সাফল্য কিংবা সফলতা মানব জীবনের এমন একটা অবস্থা যাকে পাওয়ার জন্য আমরা সবাই হন্যে হয়ে দিনরাত দৌড়াচ্ছি। ছোটবেলা থেকে আমাদের প্রত্যেকটি মানুষকে এভাবেই মানসিক ট্রেনিং দিয়ে বড় করা হয়েছে যে, জীবনে সফল হতেই হবে। ব্যর্থতার কোন মূল্য নেই, ব্যর্থ মানুষ জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন মানুষ। অক্সফোর্ড ডিকশনারি সফলতার সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে-

Success may refer to: Attainment of higher social status. Achievement of a goal, for example academic achievement. The opposite of failure.

বাংলা করলে দাঁড়ায়- উচ্চতর সামাজিক মর্যাদা অর্জন, নিজের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন। পার্থিব জীবনের বিভিন্ন সময়ে ও পর্যায়ে সফলতার কিছু প্যারামিটার আছে। আবারো বলে নেই, এগুলো আমাদের পৃথিবীর জীবনের প্যারামিটার, এগুলো আমাদের মতন মানুষেরাই বানায় এবং নিয়ন্ত্রন করে। এবং আমরা অধিকাংশ মানুষই পুরোপুরি নিশ্চিত যে এগুলোই সফলতার মাপকাঠি। এক নজর দেখে নিন।

  • পড়াশুনা, ডিগ্রী, উচ্চতর পড়াশুনা
  • টাকা, আরো টাকা, আরো অনেক টাকা। যত কোটি টাকা তত বেশি সফলতা।
  • ভাল চাকরি, ভাল বেতন
  • জীবনযাত্রার উচ্চমান। বিদেশে প্রতিষ্ঠিত জীবন।
  • প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা
  • প্রতিষ্ঠানে ভাল পজিশন
  • ক্ষমতা। সরকারি, সামরিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অপরাধমূলক, সন্ত্রাসী, মাফিয়া যেকোন ধরনের ক্ষমতা।
  • বাড়ি, গাড়ি, জমির মালিক হওয়া
  • খ্যাতি, জনপ্রিয়তা অর্জন। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। জনপ্রিয় খেলোয়াড়।
  • সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন। ফলোয়ার, ফ্যান, ভেরিফাইড একাউন্ট।
  • বংশ মর্যাদা
  • সম্পর্ক। সন্তান, স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা।
  • শারীরিক ক্ষমতা, সৌন্দর্য। অন্য মানুষকে আকৃষ্ঠ করার মতন রূপ/গুণ।

প্রতিটি মানুষের বুদ্ধি, চিন্তা, মেধা, ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, রুচি, জীবনের লক্ষ্য আলাদা। কাজেই এই লিস্টের বিষয়গুলো একজন শিক্ষিত মানুষের জন্য একভাবে উঠানামা করবে, একজন গরীব রিকশাওয়ালার জন্য আরেকভাবে, একজন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড়, গায়ক কিংবা সন্ত্রাসীর জন্য সম্পূর্ণ আরেকভাবে। জীবনে চলার পথে যেকোন সৎ/অসৎ উপায়ে উপরের সবকটি বা অধিকাংশ অর্জন করতে পারার নামই হচ্ছে পার্থিব সফলতা।

