আমি মানুষটা এমন, দুই পা এগিয়ে গেলে, দেড় পা পিছিয়ে যাই। নেট অগ্রগতি হয় আধা পা। তা হতাশ হতে যেয়ে ভাবি, আহা না এগুলে তো ওই আদ্ধেকও উন্নতি হতো না।

আমার ছোট্ট জীবনে যা কিছু পেয়েছি, হিসেব করে দেখি আমি যা deserve করি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাকে তার চেয়ে অধিক নিয়ামাত দেন। হয়তো তাঁর বোকা-অলস বান্দাহটাকে সুযোগের পর সুযোগ দিয়ে যাচ্ছেন, তবুও যদি কৃতজ্ঞ হয়!

নিভৃতে বসে বসে বিনয়ের ছদ্মাবরণে কয়েকটি অহংকারের দানা হেমবর্ণ বলয় তৈরি করে, অনবধানতার চাদর সরিয়ে দেখার অবকাশ হয় না, এত-ই ব্যস্ত আমি। তারপর একদিন সচকিত হই, শিউরে উঠি, এ কার দাসত্ব করছি আমি? সর্বশক্তিমানের না স্বীয় সত্তার? কার কাছ থেকে প্রতিদান চাই আমি? লোকের প্রশংসার কাছে এত দুর্বল কখন হলো আমার হৃদয়, টেরই পাই নি।

মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানুষটির সতর্কবাণী মনে পড়ে, “যার হৃদয়ে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না” [১]। বাষ্প জমে ওঠে দুচোখের কোণে। ব্যাকুল হয়ে বলে ফেলি প্রিয়তমের দরবারে, দেখো না কতো দুর্বল আমি! তুমি মাফ না করলে আমি যে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হবো। হৃদয়ের কলুষতাগুলো মোমের মত গলে পড়ে অশ্রু হয়ে, কী অদ্ভুত প্রশান্তি আল ওয়াদুদের কাছে প্রত্যাবর্তনে!

তারপর সময় বয়ে যায়। আমি একদিন হঠাৎ পুনরায় বিস্মৃত হই। ভুলে ভুলে যাওয়া, ফিরে ফিরে আসার এই চক্র চলতে থাকে। আমি জানি না আপনাদের কয়জনের সাথে মিলবে ওপরের কথাগুলো। কিন্তু আমি আমার একান্ত অনুভূতিটুকুই বললাম।

একদিন আমাদের গ্রহটির বার্ষিক-গতির পরিক্রমায় একটি পূণ্যময় সময় চলে আসে। এ তো সেই মাস যে মাসের একটি রাতে মানব জাতির চলার পথের দিশারী ক্বুরআন কারীম নাযিল করা হয়েছে। এ মাসে মুসলিমদের জন্য আল্লাহর নির্দেশ, “তোমাদের পূর্ববর্তীদের মতই তোমাদের উপরও রোযা ফরজ করা হয়েছে, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো” [২]।

রামাদানের কিছুদিন আগ থেকে মনের ভেতর কেমন দখিনা হাওয়া বয়ে যায়। এই সময়টুকুর মধ্যে যে জীবনের সবচেয়ে precious মুহূর্তগুলো লুকিয়ে থাকে। একটি মহামূল্যবান রাত্রি তার সৌম্য মর্যাদা নিয়ে সুপ্ত থাকে। কোন বুদ্ধিমান মুমিনেরই সঙ্গত হবে না, তাকে হেলায় হারিয়ে ফেলা by any chance। এই সেই রাত্রি যার মহিমা নিয়ে ক্বুরআনে পুরো একটি সূরা নাযিল করা হয়েছে,

“আমি একে (কুর’আনকে) নাযিল করেছি ক্বদরের রাতে।
আপনি কি জানেন কদরের রাত কী?
কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও ভালো।
ফেরেশতাগণ ও রূহ এই রাতে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে।
এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময়, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।” [৩]।

