ঘটনা ১ -

আপনার বড় ভাইয়ের সাথে আপনার তুমুল কথা কাটাকাটি হচ্ছে। একটা ভাল বড় ভাই পাওয়া বেশ ভাগ্যের ব্যাপার, সবার কপালে সেটা জুটে না। পিঠাপিঠি দুই ভাই থাকলে সাধারনত বড়ভাইরাই একটু সুবিধা পায়, যখন তখন মনের আনন্দে যন্ত্রনা দিতে পারে ! আপনার ভাই তাঁর ক্রিকেট খেলার জার্সিটা খুঁজে পাচ্ছেনা। কিছুক্ষন এই রুম ঐ রুম খুঁজে সে আপনার কাছে এসে বলল- “এই আমার জার্সি দে। নিশ্চয়ই তুই পরেছিলি ঐটা।”

আপনি পড়ার টেবিলে বসে ছিলেন। আপনার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। – “আমি নেই নাই ভাইয়া”।

সে আপনার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে গোঁয়ারের মতন বলল- “তোর কথা বিশ্বাস করিনা। তুই-ই নিয়েছিস। এরআগেও তুই আমার জার্সি পরে বাইরে গিয়েছিলি। জানিসনা না বলে অন্যের জিনিস নিলে সেটা চুরি হয়? তুইতো একটা চোর !” শুধু এই বলেই সে থামলনা। লাফাতে লাফাতে সে মায়ের কাছে গেল আর আপনার নামে কমপ্লেইন করতে লাগল। আপনার মনে হল রাগে আপনার মাথা এখনি বিস্ফোরিত হয়ে যাবে। প্রথমে চোর অপবাদ, তারপর মিথ্যা অভিযোগ, এটা কারোর সহ্য হয়? রাগে ক্রোধে আপনার ইচ্ছা হল তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে। কিন্তু চাইলেই সব করা যায়না। একদৌড়ে আপনি মায়ের রুমেগেলেন। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে বললেন- “আল্লাহর কসম! খোদার কসম !আমি নেই নাই তোর জিনিশ !! লজ্জা করেনা তোর এতগুলা মিথ্যা কথা বলতে ?? “

আপনার ক্রোধে আগুনঝরা রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে আপনার ভাই বুঝে নিল যে অবস্থা সিরিয়াস। সে এটাও বুঝে নিল যে, আসলেই আপনি সত্যবাদি। মাথা নিচু করে সে আপনার সামনে থেকে চলে গেল।

ঘটনা ২ -

আপনি ক্লাসে বসে মনোযোগ দিয়ে একটা অঙ্ক করার চেষ্টা করছেন। আপনার দুষ্ট বন্ধুটি অনেকক্ষন ধরে নানাবিধ উপায়ে আপনাকে জ্বালাতন করে যাচ্ছে। কিছুক্ষন আপনাকে পেছনে থেকে পেন্সিল দিয়ে খোঁচাল। আপনি চরম বিরক্ত হলেন – “দোস্ত ডিস্টার্ব করিসনা প্লিজ”।

কে শুনে কার কথা ! দ্বিগুন উদ্যমে সে শুরু করল। কাগজ পাকিয়ে একটা চিকন নল বানিয়ে সে আপনার কানের মধ্যে ঢুকানোর চেষ্টা করতে লাগল। কানের ভিতরে একটা খোচা খেয়ে আপনি ভয়ঙ্কর চমকে গেলেন। আপনার হাতের ধাক্কা লেগে টেবিলে রাখা পেপসির ক্যানটা উলটে গিয়ে সারা টেবিল মাখামাখি হয়ে গেল। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে হাতের মুঠি পাকিয়ে আপনি আপনার বন্ধুকে বললেন- "I SWEAR, I’ll Kill you man”

আমি দুটি সিরিয়াস দৃশ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি উপরে। সিরিয়াস ঘটনা আমাদের জীবনে প্রায়ই ঘটে। কোন বিষয়ে উত্তেজিত হতে থাকলে আমরা গলার স্বর চড়াতে থাকি। অবস্থা আরো বেশি সিরিয়াস হয়ে গেলে আমরা শপথ নেই, কসম করি। যেহেতু আল্লাহ সবচেয়ে বড় ও মহান ও পবিত্র, তাই যখন কেউ আল্লাহর শপথ নিয়ে কোন কথা বলে, স্বাভাবিকভাবেই আশেপাশের মানুষ (Audience) বুঝতে পারে যে অবস্থা আসলেই সিরিয়াস। শপথ নিয়ে কথা বলা কোন ফাজলেমী বা মশকরা নয়। বিনা কারনে মানুষ শপথ নেয় না। মানুষ কোর্টে শপথ নেয়, সাক্ষ্য দেবার সময় শপথ নেয়। শপথের অন্যান্য প্রতিশব্দগুলো হচ্ছে কসম, oath, swear।

আল্লাহ কিভাবে শপথ নেন, আল্লাহ কেন শপথ নিয়েছেন কুর’আন এ, সেটার একটা নমুনা এই আর্টিকেল এ দেখানো হয়েছে। এই আর্টিকেল এ কুর’আনের ১০০ নম্বর সূরার ( আল-আদিয়াত) ভাষাগত সৌন্দর্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, পুরো কুর’আন এ যতগুলো শপথ নিয়েছেন আল্লাহ্‌, সবগুলোর পিছেই এরকম কোন না কোন শিক্ষা আছে। এই আর্টিকেল এ আরো যে কয়টি বিষয় দেখান হয়েছে-

[] কুর’আনের সূরাগুলো ইচ্ছেমতন কোন র‍্যান্ডম অর্ডার এ লিপিবদ্ধ করা হয়নি। কোনটার পরে কোনটা হবে এটা আল্লাহ নিজে তাঁর জ্ঞান দিয়ে ঠিক করেছেন। প্রত্যেকটি সূরা তার আগের বা পরের সূরার সাথে কোন না কোন সম্পর্ক বজায় রাখে। এখানে সেটার একটু নমুনা দেখান হয়েছে।

[] এখানে Quranic Imagery দেখানো হয়েছে। কুর’আন প্রচন্ড শক্তিশালী একটি রিমাইন্ডার। কখনো কখনো আল্লাহ মূল মেসেজটা বলার আগে একটা তীব্র দৃশ্য তৈরী করে নেন, এটাকেই বলা হয় Imagery.