ছাত্রজীবনে সফলতা হচ্ছে ভাল স্কুল, ভাল রেজাল্ট, জিপিএ ৫, ভাল কলেজ/ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়া। তাই আমরা ৩-৪ বছর থেকেই এই সাফল্যযুদ্ধ শুরু করি। স্কুলে ভর্তি হই। একটার পর একটা ক্লাস পার করি। ১৫-১৬ বছর ধরে বাবা-মা ও নিজেরা সংগ্রাম করে জিপিএ ৫ পাই। এই লম্বা সময়ের মধ্যেই আমাদের ব্রেইন আরো অনেক ধরনের জটিল খুঁটিনাটি তথ্য বিশ্লেষণ করতে শিখে যায়। সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা থেকে আমাদেরকে শিখান হয় যে, সরকারি জায়গায় কেবলমাত্র “ভালরা” চান্স পায়, আর যারা অত “ভাল” না তারা প্রাইভেট এ টাকা দিয়ে পড়ে। তাই এবার আমরা এই সফলতার পিছে দৌড়াই, কারণ এটা হচ্ছে উচ্চতর সামাজিক মর্যাদা অর্জন, উপরের সংজ্ঞার মধ্যেই আছে। আমাদের ও আমাদের বাবা-মায়ের শিক্ষিত ব্রেইনগুলো এমনভাবে কন্ডিশন্ড হয়ে গেছে যে যতক্ষন সবাইকে বলতে না পারব- "আমার ছেলেটা বুয়েটে, মেয়েটা ঢাকা মেডিকেলে, আরেক ছেলে আইবিএ তে আছে…" – ততক্ষন আমরা নিজেদের সফল ভাবিনা। এরপরে সেই ভাল কিংবা খারাপ জায়গা থেকে সফলভাবে পাশ করে আমরা বের হই। এরপর পেশাগত জীবনে ঢুকি।

যদি আমরা ডাক্তার হই, আমরা সফলতার জন্য ঠিক কি চাই? ডাক্তার হিসেবে বাংলাদেশে সফলতার রাস্তাটা খুব সহজ না। আমরা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রীর পিছনে বছরের পর বছর কষ্ট করি। অনেকের হয়, অনেকে হাল ছেড়ে ঝরেও যায়। আমরা সরকারি চাকরি চাই। নিজের মনমত জায়গায় পজিশন চাই, প্রোমোশন চাই। চাইলেই কি হয়, তাও মজার দেশ বাংলাদেশে? তখন আমরা অনেকেই বাধ্য নিরুপায় হয়ে বিশেষ কোন দলের সাথে উঠাবসা করা শুরু করি, দলীয় প্রোগ্রামে নিয়মিত হাজিরা দেই, নেতাদের তেল দেই। তো একদিন আমরা এগুলোও পেয়ে যাই। এরপর আমরা চেম্বার জমাই, রোগী জমাই, বিভিন্ন কনসাল্টেশন সেন্টারে বসি। এইভাবে কয়েক দশক ধরে টাকাপয়সা, খ্যাতি, প্রমোশন, পাবলিকেশন, সেমিনার ইত্যাদি অর্জন করে আমরা একদিন সমাজের চোখে “বড় ডাক্তার” হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেই। আর পরকালের জন্য আদৌ কিছু অর্জন নিয়ে যাই কিনা সেটা আসলে বলা খুব মুশকিল।

নিজে পেশায় ডাক্তার, তাই ডাক্তারদের জীবন খুব ভাল করে দেখি। কিন্তু আসলে সব পেশাতেই কমবেশি একই অবস্থা। অধিকাংশ মানুষই জীবনপূজা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। ৬০-৭০ বছরের পুরো জীবনটাই আমরা দিয়ে দিচ্ছি কিভাবে ভাল থাকা যায় তার পিছনে। যদি আমাদের একটা প্রস্তাব দেওয়া হয় যে, দেশে আর মাত্র ২ বছর থাকার পরই সপরিবারে ৩০ বছরের জন্য লন্ডন, কানাডা, সুইডেন কিংবা অ্যামেরিকায় আমরা থাকতে পারব, তাহলে কোন দেশের জীবনের জন্য আমরা বেশি সিরিয়াসলি কাজ করতাম? জীবন শেষে চাওয়া-পাওয়ার, অর্জনের হিসেব মেলাতে গিয়ে আমরা দেখি যে, আখিরাতের একাউন্ট বড়ই হালকা, বড়ই দূর্বল। তাতে নেই আল্লাহ-সচেতনতা (তাক্বওয়া), সালাত, কুর’আন, নেই সিনসিয়ারিটি, নেই আত্মসমর্পণ। আছে কিছু লোক দেখানো সামাজিক ধর্মীয় রীতিনীতি, কিছু নিম্নমানের দায়সারা জুম্মার নামাজ। এই নিয়ে আমরা চলে যাই এমন এক জীবনে যেখানে থাকতে হবে হাজার হাজার বছর, যেখানে সময় সীমাহীন। আমাদের হিসাবনিকাশ অতি হাস্যকর, ভীতিকর, আত্মবিধ্বংসী