এই সেই রাত যার সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতে ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান লাভের আশায় ইবাদাতের জন্য দাঁড়ালো তার অতীতের সমস্ত গোনাহ মাফ করা হয়েছে” [৪]।

আমার মতো দুর্বল ঈমানদারদের জন্য এ তো এক মহা সুযোগ! নির্ঝরের মত বয়ে যাওয়া অল্প কিছু সময়, অথচ কী অসীম তার বারাকাহ! সেই রাতটি অন্বেষণ করতে বলা হয়েছে রামাদানের শেষ দশদিনে [৫], অন্য একটি রেওয়ায়াতে আছে শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোয়[৬], আবু হুরাইরার (রাঃ) বর্ণনামতে ও রাসুলে (সাঃ) সূত্রে, সাতাশ বা উনত্রিশের রাত [৭], অন্য আরেকটি রেওয়ায়াতে আছে রামাদানের শেষ রাত [৮]।

এই যে এত বর্ণনা!! বিভ্রান্ত লাগছে? মুফাসসিরগণ ধারণা করেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছাতেই রাত্রিটির ঠিকানা গোপন রাখা হয়েছে। তবে সে রাতের বাড়ী যে শেষ দশদিনের যে কোন এক রাতে তা নিশ্চিত। যৌক্তিকতা খুঁজছেন? আচ্ছা, সেই মহিমান্বিত রাত্রির বারাকাহর জন্য আপনার আকাঙ্ক্ষা কতখানি, তা আপনার অন্বেষণেই প্রমাণিত হবে, তাই না? রাহমান চান যে আপনি- আমি- আমরা সেই রাত্রি খোঁজে দশটি যামিনী কাটাই, তাতে সাওয়াবের পাল্লাটা তো আমাদেরই বাড়বে।

চলুন, আমরা ক্বদরের জন্য ছোট্ট একটা plan করে ফেলি আর আল্লাহর কাছে অনেক অনেক দোয়া করি যেন তা বাস্তবায়ন করতে পারি, আপনারা দেখুন তো কাজে লাগে কী না।

ক) শেষ দশদিনের কোন রাত (অন্তত পক্ষে বেজোড় তারিখের রাতগুলো) হাতছাড়া করবো না ইনশা আল্লাহ, হতে পারে আমি যেই রাতে কেবল অলস ঘুমিয়ে কাটালাম, সেই রাতে হয়তো অতিবাহিত হয়ে গেলো মহিমান্বিত ক্বদর। এমনও তো হতে পারে এটাই আমার জীবনের শেষ রামাদান। ক্বুরআন তিলাওয়াত, হাদীস ও সিরাত অধ্যয়ন ও নাফলিয়াত আদায়ের মাধ্যমে কাটবে আমার প্রহর। (যাদের পক্ষে ইতিকাফ করা সম্ভব তারা অবশ্যই ইতিকাফ করবেন।)

খ) আল্লাহর পছন্দনীয় কুরআন ও সহীহ হাদিস থেকে নেয়া দোয়াগুলো সংগ্রহ করবো, অর্থসহ মুখস্ত করবো কিছু, যেমনঃ রাসুলুল্লাহ শেখানো, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা-ফু আন্নি- অর্থঃ হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন সুতরাং আমাকে ক্ষমা করুন।

গ) দিনের বেলা কিছু সময় ঘুমিয়ে নেবো, সাহরী ও ইফতারে স্বাস্থ্যকর খাবার খাবো যাতে আমি সুস্থ থাকতে পারি।

ঘ) পরিবারের সবাই মিলে ক্বুরআন পড়বো, আলোচনা করবো। কারণ আমরা সবাই একসাথে জান্নাতে থাকতে চাই!