[] কিভাবে অনুবাদে ভাব হারিয়ে যায় সেটা এখানে দেখানো হয়েছে। এজন্য মোটামুটি ভাবানুবাদ দেয়া হয়েছে, তারপরে মূল আরবি শব্দগুলোর ব্যখ্যা দেওয়া হয়েছে। আরবি যারা পড়তে পারেন না সেজন্য আরবি উচ্চারন (Transliteration) দেয়া হয়েছে।

প্রত্যেকটি শপথের দুটি অংশ আছে- সাবজেক্ট আর অবজেক্ট। উপরের ১ম ঘটনায় আপনি একটা শপথ নিয়েছিলেন।

Object = যেটার নামে শপথ নেয়া হয়। The Thing being sworn by. [ আল্লাহর কসম, খোদার কসম]

Subject = যে তথ্যটি আপনি জানাতে চাচ্ছেন। The answer to the oath. [আমি নেই নাই তোর জিনিস]

মানুষ কেন শপথ নেয়? মানুষ কেন কসম কাটে? আপনি শপথ করেছিলেন তার কারন ছিল-

[] আপনি প্রচন্ড সিরিয়াস ছিলেন। একই কথা যদি আপনি স্বাভাবিকভাবে নরমাল টোনে বলতেন, আপনার কথা ততটা বিশ্বাসযোগ্য হত না।

[] আপনি শপথ করে আপনার কথার প্রতি শ্রোতার দৃষ্টি আকর্ষন করলেন।

[] ভয় দেখাতে, থ্রেট দিতে।

কথার মাঝে শপথ নেওয়ার এই প্রথা নতুন কিছু না। প্রাচীন আরবরাও একই কাজ করত। কথার মাঝখানে উত্তেজিত হয়ে গেলে, বা সিরিয়াস কিছু বললে, বা শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখার জন্য তারা তাদের জীবনের গুরূত্বপূর্ন জিনিসগুলোর নামে শপথ নিত। সেটা হতে পারে তাদের জীবন, বাবা-মা, তলোয়ার, ঘোড়া। আরবিতে যেকোন শপথ শুরু হয় (“wa” وَ) দিয়ে। আরবদের মধ্যে খুবই প্রচলিত একটা শপথ ছিল Wallahi = I swear by Allah.....

কুর’আন আমাদের যুগে আসেনি। কুর’আন এসেছিল ১৪০০ বছর আগে একটি আরব সমাজে। কুর’আনের পুরো মেসেজ উপলব্ধি করতে হলে আমাদেরকে সেই সময়ে আরবদের জীবন সম্পর্কে জানতে হবে। ইন্টারনেট ও তথ্য প্রযুক্তিকে ধন্যবাদ, আরবদের জীবন ও ইসলাম নিয়ে প্রচুর ভাল ভাল ডকুমেন্টারী এখন পাওয়া যায়। কুর’আনে আল্লাহ্‌ বহুবার শপথ নিয়েছেন। ৩০তম পারায় শেষ ৩৭ টি সূরায় আল্লাহ্‌ যে সবের নামে শপথ নিয়েছেন সেগুলোর কিছু কিছু এখানে দেয়া হল-

ফেরেশতা, মহাকাশ, কিয়ামতের দিন, ভোর, দশ রাত, জোড়-বিজোড়, মক্কা শহর, সূর্য, চাঁদ, পৃথিবী, মাটি, মানুষের রূহ, আল্লাহ্‌, ভোরের আলো, রাতের অন্ধকার, ডুমুর, জলপাই, যুদ্ধের ঘোড়া, সময়।

আল্লাহর করা শপথের মধ্যেও সাবজেক্ট ও অবজেক্ট রয়েছে। সেটার চেয়েও বেশি গুরুত্বপুর্ন হল, তাঁর শপথের সাবজেক্ট ও অবজেক্ট এর মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। যখনি আল্লাহ্‌ কুর’আনে শপথ নিয়েছেন তারমানে সেখানে তিনি অত্যন্ত সিরিয়াস কোন মেসেজ আমাদেরকে দিয়েছেন। কুর’আনের কথাগুলোর বাচনভঙ্গির সাথে প্রাচীন আরবদের বাচনভঙ্গীর মিল আছে। একারনে যখনি তারা নাবি(স) এর মুখ থেকে কুর’আন শুনত, তাদের অনেকেরই অনূভুতি হত এরকম-

– "একি !! মুহাম্মাদ এগুলো কি বলছে ? ওকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। এরকম শক্তিশালী কথা তো আমি জীবনেও কখনো শুনিনি। এভাবে কথা বলা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব না। আমি এখনই সাক্ষী দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, আর মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।"

বহু কাফের আরব কুর’আনের আয়াত শুনামাত্র সাথে সাথে মুসলিম হয়ে গেছে এরকম অগনিত নজির আছে। আরবদের কাছে কুর’আনের ভাষা বোঝা সহজ। কুর’আনের ভিতরে যে প্রচন্ড শক্তিশালী ভাষাগত সৌন্দর্য ও আবেগ( Linguistic Beauty) আছে সেটা সহজেই তারা ধরতে পারত। সেই হুবহু একই আবেগ আমরাও ধরতে পারব যদি আমরা আরবি ভাষা ও গ্রামার ব্যবহার করে কুর’আন-কে বোঝার চেষ্টা করি। আধুনিক যুগে এসে অতিরিক্ত মর্ডান মানুষে পরিনত হয়ে আমরা আসলে মানুষের খোলসবিশিষ্ট একটি অন্তঃসারশূন্য জৈবিক প্রানীতে এসে ঠেকেছি। হিন্দী সিনেমার সস্তা ডায়লগ শুনে আমাদের বুকের ভিতর হুহু করে উঠে। রোমান্টিক সিনেমা আর বই পড়ে আমরা কেঁদে বুক ভাসাই। সবকিছুই আমাদের আবেগকে নাড়া দেয়, একমাত্র আল্লাহর কথাগুলো ছাড়া। দোষ যে পুরোপুরি একপাক্ষিক, সেটাও আসলে বলা যাবেনা। এই ধরনের কমপ্লেক্স সমস্যাগুলোর পিছে নানারকম কারন আছে (Multi factorial causes)। ছোট একটা নমুনা আমি দেখাচ্ছি।

সমাজে কুর’আন নিয়ে কারা পড়াশুনা করে এটা চিন্তা করতেই অটোমেটিক্যালি আমাদের মনের পর্দায় যে প্যারামিটারগুলো ফুটে উঠে তা অনেকটা এরকম- মাদ্রাসার ছাত্র। রঙ জ্বলা ফিকে আধময়লা পাঞ্জাবি-পায়জামা, বা জোব্বা। দাড়ি আছে, মাথায় টুপি আছে। চেহারায় খুব বেশি শিক্ষার ছাপ নেই। কথাবার্তায় যথেষ্ট “স্মার্টনেস” নেই। দামি স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির ব্যাচেলরস মাস্টার্স ডিগ্রী নেই। পান খাওয়া দাঁত। বিজ্ঞান-আধুনিক প্রযুক্তি-কারেন্ট ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে তেমন কিছু জানেনা। কুসংস্কারাচ্ছন্ন। কথার মাঝখানে বারবার ঈমান / এক্বীন / ফায়দা / মেহনত / ওলামা / বুজুর্গ / হুজুরে পাক / আল্লাহর কুদরত শব্দগুলোর ব্যবহার। সমাজে হুজুর /মাওলানা / মোল্লা / মুন্সী নানা নামে পরিচিত, কৌতুক ও ব্যঙ্গাত্মক হিসেবেই নামগুলো বেশি প্রচলিত। হুজুরদের নিয়ে বানানো ট্রল সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বিনোদনের একটি হট আইটেম। সমাজের শিক্ষিত শ্রেনীর সাথে এদের বেশ ভাল একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরী হয়ে গেছে। ধর্মীয় প্রয়োজন ছাড়া এনাদের সাথে সাধারন মানুষজনের তেমন একটা মেশা হয়না। অনেকটা তেল আর জলের মতন; ঝাকাবেন, কিন্তু মিশবে না।