পৃথিবীতে কখন মানুষ নিজেকে সফল মনে করে, কিংবা অন্যকে সফল মনে করে? Successful people in History লিখে সার্চ দিলে আপনি অনেক মানুষেরই তালিকা পাবেন। উপরে একবার বলেছি, আবারো বলি, এই তালিকা আমরা মানুষরাই তৈরী করি, এবং আমরা মানুষরাই তাদেরকে অনুসরণ করি, তাদের মতন হবার চেষ্টা করি। কয়েকটা দিলাম-

Business- Bill Gates, Larry Page, Steve Jobs
Authors- JK Rowling, Stephen King
Music- John Lennon, Michael Jackson
Arts- Stephen Spielberg
Sports– Pele, Messi, Ronaldo, Bolt, Federer
Politics- Nelson Mandela
Religion- Pope Francis

এগুলো মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গি। যিনি মানুষকে বানিয়েছেন, তার অণু পরমাণু ডিজাইন করেছেন তিনি খুব ভাল করেই মানুষের এই স্বভাব জানেন। যেহেতু তিনি জীবিত, সর্বজ্ঞানী একজন সত্ত্বা, তিনিও তাঁর বই কুর’আনে সফলতা সম্পর্কে তাঁর মতামত দিয়ে দিয়েছেন। তিনি ভাল করেই জানেন, কিছু মানুষ যেমন পার্থিব জীবনকে আঁকড়ে ধরবে, তেমনি কিছু মানুষ তাঁর দেওয়া সফলতার সংজ্ঞাকেও একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আল্লাহ কাউকে কখনোই জোর জবরদস্তি করেন না, তিনি প্রত্যেককে তাঁর বিচারবুদ্ধি স্বাধীনতা নিয়ে বেঁচে থাকতে দেন। তিনি শুধু দেখেন কে কি করে। কে বুদ্ধি খাটায় আর কে খাটায় না। কে জীবনের ধোঁকায় পরাজিত হয়, আর কে এই মরীচিকাকে পাশ কাটিয়ে আসল সত্য দেখতে পারে।

কুর’আনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেকগুলো সূরার অনেক জায়গাতেই আল্লাহ সাফল্য, সফলতা, মহাসাফল্য এই তিনটি বিষয় নিয়ে বলেছেন। দেখা যাক আল্লাহ পৃথিবীর জীবনকে কিভাবে মূল্যায়ন করেছেন।

পৃথিবীর জীবন

"তোমরা জেনে রাখো যে পার্থিব জীবনটা তো খেলাধুলাআমোদ-প্রমোদজাঁকজমকতোমাদের নিজেদের মধ্যে হামবড়াই এবং ধনদৌলত ও সন্তানসন্ততির প্রতিযোগিতা মাত্র। এটি বৃষ্টির উপমার মতো যার উৎপাদন চাষীদের চমৎকৃত করে, তারপর তা শুকিয়ে যায়, তুমি তখন তা দেখতে পাও হলদে হয়ে গেছে, অবশেষে তা খড়কুটো হয়ে যায়! আর পরকালে রয়েছে কঠোর শাস্তি, পক্ষান্তরে রয়েছে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে পরিত্রাণ ও সন্তষ্টি। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগবিলাস ছাড়া তো আর কিছু তো নয়। [৫৭ঃ২০]"

"Know that the life of this world is only play (la’ib) and amusement (lahw) and pomp/beauty (zeenah) and mutual boasting among you (tafaakhur), and Rivalry in respect of wealth and children.

(It is) as the likeness of vegetation after rain, thereof the growth is pleasing to the tillers; afterwards it dries up and you see it turning yellow; then it becomes straw.

