আধুনিক বস্তুবাদী প্যারাডাইম এবং ইসলামের অবস্থানের মধ্যে মৌলিক অনেক পার্থক্য আছে। এই দুই অবস্থানের মধ্যে সংঘাত তাই অবধারিত হয়ে দাঁড়ায়। মুসলিম হিসেবে এসব সংঘাত এবং সংকটের মোকাবেলা আমাদের করতে হয়। এই সংঘাত আমাদের সামনে আসে বিভিন্ন প্রশ্ন কিংবা দ্বন্দ্বের আকারে। কিন্তু মূল সমস্যার জায়গাটাতে আমরা মনোযোগ দেই না। সাধারণত আমাদের অ্যাপ্রোচ থাকে কেইস বাই কেইস বেইসিসে এই সংকটগুলোর মোকাবেলা করার।

“বিজ্ঞান ওটা বলেছে কিন্তু কুরআনে এটা আছে। নাস্তিকরা এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এর জবাব কী?”

“আমার এক বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছে, মাদার তেরেসা অনেক ভালো মানুষ, সে কেন জাহান্নামে যাবে? এই প্রশ্নের জবাব কী?”

“ইসলামে পুরুষকে চার বিয়ে করার অনুমতি কেন দেয়া হয়েছে? এটা কি অধিকারক্ষুণ্ণ করা হলো না?”

“ইসলামে চোরের শাস্তি হিসেবে হাতকাঁটা, ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করার বিধান আছে। এগুলো কি অমানবিক না?”

প্রশ্ন করার সময় আমরাও প্রশ্নগুলো এভাবে করি। আর উত্তরগুলোও এভাবে আসে, প্রতিটা প্রশ্ন নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা মৌলিক একটা ব্যাপার এড়িয়ে যাই। দেখুন ওপরে আমি যে প্রশ্নগুলো আনলাম, এগুলোর সবগুলোর মধ্যে কিছুটা অন্তর্নিহিত বিশ্বাস আছে। কিছু অবস্থানকে স্বতঃসিদ্ধ বা স্বপ্রমাণিত হিসেবে ধরে নেয়ার পর এই প্রশ্নগুলো করা হয়েছে। ইসলামের অবস্থানকে জাস্টিফাই করতে শুরু করার আগে, আমাদের এই অন্তর্নিহিত বিশ্বাসগুলোকে যাচাই করে দেখা দরকার। এই বিশ্বাসগুলোকে আমরা গ্রহণ করবো কি না, সেই সিদ্ধান্তেও আসা দরকার। তারপর নাহয় ইসলামের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করার কথা আসবে।

যেমন ধরুন, বিজ্ঞানের কোন অবস্থানের সাথে ইসলামের সংঘাত নিয়ে যখন বলা হচ্ছে, তখন ধরে নেয়া হচ্ছে বিজ্ঞান চূড়ান্ত সত্য। বিজ্ঞান যা বলে তা সর্বদা ১০০% সঠিক। কোন কিছু বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে সেটা সত্য হতে পারেনা। বিজ্ঞান সুনিশ্চিত জ্ঞান দেয়।

ভালো মানুষ কেন জাহান্নামে যাবে, এই প্রশ্ন করার সময় ‘ভালো মানুষ’ এর একটা সংজ্ঞা ধরে নেয়া হয়েছে। উত্তর দিতে হলে আগে দেখতে হবে সেই সংজ্ঞা সঠিক কি না। আগে আমাদের ‘ভালো মানুষ’ এর সংজ্ঞা এবং মাপকাঠি ঠিক করতে হবে। ভালো এবং মন্দের সংজ্ঞাও ঠিক করতে হবে।

পুরুষের জন্য চার বিয়ের সুযোগ থাকা, উত্তরাধিকারে ছেলে এবং মেয়ের অংশ ভিন্ন হওয়া বা এধরনের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে অধিকারের ব্যাপারে প্রশ্ন আনলে আগে ঠিক করে নিতে ‘অধিকার’ এর কোন সংজ্ঞা এবং মাপকাঠি গ্রহণ করা হচ্ছে? অধিকারের অনেক অর্থ হয়। অনেক মাপকাঠি হয়। বিভিন্ন সংজ্ঞা এবং মাপকাঠি একে-অপরের সাথে সাংঘর্ষিকও হয়। প্রশ্নকারী কোন মাপকাঠি গ্রহণ করেছেন? আর মুসলিম হিসেবে আমরা কোনটা গ্রহণ করবো?

হুদুদ বা ইসলামী দন্ডবিধানের ব্যাপারে যখন মানবিকতার জায়গা থেকে আপত্তি আনা হবে, তখনো আমাদের দেখতে হবে মানবিকতা বলতে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে? মানবিক-অমানবিকের সীমারেখা নির্ধারণ কীসের ভিত্তিতে হবে? কে এগুলো ঠিক করে দেবে?