কুর’আনের একজন ছাত্রের যে চিত্র/ধারনা কখনো আমাদের মাথাতেই আসেনা তা হল- ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর কর্মকর্তা। একজন প্রফেসর লেভেলের ডাক্তার। একজন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। একজন প্রোগ্র্যামার। একজন সফটওয়্যার ডেভেলপার। একজন আরকিটেক্ট। একজন জীববিজ্ঞানী। আমাদের ধারনা অনুযায়ী, সমাজের এই স্তরের উচ্চশিক্ষিত লোকজন কুর’আন পড়ে না, কুর’আন নিয়ে গবেষনা করেনা, চিন্তা করে না। এরা কেন করবে? কুর’আন নিয়ে তো পড়বে ঐসব অর্ধ শিক্ষিত হুজুররা, যারা জীবনে তেমন কিছু করতে পারেনি। আমাদের কাজ বিজ্ঞান পড়া, গবেষনা করা। উনারা ধর্মকর্ম করবেন…এইতো। Were not their type. We’re Muslims, but not “that” muslim !

একদম না। মোটেও না। কখনোই না। পৃথিবীর যেকোন ধর্ম, বর্ন, পেশার মানুষ কুর’আন নিয়ে স্টাডি করতে পারে। কুর’আন কাউকে “হুজুর” খেতাব দেওয়ার জন্য নাযিল হয়নি বা এটা কোন “হুজুরদের বই” না। এটি পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের জন্য একটি কমপ্লিট ইন্সট্রাকশন ম্যানুয়াল। আমাদের রোগগুলো হচ্ছে কূর’আনের প্রতি অনীহা / ভাল-না-লাগা / কিছু-না-বোঝা / ইসলাম-ফোবিয়া / হুজুর এলার্জী… ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। আমাদের পক্ষ থেকে আমাদের গাফিলতি / অপরাধ হচ্ছে কুর’আনের মেসেজ বোঝার চেষ্টা না করা। আমরা এমন একটি উন্নত সময়ে বাস করি যখন রিসোর্স কোন সমস্যাই না। বরং উলটা সমস্যা হতে পারে, এত এত রিসোর্সের মধ্যে কোনটা ফেলে কোনটা শিখব সেটা নিয়ে কনফিউশান তৈরী হতে পারে ! যেখানে সাহাবারা একটা হাদিস শিক্ষা করার জন্য দিনের পর দিন সফর করতেন, সেখানে আমরা মনিটরের সামনে বসেই সবকিছু পেয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তারপরো শিখছি না। আমাদের প্রত্যেককে মনে রাখতে হবে, একদিন আমাদেরকে এই সবকিছুর পাই-পাই অনু-পরমানু হিসাব দিতেই হবে, আমরা চাই আর না চাই। সেদিন আমরা আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে কখনো বলতে পারব না যে আমাদের শেখার সুযোগ ছিলনা। কখনো না।

মানুষ একটি বিনোদনপ্রিয় জীব। হাজার বছর আগেও মানুষ বিনোদন করত, এখনো করে। সময়ের সাথে সাথে বিনোদনের মাত্রা পাল্টেছে, কিন্তু বিনোদন বন্ধ হয়নি কখনো। আজকের যুগে আমরা হাই রেজ্যুলেশন থ্রিডি সিনেমা দেখি। যুদ্ধের সিনেমা, একশান সিনেমা, এগুলোসবসময়েই মানুষের প্রিয়, বিশেষত ছেলেদের ! আরবদের সময়ে সিনেমা দেখার ব্যবস্থা ছিলনা। তারা মুখে মুখে ছড়া তৈরী করত। কবিতার লড়াই ছিল তাদের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি বিনোদন। আমাদের দেশে এখনো কোন কোন গ্রামাঞ্চলে “কবির লড়াই” প্রচলিত আছে। কবিতার কথাগুলোকে আরবরা নিজেদের মনের মধ্যে কল্পনা করে একধরনের সিনেমা দেখতে পেত। কুর’আন প্রাচীন আরবদের কথা বলার, কবিতা বলার এই বাকরীতি অনেকটাই ধরে রেখেছে। এ কারনে কুর’আনের ভাষা না গদ্য, না পদ্য। কুর’আনের সুরাগুলো কোন কবিতা নয়, কিন্তু আবার লাইনে লাইনে কেমন অদ্ভূত একটা ছন্দ আছে। মুসলিম, এমনকি অমুসলিম ভাষাবিদরা পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে আরবি ভাষায় এরচেয়ে শক্তিশালী কোন মৌখিক কাব্য রচিত হয়নি এর আগে।

আসুন সূরা আদিয়াতের গঠনটা দেখা যাক। এটা ১০০ নম্বর সূরা, কিন্তু নাযিলের ক্রম (Revelation Order) অনুযায়ী এটা ১৪ নম্বর সূরা [http://goo.gl/BDYQP0]।

এটা একটা মাক্কী সূরা, যার অর্থ এটার মেসেজ প্রথমে এসেছিল মক্কার কুরাইশদের কাছে। যেহেতু এটা ১৪ নম্বর সূরা, তারমানে এটা একটা Early Meccan Sura. মক্কার প্রথম ১৩ বছর নাবি মুহাম্মাদের (স) জন্য অত্যন্ত কঠিন ও দুঃসহ একটি সময় ছিল। এ সময়ে তাঁকে আরব সমাজের সীমাহীন অত্যাচার, গালাগালি, কটূ কথা সহ্য করতে হয়েছে। আমি এখানে সেগুলো বিস্তারিত বলতে চাচ্ছি না।

এর আগের সূরা হচ্ছে সূরা যিলযাল( The Earthquake)। এখানে দেখানো হয়েছে যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, ভয়ঙ্করভাবে কাঁপছে। পৃথিবী তার ভেতরের সব জিনিস উগলে দিচ্ছে। আতঙ্কে পাথর হয়ে মানুষ জানতে চাইছে- “কি হয়েছে এর !!?”. সূরা আদিয়াত সুরা যিলযাল এর ঘটনাকে জাস্টিফাই করছে। এখানে আল্লাহ্‌ দেখাচ্ছেন কি কি কারনে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে একদিন। কি কি অন্যায় মানুষ করে যাচ্ছে দিনের পর দিন যার কারনে পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে।

এই সূরায় আল্লাহ মূলত একটি শপথকে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথম ৫ আয়াতে তিনি আরবদের মনে একটি একশান সিনেমার মতন দৃশ্য তৈরী করে আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছেন। তারপরের ৬ আয়াতে তিনি তাঁর মূল মেসেজটি দিয়েছেন। আপনি যদি ভুলে গিয়ে থাকেন তাহলে আমি আপনাকে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, প্রত্যেকটি শপথের দুটি অংশ আছে- সাবজেক্ট আর অবজেক্ট। এই সূরায় প্রথম ৫ আয়াতে আল্লাহ্‌ তাঁর শপথের অবজেক্ট জানিয়েছেন, তারপরের ৬ আয়াতে সেটার সাবজেক্টকে ব্যাখ্যা করেছেন।

Object = যেটার নামে শপথ নেয়া হয়। The Thing being sworn by.