But in the Hereafter (there is) a severe torment (for the disbelievers & evildoers), and (there is) forgiveness from Allâh and (His) Good Pleasure (for the believers). And the life of this world is only a deceiving enjoyment."

কুর’আনের এই এক আয়াতেই আমাদের পুরো জীবনের সারমর্ম আছে। মাত্র ৮-৯টি শব্দের ভেতর আল্লাহ আমাদের পুরো জীবনের প্ল্যানকে দিয়ে দিয়েছেন আমাদের জীবন হচ্ছে এরকম-

  1. শৈশবকাল। আয়াতটি শুরু হয়েছে খেলাধুলা (la’ib) দিয়ে, আর শিশুরা খেলাধুলা নিয়েই থাকে।
  2. কৈশোর। আমরা আরেকটু বড় হই আর নানারকম বিনোদনে নিজেদেরকে ব্যস্ত করে ফেলি। আয়াতের ২য় শব্দ হচ্ছে বিনোদন আমোদ-ফূর্তি (lahwun)
  3. তারুণ্য- যৌবনকাল। আরেকটু বড় হয়ে নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য, জাঁকজমক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আয়াতের ৩য় শব্দ হচ্ছে জাঁকজমক (zeenatun)
  4. তারপরে পেশাগত জীবন শুরু করি, আয় রোজগার শুরু করি। টাকা পয়সা হাতে পেয়ে নিজেদের মধ্যে লোক দেখানো প্রবৃত্তি চলে আসে। মানুষের সাথে শো-অফ করি, মানুষকে নিজের বাড়িগাড়ি জমি সন্তান ইত্যাদির বড়াই আর প্রতিযোগিতা করি (boasting – tafaakhur)। আয়াতটির শেষ বৈশিষ্ট্য ঠিক এই দুইটিই। (takaathur fi alamwaal wa al-aulaad)।

আর দুনিয়ার জীবন তো খেলাধুলা আর তামাশা ছাড়া আর কিছুই না। আর যারা আল্লাহর প্রতি সবসময় সচেতন থাকে ( তাক্‌ওয়া অর্জন করে) তাদের জন্য আখিরাতের বাসস্থানই সবচেয়ে উত্তম। তাহলে কেন তোমরা বুঝবে না, বুদ্ধি খাটাবে না? [৬:৩২]

আর দুনিয়ার এই জীবনটা আমোদ-প্রমোদ ও খেলাধুলা বৈ তো নয়। আর নিশ্চয়ই পরকালের আবাসই তো আসল জীবন। যদি তারা জানত! [২৯:৬৪]

নিঃসন্দেহে এই দুনিয়ার জীবন শুধু খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদ। আর যদি তোমরা ঈমান আনো ও ধর্মভীরুতা অবলন্বন কর তবে তিনি তোমাদের প্রদান করবেন তোমাদের পুরস্কার, আর তিনি তোমাদের থেকে তোমাদের ধনসম্পদ চাইবেন না। [৪৭:৩৬]

...

