলেজে উঠেছি। একদিন পত্রিকার পাতায় একটি আর্টিকেল চোখে পড়লো। স্বামী কি স্ত্রী’র পাশে বন্ধু হতে পারে।? দু’চোখে উৎস্যুক নিয়ে পড়ে দেখি বিপক্ষে অবস্থানকারীদের সংখ্যাই বেশী। চুপি চুপি বলি পাঠক, আমার কলেজের বিশেষ একজন অধ্যাপিকা ম্যাডাম ও দেখি সেই দলে। আর সমর্থন করেছেন যারা তাদের সংখ্যা ২/১ জন শুধু। স্বামীরা যে বস সুলভ আচরণ করেন, স্ত্রী’র ক্যরিয়ারকে মেনে নিতে পারেন না, নিজের ডিসিশনকেই বেশী প্রাধান্য দেন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় তারা তুলে ধরেছেন। পুরো আর্টিকেলটি পড়ে মনে হল স্বামী শব্দটির সাথে স্বার্থপর, সংকীর্ণমনা,স্বৈরাচারী এধরণের শব্দগুলোর গোপন এক আঁতাত আছে।

বন্ধুদের মাঝ হতে আমার বিয়েটা বেশ তাড়াতাড়িই হয়েছিলো। আমি যখন অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ি তখন। আমি মনে মনে ভাবলাম ইয়া আল্লাহ সত্যিই এবার বিপদে পড়েছি। আমি যদিও পরিবারের সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান কিন্তু তাই বলে যখন তখন ২৪ ঘন্টা কেউ আমার উপর হম্বি তম্বি করুক সেটা আমার একদম পছন্দ নয়। তাই শুরু হল আমার ওয়াচিং এর পালা।

বিয়ের কয়েক দিনের মাঝেই খেয়াল করলাম আমার ‘স্বামী’ বাইরে বের হলেই ফুল কিনে আনে। আজ এত বছরে ও সেই অভ্যাসের নড়চড় হয়নি। আমার প্রবাসী জীবনে তো বটেই। ১ মাসের জন্য বাংলাদেশে গেলেও ও ফুল কিনতে ভুল হয় না ওর। একদিন কথা প্রসঙ্গে বড় আপু বলেছিলো আমি যে ফুল খুব পছন্দ করি সেটা আপুর কাছ হতে ও শুনেছিলো। গত ২/১ বছর আগের ঘটনা। জরুরী প্রয়োজনে আমার স্বামীকে ২ সপ্তাহের জন্য একাই দেশে যেতে হল। আমার এর আগে কখনো এরকম একা থাকার অভিজ্ঞতা নেই। তাই প্রথম প্রথম খুব ভয় পেলাম। পরে ভয়টা অভিমানে রুপ নিলো। ঠিক করলাম ও জেদ্দায় ফিরলে কথা বলা বন্ধ করে দেব। এয়ারপোর্ট হতে যখন বাসায় ফিরলো আমি দরজা খুলে সালাম দিলাম। রজনীগন্ধার একঝলক সৌরভ এসে আমার নাকে লাগলো। ফুলপ্রেমী আমার নাক রজনী গন্ধাকে ভুলে যাবে এ হতেই পারে না। কিন্তু ব্যপারখানা কি? হঠাৎ দেখি ও মুচকি হেসে পেছনে লুকিয়ে রাখা হাতটা বের করে আনলো। ওমা প্রায় ৫০টার মত রজনী গন্ধা। অভিমান কি আর থাকে পাঠক। আমার মেঘ বিদূরিত মুখ লুকাতে গলায় প্রাণপণে গাম্ভীর্য ধরে বললাম- আহা ফুল গুলো তাড়াতাড়ি দাও। বেচারারা এতটা পথ পেরিয়ে এসেছে। নিশ্চয় ওদের পানির তেষ্টা পেয়েছে।

আমার বিয়ের আগে রান্নার অভিজ্ঞতা শুধু দু’দিন চা বানানোর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো। বিয়ের পর যখন প্রবাসী জীবন শুরু হল তখন তো কিছুই রাঁধতে পারিনা। কাকে দিয়ে যে কাকে রাঁধে সে জিনিসটাই আমি বুঝতাম না। আমার ‘স্বামী’র কাছ হতে জানলাম ১ কাপ চালে ২ কাপ পানি দিতে হয়। আর যে কোন তরকারি রাঁধতে হলে তেল, পেঁয়াজ , লবণ, মশলা অত্যাবশ্যকীয় জিনিস। ব্যস শুরু হল রান্নায় হাতখড়ি। প্রথম প্রথম ভাত, ডাল আর ডিম ভাজতাম শুধু। এমনও অনেক বার হয়েছে আমার নিজের রান্না আমি নিজেই খেতে পারিনি। কিন্তুসেই শুরু হতে এত বছর জীবনে আমার স্বামী কখনো বলেনি তোমার ওই রান্নাটা ভালো হয়নি। সব সময় হাসি মুখে খেয়ে উঠেছে।