Subject = যে তথ্যটি বক্তা জানাতে চাচ্ছেন। The answer to the oath.

এই সূরাটার বাংলা অনুবাদ করলে সেটা খুব একটা প্রাঞ্জল হয় না, সেকারনে আমি সাথে একটা ইংরেজি অনুবাদ দিলাম। অনুবাদে আল্লাহর কথার যে অসাধারন বিষয়গুলো হারিয়ে যায় সেটাই আমি তুলে ধরার চেষ্টা করি মাত্র। আর এটাও মাথায় রাখতে হবে যে বিক্ষিপ্তভাবে বিচ্ছিন্ন কোন/কয়েকটি আয়াত পড়ে আসল তথ্যটা সঠিকভাবে পাওয়া যাবেনা, যদি না আপনি মূল টপিক ও পটভূমি ( যেটাকে Context বলে) ধরতে না পারেন। এ কারনেই আপনি খেয়াল করবেন কুর’আন এ একটু পর পর আল্লাহ্‌ প্রসংগ পরিবর্তন করে ফেলেছেন, যেটা সম্পূর্ন তাঁর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত (Intentional) ও সেটার পিছে অসাধারন কোন সৌন্দর্য অবশ্যই আছে। মূল কুর’আন বোঝার ক্ষেত্রে অনুবাদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত এই প্রশ্নগুলোর প্রতি-

“আল্লাহ্‌ এখানে কি বলতে চেয়েছেন? আল্লাহ্‌ কেন এই কথাটা বললেন? আল্লাহ্‌ শুধুই আমার জন্য কি বললেন এই লাইনে? আল্লাহ্‌ কেন এই ঘটনাটা বলেছেন আমাকে? এখানে আমার জন্য কি কি নির্দেশ ও গাইড্যান্স আছে? এই লাইনের শিক্ষাটা আমি কিভাবে আমার জীবনে কাজে লাগাতে পারি?কেন এখানে আল্লাহ্‌ হঠাৎ করে টপিকটা পালটে দিলেন? কি শিক্ষা আছে এটার মধ্যে? ”

আসুন আমরা আরবের দিনগুলো একটু কল্পনা করি, কারন কুর’আন বোঝার জন্য সেইদিনগুলো কেমন ছিল এটা জানা আমাদের জন্য জরুরী। মনে করুন কয়েকজন আরব এক জায়গায় বসে কথাবার্তা বলছে। সূরা আদিয়াত নাযিল হয়েছে, একজন সেটা নাবি মুহাম্মাদ(স) এর মুখ থেকে শুনে এসেছে একটুআগে, এখন সে সেটা তার বন্ধুদের শুনাচ্ছে। আল্লাহ্‌ সূরা আদিয়াত শুরু করেছেন এভাবে-

وَٱلۡعَـٰدِيَـٰتِ ضَبۡحً۬ا (١ – Wal ‘Aadiyaati Dab’Haan

“I swear by the charging battle horses those pant”

“সেই যুদ্ধের ঘোড়াগুলোর শপথ, যারা প্রচন্ড গতিতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসে”

আরবিতে যেকোন শপথ শুরু হয় (“wa” وَ ) দিয়ে। আরবি একটি অত্যন্ত concise ভাষা। অনেকসময়ই কুর’আনে এমন শব্দ আসে যেটার পূর্ন ভাবার্থ বাংলা বা ইংরেজি অনুবাদে ঠিকমতন ফুটে না ওঠায় সেখানে ঠিক কি বোঝানো হয়েছে তা পাঠক বুঝতে পারেনা।

আরবিতে Adiy= প্রচন্ড গতিতে ডাইনে বামে না তাকিয়ে কোন কিছুর দিকে ছুটে যাওয়া। ঠিক যুদ্ধের ময়দানে যোদ্ধারা যেটা করত আগের দিনে।

aadiyAAT (feminine)= ৮-১০ টির মতন মাদী যুদ্ধের ঘোড়ার একটি ছোট দল।

Dab’Haan, ضَبۡحً۬ا= হাঁপান/ জোরে জোরে শ্বাস নেয়া/ panting of the war horse in its aggression। ঘোড়া যখন তার সর্বোচ্চ গতিতে দৌড়াতে থাকে তখন সে নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে শব্দ করে শ্বাস নেয় ও হাঁপায়। এটাকেই দব’হা বলে।

ঘোড়া?!? ঘোড়া কেন?? এত কিছু থাকতে আল্লাহ, যিনি মহাবিশ্বের স্রষ্টা, তিনি কেন ঘোড়ার শপথ নিচ্ছেন এখানে??আসুন আমরা বোঝার চেষ্টা করি।

সেই সময়ের একজন আরবের কাছে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন জিনিসগুলো ছিল- সম্মান, বংশ-মর্যাদা, আভিজাত্য, গোত্র, বাহন(ঘোড়া), যুদ্ধ, ইত্যাদি। আপনি একটিও পুরান দিনের যুদ্ধের সিনেমা দেখেননি যেখানে ঘোড়া নেই। পৃথিবীতে আজকের দিনেও যতগুলো ঘোড়ার জাত (breed) আছে তার মধ্যে এক নম্বর হল অ্যারাবিয়ান হর্স। গুগল এ “World’s best Horse Breed” দিয়ে সার্চ করলে ১ নম্বরে যেটা আসে সেটা হচ্ছে অ্যারাবিয়ান হর্স।

হাজার হাজার বছর ধরে আরব মরু বেদুইনরা বাহন ও যুদ্ধের জন্য আরবীয় ঘোড়াকে ব্রিডিং করে এসেছে। মরুর প্রচন্ড রুক্ষ কর্কশ ও বন্ধুর জলবায়ুতে টিকে থাকার জন্য আরবীয় ঘোড়াগুলোর ফুসফুসের আকার হত বিশালাকার ও স্ট্যামিনা ছিল অসাধারন। রুক্ষ পরিবেশে মানুষ ও ঘোড়াকে খাবার ও পানি শেয়ার করে চলতে হত, এমনকি কখনো একই তাবুতে থাকতে হত। মানুষের সাথে থাকতে থাকতে এই ঘোড়াটির মানুষের সাথে অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক ডেভেলপ করে হাজার হাজার বছর ধরে। মূলত যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবেই এই ঘোড়া ব্যবহার করত আরব বেদুইনরা। আরব বেদুইনদের মরুর জীবনে ঘাত-সঙ্ঘাত লেগেই থাকত। যে যখন পারত আরেক কাফেলা দলকে লুটপাট করে নিত। ঝড়ের গতিতে হামলা চালিয়ে একদল বেদুইন দস্যু আরেকদলের উট, দুম্বা, ভেড়া, বকরির পাল লুঠ করে নিত। এ কাজ তারা শুধু তখনই করতে পারত যদি তাদের কাছে দ্রুতগতির কিছু ঘোড়া থাকত।

...

