“বিছানার তলে কে রে! ওরে বাবা, তাড়াতাড়ি ঘুমাই।”, “ওরে বাবা, বারান্দায় কিসের যেন শব্দ! ঘুমাও ঘুমাও।” এই জাতীয় নানা ধরণের কথা বলে আমরা আমাদের বাচ্চাদেরকে ভয় দেখাই। আমি বুঝি আমরা অনেক সময় কতটা অসহায় না হলে আমাদের প্রিয় সন্তানকে ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াই বা খাবার খাওয়াই। সব সময় অসহায় হয়েই যে করি, তাও নয়। আমরা অনেকেই বুঝিই না এমনটা করা কতটা ক্ষতিকর! কিন্তু কখনই কি একটু ভেবে দেখেছেন, এই সামান্য ভয় তাদের ভেতর কিভাবে কাজ করছে? ভাবেননি নিশ্চই। আসুন একটু ভেবে দেখা যাক।

আমরা সাধারণত তখন থেকেই আমাদের শিশু সন্তানকে ভয় দেখাই যখন থেকে সে ‘না’ বলা শেখে বা জিদ দেখায় বা খাবার খেতে চায় না, ঘুমাতে চায় না ইত্যাদি। তার মানে, যখন কিনা তার বয়স এক-দেড় বছর, আর সম্ভবত এই ভয় দেখানো চলতে থাকে ৪-৫ বছর বয়স পর্যন্ত। আর সম্ভবত ৬-৭ বছর বয়স থেকে ভয় দেখানোর সাথে সাথে ধমক ও মাইরও চলে।

আসুন দেখা যাক সুনাতার মতো শিশুকে আমরা কিভাবে ভয় দেখিয়ে খাওয়াই বা ঘুম পাড়াই।

- বিছানার তলে কে রে! ওরে বাবা, সুনাতা তাড়াতাড়ি ঘুমাও।

- ওরে বাবা, বারান্দায় কিসের যেন শব্দ! এই সুনাতা জলদি ঘুমাও ঘুমাও।

- এ–ই—–চো–খ—ব–ন্ধ– ক–রো, নইলে আমি কিন্তু ঐ বুড়িকে ডা–ক দে–বো। ইত্যাদি

বাচ্চার কথা ভুলে যান কিছুক্ষণের জন্য। ধরে নিন, আপনি প্যারালাইজড একজন মানুষ, বিছানায় শুয়ে আছেন, আর আপনি বুঝতে পেরে গেছেন যে আপনার বিছানার নিচে দু’জন ডাকাত আশ্রয় নিয়ে বসে আছে। আপনার ঘরের লোকজন বাইরে গেলেই ওই দু’জন নিচ থেকে বের হয়ে আসবে। হয় আপনাকে ওরা মেরে ফেলবে বা আহত করবে আর তারপর লুটপাট করবে। আপনি প্যারালাইজড, আর তাই আপনি ডাকাতের উপস্থিতির কথা বলতেও পারছেন না ঘরের মানুষকে। একবার ভেবে দেখুনতো ঐ সময়টায় আপনার কেমন লাগবে! আপনি মনে মনে চিৎকার করে আপনার পরিবারের লোকদের বলছেন, ‘তোমারা ঘর থেকে বের হবা না। তোমরা আমাকে ঘর থেকে বের করো। বিছানার নিচে ডাকাত আছে।…’ আপনি আরো ভাবছেন, ‘একটু পরেই ওরা হয়তো আমাকে মেরে ফেলবে, আমার মৃত্যু হবে…’

কেমন লাগল এই কথাগুলি ভাবতে? যদি শিহরণ বোধ না করেন তবে আরেকবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন। যদি তাও শিহরণ বোধ না করেন তবে এবার ভাবুন ওই প্যারালাইজড মানুষটার জায়গায় আপনার বাচ্চা শুয়ে আছে। আর সত্যি সত্যিই বিছানার নিচে আছে এক ছেলে ধরা। যে কিনা বাচ্চা ধরে নিয়ে যায়। আপনি আপনার বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে হয়ত গোসল করতে যাবেন আর এরই মাঝে ওই ছেলে ধরা বের হয়ে আপনার বাচ্চাকে নিয়ে উধাও। (কি ভয়ংকর!), এবার কি শিহরণ বোধ করলেন?