দেখুন, আপাতভাবে সাধারণ মনে হলেও, এই প্রতিটি প্রশ্নের ভেতরে, প্রতিটি প্রশ্নের পেছনে মেটাফিযিকাল কিছু ক্লেইম আছে। কিছু বিশ্বাস আছে। প্রশ্নগুলো করার আগে জ্ঞানের উৎস, ভালো মন্দের সংজ্ঞা, অধিকারের মাপকাঠি, মানবিক-অমানবিকের সীমারেখার মতো বড় বড় বিষয়ে কিছু নির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে। যে অবস্থানগুলো সংশয়পূর্ণ। জ্ঞানের একক ও চূড়ান্ত উৎস হিসেবে বিজ্ঞানের অবস্থান স্বপ্রমাণিত কিংবা স্বতঃসিদ্ধ না। নৈতিকতা, মূল্যবোধ, অধিকার এগুলো দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা সংক্রান্ত বিষয় না। এগুলো মাপা যায় না, ওজন করা যায় না। এই অবস্থানগুলো ঔচিত্যবোধের সাথে জড়িত। বিশ্বাসের সাথে জড়িত। জ্ঞানের ধরণ, অস্তিত্বের ধরনের মতো বিষয়ের সাথে জড়িত। এসব ব্যাপারে গত কয়েক শ’ বছর ধরে নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলের কিছু মানুষ, কিছু ধারণাকে ধ্রুব সত্য হিসেবে গ্রহণ করে নিলেই, আমরা সেটা মেনে নিতে বাধ্য না।

লক্ষণীয় বিষয় হল এই প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের অবস্থান আর আধুনিক বস্তুবাদী সভ্যতার অবস্থান আলাদা। ইসলাম মানবীয় যুক্তি, চিন্তা এবং বিজ্ঞানকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে চূড়ান্ত এবং সুনিশ্চিত জ্ঞানের উৎস একটিই

তা হচ্ছে ওয়াহি

অন্যদিকে বস্তুবাদী সভ্যতা ওয়াহিকে অস্বীকার করে। যদি অস্বীকার নাও করে, তাহলে কমসেকম অপ্রাসঙ্গিক মনে করে।

একইভাবে ভালোমন্দের সংজ্ঞা আল্লাহ ঠিক করে দিয়েছেন। যে মাপকাঠি অনুযায়ী সবচেয়ে বড় অপরাধ হল শিরক এবং কুফর। সবচেয়ে বড় কল্যাণ হল তাওহিদ ও ঈমান। এই মাপকাঠি না বুঝলে সেলিব্রিটি কিংবা প্রভাবশালীর মৃত্যুতে শোক জানানো হালাল না হারাম সেটা বুঝিয়ে খুব একটা লাভ নেই। একই কথা প্রযোজ্য অধিকার এবং মানবিকতার ব্যাপারে। এই বিষয়গুলো মানবজাতির সৃষ্টিকর্তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সেটা বাদ দিয়ে আমরা কেন সৃষ্টির বানানো মাপকাঠি গ্রহণ করবো?

কাজেই ইসলাম নিয়ে সংশয়, কিংবা ইসলামের কোন দিক নিয়ে এ ধরনের প্রশ্নগুলোর মূল উৎস হল আধুনিক বস্তুবাদী প্যারাডাইমের সাথে ইসলামের অবস্থানের দ্বন্দ্ব। এরকম প্রশ্নের যতোই উত্তর দেয়া হোক না কেন, যতোক্ষণ এই দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করা হবে না, ততোক্ষণ প্রশ্ন আসতেই থাকবে। কারণ আমাদের মধ্যে এই দুই প্যার‍্যাডাইমের সংঘাত চলছে। একদিকে আমরা নিজেদের মুসলিম হিসেবে চিন্তা করছি। অন্যদিকে আমরা আধুনিকতার সন্তান। আধুনিক বস্তুবাদী সভ্যতার অন্তর্নিহিত চিন্তাগুলো আমাদের প্রভাবিত করেছে। আমরা বুঝে না বুঝে এই কাঠামোর ভেতরেই চিন্তা করতে শিখেছি। আমাদের নিশ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে সাথে, আমাদের যাপিতজীবনের সাথে সাথে আমরা আধুনিক সভ্যতার বস্তুবাদী ধ্যানধারণাগুলো শুষে নিয়েছি। অথচ ঐতিহাসিক বাস্তবতা হল এই ধ্যানধারণগুলোর মধ্যে অনেকগুলো এসেছে নাস্তিক্যবাদী কিংবা কমসেকম সংশয়বাদী দর্শনের জায়গা থেকে।

এসব প্রশ্ন, এসব সংশয় এবং সন্দেহের মোকাবেলা করতে হলে আমাদের এর উৎসকে চিনতে হবে। এর শেকড়ের দিকে তাকাতে হবে। প্রশ্ন করতে হবে সেক্যুলার-লিবারেল চিন্তার কাঠামোর ফার্স্ট প্রিন্সিপালসগুলোকে। ‘তোমার মাপকাঠি আমি কেন মেনে নেবো?’—এই প্রশ্ন করতে শিখতে হবে। এবং সাধারণ মুসলিমদের সামনে এই মাপকাঠির ভুলগুলো তুলে ধরত হবে। যতোক্ষণ এটা করা হবে না, ততোক্ষণ সন্দেহ তৈরি হতে থাকবেই। প্রশ্ন আসতে থাকবেই।