একই হাদিস, কুরআনের আয়াত হয়তো নিজে অনেকবার পড়েছি, অনেকের কাছ থেকে শুনেছিও- কিন্তু কোনো ভাবান্তর ঘটেনি। ক’দিন পর হয়তো ভুলেও গিয়েছি। কেন এমন হয়? মালিক ইবনে দিনার (রহ) উত্তর দিয়েছেন-

إنَّ الْعَالِمَ إِذَا لَمْ يَعْمَلْ بِعِلْمِهِ زَلَّتْ مَوْعِظَتُهُ عَنِ الْقُلُوبِ كَمَا يَزِلُّ الْقَطْرُ عَنِ الصَّفَا

“যে আলিম তার ‘ইলম অনুযায়ী আমল করে না, তার ‘ইলম (মানুষের) অন্তর থেকে চলে যায়, ঠিক যেভাবে বৃষ্টি ঝরে পড়ে যায় মসৃণ পাথর থেকে।” (শুয়াবুল ইমান, হাদিস নংঃ ১৭০০)

আবার অনেকসময় নিজ থেকেও কুরআন-হাদিসের কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মানুষের অন্তরে পৌঁছাতে পারিনি। পারব কীভাবে? কথাগুলো যে আগে নিজের অন্তরেই প্রবেশ করেনি। সালাফরা বলতেন,

إِذَا خَرَجَ الْكَلَامُ مِنَ الْقَلْبِ وَقَعَ فِي الْقَلْبِ، وَإِذَا خَرَجَ مِنَ اللِّسَانِ لَمْ يُجَاوِزِ الْآذَانَ

“মুখ থেকে আসা কথা কান পর্যন্ত পৌঁছায়। কিন্তু যে কথা অন্তর থেকে আসে, তা অন্তরেই পৌঁছায়।” (জামি’ই বায়ানুল ‘উলুম ওয়া ফাদ্বলিহ, ১/৭০২)

আবার, কখনো কখনো শুধু অন্তর থেকে চাওয়াই যথেষ্ট না। এর সাথে প্রয়োজন সে চাওয়া অর্জনের জন্য ত্যাগের মানসিকতা থাকা। কষ্ট সহ্য করার দৃঢ়তা থাকা। দ্বীনের বিষয়ে সিরিয়াস হবার পর আমরা প্রায় সবাই অনেক কিছু মন থেকে পাবার বাসনা রেখেছি। যেমনঃ কুরআন হিফয করার, ভালোমত আরবি শেখার, ‘ইলমের জন্য বেসিক বইগুলো পড়ার। কিন্তু বললে ভুল হবে না একশো জনের নিরানব্বই জনই লক্ষ্যের সিকিভাগও অর্জন করতে পারিনি। কেন?

ইচ্ছে ছিল কিন্তু ইচ্ছে অর্জনের জন্য ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা ছিল না। উস্তাদ আসিফ মেহের আলী তার ‘মদিনা এরাবিক বুক’-এর ক্লাসগুলোতে একবার বলেছিলেন, দ্বীনি ‘ইলম অর্জন সিরিয়াসভাবে অর্জন করতে চাইলে আমাদের সবাইকে ‘পরওয়ানা’- হতে হবে। যারা হিন্দি-উর্দু সাহিত্য পড়েছেন, তারা জানেন সেখানে কীভাবে পরওয়ানার স্তুতি গাওয়া হয়েছে। পরওয়ানা (উর্দু پروانه, হিন্দি परवाना) হচ্ছে এক ধরনের পোকা যারা আগুনের চারপাশে ঘুরে আর একসময় আগুনে আত্মহুতি দেয়। তাদের পুরো জীবনটা কাটে আলোর নেশায়, আর শেষ হয় আলোর মাঝেই। এখানে আলো বলতে কখনো সত্যকে বোঝানো হয়, কখনো বা জ্ঞানকে বোঝানো হয়।


উস্তাদ আসিফ মেহের আলী কবি ইকবালের একটি কবিতা উদ্ধৃত করতেন। আমাদের দেশে যেমন অনেক স্কুলে জাতীয় সঙ্গীতের পর কবি নজরুলের ‘চল চল চল’- আবৃত্তি করানো হয়, পাকিস্তানে তেমনি শিশুদের কবি ইকবালের ‘বাচ্চে কি দু’আ’- নামে একটি কবিতা সুর করে গাওয়ানো হয়। যার মধ্যে দু’টি লাইন এমন-

زندگی ہو مری پروانے کی صورت یا رب
علم کی شمع سے ہو مجھ کو محبت یا رب
“আমার জীবন যেন হয় পরওয়ানার মতো, হে রব,
ইলমের প্রদীপের সাথে যেন হয় মহব্বত, হে রব!”

হিন্দিভাষীদের মাঝে অন্য একটি কবিতার জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করেছি-

मुझे आसमानो में उड़ने का शोक हैं,
परिंदो के बीच खेलने का शोक हैं,
अगर मुझे जानना हो तो जरा दूर से ही जानना
मैं परवाना हूँ, मुझे आग में जलने का शोक हैं!
“আমার ইচ্ছে আছে আকাশে উড়ে বেড়াবার,
পাখিদের মাঝে খেলা করবার।
যদি আমাকে জানতেই হয়, একটু দূর থেকেই দেখবে-
আমি যে পরওয়ানা, ইচ্ছে আছে আগুনের সাথে খেলতে।”

অনেকসময় আমরা বুঝতে পারি দ্বীনের জন্য কোনটা করা উচিত। দুনিয়ার জন্য পারি না। ক্যারিয়ারের জন্য, অর্থের জন্য, ‘লোকে কী বলবে’- এটা ভেবে করা হয়ে ওঠে না। নিজেকে দ্বীনি পরিচয় দিয়েও দুনিয়ার সিরিয়াসনেসের সিকিভাগও আখিরাতের জন্য দেয়া হয় না।

আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মুখের সাথে অন্তরের সংযোগ করুন। সেই সাথে আমাদেরকে দান করুন লম্বা সময় তাঁর দ্বীনের জন্য লেগে থাকার মানসিকতা। মানুষ হা-হুতোষ করবে, ক্যারিয়ার ধ্বংসের ভয় দেখাবে। কিন্তু একজন ইমানদার কখনো ভয় পায় না।

সে তো পরওয়ানার মতো। সে দুনিয়ার আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে চায়।