একবার আমি আড়াই বছরের এক বাচ্চার চিকিৎসা করি। এটা ছিল এক মঙ্গলবার এবং বুধবারে বাচ্চাটির স্বাস্থ্য বেশ ভালই ছিল। বৃহস্পতিবার সকাল ১১.১৫ এর দিকে ... আমি কখনই ঐ সময়টার কথা ভুলতে পারবো না তখনকার প্রচন্ড আলোড়নের কারনে। এক নার্স আমাকে এসে জানালো যে একটি বাচ্চার হৃদযন্ত্র এবং শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি বাচ্চাটির কাছে গেলাম এবং প্রায় ৪৫ মিনিটের মত কার্ডিয়াক মাসাজ করলাম। এই পুরো সময়টা জুড়ে হৃদপিন্ড কাজ করে নি।

তারপর, আল্লাহর ইচ্ছায় পুনরায় হৃদপিন্ড তার স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ শুরু করলো এবং আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। আমি শিশুটির পরিবারকে তার অবস্থা সম্পর্কে জানাতে গেলাম। আপনারা হয়ত জানেন যে, রোগীর পরিবারকে তার খারাপ অবস্থা সম্পর্কে জানানোর বিষয়টা কতটা বিব্রতকর। একজন চিকিৎসকের জন্য এটা সবচাইতে কষ্টসাধ্য কাজগুলোর একটি যদিও এর দরকার আছে। তাই আমি বাচ্চার বাবাকে খুজতে লাগলাম কিন্তু পাচ্ছিলাম না। তখন আমি বাচ্চাটির মাকে দেখতে পেলাম। আমি তাকে জানালাম যে রোগীর গলায় প্রচুর রক্তক্ষরন হৃদপিন্ডের এই হঠাৎ অচলাবস্থার কারন; আমরা রক্তক্ষরনের সঠিক কারন বলতে পারছি না এবং আশংকা করছি তার মস্তিষ্ক মরে গেছে। ... আপনাদের কি মনে হয়? এ কথা শুনে বাচ্চাটির মায়ের প্রতিক্রিয়া কি ছিল? সে কি কান্না শুরু করেছিল? আমাকে দোষারোপ করছিলো? না। এমন কিছুই হয় নি। বরং তিনি বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ! (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহতা’আলার)” এবং চলে গেলেন।

প্রায় ১০ দিন পর, বাচ্চাটি নড়তে শুরু করলো। আমরা আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলাম এবং খুব আনন্দিত হলাম এ কারনে যে তার মস্তিষ্কের অবস্থা বেশ ভালই ছিল। ১২ দিন পর বাচ্চাটির হৃদযন্ত্র আবার বন্ধ হয়ে গেল সেই একই জায়গায় রক্তক্ষরনের ফলে। আমরা ৪৫ মিনিটের মত আরেকটা কার্ডিয়াক মাসাজ করলাম কিন্তু এবারে আর কাজ হল না, হৃদপিন্ড চালু হলো না। আমি বাচ্চার মাকে জানালাম যে, আর কোন আশা নেই। তখন সে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ! হে আল্লাহ, যদি ওর সুস্থতায় কোন মঙ্গল থেকে থাকে তবে ওকে সুস্থ করে দাও, হে আমার প্রভু!”

আল্লাহর অশেষ রহমতে একটু পরে বাচ্চার হৃদপিন্ড আবার সচল হলো। একজন অভিজ্ঞ ট্রাকিয়া বিশেষজ্ঞ রক্তক্ষরন বন্ধ করতে সক্ষম হওয়ার পর হৃদপিন্ডের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা পর্যন্ত এই ছেলেটি আরো ৬ বার এরকম হৃদপিন্ডের অচলাবস্থার স্বীকার হয়েছিল। ইতোমধ্যে সাড়ে তিন মাসের মত হয়ে গেছে এবং বাচ্চাটি সুস্থ হচ্ছিল বটে কিন্তু চলাফেরা করতে পারছিল না। তারপর যখনই সে একটু করে চলতে আরম্ভ করলো, এর চাইতেও অদ্ভুত এবং বিরাট আরেক মস্তিষ্কের সমস্যা দেখা দিল তার, যা আমি কখনও এর আগে দেখি নি। আমি তার মাকে এই মারাত্নক ঝামেলার কথা জানালাম এবং তিনি কেবল বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ!” এবং চলে গেলেন।