তবে কেন আমরা আমাদের শিশুকে এমন ভয়ংকর ভয় দেখাই যেটা বাস্তবে ঘটলে নিজেই সহ্য করতে পারব না? দেখুন, যে বাড়িতে আমরা আমাদের প্রিয় সন্তান নিয়ে বাস করছি, সেই শিশু সন্তানকেই ভয় দেখাচ্ছি যে বিছানার নিচে ছেলে ধরা আছে, ভুত আছে। আবার এটাও বলে দিচ্ছি যে ছেলে ধরা ধরে নিয়ে যায়। আপনার কি ধারনা এই সকল ভয়ে আমাদের বাচ্চারা তাড়াতাড়ি ঘুমায়? একদম মিথ্যা ধারণা। উপরে যে ডাকাতের উদাহরণ দিলাম, তখন কি আপনার ঘুম আসত/এসেছিল? তবে ভয় পেলে কেন আমাদের বাচ্চারা ঘুমাবে বলুন?

এবার দেখা যাক শিশুটির মনে কী ভাবনা হয়, যখন আমরা এভাবে ভয় দেখাই। সে চরম আতংকিত হয়! সে ভয় পেতে থাকে তার ঘরকে! সে ভয় পায় তার বিছানাকে! সে তার বাসাকে নিরাপদ মনে করে না! শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাকে! মা ঘুমাতে বলে কিন্তু তার ভয় কমে না! সে ভয়ে থাকে যে, ঘুমিয়ে গেলেই মা উঠে ঘরের কাজে যাবে, আর তখন ছেলে ধরা তাকে ধরে নিয়ে যাবে! এই সব ভাবতে থাকে আর ভাবতেই থাকে। আর এই সব ভাবতে ভাবতে একটা পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে সে ঘুমিয়ে যায়। সে স্বপ্নেও ছেলে ধরাকেই দেখে। ভয়ের স্বপ্ন দেখে! ঘুম ভাঙলে যখন দেখে পাশে কেউ নেই ভয়ে কান্না করে! কারণ তার মনে পড়ে যায় যে, বিছানার নিচে হয়ত ছেলে ধরা আছে।

একবার চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন, এই আমি আপনি একটা সন্ত্রাসীর মতো আচরণ করি আমাদের প্রিয় সন্তানদের সাথে! তাকে বারে বারে ভয় দেখিয়ে আমরা বুঝিয়ে দিচ্ছি যে, এই ঘর নিরাপদ নয় তোমার জন্য, এই বিছানা নিরাপদ নয়, এই আমিও দুর্বল ওই ছেলেধরাকে বা ভুতটাকে তাড়াতে (মানে সন্তানকে বুঝিয়ে দিলাম যে তোমার মা-বাবাও দুর্বল মানুষ)| ভয় দেখিয়ে সন্তানকে বুঝিয়ে দিচ্ছি যে তুমিও আমার মতই দুর্বল হও সোনামণি। একই ভয় বারে বারে দেখিয়ে আমরা বুঝিয়ে দেই যে ঘরের ছেলেধরা তাড়াতে পারিনি, তাড়ানো যায় না। আর তাই শিশুটাও বুঝে যায়, আমার মা-বাবাই যাকে তাড়াতে পারেনি আমি কেমন করে পারব! আর ঠিক এভাবেই আমরা ওর সাহসে পর্দা টেনে দেই। বাঁধা দেই ওর বিকাশের, স্বাধীনভাবে চিন্তা করার। আমরা শুধুই আমাদের একটু আরামের জন্য আমাদের প্রিয় সন্তানকে এমন বীভৎস ভয় দেখাই! ভয় দেখাই দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, বছরের পর বছর।

আপনরা কেউ কেউ হয়ত হেসে বলবেন, আমাদের মা-বাবাও তো ভয় দেখিয়েছিল ছোট বেলায়, আমরা তো ভীতু হইনি বা বড় হয়ে বুঝে গেছি যে ওসব নিছক একটু ভয় ছিলো। কই, সমস্যা তো হয়নি। তাই যদি একটু প্রয়োজনে আমাদের সন্তানকেও ভয় দেখাই, সমস্যাটা কোথায়?

আমি একদম সঠিক উত্তর না দিতে পারলেও একটু চেষ্টা করব ভিন্নভাবে উত্তর দেবার। আপনারা অনেকেই হয়তো জেনেছেন যে একটা শিশুর সবচেয়ে বড় বিকাশ নাকি প্রথম ৫ বছরের মাঝেই হয়। আর এই প্রথম ৫ বছর বয়সটাই যদি একটা শিশু ভয়ভীতি, মাইর, বকাঝকা, গালাগালি, জোরাজুরি, অবহেলার মাঝে বড় হয় তবে তার বিকাশের কি অবস্থা হবে বলুন?

