সূরা হুমাযাহ এর প্রথম লাইন। এর মধ্যে বেশ একটা ছন্দ আছে, আমার খুব ভাল লাগত, তাই কবিতার লাইনের মত আওড়াতাম – মানে সম্পর্কে কোন ধারণাই না রেখে। সেদিন একজনের মুখে শুনলাম হুমাযাহ আর লুমাযাহ এই শব্দ দুটি দিয়ে নাকি ২৩ ধরণের আচার আচরণকে নির্দেশ করা হয়েছে। তাফসিরটা শুনলাম, ভয় খেলাম, যথারীতি আরো একবার মানুষের কাজকর্মের ব্যাপারে আল্লাহর জ্ঞান দেখে মুগ্ধ হলাম।

প্রেক্ষাপট:

সূরা হুমাযাহ হচ্ছে কুরআনের শেষ পারার প্রায় শেষের দিকের একটা সূরা। ধারাবাহিকতার দিক থেকে এই সূরার বেশ একটা তাৎপর্য আছে। আল্লাহ জানেন কুরআনের শেষ পারার মিনি সূরাগুলিই বেশি মানুষ শিখবে আর পড়বে, তাই অল্প ছোট্ট ছোট্ট লাইনে বিপুল মেসেজ দেয়া আছে। বলা হয় তিন লাইন বিশিষ্ট সূরা আসর নাকি একজন মুসলিমের জীবনধারণের পক্ষে যথেষ্ট। আর শেষ পারার অর্থ পড়লে দেখবেন নিয়ম কানুনের চেয়ে এখানে স্পিরিচুয়ালিটির উপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে। মানুষের কিছু অপছন্দনীয় স্বভাবের সমালোচনা করা হয়েছে এবং পরকালে তার শাস্তির বিবরণ দেয়া হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সূরা হচ্ছে হুমাযাহ; এখানে দোজখের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপটা তুলে ধরা হয়েছে, পুরো কুরআনের আর কোথাও শাস্তিকে এত কঠিন করে বলা হয়নি।

জানেন, সূরা হুমাযাহর বিষয়বস্তু কী? যারা বলেন কুরআন কল্পিত কিছু জায়গার বর্ণনা আর পুরানো গল্প রূপকথার সংকলন তারা একটু ধৈর্য ধরে পড়ে দেখেন।

পুরনো বান্ধবীর সাথে ফোনে কথা বলছি, অন্যরা কে কেমন আছে খোঁজ নিচ্ছি। চট করে ওপাশ থেকে বলে ফেলল, ‘জানিস সিমির বিয়ে হয়েছে, জামাইটা দেখতে একদম সুন্দর না।’ অথবা ‘রিদিমা কীইইই মোটা হইসে দেখসিই্ইস……’ অথবা ‘আমার শাশুড়ির কাজকাম দেখলে মেজাজটা এমন খারাপ হয়..’. ছেলেদের বেলায় ‘শাফিন কি এখনো ওই ১২,০০০ টাকার চাকরিই করে?’ ‘দুইদিন পরপর জিএফ চেঞ্জ করে কেন?’ ‘পোলাটার ভাবস মারা আর শেষ হইলনা।’

আমার মনে হয় সবাই বুঝে গেছেন আমি কী বলতে চাচ্ছি। জ্বী। সূরা হুমাযাহ আপনাকে আমাকে নিয়েই কথা বলছে। এখন দু’একটা কমন রেসপন্স এর উত্তর দেই।

‘বাহ! সে করতে পারবে আর আমি বলতে পারবনা?’

– জ্বী না। সে কিছু করলেই পাড়ায় পাড়ায় বলে বেড়ানোর অধিকার আপনাকে কেউ দেয়নি।

‘আহা! পাড়ায় পাড়ায় বলব কেন? আমরা আমরাই ত, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা যাবেনা?’

– যাবে! যাবে না কেন? আপনি চাইলে কে নিষেধ করেছে? মদ ও ্ খাওয়া যাবে, পরকীয়াও করা যাবে, মানুষ খুন ও করা যাবে। খালি শাস্তির চিন্তাটা মাথায় না থাকলেই হল।

‘কী বল! এইগুলি ত অবভিয়াস, সবাই জানে, জানা জিনিস আমি বললেই কী আর না বললেই কী?’

– তাই? না বললে কিছু না? তাহলে কেন ভাই শুধু শুধু মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগসেন? আপনি দাবি করতে পারেন এই ছোট্ট কথাগুলি যে গীবত এইটা আপনার জানা ছিলনা। জানা আর না জানার মধ্যে পার্থক্য ত কেবল একটা স্টেটমেন্ট, তাই না? তা্হলে এখন বলি, জেনে নিন!

‘তোমরা কি জান গীবত কী? গীবত হচ্ছে কারো অনুপস্থিতিতে এমন কিছু বলা যা সাক্ষাতে বলা হলে সে অখুশি হত।’ ইয়া রাসুলুল্লাহ, যদি তা সত্য হয়, তবুও? ‘যদি সত্য হয় তাহলে ত তুমি তার গীবত করলে, আর মিথ্যা হলে তুমি তার নামে অপবাদ দিলে।’ (বুখারী)

হুমাযাহ আর লুমাযাহ বলতে যদি খালি গীবতই বোঝাত, বেঁচে যেতাম। পড়তে থাকুন।

বাংলাদেশের আড্ডার প্রিয় উপকরণ হচ্ছে চা আর বিটলামী। হো হো হাসি চালায় যাওয়ার জন্য একেকজনকে টার্গেট করা হয়, তার মাথার টাক, কথার অ্যাক্সেন্ট, পেটের মেদ থেকে শুরু করে বারো-চোদ্দ বছর আগেকার অতীব লজ্জাস্কর ঘটনা পর্যন্ত তুলে হাসাহাসি করা হয়। বাই চান্স, কোন ভাবে, কোন কথায়, কারো কোন ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনে যদি সে কষ্ট পেয়ে যায়, তাহলে বিদ্রুপকারীর জন্য তিন লেভেলে অভিশাপ আছে।