চেঙ্গিস খান, নেপোলিয়ন, আলেকজান্ডার দা গ্রেট, জর্জ ওয়াশিংটন এরা সবাই আরবীয় ঘোড়া চালিয়েছেন। একজন আরব কয়টি ভাল ঘোড়ার মালিক সেটা দিয়ে তাদের সম্পদ ও মর্যাদা বিচার করা হত। মূল্যবান এই প্রানীটির প্রজননের ব্যাপারে আরবরা অত্যন্ত সাবধানী ছিল, কারন ক্রস-ব্রিড হয়ে গেলে এই রাজকীয় প্রানীটির মূল্য হারিয়ে যেত। তাই আজকের দিনেও যেসব Pure Bred আরবীয় ঘোড়া পাওয়া যায়, সেগুলো হুবহু সেই হাজার বছর আগের প্রাচীন আরবের ঘোড়াগুলোর মতই। এরাবিয়ান হর্স এসোসিয়েশন এর অনলাইন মার্কেটে ঢুকে আমি দেখেছি এখানে ঘোড়ার দাম সর্বোচ্চ ৬০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আছে। নাবি মুহাম্মাদ(স) তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যেন তারা আরবি ঘোড়ার প্রতি যত্নবান ও দয়ালু হয়। তিনি আরো বলে গিয়েছিলেন যেন তারা মাদি ঘোড়াগুলোকে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে যত্ন করে, কারন এদের উপরই বংশ নির্ভর করে।

আল্লাহ এখানে ঘোড়ার শপথ নিচ্ছেন। সাধারন কোন ঘোড়া নয়, আরবীয় ঘোড়া। সাধারন কোন আরবীয় ঘোড়া নয়, আরবীয় যুদ্ধের ঘোড়া। শুধু যুদ্ধের ঘোড়া বলেও আল্লাহ থামেননি, আল্লাহ বলেছেন- মাদী যুদ্ধের ঘোড়া। মাদী ঘোড়া পুরুষ ঘোড়ার চেয়ে জোরে ছুটতে পারে বলে যুদ্ধের জন্য সেটা আরবদের বেশি পছন্দ ছিল। একজন আরব বেদুইনের কাছে সবচেয়ে দামি সম্পদ ছিল তার মাদি ঘোড়া। ঘোড়া ছাড়া একজন আরব তার জীবন কল্পনা করতে পারত না তখন। ২০১৪ সালের শহুরে যান্ত্রিক জীবনে এসে ঘোড়া বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এখনো শখের বশে আদর করে বহু দেশের মানুষ এই রাজকীয় প্রানীটিকে নিজের জীবনে স্থান দিয়ে রেখেছেন। আল্লাহ এখানে যেধরনের এলিট ঘোড়ার কথা বলছেন প্রতিটি আরব স্বপ্ন দেখত এমন একটি ঘোড়ার সৌভাগ্যবান মালিক হবার। পাহাড়ের মতন প্রকান্ড কালো চকচকে শক্তিশালী একটা ঘোড়া কে না চায়? আহা !

প্রতিটি পুরুষ মানুষ অ্যাকশন, এডভেঞ্চার, রোমাঞ্চ, গতি এসব ভালবাসে। আপনি কি নীড ফর স্পীড গেইম খেলেছেন? হ্যা, অবশ্যই আপনি খেলেছেন। আপনি নিশ্চয়ই একটা পোর্শে, ফেরারি, ল্যামবরগিনি স্পোর্টস-কার চালানোর স্বপ্ন দেখেন? বা একটা কয়েক হাজার সিসি ইঞ্জিনের সুজুকি বা ডুকাটি মোটরবাইক আপনার হাতের মধ্যে জান্তব গর্জন করছে আর আপনি ২০০ কিলো বেগে হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যাচ্ছেন? হ্যা, সবাই এগুলো ভালবাসে। যুগ পাল্টেছে কিন্তু মানুষের সেই আদি অকৃত্রিম ইচ্ছা আগেও একই ছিল। আমাদের সময়ে যেটা হচ্ছে গাড়ির ইঞ্জিনের হর্স পাওয়ার, আরবদের সময়ে সেটা ছিল সত্যিকার হর্স পাওয়ার। অ্যারাবিয়ান হর্স পাওয়ার !!!

কাজেই একজন আরব শ্রোতা যখন এই আয়াতটি শুনত তখন সে এরকম একটা অ্যাকশন দৃশ্য কল্পনায় দেখতে পেত- ৮-১০ জন আরোহীর একটা দল যুদ্ধের ঘোড়ায় চড়ে প্রচন্ড গতিতে ছুটে যাচ্ছে সামনের দিকে তাদের শত্রুর দিকে। ডানে বায়ে কোন দিকে তাকাচ্ছে না তারা, কোন কিছুর পরোয়া করে না তারা। তাদের ঘোড়াগুলো সর্বোচ্চ গতিতে দৌড়াচ্ছে। প্রচন্ড শক্তিশালী এই শ্রেষ্ঠ ঘোড়াগুলো পর্যন্ত হাঁপাচ্ছে। ফোঁস ফোঁস করে তারা ভারি দম নিচ্ছে, তাদের বিশাল বুকের খাঁচা নিঃশ্বাসের তালে তালে হাপরের মতন ঊঠানামা করছে। প্রচন্ড প্ররিশ্রমে তাদের মুখ থেকে লালা ঝরছে, চোখগুলো যেন কোটর থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসবে। যুদ্ধের প্রচন্ড আগ্রাসন নিয়ে ছুটে আসছে একদল যোদ্ধা…

...

এবার আল্লাহ বলছেন-

فَٱلۡمُورِيَـٰتِ قَدۡحً۬ا (٢) – Fal Mooriyaati Qad’Han

And they strike fire sparks with their hooves.

