‘রাগ হলে আমার লজিক্যাল সেন্স হারিয়ে যায়। অদ্ভুত সব কারণ একটার উপর একটা যোগ হতে থাকে। আমি নিজের মধ্যে বুঝতে পারি, আমি রাগ করছি কারণ আমার মধ্যে একটা হেরে যাওয়া অনুভূতি হচ্ছে। আমি নিজের মত করে একটা কিছু ভেবে রেখেছিলাম, কিন্তু বাস্তবে তেমন করে হয়নি। আমি হেরে যাচ্ছি, আমার কথা কেউ পাত্তা দিচ্ছেনা, আমার সুযোগ সুবিধার দিকে কারো খেয়াল নেই… আমার উপর অন্যায় হলে দেখার কেউ নেই..’

উপরের কথাগুলো একটু অদল বদল করে দিলে প্রত্যেকেই নিজের ছায়া খুঁজে পাবেন। রাগ এমন এক জিনিস, তখন কে যে কী থেকে কী হয়ে যায়, কোন ঠিকঠিকানা থাকেনা। রাগ আর মাতাল অবস্থার মধ্যে আমি কোন পার্থক্য দেখি না। যে মাদক নেয়া থামাতে পারে না, তাকে আমরা বলি, ওর নিজের উপর কন্ট্রোল নেই। যে রাগ হলে শান্ত হতে পারেনা, তাকেও আমরা বলি, ওর কন্ট্রোল থাকেনা। আফসোস, মাদকাসক্ত কে আমরা দেখি ঘৃণার চোখে, আর বদরাগ কে দেখি কিঞ্চিৎ প্রশ্রয়ের চোখে।

কেন এভাবে রেগে যাই আমরা? আগের কোন রাগকে ট্র্যাক করতে পারবেন? এখানে রাগ বলতে আমি কিন্তু ‘অযৌক্তিক রাগ’ বুঝাচ্ছি। নিজের উপর অন্যায় হলে যে রাগ হয়, সে রাগের কথা বলছি। যে রাগ কমানোর জন্য মানুষ মেডিটেশনের দ্বারস্থ হয়, ডাক্তারের কাছে মুখ কাঁচুমাচু করে বলে, ‘দেখেন ত ডাক্তার সাহেব, আমার প্রেশারটা কি বেশি দেখে এত রাগ উঠে?’, সেই রাগের কথা বলছি। আমার রাগের ৯০%ই তৈরি হয় ‘এটা অন্যায়’ – এই চিন্তা থেকে। এই যেমন বন্ধুরা সবাই মিলে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করছি, এর মাঝে একজন বলা নাই কওয়া নাই শেষ মুহূর্তে পিছু হটল। হয়ে গেলাম রাগ, ‘তার কি এইটা উচিৎ হইসে?’ বাসায় গুরূত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত আমাকে জিজ্ঞাসা ছাড়াই নিয়ে ফেলল। রাগ, ‘আমি কি কেউ না?’ গ্রুপে মিলে কোন কাজ করছি, একজন ফাঁকিবাজি করল। হয়ে গেল মেজাজ খারাপ, ‘ফাইজলামি পাইসে?’ প্রত্যেকবারই হয় ‘আমার’ কমফোর্ট নষ্ট হয়েছে, নয়ত ‘আমার’ ইগো হার্ট হয়েছে, অথবা ‘আমার’ তৈরি করা প্ল্যান অনুযায়ী কাজ হয়নি। প্রত্যেকটাই খুব আত্মকেন্দ্রিক কারণ, কিন্তু আমি যখন রেগে যাচ্ছি, তখন আর স্বার্থপরতার ওই দিকটা আর চোখে পড়ছে না, মনে হচ্ছে, আমি বৃহত্তর স্বার্থে অন্যায়ের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাতে রাগ দেখাচ্ছি। অথচ এই ঘটনাটাই অন্যের বেলায় ঘটলে হয়ত আমি মিষ্টি মিষ্টি হেসে ধৈর্য ধরার উপদেশ দিতাম। এ রকম ডাবল স্ট্যান্ডার্ড, হীন একটা চিন্তাকে মনের ভেতর মহৎ বানিয়ে ফেলছে কে?