আমি ছোট বেলায় খুব খাবার বাছাবাছি করতাম। ২/৪ রকম মাছ ছাড়া তেমন কোন মাছই খেতাম না। একদিন ছোট ভাইয়া ইংল্যন্ড হতে ফোন করে আমার হ্যজব্যন্ডকে বলল- ও তো খাবার নিয়ে আপনাকে খুব বিরক্ত করে তাই না? ছোট বেলা দেখতাম আম্মুকে খুব জ্বালাতো। আমার স্বামী দেখি এদিক হতে জবাব দিলো – ও যেটা পছন্দ করে না আমি সেটা বাসায়ই আনিনা। আসলেও তাই প্রথম প্রথম আমি মাছ খাইনা বলে ও তেমন মাছ আনতো না। কিন্তু পরে আমি ভেবে দেখলাম- আহা বেচারা মাছ খেতে এত পছন্দ করে। তখন হতে আমি ও একটু একটু খেতে শুরু করলাম। এখন আলহামদুলিল্লাহ অনেক মাছই খেতে পারি।

জীবনের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের সাথে মিল রেখে কখনো প্রিয় স্বদেশ ছাড়তে হবে এটা আমার কল্পনার ও অতীত ছিলো। তাই বিয়ের সময় এ নিয়ে খুব মন খারাপ ছিলো। তাছাড়া তখনো আমার পড়ালিখাটা শেষ হয়নি। তাই ভেবেছিলাম বিয়ের পর লিখাপড়ার সাথে জনমের মত ছেদ পড়ে গেল। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ আমার স্বামী আমার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে আমাকে পড়ার পূর্ণ সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ডিগ্রী পরীক্ষা দিতে গিয়ে প্রথম ভিসাটাই ক্যনসেল হয়ে গেল। পরে ও মাষ্টার্সের সময় সেশন জটের কারণে আমাকে বছরে ২/৩ বার ও দেশে যেতে হয়েছে। ততদিনে আমার প্রথম দুটো সন্তানের ও জন্ম হয়। কিন্তু আমার স্বামী কখনো আমাকে বাধা দেয়নি। বিয়ের সময় যেসব নিন্দুকেরা বাঁকা ভাবে বলেছিলো- গেলো অত মেধাবী মেয়েটার পড়া এবার বারোটা বেজে গেল। তারাই দেখতাম পরবর্তীতে বলতো- তোমার স্বামী তো দেখি জেদ্দা আর বাংলাদেশকে বাড়ি আর উঠোন বানিয়ে ফেলেছে।

মনে পড়ে আমার মাষ্টার্স কমপ্লিট হবার পর একদিন এক ভাবী ফোন করে বললেন- ভাবী আপনি শপথ করে বলেন তো আপনার স্বামী আপনাকে চাকরী করতে লিখাপড়া করায়নি। আমি বললাম- প্রশ্নই উঠেনা। তখন মহিলা কাঁদ কাঁদ গলায় বললেন- ভাবী অনার্সে আমার এত ভালো রেজাল্টের পর ও আমার স্বামী আমাকে মাষ্টারসটা কমপ্লিট করতে দিচ্ছেনা। অথচ ওর সামর্থ আছে। আমি যখন আপনার কথা বললাম তখন বলল- দেখ গিয়ে উনাকে দিয়ে উনার হ্যজব্যন্ড চাকরি করাতে চান।

আমি একবার চাকরি নেব কিনা ওর মতামত চাইলে ও বললো- তোমার ইচ্ছে। আমি জোর খাটিয়ে কিছু বলবো না। তবে তুমি এখন তোমার অবসরটা কিছু সৃষ্টিশীল কাজে লাগাতে পারছো। তাই বলবো তোমার অবসরটা কারো কাছে বেঁচে দিও না। আমার ওর পরামর্শ গ্রহণ করেছিলাম।

