সন্তানের তারবিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো : তাকে হায়া শিক্ষা দেওয়া এবং মন্দ মানুষ সম্পর্কে সতর্ক করা।

বর্তমান প্রজন্মের বাবা-মা পৃথিবী সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখলেও সন্তানকে সতর্ক করার ব্যাপারটা গুরুত্ব দেন না। কিন্তু যখন কোনো ঘটনা ঘটে তখন আফসোস আর কান্না ছাড়া উপায় থাকে না। শিশুদের জন্য ভয়ংকর একটা ব্যাপার হচ্ছে যৌন হয়রানি। বাইরের পৃথিবীর অনেক কিছুই একটা শিশু নিতে পারে কিন্তু যৌন হয়রানির কবলে পড়ে তার কচি মন একটু বুঝতে শেখার বয়স হলেই ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। সে মন কখনোই আর সুন্দর ও পরিপূর্ণ সুস্থভাবে প্রস্ফুটিত হতে পারে না। পেডোফিলদের কথা নিশ্চয়ই আমরা জানি। নারী হিসেবে মায়েদের আরো বেশি জানার কথা। এ থেকে বাঁচার জন্য সন্তানকে প্রথমেই লজ্জা কী তা শেখাতে হবে।

সন্তান তিনচার বছর বয়স থেকেই বলতে হবে ‘দেখো বাবু, এ তোমার প্রাইভেট পার্ট। এদিকে কেউ যেন না দেখে। কেউ যদি নিজের ইচ্ছায় অন্যদের নিজের প্রাইভেট পার্ট দেখিয়ে বেড়ায় অথবা অন্যের প্রাইভেট পার্ট দেখে বেড়ায় তবে শয়তান তার ওপর সওয়ার হয় এবং তাকে দিয়ে মন্দ কাজ করায়।’

তারপর তাকে সতর্ক করতে হবে ‘বাথরুমের প্রয়োজন ছাড়া আব্বু-আম্মুও যেন প্রাইভেট পার্ট স্পর্শ না করে। আর অন্য কেউ যেন কখনো স্পর্শ না করে। যদি কেউ করে সে আসলে মানুষ নয়, সে মানুষ রূপ ধরে থাকা শয়তান। তুমি সাথে সাথে চিৎকার করবে, আব্বু-আম্মুকে বলবে। আমরা শয়তানকে পাকড়াও করব।’

পেডোফিলদের কথা শিশুরা জানে না বলে তারা এটাকে অনেকসময় স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই ধরে নেয়। তারা তো ‘খারাপ স্পর্শ’ ‘ভালো স্পর্শ’ জানবে না, যতক্ষণ না বাবা-মা তাকে শিখিয়ে দিচ্ছেন কোনটা খারাপ স্পর্শ আর কোনটা ভালো স্পর্শ! পিতা-মাতা ফল-পানিকে ফল বললে, পানি বললে শিশুটা যেমন শিখে এটা ফল আর এটা পানি। এভাবেই তাদেরকে শেখাতে হবে কোনটা খারাপ স্পর্শ আর কোনটা ভালো স্পর্শ। আমরা ভালো-মন্দ অনেক কিছু বাচ্চাকে শেখাই, শুধু এ জিনিসটা শেখাই না। তাই পেডোফিল কোনো ব্যক্তি যখন আপনার শিশুকে কোলে তুলে নেয় তখন বাচ্চাটি ভাবে এটা আদর।

আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার বাচ্চার সাথে এমন হবে না, বাসার দারোয়ান, কাজের লোক, পাশের বাসার কেউ আসলে আপনি বাচ্চাকে তার কোলে দিয়ে দিলেন, ভাবছেন সে তো পরিচিত লোক, ভালো লোক, সে এমন না। অথবা ভাবছেন লোকটা বিবাহিত, বয়স্ক, বৃদ্ধ, সে এমন নোংরা কিছুতেই হবে না। কিন্তু আসলেই কি তাই? একটা জরিপ চালিয়ে দেখুন আশপাশের মেয়েদের ওপর। এদের সংখ্যা কম নয় তা বেশিরভাগ মেয়ে জানে।

একটা প্রতিবেদনে পড়লাম, শিশু যৌন নিপীড়নসংক্রান্ত যে ভয়ানক চিত্র ও পরিসংখ্যান দেখা যায় তা থেকে জানা গেছে, ১৮তম জন্মদিনের আগেই প্রতি তিনটি মেয়ের একটি মেয়ে এবং প্রতি ৬টি ছেলের একটি ছেলে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। আর এদের শীর্ষে থাকা ৮৫ শতাংশই তাদের নিপীড়ককে আগে থেকেই চেনে বা জানে।

আরেকটা প্রতিবেদনে এদের থেকে বাঁচার কিছু উপায় বলা হয়েছে। যেমন- 

এক. আপনার ছোট্ট মেয়েকে সর্বদা চোখে চোখে রাখুন। বিশেষ করে কোনো ভিড়ে বা অনুষ্ঠানে মেয়েকে চোখের আড়াল করবেন না। কেননা পেডোফিল ব্যক্তি তক্কে তক্কে থাকে, কখন মেয়ে আপনার চোখের আড়াল হবে আর কখন সে কুকর্ম শুরু করবে।