“তাদের ক্ষুরের প্রচন্ড জোরালো আঘাতে আগুনের স্ফুলিংগ ওঠে”

আল্লাহ এই বাক্যটী “ওয়া” দিয়ে শুরু না করে “ফা” দিয়ে শুরু করেছেন [আরবিতে ফা = এবং/তারপর], অর্থাৎ এটি নূতন কোন শপথ নয়, এটি আগের ঘটনারই পরের দৃশ্য (A continous picture scene)।

Mooriyat= Causing sparks to fly. আগুনের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করে যে।

Qad’Haan= Violent strike which is very loud and powerful. জোরাল শক্তিশালী আঘাতের শব্দ।

প্রথম আয়াতে আল্লাহ দূর থেকে আসা একদল ঘোড়সওয়ারের দৃশ্য তুলে ধরেছিলেন। সিনেমাটোগ্রাফির ভাষায়, এরপর ক্যামেরা অ্যাংঙ্গেল জুম ইন করে চলে গেল ঘোড়ার নাকে। এরপর আবার ক্যামেরা অ্যাংঙ্গেল চলে যাচ্ছে ঘোড়ার পায়ে। একজন আরব, হোক সে কাফের বা মুসলিম, যখন নিজেদের বাস্তব জীবনের এই দৃশ্যগুলো আল্লাহর আয়াতের মাধ্যমে শুনতে পেত, তখন আক্ষরিক অর্থেই সে নিজের কল্পনায় একটি অ্যাকশন সিনেমা দেখতে পেত।

এই আয়াতে আল্লাহ যে দৃশ্যটা দেখাচ্ছেন- যুদ্ধের প্রচন্ড আগ্রাসন নিয়ে তীব্র বেগে ছুটে আসছে একদল ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা। পাথুরে মাটি্র সাথে ঘোড়ার ক্ষুরের লোহার নাল-এর প্রচন্ড সঙ্ঘর্ষে আগুনের স্ফুলিংগ বের হচ্ছে বারবার। সাথে কানফাটানো শক্তিশালী শব্দ হচ্ছে তালেতালে- খটাখট খটাখট খটাখট। একটার পর একটা ঘোড়া যাচ্ছে আর পিছে রেখে যাচ্ছে একটা আগুনের স্ফুলিঙ্গের শিখা।

আস্তে আস্তে আল্লাহ পুরো দৃশ্যটার তীব্রতা ও প্রচন্ডতা ( Intensity and thrill) বাড়াচ্ছেন। এরপরের দুই আয়াতে তিনি বলছেন-

فَٱلۡمُغِيرَٲتِ صُبۡحً۬ا (٣)فَأَثَرۡنَ بِهِۦ نَقۡعً۬ا (٤

– Fal Mugheerati Sub’Haan; Fa Atharna bihi naq’An

“Then they ambush at the dawn. Then They rise a cloud of dust. “

“তারপর তারা ভোরবেলায় আক্রমন করে। তারপর ধূলার মেঘ সৃষ্টি করে। “

Mughererah= Attack/ambush/rob/kill . আক্রমন করা।

Subha= ভোরের প্রথম আলো। ঊষা।

আল্লাহ বলছেন, এই দস্যুদল বা যোদ্ধা( বা যাই তাদের পরিচয় হোক) আক্রমন করতে আসছে ভোরবেলায়। আরবরা মরুর মানুষ। মরুভূমিতে তাদেরকে সবসময়ে নিজের দলের সাথে থাকতে হত। দল হারিয়ে ফেলা মানেই মৃত্যু। খাবার, পানি, সম্পদের জন্য একদল বেদুইন আরেকদলের উপর প্রায়ই হামলা করত। কাউকে আক্রমন করার সবচেয়ে মোক্ষম সময়ে হচ্ছে গভীর রাত, যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে। অদ্ভূত ব্যাপার হল, আল্লাহ বলছেন, এই ৮-১০ জনের ছোট দলটা আক্রমন করতে আসছে ভোরের আলোয়। তাদের দলটা যদি ৫০-১০০ জনের হত তাহলেও একটা কথা ছিল। তাছাড়া মরুর বুকে অনেক দূর থেকেই কাউকে আসতে দেখা যায়। ৮-১০ জন নিয়ে দিনের আলোয় সম্পূর্ন জানান দিয়ে শতভাগ প্রস্তুত কোন শত্রুকে হামলা করা নিতান্তই আত্মহত্যার সামিল। তাছাড়া এর আগের আয়াতে আল্লাহ বলেছিলেন, এদের ঘোড়ার ক্ষুরের আঘাতে মাটি থেকে আগুনের ফুলকি বের হয়। ভোরবেলায় শিশির পড়ে, মাটি ভেজা থাকে। ভেজা মাটিতে কত জোরে ঘোড়া চালালে আগুন বের হতে পারে আপনার কোন ধারনা আছে !?

এখানে আল্লাহ যেটা বোঝাচ্ছেন সেটা হচ্ছে, এই ছোট বেদুইন দস্যুদল বেপরোয়া, অকুতোভয়, ড্যাম কেয়ার, নিজেদের জীবন নিয়ে তাদের কোন মায়া নেই। তারা জানে ভোরে অল্প কয়েকজন যোদ্ধা নিয়ে পূর্ন একদল শত্রুকে আক্রমন করা আর মৃত্যুকূপে লাফ দেওয়া একি জিনিস। কিন্তু তাদের কিছু যায় আসে না। কোন কিছুতেই তাদের কিছু যায় আসে না। যার জীবনেরই মায়া নেই, তার কিসের ভয়?

Atharna = They(the horses) cause to rise, Athar = rise

Naq’A = Trail of Dust. Cloud of dust. ধূলির মেঘ।

আল্লাহ আবার ক্যামেরার ফোকাস পরিবর্তন করছেন এখন। তিনি বলছেন এই ঘোড়াগুলো এত জোরে দৌড়ায় যে এদের পেছনে ধূলা উড়তে উড়তে মেঘের মতন সৃষ্টী হয়। এটি জানানোর আরো একটি কারন হল দূর থেকে তাদের ধূলোর মেঘ দেখেই তাদের প্রতিপক্ষ বুঝে নেবে যে বিপদ আসছে এবং তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রেডি হয়ে যুদ্ধের ফরমেশনে দাড়িয়েই থাকবে। যারা দূর থেকে ধূলার মেঘ উড়িয়ে শত্রুকে দেখিয়ে দেখিয়ে আক্রমন করতে যায়, নিঃসন্দেহে তারা মৃত্যুভয় নিয়ে চিন্তিত নয়।

আল্লাহ তাঁর শপথের অবজেক্ট শেষ করছেন এই আয়াত দিয়ে এখন-

فَوَسَطۡنَ بِهِۦ جَمۡعًا – Fa wasatna bihi jam’a.