আমি মাঝে মাঝে কিছু হাতের তৈরী শোপিস বানাই। আমার স্বামী সব সময় আমার এই কাজের সহযোগী। একদিন তো একটি গাছের চ্যাপ্টা গুঁড়ির উপর আর একটি মরা গাছের কান্ড লাগিয়ে একটি পাহাড়ী গ্রাম বানাচ্ছি। সব কিছু ঠিকমত হল। কিন্তু আলাদা কান্ডটা কিছুতেই লাগাতে পারছিনা। আমি অভিমান করে বললাম- ঘরে কি কেউ নেই আমাকে একটু সাহায্য করবে? সঙ্গে সঙ্গে ও এসে লেগে গেল। দু’জন মিলে এই কাজ শেষ করে ঘুমুতে গেলাম প্রায় রাতের ১টা।

আমি আমার পরিবারে ছোট ছিলাম বলে আমার যে কোন ডিসিশনে বড়দের ভূমিকাই বেশী ছিলো। বিয়ের পর দেখি যে কোন ব্যপারে আমার স্বামী আমার সাথে পরামর্শ করে। সত্যি বলছি পাঠক আমি অবাক হয়ে মনে মনে ভাবতাম সব ব্যপারে আমাকে এত জিজ্ঞেস করার কি আছে। আমাদের বাসায় তো আমাকে এভাবে গুরুত্ব দেয়া হত না। পরে পরে বুঝেছি আসলে দু’জনের যৌথ জীবন যাপনে এই দিক গুলোর ঘাটতি অনেক পরিবারে মনোমালিন্যের কারণও ঘটায়।

আমি মাছের ডিম খেতে খুব পছন্দ করি সেটা বড় মাছ হোক আর ছোট একটি পুটি মাছের ডিমই হোক। আমার বিয়ের পর হতেই দেখি যখনই খেতে বসি আমার স্বামী মাছের ডিম পেলেই সেটা প্লেটের একপাশে সরিয়ে রাখে। পরে কেউ না দেখে অমনি করে আমার প্লেটে চালান করে দেয়। আমি মনে করি অতটুকু মাছের ডিম আসলে কোন বিষয় না । কিন্তু ও যে আমার ছোট খাটো পছন্দের ও খেয়াল রাখে সেটা ভেবেই বেশী ভালো লাগে। আর এখন তো আমরা এক সাথে খেতে বসলে ও যখন মাছের ডিমটা আমার প্লেটে চালান করে দেয় তখন বাকী তিনজন হৈ হৈ করে বলে- আব্বু, তুমি আম্মুর প্লেটে কি দিলে? তখন কি আর করা আমি সেই কড়ে আঙ্গুলের অর্ধেকের মত ডিমটিকে ৫ভাগ করে সবার প্লেটে একটু একটু ডিস্টিবিউট করি। খাদ্য হিসেবে যদিও জিনিসটি তেমন কিছুই নয়। কিন্তু আমাদের ৫ সদ্যসের মাঝে ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়াতে সত্যিই কিন্তু অনেক কিছু।

আসলে আমি মনে করি স্বামী স্ত্রী’র মাঝে বন্ধুত্বের একটি বন্ধন তৈরী করতে অনেক বেশী পরিশ্রমের দরকার হয়না। একজন অন্যজনের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, অন্যের পছন্দের গুরুত্ব দেয়া,পারস্পরিক পরামর্শ, একে অন্যকে বুঝতে পারাএ ধরণের বিষয়গুলোকে খেয়াল করলেই চলে। আজকাল অনেক উচ্চশিক্ষিত স্বামী-স্ত্রী’র মাঝে যে অহরহ পরিবার ভাঙ্গার ঘটনা ঘটে আমি মনে করি এর মূলে বড় কোন ব্যপার দায়ী নয়। শুরুর কথায় আসি আমি কিন্তু আমার পারিবারিক জীবনে পথ চলায় স্বামী শব্দটির অর্থ পাই- সহমর্মী, সহানুভূতিশীল সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে।

আমার স্বামীর এক কলিগ একবার ওকে জিজ্ঞেস করেছিলো- আপনাদের মধ্যে তো কখনো ঝগড়া হয় না তাই না? আমি বলবো খুনসুটি ছাড়া সম্পর্ক গুলো বড় বেশী ফরমাল মনে হয়। তবে আমরা সেই খুনসুটিকে কখনো বাড়তে দিইনা। আর আমার পিচ্চি মেয়েটি তো আছে আমাদের দু’জনের হাতটা মিলিয়ে দিয়ে বলবে – এখন তোমরা ফ্রেন্ড হও।

তাই বলবো স্বামী -স্ত্রী আসলে একে অন্যের বন্ধু হতে পারেন কিনা এটা সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছার উপরই নির্ভর করে। আসুন আমরা এখন হতেই এই সম্পর্কের প্রতি যত্নবান হই।