আজকের পৃথিবীতে খেলা, আমোদ, বিনোদনের এত বেশি প্রাচুর্য যে মানুষ এখন এইসবের নেশা থেকে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না। আগে বাবা মা চাইতেন সন্তান ইন্টারনেট শিখে একটু আধুনিক হোক, প্রযুক্তি শিখুক। আর বর্তমান সময়ে এসে মোবাইল আর ইন্টারনেটের আসক্তি থেকে সন্তানকে সরিয়ে রাখার জন্য বাবা মা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। আধুনিকতার নামে এ এখন নতুন এক ড্রাগস। টিভিতে শত শত চ্যানেল। খেলা, নাটক, সিনেমা, সিরিয়ালের কোন শেষ নেই। একটা শেষ হয়, ৫টা শুরু হয়। মানুষ পাগলের মতন খেলা দেখছে। খেলাই ত, নির্মল বিনোদন, তাইনা? আসলেই কি খুব নির্মল নির্দোষ?ক্রিকেটপাগল বা ফুটবলপাগল কাউকে চিনেন? দেখবেন তার জীবনের বিরাট বড় একটা সময় চলে যায় খেলার পিছনে। খেলা খেয়ে নিচ্ছে তার মূল্যবান সময়, ক্ষতি করছে তার আখিরাতের। নামাজের সময় চলে যায়, ওয়াক্তের পর ওয়াক্ত আযান হয়ে যায়, মুয়াজ্জিন ডাকতে থাকেন- "আসো নামাজের দিকে, আসো সফলতার দিকে" …কিসের কি? এরা টিভির সামনেই বসে থাকে। প্রতিটা বল বাই বল খেলা দেখতে হবে, ক্লাবের প্রতিটা খেলা লাইভ দেখতে হবে। যেন প্রতিটা বল লাইভ দেখার মধ্যেই জীবনের সকল সফলতা নিহিত। আর কিছুদিন পরপর যখন ওয়ার্ল্ড কাপ বা বড় কোন টুর্নামেন্ট হতে থাকে, তখন গোটা দেশের চেহারাই বদলে যায়। বাড়িতে বাড়িতে পতাকা উড়তে থাকে, মানুষের চুলের স্টাইল পরিবর্তন হয়ে যায়। মানুষ কাজ থেকে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে। নাস্তা, চিপস, আর হরেক রকম খাবারের আয়োজন করা হয়। রীতিমত উৎসব উৎসব আমেজ চারদিকে। খেলা নিয়ে যে পরিমাণ আগ্রহ আর উত্তেজনা মানুষের, তার ১% ও আখিরাত নিয়ে আছে? কখনো কি একবারো চিন্তা হয় যে এইগুলো ক্ষনিকের তামাশা, ফূর্তি আর বিনোদন ছাড়া আর কিছুই না?

এভাবে যারা খেলার ধোঁকায় পড়ে থাকে, তাদের জন্য কঠিন সাবধানবাণী হচ্ছে-

যারা পার্থিব জীবনের মোহ ও ধোঁকায় আচ্ছন্ন ছিলে, আর খেল-তামাশা, ফুর্তি ও বিনোদনকেই নিজেরদের ধর্মরূপে গ্রহন করেছিলে। অতএব আজকে আমি তাদেরকে সেভাবেই অবজ্ঞা করব, যেভাবে পার্থিব জীবনে তারা এই দিনের সাক্ষাতকে অবজ্ঞা করেছিল, আমার বিধিবিধানকে অস্বীকার করেছিল। [৭ঃ৫১]

সাফল্য [ফাওযুল আ’যীম]

আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই এক মহা সাফল্য অর্জন করল। [৩৩ঃ৭১]

অবশ্যই সাফল্য লাভ করবে যে আত্মশুদ্ধি অর্জন করবে। [আল-আ’লা ৮৭ঃ১৪]

কুর’আনে তাকওয়া, ঈমান, ভালকাজ, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য এই কাজগুলো বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। কারণ এইগুলো সবকয়টি সম্পর্কিত। আল্লাহর প্রতি ঈমান না থাকলে কখনোই আল্লাহর প্রতি সচেতনতা থাকবেনা। আবার আল্লাহর প্রতি নিয়মিত সচেতন না থাকলে ঈমানও দূর্বল হতে থাকবে। ঈমান আর তাকওয়া না থাকলে ভালকাজ করাও অসম্ভব, কারণ কোন কাজ ভাল আর কোনটা খারাপ তা আল্লাহ ও রাসূলের (সাঃ) মাধ্যমেই একমাত্র অনুমোদিত। কাজেই কেউ যদি সমকামীদের বিয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাকে ভাল কাজ করছে বলে ভাবে, সেটার আখিরাতে কোন মূল্য নেই। আল্লাহ ও রাসূলের (সাঃ) পথ অনুসরণ না করলে ভাল কাজ করাও সম্ভব না। আবার ভাল কাজ না করলে ঈমানও বজায় থাকবে না। ভাল-মন্দের মাপকাঠি মানুষ কখনোই নির্ভুলভাবে বের করতে পারবে না, কারণ মানুষ তর্কপ্রিয় প্রানী। এজন্য প্রয়োজন ঐশ্বরিক জ্ঞান বা ওয়াহী, যা কেবলমাত্র মানুষের স্রষ্টাই দিতে পারেন, কারণ তিনি মানবিক ত্রুটি হতে মুক্ত, এবং তিনিই মানুষের সবচেয়ে বড় কল্যাণকামী।