“And they penetrate through the middle altogether”

“তারপর তারা দলবদ্ধভাবে (শত্রুর ব্যূহকে) ভেদ করে মাঝে ঢুকে পড়ে”

Wasatna= They(horses) penetrate through the middle; তীব্রগতিতে কোন ব্যূহকে ভেদ করা।

Jam’a = Altogether

যুদ্ধের শেষ দৃশ্য। এরকম দৃশ্য আপনি আগের দিনের যেকোন যুদ্ধের সিনেমাতে ( ট্রয়, গ্ল্যাডিয়েটর) অবশ্যই দেখেছেন। একদল ঘোড়সওয়ার আরেকদলের দিকে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে। হাতে চকচকে খাপখোলা তলোয়ার। প্রতিপক্ষ আরেকদল পদাতিক যোদ্ধা এক সারিতে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সারির সামনের জনের প্রত্যেকের হাতে একটা করে খোলা বর্শা। আস্ত ঘোড়া গেঁথে ফেলা যায় এই বর্শা দিয়ে। প্রত্যেকের চোখে রক্তের নেশা, মৃত্যুর নেশা। একটি আরবীয় ঘোড়া সহজেই ৫০-৬০ কিমি গতিতে দৌড়াতে পারে। নরম মাখনের ভিতরে যেমন করে ছুরি ঢুকে যায়, তেমনি করে ঘোড়াগুলো ঢুকে পড়ল শত্রুদলের ভিতর। যুদ্ধের প্রাথমিক ধাক্কায় ছিটকে পড়ল দুইদল দুইদিকে। ঢাল- তলোয়ারের ধাতব ঝনঝনানি, ঘোড়া ও মানুষের আর্তনাদ ও ঘাম-রক্তের ভারি গন্ধে নারকীয় হয়ে এল পুরো পরিবেশ………।

...

মনে করুন আপনি একটা যুদ্ধের সিনেমা খুজছিলেন অনেক দিন ধরে। একদিন টিভি ছেড়ে দেখেন সেটা হিস্ট্রি চ্যানেল এ দেখাচ্ছে। চোখের পল্ক না ফেলে আপনি সেটা গোগ্রাসে গিলা শুরু করলেন। সিনেমার মধ্যে যখন একটা প্রচন্ড যুদ্ধের দৃশ্য চলছে, সিনেমার নায়ক ঘোড়া থেকে পড়ে গেছে, তার হাত থেকে তলোয়ার পড়ে গেছে, ঠিক এইসময়ে কারেন্ট টা চলে গেল আর বোনাস হিসেবে বাইরে একটা ট্রান্সফর্মার বার্স্ট করল। রাগে দূঃখে ক্ষোভে আপনার ইচ্ছে করল নিজের হাত চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে।

ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধের এই প্রচন্ড তীব্র বর্ননাটা আল্লাহ শেষ করেননি। এটা তিনি এটুকু পর্যন্তই বলেছেন। কিন্তু কেন?!? এই পর্যন্ত শুনে যেকোন আরব শ্রোতাই উত্তেজনায় তার হাত মুঠি করে অপেক্ষা করবে পরের লাইনটি শুনার জন্য। আরো মনে করুন, একজন আরব শ্রোতার এক হাতে ধরা রয়েছে তার প্রিয় ঘোড়াটি। সে চরম আগ্রহ নিয়ে ঘোড়ার যুদ্ধের এই আয়াতগুলো শুনছে আর তার ঘোড়াটির গায়ে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বিশ্বস্ত ঘোড়াটিও মনিবের পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়াটি তার বহুদিনের সঙ্গী,বহু যুদ্ধ, বহু সুখদুঃখের সাথী। একসাথে তারা বহু পথ পাড়ি দিয়েছে। কাজেই এই মূহুর্তে সে তীব্র আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে আল্লাহ্‌ এর পরের লাইনে কি বলেন সেটা শোনার জন্য।

...

আল্লাহ্‌ পরের লাইন বললেন। এতক্ষন ধরে পুরো দৃশ্যটা ধাপে ধাপে তৈরী করেছেন আল্লাহ্‌ শুধুমাত্র এই লাইনটা বলার জন্য। কিন্তু যেটা বললেন সেটা আরব শ্রোতা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। আল্লাহ্‌ বললেন-

 إِنَّ ٱلۡإِنسَـٰنَ لِرَبِّهِۦ لَكَنُودٌ۬ (٦) وَإِنَّهُ ۥ عَلَىٰ ذَٲلِكَ لَشَہِيدٌ۬

Innal Insaana lirabbihi la kanood. Wa Innahu ‘Ala thalika la Shaheed.

“There is absolutely no doubt that the human being is TRULY, EXTREMELY disloyal/Ungrateful to His Master. And indeed, he is to that a witness."

আরবীয় ঘোড়া সম্পর্কে এরাবিয়ান হর্স এসোসিয়েশন বলেছে-

“An Arabian will take care of its owner as no other horse will, for it has not only been raised to physical perfection, but has been instilled with a spirit of loyalty unparalleled by that of any other breed. If you’re looking for a companion who’ll be your partner in adventure or competition-and your friend for life-then an Arabian may be the horse for you “

আরবীয় ঘোড়া প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ও খুবই বিশ্বস্ত প্রানী। এরা যুদ্ধের ময়দানে অসাধারন বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য বিখ্যাত। যুদ্ধের ময়দানের প্রথমেই প্রতিপক্ষের তরবারির ও বর্শার আঘাত লাগত তাদের ঘোড়ার গায়ে। বিশালাকার হবার কারনে প্রায় সময়েই এরা তরবারির আঘাত, এমনকি বর্শার আঘাতেও মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ত না। একজন আরব মনেপ্রানে ঘোড়া ভালবাসত। তার চেয়েও সে বেশি ভালবাসত যুদ্ধের ঘোড়া। তার চেয়েও বেশি ভালবাসত সে মাদি যুদ্ধের ঘোড়া। তার চেয়েও সে বেশি ভালবাসত প্রভুভক্ত বিশ্বস্ত মাদি যুদ্ধের ঘোড়া। আরবরা তাদের ঘোড়ার শক্তি, গতি, বিশ্বস্ততা নিয়ে কবিতা পর্যন্ত লিখত। আগের আয়াতে দেখা যাচ্ছিল, মাত্র কয়েকটি ঘোড়া নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পশুপাখির কিছু সহজাত প্রবৃত্তি আছে। কোন বিপদ আঁচ করতে পারলে, কোন জায়গায় আগুন লাগলে, মৃত্যুভয় পেলে সাথে সাথে তারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এটাকে Animal Instinct বলে। কিন্তু যুদ্ধের ঘোড়া ব্যতিক্রম। মরণে তার কোন ভয় নেই, কোন দ্বিধা নেই। তার পিঠে যে বসে আছে সে-ই তার মালিক। মালিক তাকে দিয়ে যা করাবে, সে তাই করবে। আপনি দৃশ্যটা কল্পনা করুন। একটি ঘোড়ার গায়ে এফোঁড়ওফোঁড় বিঁধে আছে একটি বর্শা, গা থেকে ফিনকি দিয়ে ফোয়ারার মত রক্ত ঝরছে। তারপরো ঘোড়াটি পালিয়ে যাচ্ছে না, সে পিঠে তার মনিবকে নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। যতক্ষন পর্যন্ত তার দেহে শেষ বিন্দু নিঃশ্বাস আছে ততক্ষন সে তাঁর প্রানপ্রিয় মালিককে ত্যাগ করবেনা। যতক্ষন প্রভুর জন্য লড়াই করা সম্ভব, সে করবে। প্রভুর জন্য সে মরবে। কারন সে সাধারন কোন ঘোড়া নয়। সে যুদ্ধের ঘোড়া। হয়ত ক্ষনিকের জীবন তার। কিন্তু জীবনের এরচেয়ে অর্থবহ ও গৌরবান্বিত কোন সংজ্ঞা হওয়া সম্ভব নয়। বিশ্বস্ততার এরচেয়ে বড় কোন নজির হওয়া সম্ভব না।

