ধর্মের দিকে আমার নিঃসঙ্গ পথচলা শেষ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেয়ের সাথে পরিচয়ের পর। সে পড়াশুনায় আমার চেয়ে একবছর এগিয়ে—নাম ছিল সান্দ্রা। আমি অনেকদিন ধরেই তাকে আফ্রিকান ক্যারিবিয়ান সোসাইটিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলাম। ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল হানাহ। হানাহ একজন আরব মুসলিম, ওর বাবা মিশরি আর মা জানজিবারের। আমার মনে পড়ে, আফ্রিকান ক্যারিবিয়ান সোসাইটির বর্ণবাদী নীতির বিরুদ্ধে সে সবসময়ই সোচ্চার ছিল। এসব থেকে দূরে থাকতে চাই, তাই আমি এই দুজনকে তেমন ঘাঁটাইনি আর। কিন্তু একদিন ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সান্দ্রাকে দেখলাম কিছু বন্ধুর সাথে বসে আছে। সান্দ্রা ছাড়া তাদের সবাইকে একরকম দেখাচ্ছিল। সান্দ্রার চেহারার ভাবটা ছিল অন্যরকম, মাথার হিজাবটাও। ওটা ছিল বাঙালীদের হিজাবের মতো লেইস লাগানো, যদিও সে ওটাকে মাথা থেকে ঝুলতে না দিয়ে ভালোভাবেই পুরো মাথা ঢেকে রেখেছিল। ওকে অন্যরকম লাগছিল। কী করেছে সে? আমি নিজেকেই প্রশ্ন করলাম। আমার খুব আগ্রহ হলো ওর এই নতুন বেশ সম্পর্কে জানতে, তাই কাছে না গিয়ে পারলাম না। সেদিন তখনই সে আমাকে জানাল যে সে মুসলিমদের বিশ্বাসটাকে নিজস্ব করে নিয়েছে—গত সপ্তাহের ছুটির দিনটায় শাহাদাহ পাঠ করেছে-

আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুলুল্লাহ

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ্‌ ছাড়া ইবাদতের উপযোগী আর কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর রাসূল।

সে তখন একজন মুসলিম। আমি তখন একইসাথে বিস্মিত এবং ঈর্ষান্বিত। তাকে ভীষণ খুশি দেখাচ্ছিল। যেন সে জানে যে সে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহুল কাজ করে ফেলেছে। যেন সে একদম ঠিক কাজটিই করেছে। সে অনেক সাহসী একটা কাজ করে ফেলেছে, যে কাজটি করার জন্য আমি ভয় পাচ্ছি।

“ভালো”, আমি কোনোমতে বললাম, “তুমি আমার চেয়ে বেশি সাহসী”। এরপর আমি ইসলাম নিয়ে আমার পড়াশুনা ও অগ্রগতি সম্পর্কে তাকে বললাম। তখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কি হোস্টেলে তার রুমে গিয়ে তাকে হিজাব পরা শিখিয়ে দেব কি না। আমি খুশি হয়ে রাজী হলাম। পরেরদিনই গেলাম, মিশর থেকে আনা সোনালী-লাল কারুকাজ করা একটি হিজাব নিয়ে। সাথে আরও দুটি ছিল, হিজাবের জন্য সবচেয়ে উপযোগী কালো রঙয়ের একটি হিজাব আর আরেকটি গাঢ় নীল শিফনের। সে রাতেই, বারবার হিজাব পরা শেখার চেষ্টা করে করে আর ব্যর্থ হতে হতে একটা নতুন বন্ধুত্ব গড়ে উঠা শুরু করল—এমন একটা বন্ধুত্ব যা আমার জীবনকে সারাজীবনের জন্য পরিবর্তন করে দিয়েছিল।

