(১)

গল্পটা আমরা সবাই জানি। বনী ইসরাইলের ঘটনা। মুসা(আ)-এর শরীয়াতে শনিবার দিন ছিল বিশ্রামের দিন। সে দিন কোনো প্রকার কাজ করা হারাম ছিলো। এমনকি জীবিকার জন্য মাছ শিকার করাও হারাম ছিল। আল্লাহ্‌ তা'আলা তাদের পরিক্ষা করলেন।

শনিবার দিন বিশাল আকারের মাছগুলো পানিতে লাফালাফি করতো। আর অন্যদিন অনেক কষ্ট করেও মাছ শিকার করা যেতো না। এ অবস্থা দেখে এক এলাকার লোকজন তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। এক গ্রুপ শনিবার দিনেই নির্দেশ অমান্য করে মাছ শিকার করার সিদ্ধান্ত নিলো। আরেক গ্রুপ তাদেরকে মাছ শিকার করতে নিষেধ করলো। আর তৃতীয় গ্রুপ মাছ শিকার করলো না, আর অন্যদের শিকার করতে নিষেধও করলো না। উল্টো যারা নিষেধ করতো তাদের বলতো, “ঐ পাপীদের দল তো ধ্বংস হবেই। তাদের বেহুদা উপদেশ দিয়ে লাভ কি? বাদ দাও এসব।”
আল্লাহ্‌ তা'আলা তাদের সম্পর্কে বলেন,

“আমি সেসব লোককে মুক্তি দান করলাম যারা খারাপ কাজ থেকে বারণ করত। আর গুনাহগারদের পাকড়াও করলাম নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের না-ফরমানীর কারণে।
তারপর যখন তারা এগিয়ে যেতে লাগল সে কাজে যা থেকে তাদের নিষেধ করা হয়েছিল, তখন আমি নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা লাঞ্ছিত বানর হয়ে যাও।” (সূরা আল-আরাফ, ৭:১৬৫-১৬৬)

এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহ্‌ তা'আলা যারা মাছ শিকার করেছিলো, তাদের বানরে রূপান্তরিত করেছিলেন। আর যারা নিষেধ করেছিলো, তাদের মুক্তি দান করেছিলেন। কিন্তু যারা নিষেধও করেনি, আবার মাছও শিকার করেনি তাদের কি হলো? ইবনে আব্বাস (রা) এ আয়াতটি পড়ে কেঁদে দিয়েছিলেন। তাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে উনি বলেছিলেন,
“আমি তো জানতে পারছি নিষেধকারীরা মুক্তি পেয়েছিলো। কিন্তু অন্যদের (যারা নিষেধ করেনি তাদের) কী হলো তা তো জানতে পারছি না। (তারা এমন যে, আল্লাহ তা'আলা তাদের কথা উল্লেখ করারও প্রয়োজনবোধ করেননি। তাদেরকে জানার কোনো প্রয়োজন নেই। )
বিপদ তো এটাই যে, আমরাও লোকদের খারাপ কাজ করতে দেখছি, অথচ কিছুই বলছি না।” (ইবনে কাসির)

(২)

"তারা পরস্পরকে মন্দ কাজে নিষেধ করত না, যা তারা করত। তারা যা করত তা অবশ্যই খারাপ কাজ ছিল।"

সূরা মায়েদার ৭৯ নং আয়াত। তাফসীর আহসানুল বায়ানের লেখক এ আয়াতের ব্যাখ্যায় চমৎকার একটি হাদিস এনেছেন। রাসূল (সা) বলেছেন, "সর্বপ্রথম বনী ইসরাইলের মধ্যে যে ত্রুটি প্রবেশ করেছিল তা হচ্ছে, একজন মানুষ যখন অপরকে কোন অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত দেখত, তখন বলত, 'আল্লাহকে ভয় কর। আর এই পাপ বর্জন কর। এ তোমার জন্য বৈধ নয়।'