ঙ) এই রাতে ফেসবুক, টুইটার, মোবাইল ফোন কিংবা অহেতুক গল্পে সময় কাটাবো না। বরং সারাটাক্ষণ কানেক্টেড থাকবো আল্লাহর সাথে।

চ) নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, বন্ধুদের জন্য, আমার প্রিয় স্বদেশবাসীর জন্য, মুসলিমদের জন্য, অমুসলিমদের জন্য সব্বার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করবো। পৃথিবীব্যাপী যে ঘোর অমানিশা নেমে আসছে, তা হতে আল্লাহ কাছে আশ্রয় চাইবো। সুদূর তিউনিশিয়া, মিসর, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিনের আমাদের যে ভাই-বোনেরা নির্যাতিত হচ্ছেন, তাদের জন্য দোয়া করবো।

ছ) তিনি করুণা করে আমাদের যে সুযোগটি দিয়েছেন তার জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বারেবারে তাওবাহ করবো, প্রতিজ্ঞা করবো, সাহায্য চাইবো নিজ নিজ কর্মনীতি সংশোধন করে নেয়ার ব্যাপারে।

প্রখ্যাত লেখক খুররম যাহ মুরাদের একটি উপমা আমার ভারী ভালো লাগে,

“যখন বৃষ্টি ঝরে, নদী-নালা, খাল-বিল, সাগর কিংবা সমতল, নরম মাটি কী শক্ত পাথর সবার ওপরেই তা সমানভাবে পড়ে। কিন্তু একটি বড় প্রশস্ত পুকুরে যে পরিমাণ পানি ধারণ করা সম্ভব একটি ছোট কলসীর পক্ষে তা ধারণ করা সম্ভব না। মরুভূমি বা অনুর্বর পাথরে বারিধারা পড়ে কেবল গড়িয়েই চলে যায়, ভূমি তা থেকে উপকৃত হতে পারে না। রামাদানুল মোবারাকের ওই মওজুদ রাহমাহ থেকে আপনি কতটুকু নিজের করে নিতে পারবেন? উর্বর ভূমির মতো আপনার মন নরম করুন হৃদয়ে ঈমানের বীজ রোপন করুন, ইনশা আল্লাহ বীজ অঙ্কুরিত হবে, একদিন তা পরিপূর্ণ বৃক্ষ হয়ে ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে উঠবে। পক্ষান্তরে আপনার মন যদি হয় পাথরের মত কঠিন আপনি যদি অসতর্ক কৃষকের মত শুয়ে-বসে-ঘুমিয়ে দিন কাটান তাহলে রোজা, তারাবীহ, ক্বদরের বারাকাহের সমস্ত বারিধারা বয়ে চলে যাবে, আপনার তহবিলে কিছুই আসবে না।” [৯]

আল্লাহ না করুন রহমের এই বরষাকাল চলে যাওয়ার পর আমাদের হৃদয়ের পূণ্যের আধারটি শুষ্ক- শূন্য রয়ে গেল। আমাদের ক্ষুৎপিপাসার কষ্ট কেবল কষ্টতেই পর্যবাসিত হলো, আমরা অভিশপ্তদের দলভূক্ত হলাম, আল্লাহ না করুন।

বরং যেন রামাদান ও ক্বদরের বারাকাতের সবটুকু আমরা আপন করে নিতে পারি, এ মাসের বারাকাহর মূল মর্মটি বুঝে সেই ক্বুরআনের আহবান শোনার-মানার জন্য আমাদের হৃদয় উন্মুক্ত রাখি সারাটি জীবন। আমীন।

তাহলে, কাটুক প্রহর অন্বেষণে!! ?


Appendix:

[১] রিয়াদুস সলিহীন ৬১৩, সহীহ মুসলিম।
[২] বাকারা ১৮৩ নং আয়াহ
[৩] সুরা আল কদর মাক্কী
[৪] বুখারী ও মুসলিম
[৫] আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণিত- বুখারী
[৬] আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত- বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী
[৭] আবু দাউদ
[৮] মুসনাদে আহমাদ
[৯] খোশ আমদেদ মাহে রমযান- খুররম যাহ মুরাদ