ব্লগপাড়ায় আমি পুরোপুরিই নতুন। কিন্তু তারপরেও শুভাকাঙ্ক্ষী পেতে সময় লাগেনি। তাদেরই একজন বললেন নোটের কমেন্ট পেলে ছোট্ট করে জবাব দিতে। এতে পাঠক খুশি হয়। আমি অকূল পাথারে পড়ে গেলাম। কেন, একটু পরে বলছি।

গত শুক্রবারে জুম্মায় intention নিয়ে কথা বলছিল। অনেকেই বোধহয় ইমাম নববীর ৪০ হাদিস এর কথা জানেন। ইমাম নববী অনেক বাছাই করে শত শত হাদিস থেকে মাত্র চল্লিশটা হাদিস নিয়ে একটা সংকলন বের করেছিলেন। এতে এমন হাদিসগুলোই জায়গা পেয়েছিল যেগুলো মানুষের জীবনে খুবই কাজে লাগবে বলে তিনি মনে করেছিলেন। ইয়া মোটা বই, তিনটা খণ্ড। এক লাইনের হাদিসএর উপর দশ-বার পৃষ্ঠা বিশ্লেষণ। ত সেই বইয়ের প্রথম হাদিস হচ্ছে,

“প্রত্যেক কাজের ফলাফল তার নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়্যত করেছে।..’

শুনতে খুব ছোট, কিন্তু চিন্তা করতে থাকলে এই দুইটা লাইন থেকে অনেক কিছু বের হয়। এই যেমন, ‘প্রত্যেক কাজ।’ প্রত্যেক কাজ? সকাল বেলা উঠে চা বানালাম, ল্যাব মিটিং এ প্রেজেন্ট করলাম, আমার স্বামীর সাথে কিছুক্ষণ বসে বার্সেলোনার খেলা দেখলাম – এই সব জিনিসের নিয়্যত? খাইসে! এর ত কোন নিয়্যতই করি নাই! ভাল্লাগসে, করসি, দরকার ছিল, করসি।

এই হাদিসটার আমি মনে করি বেস্ট পার্ট হচ্ছে এই ‘প্রত্যেক কাজ’ অংশটা। এতে করে হবে কী, আমরা আমাদের কাজে আরো অনেক বেশি চিন্তা ইনভলভ করব। দোকানে নারকেল তেল কিনতে গেলে প্যারাসুট ই প্রথমে হাতে লাগে। কেন? কারণ টিভিতে অ্যাড এ বলেছে এটা খাঁটি। বছরের পর বছর গুলশান এভিনিউ ফলো করব। কেন? (উত্তরটা আমি জানিনা।) নিজের কাজকে যত বেশি প্রশ্ন করতে অভ্যস্ত হব, তত আমরা ইন্‌সটিংকট এর দাসত্ব থেকে বের হয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীর মত আচরণ করব।

তেমনি কথা বলার ক্ষেত্রেও। জিহ্বার (অথবা কীবোর্ডের) উপর কড়া কন্ট্রোল আছে এমন মানুষ কমই আছে। আমাকে কেউ গীবত করতে আসলে আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘এই কথাটা কেন বললা?’ বেচারা থতমত খেয়ে যায়। মিনমিন করে বলে, ‘না জানায় রাখলাম আর কি!’ মেজাজ খারাপ থাকলে তখন আরো ধরে বসি, ‘এই ইনফরমেশনটা আমাকে কীভাবে হেল্প করবে?’ খিক্ খিক্! আর এই বুঝে শুনে কথা বলার অভ্যাসটা অন্যদের থামাতে যত না সাহায্য করেছে, আমার আমাকে থামাতে তার দশগুণ বেশি কাজে লেগেছে। আমি এখনও জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে আনার যুদ্ধ করে যাচ্ছি।

এরপর আসছে ফলাফল। ফলাফলকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। জাগতিক ফলাফল, আধ্যাত্মিক ফলাফল। খুব জাগতিক কাজকেও টেনে আধ্যাত্মিক ফলাফল বানায় ফেলা যায়। আবার আধ্যাত্মিক কর্মকান্ডও জাগতিক স্তরে নেমে আসে যদি নিয়্যতে গোলমাল থাকে।