আল্লাহ বলছেন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই এক মহা সাফল্য অর্জন করল। কাজেই আল্লাহর চোখে এটা সাধারণ কোন সফলতা নয়, এটা মহাসাফল্য। এটা এমন এক বিরাট সম্মান আর অর্জন, যার পুরস্কার শুধু আখিরাতেই দেওয়া সম্ভব। সেই পুরস্কার হচ্ছে জান্নাত, আল্লাহর অনুগ্রহ, জাহান্নাম থেকে মুক্তি। মানব আত্মার সকল অতৃপ্তি, পিপাসা, সকল চাওয়া যেখানে গেলে মিটবে সেটাই জান্নাত। মানবজীবনের যাত্রা শুরু হয় মায়ের গর্ভ থেকে। জীবনকাল শেষ করে মৃত্যুর মাধ্যমে সেই যাত্রা অব্যাহত থেকে যায়। শরীর পচে যায়, আত্মা পদার্থের এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তর হয় মাত্র। মানব সত্তার এই যাত্রা অনন্ত অসীমকালের।

আর আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে তাদের সাফল্যসহ নাজাত দিবেন [৩৯ঃ৬১]

তোমার রবের পক্ষ থেকে অনুগ্রহস্বরূপ, এটাই তো মহাসাফল্য [৪৪ঃ৫৭]

আর যারা যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের রব পরিনামে তাদেরকে নিজ রহমতে প্রবেশ করাবেন। এটিই সুস্পষ্ট সাফল্য [৪৫ঃ৩০]

সফলতা, মহাসাফল্য

প্রতিটি প্রানী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করবে। আর অবশ্যই কিয়ামতের দিনে তাদের প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে দেয়া হবে। সুতরাং যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফলতা পাবে। আর দুনিয়ার জীবন তো শুধু ধোঁকার সামগ্রী। The present world is only an illusory pleasure. [৩ঃ১৮৫]

দুনিয়ার জীবন কেমন এটা বোঝাতে আল্লাহ কুর’আনে “মাতা / Maata” শব্দটি ব্যবহার করেছেন। মাতা শব্দটি আরবরা ব্যবহার করে ছোটখাট কোন জিনিস যেমন ন্যাকড়া, ঝাড়ু, বেলচা, এইগুলো বোঝাতে। এইগুলো নষ্ট হয়ে গেলে কিংবা হারিয়ে গেলে কেউ মন খারাপ করে না। আল্লাহর কাছে পৃথিবীর মূল্য-ও এইসব ফালতু জিনিসের মতই। এটা একজন মুসলিমের জন্য অনেক বড় শিক্ষা। একজন মুসলিম দুনিয়ায় থাকতে আসে না, সে এখান থেকে আখিরাতের রসদ নিতে আসে, জান্নাতে যাওয়ার মতন ক্রেডিট তুলতে আসে। এটা তার কাছে রেলস্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার মতনই একটা ক্ষনিকের ৬০-৭০ বছরের সময়। এখানে কোনকিছুই নিখুঁত না, পাওয়া সম্ভবও না। না পাওয়া, দুঃখ, ছোটখাট হতাশা এখানে থাকবেই। জীবনের প্রতি এক্সপেকটেশন আর চাহিদা যত কম হবে, জীবন তত শান্তির হবে। আসল ঠিকানা একটাই। সেটা হচ্ছে জান্নাত। জান্নাতের বাগান, ঝর্ণা। পরিবার পরিজন। সবাই চিরতরুণ, হাসিখুশি, অপরূপ সুন্দর। আল্লাহর সাথে দেখা। আল্লাহর সাথে কথা। অসীম অনন্তকাল ধরে। এটাই মানব সত্তার একমাত্র সফল পরিণতি। এটাই একমাত্র হ্যাপি এন্ডিংএকমাত্র এবং শুধুমাত্র। কেউ চাইলে তর্ক করতে পারে, চিৎকার করতে পারে, গালাগালি করতে পারে, অবজ্ঞা আর অস্বীকার করতে পারে, তাতে করে সত্য একবিন্দুও পরিবর্তন হয়ে যাবেনা। সত্য তর্কের ধার ধারেনা।

আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে, যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। আর এটাই মহাসাফল্য [৪ঃ১৩]

নিশ্চয়ই মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে সফলতা [৭৮ঃ৩১]

নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। যার তলদেশে প্রবাহিত হবে প্রবাহিত ঝর্ণাধারা। এটাই বিরাট সফলতা (ফাওযুল কারীম) [৮৫ঃ১১]

তিনি মুমিন নারী ও পুরুষদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নিচ দিয়ে প্রবাহিত ঝর্নাধারা, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। আর তিনি তাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন, আর এটাই আল্লাহর চোখে মহাসাফল্য [৪৮ঃ৫]

সেদিন তুমি মুমিন পুরুষদের ও মুমিন নারিদের দেখতে পাবে যে, তাদের সামনে ও তাদের ডান পাশে তাদের নূর আলোকিত হতে থাকবে। তাদেরকে বলা হবে, আজকে তোমাদের জন্য সুসংবাদ হল জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত। সেখানে তোমরা চিরস্থায়ী হবে। এটাই হল মহাসাফল্য [৫৭ঃ১২]

সেদিন যার থেকে আযাব সরিয়ে নেয়া হবে তাকেই তিনি অনুগ্রহ করবেন, আর এটাই প্রকাশ্য সফলতা (ফাওযুল মুবীন) [৬ঃ১৬]

আর মনে কর, যেদিন সমাবেশ দিবসের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তোমাদের সমবেত করবেন, ওই দিনই হচ্ছে লাভ-ক্ষতির দিন। আর যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তিনি তার পাপগুলো মুছে দিবেন আর তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতের বাগানে, যেখানে পায়ের নিচে বয়ে যায় ঝর্ণাধারা। সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। এটাই মহাসাফল্য [৬৪ঃ৯]

...

উপরে একটা সফল মানুষের লিস্ট দিয়েছিলাম। দেখবেন যে এখানে কেউ মুসলিম নয়। না হওয়াটা স্বাভাবিক, কারণ এই লিস্ট কোন মুসলিম বানাননি। মুসলিমরা যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সফল মানুষ বলেন, তিনি আল্লাহর রাসূল (সাঃ)। তাঁর ধনী হবার সুযোগ ছিল, তিনি দারিদ্রের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর আদর্শ ইসলাম-কে পৃথিবীতে এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন যে আজকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বেড়ে চলা ধর্মবিশ্বাসের নাম ইসলাম। এবং তিনি আখিরাতেও আল্লাহর সর্বোচ্চ সম্মানিত মানুষ। কাজেই মানুষ কাকে সফল বলে তাতে কিছু যায় আসে না। একজন প্রচন্ড সফল মানুষ আখিরাতে গিয়ে আবিষ্কার করতে পারে যে তার দুনিয়ার সফলতা কোন কাজেই আসেনি। তেমনি একজন মানুষ যার দুনিয়াতে টাকাপয়সা কিংবা খ্যাতি কিছুই নেই, সেও আখিরাতে মহাসাফল্য অর্জন করতে পারে। আল্লাহর কাছে সফলতার মানদণ্ড হচ্ছে তাকওয়া, ঈমান, ভালকাজ। আপনার কি মনে হয়, আপনার দেখা সবচেয়ে সফল, সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিটি আল্লাহর হিসেবেও সফল? আজকে বিশ্বে যাদের কোটি কোটি ফলোয়ার তারা কি আখিরাতেও চরম সফল?

...