সূরা নাস এ আল্লাহ আমাদের শিখিয়েছেন শয়তানের অনিষ্টকর কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে (মিন শাররিল ওয়াসওয়াসিল খান্নাস।) শয়তান আমাদের কুমন্ত্রণা দেয় – এটা কি আমরা আসলেই বিশ্বাস করতে পারি? মাঝে মধ্যে পারি, কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই আমাদের যুক্তিবাদী মন বিশ্বাস করতে চায়না কোন জ্বীন ভূত এসে কুবুদ্ধি দিচ্ছে, আর সেটার ফল আমাদের কাজে এসে পড়ছে। শয়তানকে নিয়ে কারো সাথে রিয়েলিস্টিক আলোচনা করার চেষ্টা করে দেখুন, হাসতে হাসতে আপনাকে উড়ায় ফেলবে, স্কিজোফ্রেনিক রোগীও বানায় ফেলতে পারে। শয়তানকে নিয়ে আমি প্রায়ই চিন্তাভাবনা করি, তারপরেও, এশার নামাজ একটু দেরি করে ফেললে যখন ভী-ষ-ণ আলসেমি লাগে, ঘুমে মনে হয় পড়েই যাব, আর কষ্ট করে নামাজ পড়ে ফেলার সাথে সাথে ঘুমও পালায় – তখনও আমার মনে হয়না এটা শয়তানের কারসাজি। শয়তান এখনও আমার কাছে সামহোয়াট ইমাজিনারি কিছু। আমার বাসা, ল্যাব, ল্যাপটপ – এরা যেমন খুব বাস্তব, শয়তানকে ততটা বাস্তব ধরতে মনের মধ্যে কেমন কেমন যেন লাগে।

রাগের বেলায় শয়তানের ভূমিকা বলার আগে সূরা নাসের পরের লাইনটা আলোচনা করে নেই। আল্লাযি ইয়ুওয়াসয়িসু ফী সুদুরিন নাস, সেই শয়তান, যে মানুষের বুকের মধ্যে বসে কুমন্ত্রণা দেয়। ‘ইয়ুওয়াসয়িসু’ হচ্ছে ঘটমান বর্তমান ক্রিয়াপদ। চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে। কোন থামাথামি নেই। শয়তান বুকের মধ্যে বসে থাকবে, একটা ফুট কাটবে, আপনি তাকে ধমক দিয়ে থামাবেন, সে একটু দমে যাবে, তারপর মুখটা বাড়ায় আবার আরেকটা কিছু বলবে.. আবারও, আবার… ! আপনি যখন কোন কারণে অফেন্ডেড, আপনার মনের মধ্যে এমনিতেই কিছু নেগেটিভ চিন্তা আছে অফেন্ডারের প্রতি। এখন শয়তান করবে কি, ওই ভদ্রলোকের/ভদ্রমহিলার সাথে আপনার বিগত জীবনে যা যা খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে সব ছবির মত সামনে তুলে ধরতে থাকবে। একটা করে ছবি দেখবেন, মেজাজ খারাপ বাড়তে থাকবে। শুধু এই না, ছবির নিচে ক্যাপশনের মত একটা এক্সপ্লানেশন ও থাকবে, ও এইটা করসিল, দেখ, সে তোমার জন্য কক্ষণো কেয়ার করে নাই। সবসময় তুমিই করে গেছ… ইত্যাদি ইত্যাদি। কারো উপর রাগ হওয়ার পর তার ভালমানুষির কথাগুলি কি আপনার কখনো মনে পড়ে? আমি কারো উপর রাগ হয়ে আমার স্বামীর কাছে ঝাল ঝাড়লে সে তার ভাল দিকগুলি মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু আমার তখন আরো রাগ হয়, ‘আমি বলতেসি খারাপ আর তুমি ভাল দিক দেখাচ্ছ! আমার ত এখন নিজেকে আরো বেশি খারাপ মনে হচ্ছে!’ কী ভয়ংকর ইগো!

যাই হোক, পার্সোনাল ডিসকমফোর্ট আর শয়তানের ওয়াসওয়াসা – এ দুটোই আমাদের জন্য অনেক, তার উপর আরো আছে পারিপার্শ্বিকতার চাপ। আশেপাশের মানুষের উস্কানিতে ঘটনা আরো খারাপের দিকে গেছে – এ রকম দেখেছেন কখনো? আল্লাহ সূরা নাস এর শেষ লাইনে বলেছেন ‘মিনাল জিন্নাতি ওয়ান নাস’, খারাপ জ্বীন ও মানুষের কুমন্ত্রণা। ওয়াসওয়াসা শুধু বুকের ধারেকাছে ওঁৎ পেতে থাকা বেহায়া শয়তানটাই দেয়না, তার সাঙ্গোপাঙ্গো যারা অন্যদের ভেতর বসে আছে, তারাও একযোগে বুদ্ধি দিতে থাকে, এটা বল, ওটা মনে করিয়ে দাও। ফলাফল… থাক, নাই বা বলি। রাগ করে মানুষ বাসনকোসন ভাঙে, হাত পা ভাঙে। সম্পর্ক ভাঙে, ভাঙে আল্লাহর উপর বিশ্বাসও। তারপর একটা সময় ফলাফল দেখে কান্নায়ও ভেঙে পড়ে।