দু’টি ঘটনা শেয়ার করি।

১ম ঘটনা: যখন ওদের বয়স ৫, হঠাৎ আমার যমজ বাচ্চা-দু’টি নাইট গার্ডের বাঁশির শব্দকে ভয় পেতে থাকে। ঘুমাতে গেলে প্রচন্ড ভয় পায় বাঁশির শব্দ শুনে। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কেন? ওদের মাও নাইট গার্ডকে ভয়ংকর কিছু বলে উত্থাপন করেনি ওদের কাছে। নানা গল্পের দ্বারা অনেক চেষ্টা করেছিলাম যে নাইট গার্ড আসলে কতো ভালো মানুষ। নাইট গার্ড কতো কষ্ট করে আমাদের কি উপকার করে, সেগুলি বোঝালাম। তাও কাজ হচ্ছিলো না। শেষে এক নাইট গার্ডের সাথে দেখা করিয়ে দিলাম। ভয় কমতে থাকে। একদিন আবিষ্কার করলাম আমার ঘরের গৃহ পরিচারিকা ওই ভয়টি দেখিয়েছিল। জানি না সে কতোটা ভয়ংকর কিছু বলেছিলো।

আমার বাচ্চারা বলত ওরা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে। ওরা ঘুমাতে চাইত না। প্রায় প্রতি রাতই খুব কষ্ট করে ওদের ঘুম পাড়াতে হয়েছে। চিন্তা করে দেখুন, একটা মানুষ (তাও একটা শিশু) রাত হলেই ভয় পায়, তার নিজের ঘরেই ঘুমাতে চায় না সে, তাও একরাত নয়, দুই রাত নয়, প্রতি রাতেই তার একই ভয়। কি ভয়ংকর, তাই না?

২য় ঘটনা: আমার সহকর্মী মনিরুল ইসলাম। তার আপন ছোট ভাইয়ের জীবনে কী ঘটেছিল তা তার কথাতেই শুনুন। (নিচের লেখাটুকু মনিরুল ইসলামের) শিশুদেরকে অকস্মাৎ ভয় দেখানো যে কত বড় অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হতে পারে তা বোধহয় আমার পরিবারের চেয়ে ভালো কেউ জানে না।

আপনারা হয়ত মৃগী (epilepsy) নামক ভয়াবহ রোগের নাম শুনেছেন যার পরিণতি হয় বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অকালে মৃত্যু। আমার ৫ বছরের ছোট ভাইয়ের রোগটি যখন ধরা পড়ে, ডাক্তার বলল এটা অনেকটা বংশগত রোগ। জানতে চায় আমাদের বংশে কারো এই রোগ আছে কি না? না, আমাদের বংশে কারো এই রোগ ছিলো না। তারপর উনি জানতে চাইলেন গত কয়েক বছরে বাচ্চাটি কি কোন ভয়ংকর কিছুর সম্মুখীন হয়েছিল যা দেখে সে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল?

হ্যাঁ, হয়েছিল। একবার আমাদের গৃহ পরিচারিকা তাকে নিয়ে খালের পানিতে খেলার সময় হঠাৎ উপর থেকে ছেড়ে দিয়েছিল, সেদিন সে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। ডাক্তার ধারণা করছিলেন সেখান থেকেই হয়তো রোগটির জন্ম। এরপর আমরা তাকে দেশের অনেক স্বনামধন্য নিউরোলজিস্টকে দেখাই, এক পর্যায়ে (টানা ৭ বছর চিকিৎসার পর) সে ভালও হয় কিন্তু এতদিন তাকে বাইরের জগত থেকে আলাদা থাকতে হয়েছে বলে, এখন সে ২২ বছরের যুবক হয়েও ১২-১৪ বছরের কিশোরের মতো তার আচরণ।

বাচ্চাকে ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকুন। আর তার চেয়ে বড় কথা এই যে, ভয় না দেখিয়েও সমস্যা সমাধানের উপায় আছে। তাহলে কেন এমন নিষ্ঠুর উপায় বেছে নেয়া, বোকার মতো, বুঝি না।


নভেম্বর 25, 2010