দুই. নাগালের মধ্যে রয়েছে, এমন মেয়েকেই টার্গেট করে পেডোফিল ব্যক্তি। এমন কাউকে, যার পরিবারের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় আছে বা কোনো নিকটাত্মীয়। তাই মেয়েকে সেরকম সম্পর্কের পুরুষের তত্ত্বাবধানে রেখে যাবেন না।

তিন. কখনো ভেবে নেবেন না পেডোফিলরা সবাই অবিবাহিত। অনেক পুরুষ কিন্তু বিবাহিত হয়েও পেডোফিলিক মানসিকতার হতে পারে। তাই বাবার বন্ধু, চাচার বন্ধুরাও তালিকার বাইরে নয়। 


চার. খেয়াল রাখবেন বাসায় মেহমান এলে বাচ্চার ঠোঁটে যেন চুমু না দেয়। কেউ কোলে নিয়ে দু পায়ের মাঝে যেন না বসায়। মেয়ে শিশু একটু বড় হলে গায়রে মাহরাম কাউকে এমনকি কপালেও চুমু দিতে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করে দিতে হবে।

পেডোফিল যে কেউই হতে পারে। এদের চেনা কঠিন হলেও আপনার সতর্কতার নজর থাকলে বেঁচে যেতে পারে আপনার ফুলের মতো মেয়েটি। কিন্তু অসাবধানতাবশত কোনো শিশু যদি আক্রান্ত হয় তবে তার আচরণ দেখে বুঝতে হবে। শিশুরা যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার লক্ষণ হলো, নিজেদের বা অন্যদের প্রাইভেট পার্ট নিয়ে বারবার আগ্রহ প্রকাশ করা, একান্ত ব্যক্তিগত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো স্পর্শ করতে চাওয়া, অন্য শিশুদের সঙ্গে প্রাইভেট পার্ট নিয়ে খেলা করতে চাওয়া, অনবরত অন্যদের দরজায় উঁকি দেওয়া, ব্যক্তিগত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রদর্শন, শরীর থেকে তীব্র কটু গন্ধ বের হওয়া, মুখের চারপাশে ঘা, প্রাইভেট পার্টে আঁচড়, কালশিটে বা রক্তপাত; বুকে, পেছনে, তলপেট ও রানে আঁচড় বা কালশিটে দাগ পড়া, উদ্বেগপূর্ণ আচরণ, কোনো কিছু গোপন করে রাখার প্রবণতা, বিছানায় ঘুমাতে যাওয়ার সময় পুরো দেহ ঢেকে রাখার মতো পোশাক পরা, বিছানা নোংরা করা বা ভিজিয়ে ফেলা, আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন, যেমন শান্ত শিশু থেকে হঠাৎ-ই রাগী শিশুতে পরিণত হওয়া, ক্ষুধার অনুভূতি বদলে যাওয়া, বিশেষ কোনো ব্যক্তির জায়গায় বা তৎপরতায় যেতে না চাওয়া, ইত্যাদি কোনো শিশুর মধ্যে দেখা গেলে শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

এরকম হলে কী করা উচিত? রাগারাগি করা? আপনাকে আগে বলেনি বলে চিৎকার করা? না, তাতে বরং বাচ্চাটা আরো ভয় পেয়ে যাবে। দোষ তো মা-বাবার। বে-দ্বীন মানুষে পৃথিবী ভরপুর। তাছাড়া ধর্ষকদের ধর্ম নেই। সুতরাং দ্বীন-ধর্মের ধোহাই দিয়ে বাচ্চাকে বাঁচানো যায় না। বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন পূর্ব থেকেই সতর্কতা। আপনার অসতর্কতার কারণে যদি সন্তান নিপীড়িত হয় তবে শিশুকে বকা দেওয়া নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা ছাড়া আর কিছু না। শিশুর ধমক নয়, প্রয়োজন মমতার। কোনো রকম গিলটি ফিল না করিয়ে তাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা উচিত। সে যেন ঘাবড়ে না যায় এমনভাবে পুরো ব্যাপারটা সামাল দেওয়া উচিত এবং তাকে সুন্দরভাবে বাঁচার ব্যাপারে পুনরায় আশ্বস্ত করে তোলা উচিত। সাথে সাথে অপরধীর ব্যাপারে আশেপাশের সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে তার ব্যাপারে সবাই মিলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আজকাল তো হাতের কাছেই ভিডিও ক্যামেরা। চাইলেই প্রমাণও সংগ্রহ করা যায়। অনেকেই মুখ চেয়ে কিছু বলে না, অথবা নিজেদের বদনাম হবে বলে চুপ থাকে। সে নতুন করে অন্য কারো সাথে অপরাধ করে। আর এভাবেই পৃথিবীতে অপরাধ বাড়তে থাকে।

প্রতিটা অপরাধ নির্মূলের জন্য সর্ববপ্রথম নিজেকেই সতর্ক থাকতে হবে, নিজেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আপনার আশেপাশে এমন কোনো ঘটনা ঘটুক অথবা না ঘটুক পেডোফিলদের ব্যাপারে আগে থেকে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করা প্রত্যেক বাবা-মার দায়িত্ব।