কিন্তু তারপরের দিনই তার সাথে পানাহার ও উঠা-বসা করতে কোন প্রকার ঘৃণা বা লজ্জা বোধ করত না। অথচ ঈমানের দাবী ছিল, তাদের প্রতি ঘৃণা ও সম্পর্ক ছেদ করা। যার ফলে আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা প্রক্ষিপ্ত করেন আর তারা আল্লাহর শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যায়।"
নবী (সা) তারপর বললেন, "আল্লাহর কসম! তোমরা অবশ্যই লোকদেরকে ভালোকাজের নির্দেশ প্রদান করবে আর খারাপ কাজে বাধা দান করবে। আর অত্যাচারীর হাত ধরে নেবে (তা-না হলে তোমাদের অবস্থাও অনুরূপ হবে)।"

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, এই অপরিহার্য কর্তব্য ত্যাগ করার শাস্তি হচ্ছে, তোমরা আল্লাহর আযাবের উপযুক্ত হয়ে যাবে। এরপর তোমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলে তা গ্রহণ করা হবে না।

(৩)

কিছু মানুষ সেইফ জোনে থাকা পছন্দ করে। নিজের সামান্য ক্ষতি হবে, ইমেজ নষ্ট হবে এমন জায়গাতেও তারা খারাপ কাজের নিষেধ করে না। অথচ এটা কিন্তু উম্মাতে মুহাম্মাদির বৈশিষ্ট্য না। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
"তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটেছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে আর অসৎ কাজ করতে নিষেধ করবে।" (সূরা আলে ইমরান ৩:১১০)

এ ব্যাপারটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝা যাবে এ হাদিসটির মাধ্যমে-
রাসূল (সা) বলেছেন,"কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করবেন,"তুমি অন্যায় হতে দেখেছো অথচ এর বিরুদ্ধে কথা বলোনি কেন?"
আল্লাহ্‌ যদি লোকটাকে সঠিক উত্তর দেবার ক্ষমতা দেন তবে সে বলবে,"হে আল্লাহ্‌! আমি মানুষকে ভয় করেছি। কিন্তু তোমার রহমতের আশাও করেছি।”(ইবনে মাজাহ)
হাদিসটি আবু সাইদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি এ হাদিসটি শোনার সাথে সাথে কেঁদে ফেলেছিলেন।

অন্যায়ের প্রতিরোধ করব কীভাবে? যেসব ঈমানদার ব্যক্তিরা অন্যায়ের প্রতিরোধ করে তাদের তিনটি ক্লাসের কথা রাসূল (সা) তাঁর এক হাদিসের মাধ্যমে আমাদের জানিয়েছেন। ফার্স্ট ক্লাস হচ্ছে, যারা হাত দিয়ে করে। সেকেন্ড ক্লাস হচ্ছে, যারা মুখ দিয়ে। আর থার্ড ক্লাস হচ্ছে, যারা অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে।

অত্যন্ত দু:খের সাথে জানাতে হচ্ছে, যদি সকল অন্যায় শুধু দুনিয়াবি কিছু স্বার্থসিদ্ধির জন্য সাপোর্ট করে যান, তবে আপনি ঈমানদারদের কোনো ক্লাসেই পড়ছেন না। বরং, আপনি যালিমদের ক্লাসে পড়ছেন। এ যুলুম কিয়ামতের দিন আপনার নিকট অন্ধকার হয়ে আসবে।

যাদের যুলুম করছেন, হক্ব ছিনিয়ে নিচ্ছেন, তাদের গুনাহগুলো আল্লাহ তা'আলা আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন। আর যদি চাপানোর মত গুনাহ না থাকে তবে আপনার ভালো কাজগুলো আল্লাহ তা'আলা তাদের দিয়ে দিবেন।

মাজলুমদের এই ক্ষুদ্র দুনিয়া ছাড়া হারানোর কিছু নেই। আর যালিমদের? আল্লাহর নিকট মাছির ডানার চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ দুনিয়া ছাড়া আর কোনোই প্রাপ্তি নেই।