বর্তমানে বিয়ে বিষয়টা বেশ আলোচিত হচ্ছে৷ অনেক যুবকই বিয়েকে আর দেখছে না ক্যারিয়ারের বাধা হিসেবে৷ বিয়েকে এতোদিন, বদ্ধমূলভাবে, ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হতো৷ কিন্তু সেই ভিন্নতার দিন ঘুচিয়ে আসছে দিন-দিন৷ বাল্যবিয়ে নামক জুঁ-জুঁর ভয়ও দূর হয়ে যাবে অচিরেই৷ বিয়ের প্রয়োজনীয়তা একদিন হাড়ে-হাড়ে টের পাবে পুরো বিশ্ব৷ অবাধ উচ্ছৃঙ্খল সমাজের রাশ টেনে ধরবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠবে সকলে৷ ইসলামের জীবনভিত্তিক সমাধানের কাছে সমর্পিত হবে তখন বিশ্বনীতি (তবে ততক্ষণে জল অনেকটাই ঘোলা হয়ে যাবে৷)।

সবকিছুরই দুটো দিক থাকে৷ ইতিবাচক ও নেতিবাচক৷ বিয়ের এতো এতো আলোচনার মধ্যেও এ-দু়ই বিদ্যমান৷ বিয়ে নিয়ে যতো লেখা আমরা দেখছি৷ তার সিংহভাগই আবেগ-নির্ভর৷ সেই লেখাগুলো পড়লে মনে হয়, বিয়ে করলেই বুঝি নেমে আসবে শান্তির ফাল্গুধারা৷ তার ওপরে দীন চর্চাকরা দম্পতিদের পোস্ট দেখলে তো আফসোসের আর অন্ত থাকে না৷ এগুলো দেখে দেখে আমরা বিয়ে ব্যাপারটার সহজ সমীকরণ করতে থাকি৷

কিন্তু বিয়ে যেনো-তেনো কোন বিষয় নয়৷ এটা নয় কেবল দুজনের মিলন৷ বরং তা দুই পরিবার ও দুই গোষ্ঠির বন্ধন৷ সুতরাং এখানে বোঝাপড়ার বিষয় আছে অনেক৷

উপরন্তু বাস্তবতার ময়দান বড়ই করুণ৷ আপনি পরিবারগুলোকে ভেতর থেকে দেখুন৷ বিয়ের আশা আপনার মিটে যাবে৷ স্বামী ও স্ত্রীর মাঝের মনোমালিন্য নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা৷ পত্রপত্রিকার খবর তো আরও ভয়াবহ৷ ঢাকায় দৈনিক পঁচিশ থেকে ত্রিশটা তালাক হয়৷ সারাদেশের তালাকের সংখ্যা তবে কতো হবে? পুরো বিশ্বের কথা না হয় বাদই দিলাম৷

কথা আরও আছে৷ তালাক তো হচ্ছে আজকে৷ কিন্তু এর পেছনে দীর্ঘ ট্র্যাজেডি আছে৷ এবং সেগুলো এতো কুৎসিত ও কদর্য, যে, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়৷ কোন যুবক যদি তা দেখে৷ তবে বিয়ের আশা তার মিটে যাবে৷

একজনের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছিল৷ এই বিষয়ে সে বেশ দ্বিধান্বিত৷ সে বলল, বিয়ে নিয়ে হাদিস বলছে, যে, তা দীনের পরিপূর্ণতা৷ কিন্তু আমি তো দেখি উল্টো৷ বিয়ে করার পর, যতোটুকু দীন ছিল, তা-ও লোপাট হয়ে যায়৷ নিজের দীন তো যায়ই৷ সেই সঙ্গে ঘর থেকেও উজার হয়ে যায় দীন৷ বিষয়টাকে সে মেলাতে পারছিল না৷ ফেইসবুকের সরল হিসেব পড়ে পড়ে সে ভ্রমে পড়ে গেছে৷

আমি তাকে বললাম, এটা সত্য যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যদি বান্দা বিয়ে করে তবে সে অর্ধেক দীন পূর্ণ করে ফেলল৷ বাকি অর্ধেকের বিষয়ে তিনি আল্লাহকে ভয় করতে বলেছেন৷ (মেশকাত, ৩০৯৬)