হঠাৎ করেই আমি ইসলাম নিয়ে কথা বলার, এই ব্যাপারে আমার আগ্রহ নিয়ে কথা বলার, বিশ্বাসের ভেতর বাহির নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক করার একজন সঙ্গী পেয়ে গেলাম। আমি খুব উপভোগ করছিলাম ব্যাপারটা। আমার সমস্ত আগ্রহ তখন ইসলামের দিকে, কালোদের ব্যাপারটায় উৎসাহ দিনদিন কমে যাচ্ছিল। আফ্রিকান ক্যারিবিয়ান সোসাইটিতে তখন গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় কিন্তু আমি হতাশ—বছর যায়, বছর আসে, আলোচনার ধরণ পরিবর্তন হয় না আমাদের। আফ্রিকান ও ক্যারিবিয়ান পরিচয়ের দ্বন্দ্ব, কালো-সাদাদের সম্পর্কের বিপত্তি নিয়ে বিতর্ক চলে, নারীবিদ্বেষী ও উগ্র গান কবিতা লেখা হয়, পরিবেশ উত্তপ্ত হয়। আমার মন তখন অস্থির—এইসব হালকা-পাতলা অর্থহীন ব্যাপার কি আসলেই এত গুরুত্বপূর্ণ? মানুষ হিসেবে এইসবই কি আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা? ইসলাম নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকা আমার আগ্রহ তখন আমাকে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গী উপহার দিয়েছে—চারপাশের পৃথিবী আমি কীভাবে দেখি? মানুষ হয়ে কেন বেঁচে আছি?— এসব প্রশ্নের উত্তরে। এবং এসব উত্তর এড়িয়ে যাওয়াটা আমার কাছে দিনদিন কঠিন হয়ে উঠতে লাগল। এই দ্বিধার শেষ হলো একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রেক্ষাগৃহে। জ্যামাইকান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলাম আমি। বসে আছি, র‍্যাগ মিউজিক বাজছে জোরে, মঞ্চে নাচতে থাকা মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি, ওদের শরীর নাচানো, হাঁটু পর্যন্ত বুটজুতা পরা পা দোলানোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার নিজেকে খুব দূরের কেউ মনে হলো, খুব দূরের। মনে হলো, এখানে বসে থাকা আমিটা আসলে আমি নই, আমি আর এখানকার কেউ নই।

আমি উঠে পড়লাম, ক্যাম্পাসের অন্যপাশের প্রেয়ার রুমে চলে গেলাম। আমার আশপাশে আমার মতো কিছু মানুষ দরকার ছিল, কিছু ভালো সঙ্গ দরকার ছিল। খুব গভীরে গিয়ে কিছু অর্থ বের করে আনা দরকার ছিল—দরকার ছিল আত্মার জন্য কিছু খাবার। আমি বুঝতে পারলাম আমি আর আমি নেই, ধীরে ধীরে আমার হৃদয় এগিয়ে যাচ্ছে ইসলামের দিকে।

এসব অনুভূতির পরও আমার ভেতরে বাস্তবতা এসে আঘাত করছিল; আদর্শ, রাজনীতিও। আমি, একজন কালো আফ্রিকান মেয়ে কীভাবে ইসলামের অংশ হবে? আমি নিজেকে তখনো এভাবেই দেখতাম, যদিও আমার বাবা-মা দুজনই কালো ছিলেন না। আমি যতদূর দেখতাম, ইসলাম যেন শুধু আরব এবং এশিয়ানদেরই ধর্ম। আসলে আমি তো মুসলিম বলতে শুধু তাদেরকেই দেখেছি তখন। নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে কীভাবে নতুন জীবনের সাথে মানিয়ে নেব, আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। একটা নতুন বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, যা আমাকে আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে পারে—এমন আশঙ্কায় আমার মন ভারাক্রান্ত ছিল।

সান্দ্রা, আমার নতুন বন্ধুটি তখন আমাকে সমর্থন দিয়েছে। আমি যতবারই এসব প্রশ্ন নিয়ে কথা তুলতাম, প্রতিবার ধৈর্য নিয়ে কথা বলেছে আমার সাথে। আমার ধারণা সে দেখতে পাচ্ছিল আমি কোত্থেকে এসেছি, কিন্তু তার চেয়েও বেশি অবাক হচ্ছিল কেন আমি এই “আফ্রিকান” পরিচয় নিয়ে এত বেশি ভাবছি! ওর কাছে ব্যাপারটা ছিল সহজ—ইসলাম যদি সত্যি হয়, তাহলে বাকীসব গৌণ। যে পথ তুমি সত্য বলে মানো, এই গৌণ ব্যাপারগুলো কেন সেই পথে চলতে তোমার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে?

ফ্রম মাই সিস্টারস' লিপস
মূল: নাইমা বি. রবার্ট
অনুবাদ: নাবিলা আফরোজ জান্নাত