দ্বিতীয় ঘটনার উদাহরণ ত আমাদের চারপাশে অহরহ দেখি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা কোন স্টেটমেন্ট শুনলে চারপাশে উদাহরণ খুঁজি, নিজের মধ্যে খুঁজি না। এই লেখাটা লিখতে লিখতেই খুব খিদে পেয়েছিল। রুটিতে জেলী মাখতে মাখতে মনে হল, আচ্ছা, এই কাজটাকে কি নিয়্যতের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক স্তরে তোলা যায়? অনেক কায়দা কসরত করে বের করলাম, রুটিটা খেলে একটু ভাল্লাগবে। ব্রেনে গ্লুকোজ যাবে। লেখাটা লিখতে সুবিধা হবে। আর এই লেখায় আমি আল্লাহর কথা লিখব।

উহ! প্রতিটা কাজের বেলায় এরকম করে নিয়্যত খুঁজে বের করা? কষ্ট একেবারে কম না! তবে ছোট্ট একটু চিন্তা করে যদি এত ভাল পুরস্কার পাওয়া যায় তাহলে কেন করবনা? এখন তাই জার্নাল আর্টিকেল পড়তেও খারাপ লাগেনা। চিন্তা ভাবনা করে এটাকেও ইবাদত বানিয়ে ফেলেছি।

একই রকম কাজের অপর পিঠ হচ্ছে, জাগতিক ফল লাভের আশায় ইবাদত করা। জুম্মার খুতবায় এই বিষয়টা নিয়েই কথা বলছিল। সুন্দর করে নামাজ পড়ার একটা উদ্দেশ্য যদি হয় যারা দেখছে তারা মুগ্ধ হবে তাহলে আমি নিয়্যতে আল্লাহর সাথে মানুষকে শরীক করে ফেললাম। খালি আমার নামাজটারই বারটা বাজলনা, সম্ভবত একটা শিরক ও করে ফেললাম।

জুম্মায় আরো বলল, এই হাদিসএ নাকি নিয়্যতের বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ আমরা চাইলে একই কাজের অনেকগুলি নিয়্যত করে সেটার ফলাফল অনেকগুণ বাড়িয়ে নিতে পারি। আমার বন্ধু অপুও বলেছিল, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়্যত করেছে’ – এখানে আমরা যতগুলি নিয়্যত করব, ততগুলি পুরস্কার পাব। সুবহানাল্লাহ! একে ত খাওয়া, ঘুম – এগুলিও ইবাদত হয়ে যাচ্ছে, তার উপর আবার মাল্টিডাইমেনশনাল সওয়াব। মন টন ভাল না থাকলে মাঝে মধ্যে কলম পেন্সিল নিয়ে বসে যাই, গেম খেলার মত খুঁজে খুঁজে এক কাজ থেকে যতগুলি পারি নিয়্যত বের করি।

এই হাদিসের আরো কয়েকটা ভাল দিক হচ্ছে, এতে করে মনে অনেক বেশি কনফিডেন্স আসে। এক ত আমি স্পষ্ট করে জানি আমি কেন এই কাজটা করতে যাচ্ছি, তারপর জানি কাজের ফলাফলের চেয়ে নিয়্যত বেশি গুরূত্বপূর্ণ, সুতরাং sincerely effort দিয়েই আমার দায়িত্ব শেষ, পরে মানুষ ভাল বলল না খারাপ বলল তাই নিয়ে এত মাথা ঘামাই না। তারও উপর জানি যে আল্লাহ এই ছোট্ট একটা কাজেই অনেকগুলো কাজের সমান সওয়াব দিবেন, যদি ঠিকমত চাইতে পারি। সুতরাং কিছুই করলামনা, বা আমি কোন কাজের না এরকম হতাশা বেশি আসবেনা।

যাই হোক, ব্লগে মানুষের কমেন্টএর উত্তর দেয়ার ব্যাপারে এই নিয়্যতের প্রশ্নে আটকে গেছি। আল্লাহ যদি প্রশ্ন করে, তুমি ত আমার জন্য লিখেছ, কমেন্টগুলি কার জন্য লিখেছ? আমি যদি বলি, মানুষের জন্য, তাহলে ওরা খুশি হয়ে আমার ব্লগে আসবে। ওরা খুশি হয়ে ব্লগে আসলে তোমার কী হবে? আমার একটু ভাল লাগবে। তখন আল্লাহ যদি বলে বসে, তাহলে তোমার জন্য আত্মতুষ্টিই রইল, তাহলে?