অর্থাৎ বিয়ে না করলে দীনের অর্ধেক অপূর্ণ রয়ে গেল৷ বিয়ের মাধ্যমে যা পূর্ণ হয়ে যায়৷ বাকি ইবাদত -মুআমালাত ও মুয়াশারাতসহ দীনের বাকি অর্ধেক নিয়েও রাসুল সতর্ক থাকতে বলেছেন৷ যথাযথভাবে তা পালন করবার ইঙ্গিত দিয়েছেন৷

ইমাম গাযালি রহঃ বলেন: দীন নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে গোপণাঙ্গ ও পেটই মুখ্য কারণ৷ বিয়ের মাধ্যমে যার একটার সমাধান হয়৷ কেননা বিয়ের দ্বারা শয়তান ও প্রবৃত্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়৷ চক্ষু ও গোপণাঙ্গের হেফাজত করা যায়৷ (মিরকাতুল মাফাতিহ, পৃ ২৫০)

এই হাদিস তার যথাস্থানে ঠিক আছে৷ কিন্তু বিয়ে বিষয়ে রাসুলের এটাই শেষ কথা নয়৷ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরও কতক হাদিস আছে এই বিষয়ে৷ সেগুলো সব সামনে রেখে বিবেচনা করা জরুরি৷ কেবল বিয়ে করলেই যে আমরা দীন হেফাজত করতে পারলাম৷ ব্যপারটা মোটেই তা নয়৷ বরং বিয়েটা হতে হবে সুন্নাহসম্মত৷

যেমন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যেই বিয়ের খরচ কম৷ সেই বিয়ের বরকত বেশি৷ (বায়হাকি, মেশকাত ৩০৯৭)

কিন্তু বর্তমানে বিয়ের চে' বড় বাজেট আর কীসের? রাসুল বলছেন বিয়ের বাজেট কম করতে৷ বিয়ের আয়োজন ছোট করে করতে৷ মোহর কম ধরতে৷ কিন্তু আমরা কি এর উল্টোটা করছি না? একটা বিয়ে দিতে গিয়ে মেয়ের বাবা আর্থিক সংকটে পড়ছেন না? তো যে কাজে একজন মুসলিম সংকটে পড়ে যান৷ সেই কাজে বরকত আসবে কোত্থেকে?

এবার আসি সবচে' গুরূত্বপূর্ণ বিষয়ে— পাত্রী-নির্বাচন৷ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বিষয়টাকে অনেক গুরূত্ব দিয়েছেন৷ নারীদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলেছেন তিনি৷ তিনি বলেন: দুনিয়া পুরোটাই সম্পদ৷ তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো সালেহা বা সৎ নারী৷ (মুসলিম—মেশকাত ৩০৮৩)

সৎ নারীর বেশ কিছু পরিচয় হাদিছে পাওয়া যায়৷ তারা সন্তানের প্রতি স্নেহশীল হবেন, স্বামীর বিষয়ে হবেন আমানতদার৷ ইত্যাদি৷ অনুরূপ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসৎ নারী থেকেও সাবধান করেছেন৷ তিনি বলেন, আমার পরে পুরুষদের ওপরে নারী-ফেতনার চে' গুরতর কিছু রেখে যাই নি৷ (মুত্তাফাক—মেশকাত ৩০৮৫)

সুতরাং কেমন নারী বিয়ে করতে হবে৷ তা আমাদের বুঝবার বাকি থাকার কথা নয়৷ একটা হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সরাসরি পাত্রী-নির্বাচনের নির্দেশনা দিয়েছেন৷ তিনি বলেন- নারীদের চারটা কারণে বিয়ে হয়ে থাকে

১৷ তার সম্পদের কারণে৷
২৷ তার বংশের কারণে৷
৩৷ তার সৌন্দর্যের কারণে৷
৪৷ তার দীনের কারণে৷
সুতরাং তুমি দীনদারকে প্রাধান্য দেও৷

অনেকে এই হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা করে থাকে৷ তারা বলে, রাসুল চারটা দিক দেখে মেয়ে বিয়ে করতে বলেছেন৷ সম্পদ, বংশ, সৌন্দর্য ও দীন৷ এখন ছেলেরা সুন্দরী ও টাকা ওয়ালা বাপের মেয়ে খুঁজতে থাকে৷ উচ্চবংশীয় কন্যার খোঁজে থাকে তারা৷ তাদের যুক্তি রাসুল এগুলো দেখতে বলেছেন৷ কিন্তু দীনের কথাটা বেমালুম তারা ভুলে যায় তারা৷