১. তার অভিশাপ, যে কষ্ট পেল

২. সে যদি অভিশাপ নাও দেয়, তার কষ্ট পাওয়াটা নিজেই একটা অভিশাপ

৩. সেই মানুষের হয়ে আল্লাহ বিদ্রুপকারীকে অভিশাপ দেন।

আল্লাহই যদি অভিশাপ দেয়, কাটাবো কার কাছে গিয়ে? ভয়াবহতা বা সিরিয়াসনেস এর দিক থেকে প্রথমে হচ্ছে নির্যাতিত ব্যক্তির দু’আ (যা আল্লাহ বাবা মায়ের দু’আর মতই গুরূত্ব দিয়ে গ্রহণ করেন), তার উপরে ফেরেশতাদের দু’আ, সবচেয়ে উপরে আল্লাহর দু’আ বা কমিটমেন্ট। হুমায বা লুমায এর শিকার সেই ব্যক্তির অপমানকে আল্লাহ নিজে অভিশপ্ত করার প্রয়োজন মনে করেছেন।

তাহলে কি ফান করা বন্ধ করে দিতে হবে? না! তবে পচানো বন্ধ করে দিতে হবে, অথবা পচানোর এমন আর্ট আবিষ্কার করতে হবে যে পচানো হবে, কিন্তু কেউ পচবে না।

মানুষের আরেকটা চমৎকার স্টাইল হচ্ছে খোঁচা দিয়ে চরম অপমানজনক একটা কথা বলা, কিন্তু এমনভাবে, যে রিঅ্যাক্ট করলে উল্টো হাসির পাত্র হতে হবে। বা যদি বুকে সাহস নিয়ে রিঅ্যাক্ট করেই ফেলা হয়, উড়ায় দিয়ে বলবে, ‘আমি ত মজা করতেসিলাম, ফান ও বুঝিস না?’ এই আচরণটা ‘লুমায’ শব্দের আন্ডারে পড়ে। যারা এই অসাধারণ শিল্পটাকে আয়ত্ত করেছেন, তাদেরকে আবারো মনে করিয়ে দেই, ‘লুমায’ এর মধ্যে শুধু দু’জন ব্যক্তি জড়িত না, আল্লাহও জড়িত। আল্লাহ খুব ভালভাবেই জানেন কোনটা নির্দোষ ফান আর কোনটা ‘লুমায’।

গালি দেয়া ‘লুমায’, এমনকি যদি মিন করে নাও বলা হয়। ইউনিভার্সিটিতে রাশি রাশি গালি শিখেছি, এখন আর কাজে লাগাতে পারিনা, আফসোস্‌।

কেউ একজন একটা কথা খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, সবাই মিলে সেটা হেসে উড়ায় দিল বা হালকা করে দিল, মানুষটা একটু দমে গেল, এটাও হুমায বা লুমায। কিছু কিছু মানুষের স্বভাবই আছে, সব কিছু নিয়ে হাসিঠাট্টা করবে, সবসময়। আবার কিছু মানুষ বলার সময় খুব মন দিয়ে শুনবে, ভালভাবে রেসপন্ড ও করবে। আড়ালে অন্যদের সাথে হাসির ফোয়ারা তুলবে। আড়ালে মানুষটার প্রতি যে অন্যায় করা হল তার প্রতিশোধ নিতে আল্লাহ নিজে তাদের জন্য আগুনের অভিশাপ দিয়েছেন।
কথা বলার সময় একটা তাচ্ছিল্যের ভাব দেখানো হুমায বা লুমায। চোখ কুচকায় বিরক্তি সহকারে তাকানো, বা এমন ভাব করা যে কী ফালতু কথা বলছে – এটাও হুমায বা লুমায।

দেশের বাইরে এসে যেটা প্রতিনিয়ত ফেস করতে হচ্ছে তা হচ্ছে পর্দা করা বা একটু ইসলামী জীবনাচরণ অভ্যাস করার কারণে মানুষের উপহাসের পাত্র হওয়া। দেশেও একই অবস্থা হত কোন সন্দেহ নেই। বেশির ভাগ মানুষেরই যেটা হয়, এইসব উপহাসগুলি তারা সহ্য করে খুব কাছের আত্মীয়স্বজন থেকে। অন্যদের দোষ দিব কী, আমিই ত কিছুদিন আগ পর্যন্ত তাই করতাম। ধর্ম পালন আর পলিটিক্স – এই দুটো বিষয় নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করাটাকে বোধহয় মানুষ তাদের জন্মগত অধিকার ধরে নিয়েছে। কাউকে ‘হুজুর’, ‘মোল্লা’, ‘দাড়িয়াল ভন্ড’ বা ‘নিনজা’ বলার আগে এই জিনিসটা চিন্তা করতে হবে, যে পোশাক বা আউটলুক নিয়ে তাকে ফাইজলামি করা হচ্ছে সেটা রাসুলুল্লাহ (স) এর পোশাক, ইসা (আ) এর মায়ের পোশাক। আল্লাহর প্রিয় এই মানুষগুলির অনুকরণীয় আচরণকে হাসি ঠাট্টা করে পার পেয়ে যাওয়ার খুব একটা অবকাশ নেই।

আরো অনেকগুলি ছোট ছোট আচরণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমার মনে হয় মানুষের সচেতনতা তৈরি করার জন্য এ ক’টাই যথেষ্ট।


Meaning of Sura Humazah https://quran.com/104