এর অর্থ এই না যে, আমরা পৃথিবীর সব কাজ, চাকরি, ব্যবসা ছেড়ে বনবাসে সন্ন্যাসে চলে যাব। আমরা আমাদের জীবনেই থাকব। শুধু আমাদেরকে আগে আমাদের জীবনের ফোকাস ঠিক করতে হবে। আমাদের পার্থিব সকল কাজগুলোকে আখিরাত কেন্দ্রিক করে ফেলতে হবে। প্রতিদিন অসংখ্যবার আখিরাতের কথা, আল্লাহর কথা চিন্তা করতে হবে। এভাবে একদিন দেখা যাবে, আমাদের মাথায় জান্নাতে যাওয়া ছাড়া আর কোন ইচ্ছা নেই। পার্থিব ভোগবিলাস আর বস্তুবাদে যেমন জীবন মত্ত করে ফেলা যায়, তেমনি আখিরাত আর জান্নাতের চিন্তা দিয়েও নিজের সত্বাকে পবিত্র রাখা যায়। এটাও একধরনের মানসিক ট্রেইনিং। নিজেকে এভাবে ট্রেইন-আপ করে ফেলতে পারলে দুনিয়ার তুচ্ছ জীবন থেকে একসময় আস্তে আস্তে মন উঠে যাবে। একসময় পৃথিবীর সর্বোচ্চ মাত্রার বিনোদনও আপনাকে আপনার রবের স্মরণ থেকে সরাতে পারবে না। পৃথিবীতে আপনার শরীর থাকবে, আপনার মন পড়ে থাকবে জান্নাতে। প্রতিদিন বারবার মনে হবে- “কবে আসবে সেই দিন? কবে আসবে সেই মুহূর্ত?” আর তখনই আপনি বুঝতে পারবেন যে দুনিয়াটা আসলে ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই না, আল্লাহ যা বলেছেন তা অকাট্য পরম সত্য।

...

এই পৃথিবীর ক্ষনিকের আনন্দ-বিনোদনের মোহে নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন না। হারিয়ে ফেললে আর কেউই প্রতারিত হবে না, একমাত্র আপনি ছাড়া। কারোরই কোন ক্ষতি হবে না, একমাত্র আপনি ছাড়া। পার্থিব জীবনে মানুষের ভ্রান্ত সফলতা দেখে হতাশ আর দিকহারা হবে না। আখিরাত সত্য। জান্নাত সত্য। আগুন সত্য। এবং মহাবিশ্বের সবচেয়ে চরম সত্য। চাইলে এই সত্যকে আপনি অবজ্ঞা করতে পারেন, অস্বীকার করতে পারেন, পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন, না শোনার, না বোঝার ভান করতে পারেন। হ্যা, আপনি এতটুকু পারেন। কারণ আপনাকে এতটুকু পারার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। যেটা আপনি পারবেন না তা হল, আপনার সামনে যে সত্য আসবে তা আসবেই। তা থেকে আপনি পালাতে পারবেন না। আপনি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবেন, আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে। আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, আপনি না চাইলেও। আপনার হাতে আপনার নিয়তির সার্টিফিকেট ধরিয়ে দেওয়া হবে, আপনি চান কি না চান। আপনাকে আপনার গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হবে, বাগান কিংবা আগুন, আপনি চান কি না চান। দৌড়ানোর জায়গা নেই, পালানোর জায়গা নেই। কোন বন্ধু নেই, কোন সাহায্যকারী নেই, নেই কোন বাপ মা পরিবার পরিজন। শুধু একজনের বন্ধুত্ব আর দয়া দরকার ছিল আপনার। সেটা নিয়ে যেতে হবে এই পৃথিবী থেকেই, আপনার সময় থাকতে থাকতেই। তাই আসুন, পৃথিবীতে শুধু নিজের জৈবিক শরীরটিকে রাখি, বেঁচে থাকি একজন মুসাফিরের মতন, আর সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে নিজের মন, সত্বা, রূহকে স্থান দেই জান্নাতে, আল্লাহর পরম সান্নিধ্যে।


২০/১০/২০১৭