আমরা অনতিবিলম্বে বাচ্চাটিকে অন্য একটি সার্জিকাল ইউনিটের হাতে তুলে দিলাম যারা মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে কাজ করে এবং তারা বাচ্চাটির চিকিৎসা চালিয়ে যেতে লাগলো। তিন সপ্তাহ পর বাচ্চাটি মস্তিষ্কের জটিলতা কাটিয়ে উঠলেও নড়াচড়া করতে পারছিল না। আরো দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেল এবং এখন অদ্ভুত এক রক্তদুষনের স্বীকার হলো এবং শরীরের তাপমাত্রা প্রায় ৪১.২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে (১০৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট) উঠলো। আমি পুনরায় বাচ্চার মাকে এই ভীষন নাজুক পরিস্থিতির বিষয়ে অবহিত করলাম এবং তিনি বরাবরে মতনই ধৈর্য্য ও দৃঢতার সাথে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ! হে আল্লাহ, যদি ওর সুস্থতায় কোন মঙ্গল থেকে থাকে, তবে ওকে সুস্থ করে দাও।”

৫ নং বেডের বাচ্চার পাশে বসে থাকা এই মায়ের সাথে কথা শেষে আমি গেলাম ৬ নং বেডের আরেক শিশুর কাছে। এই শিশুটির মা কাঁদছিল এবং চিৎকার করছিল, “ডাক্তার! ডাক্তার! কিছু একটা করেন। আমার ছেলের শরীরের তাপমাত্রা ৩৭.৬ ডিগ্রী সেঃ (৯৯.৬৮ ডিগ্রী ফাঃ) সে মারা যাচ্ছে! সে মারা যাচ্ছে!” আমি অবাক হয়ে বললাম, “ঐ ৫ নম্বর বেডের মায়ের দিকে তাকান। তার সন্তানের ৪১ ডিগ্রী সেঃ (১০৬ ডিগ্রী ফাঃ) এর ওপরে জ্বর। এরপরেও উনি শান্ত রয়েছেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করছেন।” সে বললো, “ঐ মহিলার কোন বোধশক্তি নেই এবং কি হচ্ছে সে বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই।” ঠিক এই মুহুর্তে আমার মনে পড়ে গেল রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর একটা হাদিসের কথা ... “আগন্তুকদের জন্য সুসংবাদ!” কেবল দুইটি শব্দ ... কিন্তু এই শব্দ দুটো নিঃসন্দেহে একটা পুরো জাতিকে আলোড়িত করবার ক্ষমতা রাখে। আমার দীর্ঘ ২৩ বছরের চিকিৎসা জগতের জীবনে এই বোনটির মত ধৈর্য্যশীল আর কাউকে দেখি নি।

আমরা বাচ্চাটির যত্ন চালিয়ে যেতে লাগলাম এবং ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে ছয় মাস কেটে গেছে এবং বাচ্চাটি অবশেষে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বেরিয়েছে রিকভারি ইউনিট থেকে। হাটতে পারে না, দেখতে পায় না, শুনতে পাচ্ছে না, নড়তে পারছে না, হাসছে না ... এবং এমন নগ্ন বুক নিয়ে বেরিয়ে এসেছে যেন হৃদপিন্ডের স্পন্দনগুলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। শিশুটির মা নিয়মিত পোশাক পরিবর্তন করানো ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং ধৈর্য্যশীল থাকলেন আর ছিলেন আশাবাদী। আপনারা কি জানেন পরবর্তীতে এর কি হয়েছিল? আপনাদেরকে সে বিষয়ে বলবার আগে বলুন, এই শিশুটির সম্পর্কে আপনারা কি ধারনা করেন যে কিনা এত এত কঠিন রোগ-শোক, বিপদের মুখোমুখি হয়ে এসেছে? এবং এই মৃত্যুপথযাত্রী শিশুর সহনশীল মায়ের কাছে আপনারা কি আশা করেন যার কেবল মাত্রা আল্লাহতা’আলার কাছে দু’আ আর সাহা্য্যের প্রত্যাশা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না? আপনারা জানেন আড়াই বছর পর কি হয়েছিল? এই শিশুটি সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করে ছিল আল্লাহতা’আলার অশেষ রহমত এবং এই পরহেযগার মায়ের পুরষ্কার হিসেবে। সে এখন তার মায়ের সাথে দৌড়ে বেড়ায় যেন কোন দিনই তার কিছুই হয় নি এবং সে সুঠাম স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছে যেমনটি আগেও ছিল।