না, হাদিসের অর্থ এমন নয়৷ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীকে বিয়ে করার চারটা প্রবণতার কথা বলেছেন৷ এই চারটা বিষয় দেখা হয় সমাজে৷ কিন্তু রাসুলের আদেশ হচ্ছে, দীনদারকে প্রাধান্য দেও৷ সম্পদ-সৌন্দর্য ও বংশ কোনই কাজে আসবে না—যদি না দীন থাকে৷ যখন দীনদারী থাকবে তখনই দীনের পূর্ণতার প্রশ্ন আসবে৷ অন্যথায় এই প্রশ্ন অবান্তর৷

পাত্র-নির্বাচন নিয়ে তেমন কোন আলোচনাই দেখি না৷ সকলেই কেবল পাত্রী নিয়ে মাতামাতি করে৷ তো মেয়ে-পক্ষের জন্য কি কোন নির্দেশনা নেই? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছু বলেন নি এই বিষয়ে?

জি! তিনি এ বিষয়েও অনুপম উপদেশ দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, যদি তোমাদের কাছে এমন পুরুষ বিয়ের প্রস্তাব দেয়৷ যার দীনদারি ও চরিত্র উত্তম মনে হয় তোমাদের কাছে৷ তবে তার কাছে বিয়ে দিয়ে দেও৷ যদি এমনটা না করো৷ তবে জমিনে ফেতনা হবে, সমাজময় ছড়িয়ে পড়বে বিশৃংখলা৷ (তিরমিযি, মেশকাত ৩০৯০)

হাদিসটি খুবই স্পষ্ট৷ বিয়ের ক্ষেত্রে আমরা কেবলই ছেলের টাকা-পয়সা ও বাড়ি-গাড়ির হিসেব কষি৷ সে কী চাকরি করে, তার খোঁজ নিতে থাকি৷ ছেলের ঈমানের খোঁজ কি কেউ নেয়? তার দীনদারির খবর কি রাখে কেউ? আমরা মনে করি সম্পদ থাকলেই সুখে থাকবে মেয়ে৷ কিন্তু ঘটনা হয় উল্টো৷ বিয়ের পরে দেখা যায় ছেলের চরিত্রে সমস্যা৷ দীন যদি না থাকে তবে তার থেকে উৎকৃষ্ট কিছুর আশা করা বাতুলতা বৈ আর কী?

দেখা যাচ্ছে, আমাদের বিয়ের শুরটাই হয় ভুল পন্থায়৷ তো এই যাত্রা কীভাবে নির্বিঘ্ন হবার আশা করা যায়? সাংসারিক জীবন নিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন ও শিক্ষা থেকে উপদেশ ও পাথেয় আমরা গ্রহণ করি না৷ যার কুফল ভোগ করতে হয় প্রতি পদে পদে ৷

গত ১৫ এপ্রিল ফেইসবুকে একটা নৃশংস ঘটনা দেখেছে সকলে৷ স্ত্রীকে হত্যা করে লাইভে এসে সে কথা জানাচ্ছে স্বামী৷ এই ঘটনার নানামাত্রিক ব্যবচ্ছেদ হয়েছে৷ কিন্তু আপনি এমন ঘটনা আরও দেখতে পাবেন৷ পরকীয়ার জের ধরে কী ঘটে যাচ্ছে সারা দুনিয়ায়, তা কারওই অজানা নয়৷ এসকল বিষয়ের যতোই বিশ্লেষণ করুন না কেন৷ ঐ এক বিন্দুতে এসেই আটকে যাবেন৷ তা হলো দীন৷ বর্তমানে দীনের অনুপস্থিতির কারণেই সাংসারিক ফেতনা-ফাসাদ ও অঘটন ঘটছে৷ দৈনিক যে তালাক হচ্ছে, তা নিতান্তই ঠুনকো কারণে৷ যা সমর্থিত নয় ইসলামের দৃষ্টিতে৷ মানবিক বিবেকের কাছেও তা নয় গ্রহণযোগ্য৷ তবু এগুলো ঘটছে অহরহ৷ যার প্রধান কারণ, দীনী বোধ ও বুদ্ধি অনুপস্থিত আমাদের জীবনে৷

যতক্ষণ না দীন হবে আমাদের পাথেয়৷ ততক্ষণ যন্ত্রণাই হবে আমাদের সঙ্গী৷


বিয়ে—কখন দ্বীনের পূর্ণতা?
ইমরান হোসাইন নাঈম