ফেসবুকে এক ছোট বোন লিখেছিল, মানুষকে চেনার সবচেয়ে ভাল উপায় হল তাকে রাগিয়ে দেয়া। এমনিতে ফেরেশতা, আর রাগিয়ে দিলে মুখের ভাষা শয়তান টাইপ হয়ে যায়। আমি এই বক্তব্যের সাথে একমত না। রাগিয়ে দিলে মুখের ভাষা শয়তান টাইপ হয়, কারণ সে তখন শয়তান আর মানুষের ওয়াসওয়াসা দ্বারা প্রভাবিত হয়। রাসুলুল্লাহ (স) কখনোই মানুষের রাগের অবস্থা বিচার করতেন না। এমন ভাব করতেন, যেন এমন কোন ঘটনা ঘটেই নি। তিনি বুঝতেন, এটা অন্য যে কোন প্রবৃত্তির মতই মানুষের একটা দুর্বলতা। তাই উনি সবচেয়ে শক্তিশালী বলেছেন সেই ভাই বা বোনকে, যে রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে।

রাগ হলে কী করতে হবে? বলব না। যে সত্যিকারের আন্তরিক সে খুঁজে বের করে নিক। আমি চাই মানুষ বদরাগ কে মাদকাসক্তির মতই এক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করুক। বদরাগের কারণে যাদের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে তারা বিষয়টার ভয়াবহতা নিয়ে অন্যদের সাথে কথা বলুক, মানুষ যেন আরো সচেতন হয়। Domestic violence এর অনেকটুকুই আসে বদরাগ থেকে। ঠান্ডা, সুস্থ মাথায় ভায়োলেন্স করে যাচ্ছে, এরকম কেস আপনি কমই পাবেন। রাগ নিয়ে চিন্তা করুন। যে বদরাগী, সেও, যে ভুক্তভোগী, সেও। চট করে রেগে যাওয়া, লম্বা সময় রাগ ধরে রাখা – এগুলো পরিবার, সমাজের বড়সর ক্ষতি করে ফেলছে। এখন শুনি রিকশাওয়ালার সাথে ঝগড়া হলেই কষে চড় লাগিয়ে দেয় স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা। রাগ কি কেবল স্টুডেন্টদেরই আছে? আল্লাহ না করুক, এইসব অন্যায় আর অসম্মানের খেসারত যদি আপনার কোন ভাই/বোনের জীবন/সম্মানের বিনিময়ে দিতে হয়, তখন কি একচেটিয়া রিকশাওয়ালাদের দোষারোপ করে পার পাওয়া যাবে?

লেখাটা শেষ করি আমার খুব প্রিয় একটা হাদীস বলে। রাসুলুল্লাহ (স) এর সামনে এক সাহাবীর সাথে আরেকজনের ঝগড়া হচ্ছিল। সাহাবী নম্রভাবে জবাব দিচ্ছিলেন আর ওইপক্ষ একনাগাড়ে গালিগালাজ করেই যাচ্ছিল। তাই দেখে রাসুলুল্লাহ (স) মুচকি মুচকি হাসছিলেন। একটা সময় আর টিকতে না পেরে সাহাবীও উঁচু গলায় জবাব দিতে থাকল, তখন রাসুলুল্লাহ (স) সে জায়গা থেকে সরে গেলেন। ব্যাপারটা সেই সাহাবী লক্ষ করলেন, উনি এসে রাসুলুল্লাহ (স) এর কাছে জানতে চাইলেন, উনি অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণ কী। রাসুলুল্লাহ (স) তখন উনাকে জানালেন, তুমি যখন চুপ ছিলে তখন এক ফেরেশতা তোমার হয়ে জবাব দিচ্ছিল। আর তুমি যখন গলা উঁচু করলে, তখন ফেরেশতার বদলে শয়তান এসে জায়গা করে নিল, আর তোমার হয়ে জবাব দিতে থাকল। তাই দেখে আমি চলে এলাম।


2011-11-17T04:53:00+00:00