গল্প এখানেই শেষ নয়। এটা সে জিনিস নয় যা আমাকে আলোড়িত করেছিল এবং আমার চোখে পানি নিয়ে এসেছিল। যে জিনিসটি আমায় কাদিয়েছিল তা হচ্ছে,

বাচ্চাটি হাসপাতাল থেকে বের হবার প্রায় বছর দেড়েক পর অপারেশন ইউনিটের একজন আমাকে জানালো যে একলোক, তার স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি তাদের পরিচয় জানতে চাইলে সে বলল সে চেনে না। তো আমি তাদের দেখার জন্য গেলাম এবং দেখলাম এরা সেই ছেলেটির মা-বাবা আমি যার চিকিৎসা করেছিলাম। ছেলেটির তখন পাঁচ বছর এবং একটি ফুটফুটে ফুলের মতন স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছে এরই মাঝে যেন তার কখনই কিছু হয় নি। তাদের কোলে চার মাস বয়সী আরেকটি ছোট বাচ্চা ছিল সেদিন। আমি তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালাম এবং কৌতুক করে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম এই কোলের বাচ্চাটি কি তাদের ১৩ তম নাকি ১৪ তম সন্তান। তিনি আমার দিকে চমৎকার এক হাসির সাথে তাকালেন যেন আমার জন্য তার করুণা হচ্ছে। তিনি বললেন, “সদ্য ভূমিষ্ট এই শিশুটি আমাদের দ্বিতীয় সন্তান, আর আপনি যার চিকিৎসা করেছিলেন সে ছিল আমাদের প্রথম সন্তান যাকে আমরা পেয়েছিলাম ১৭ বছরের অনুর্বরতার পর। এই শিশুটিকে পাবার পর, সে এমন সব বিপদের সম্মুখীন হয়েছে যা আপনি নিজেই দেখেছেন।“

একথা শুনে, আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না এবং এরই মাঝে আমার চোখ দুটো কান্নায় ভিজে উঠেছে। আমি তারপর হালকাভাবে লোকটির হাত ধরে টেনে আমার রুমে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তার স্ত্রীর সম্পর্কে। “কে আপনার এই স্ত্রী যিনি ১৭ বছরের বন্ধাত্বের পর পাওয়া পুত্রের এত মারাত্নক সব বিপর্যয়ের মূহুর্তগুলোতেও প্রচন্ড ধৈর্য্যের সাথে মোকাবিলা করেছেন? তার অন্তর বন্ধা হতে পারে না। অবশ্যই সেটা বিশাল ইমানের দ্বারা উর্বর।” আপনারা জানেন তিনি কি উত্তর করেছিলেন? ভালো করে শুনে রাখুন হে আমার প্রানপ্রিয় ভাই ও বোনেরা। তিনি বলেছিলেন, “আমার সাথে এই মহিলার বিয়ে হয়েছিল ১৯ বছর ধরে এবং এই দীর্ঘ সময়ে আমি কখনও তাকে কোন সংগত কারন ছাড়া তাহাজ্জুদ সালাত ছেড়ে দিতে দেখি নি। আমি দেখিনি তাকে কখনও পরনিন্দা করতে, অযথা গল্প-গুজবে মত্ত হতে কিংবা মিথ্যা বলতে। যখনই আমি বাড়ি থেকে বের হয় বা ফিরে আসি সে নিজে দরজা খুলে দেয়, আমার জন্য দু’আ কর এবং আমাকে আপ্যায়ন করে। এবং সে যা কিছু করে সে সর্বোচ্চ ভালবাসা, যত্ন, সৌজন্য এবং মমত্বের পরিচয় রাখে।” লোকটি শেষ করলো এভাবে, “নিশ্চয়ই, ডাক্তার সাহেব, সে যে সমস্ত আদর্শ আচরন ও মমত্ববোধের সাথে আমার সাথে আচরন করে, আমি এমনকি তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতেও লজ্জাবোধ করি।” তাই আমি তাকে বললাম, “সত্যিই। ঠিক এমনটিই সে আপনার কাছ থেকে প্রাপ্য।”

এখানেই শেষ।


আল্লাহ বলেন,

“এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।।“ (সুরা আল বাকারাহ ১৫৫-১৫৬)