আরব শ্রোতা এক মূহুর্ত আগেও মনে মনে ভাবছিল তার প্রিয় ঘোড়াটা কতই না বিশ্বস্ত। এবার আল্লাহ্‌ তার ঘুমন্ত বিবেককে প্রচন্ড এক ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিয়ে বলছেন-

"কোন সন্দেহ নেই অবশ্যই মানুষ তার রবের প্রতি অত্যন্ত অকৃতজ্ঞ, ভয়ঙ্কর অকৃতজ্ঞ। এবং অবশ্যই তার অকৃতজ্ঞতার সবচেয়ে বড় সাক্ষী সে নিজেই।"

বিস্ময়ে স্তব্ধ ও নির্বাক হয়ে আরব শ্রোতা উপলব্ধি করতে পারল মহান আল্লাহ্‌ তাকে তার ঘোড়ার উপমা দিয়েই কি প্রচন্ড শক্তিশালী একটি রিমাইন্ডার দিয়েছেন। বিশ্বস্ততা কি জিনিস এটা সে তার ঘোড়ার কাছ থেকে খুব ভাল করে জানে। এখন আল্লাহই তাকে আবার মনে করে দিচ্ছেন যে সে আল্লাহর প্রতি কতটা অকৃতজ্ঞ। আল্লাহ্‌ তাকে বানিয়েছেন, আল্লাহ্ তার ঘোড়াটাকেও সৃষ্টি করেছেন। আরব তার ঘোড়াটার মালিক, কিন্তু সে ঘোড়াটার স্রষ্টা না। ঘোড়াটা তার জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিচ্ছে। ঘোড়ার বুদ্ধিমত্তা, চিন্তাশক্তি, আবেগ মানুষের চেয়ে অনেক কম ও সীমিত। সেটুকু চিন্তাশক্তি দিয়েই সে এত বেশি কৃতজ্ঞ যে তার জীবন সে দিয়ে দিচ্ছে মিনিবের জন্য। আর আরব শ্রোতা মানুষ হয়ে জন্মেছে, আল্লাহ্‌ তাকে সর্বোচ্চ বুদ্ধিমত্তা দান করেছেন, কিন্তু তাঁর স্রষ্টার প্রতি সে কতটাই না অকৃতজ্ঞ ! কি অসাধারন শক্তিশালী যুক্তি, তুলনা, দৃশ্য, আবেগ ও ঊপমা করেছেন আল্লাহ্‌। সুবহানআল্লাহ।।

আল্লাহ্‌ এই আয়াতে বলেছেন মানুষ হচ্ছে Kanood. এখানে একটা টান আছে, kan-o-o-d. এই টানকে আরবিতে বলা হয় “সিগাতুল মুবালাগা”, যেটা মূলত প্রচন্ডতা বুঝায়। [যেমন- আর-রাহমা~ন= অকল্পনীয় দয়ালু, সীমাহীন দয়ালু, Un-Imaginably Merciful]

Kanood= Extremely Ungrateful. Ungrateful to all the favors of Allah. Someone who always complains and never appreciates the unlimited blessings of Allah.

Kanood শব্দটির আরো একটি মানে হচ্ছে – যে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে, আলাদা করে রাখে, To separate. আরবের ঘোড়া জীবনের শেষ বিন্দু পর্যন্ত তার মনিবের পাশে ছিল। কিন্তু জগতের শ্রেষ্ঠ প্রানী মানুষ তার প্রভুর সাথে সেটা করেনা। মানুষ শুধু অকৃতজ্ঞই না, সে আরো একধাপ বেশি। সে খুব ভাল করেই জানে যে সে অকৃতজ্ঞ। তার অকৃতজ্ঞতা সম্পর্কে তার পূর্নমাত্রায় ধারনা আছে। আসুন আমরা আমাদের মর্ডান মুসলিমদের জীবনের উদাহরনগুলো দেখি। আমি সামান্য কয়েকটি পয়েন্ট দেখাব, এতেই আপনি ধারনা পেয়ে যাবেন।

মানুষ ভয়ঙ্কর রকম কমপ্লেক্স সাইকোলজিকাল ডিজাইনের একটি প্রানী। হেঁয়ালি করছি না একটুও। আমার নিজেকে আমি পুরোপুরি বুঝি না। আমার চিন্তা ভাবনা অনেকগুলোই আমি কন্ট্রোল করতে পারিনা। আমার ভিতরেই একজন ভয়ঙ্কর অপরাধী আছে, আমার ভিতরেই একজন ভাল কেউ আছে। কারন আমাকে আমি ডিজাইন করিনি। আমাকে আমার চেয়েও বেশি ভাল জানেন শুধুই আল্লাহ্‌। আল্লাহ্‌ আমাদের মধ্যে কৃতজ্ঞতা-অকৃতজ্ঞতা দুই-ই দিয়েছেন। এটা একটা পরীক্ষা। এটাই পৃথিবীতে আমাদের ক্লাস টেস্ট, যেটার রেজাল্ট আমরা পাব মরার পর। আমরা চোখ বুজে মরব। তারপর চোখ খুলব। সাথেসাথেই। অন্য জগতে। “মরা” কথাটা সঠিক না। মানুষ মরে না। মানুষ ইন্তেকাল করে। Antaqilu মানে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তন, To Transform.

আল্লাহ্‌ যে জিনিসগুলো আমাদের কাছ থেকে চেয়েছেন, আল্লাহর শপথ নিয়ে আমি বলছি, সেগুলো কঠিন হতে পারে, কিন্তু অসম্ভব না। ঈমান আনো, নামাজ পড়, ঠিকমতন কাপড়-বেশভূষা কর, রোজা রাখ, যাকাত দাও, সততা বজায় রাখ, ভাল ব্যবহার কর প্রত্যেকের সাথে, মা-বাবাকে দেখভাল কর, নিজের শরীর-মন-সত্তাকে পবিত্র রাখ, আল্লাহকে স্মরন কর, তাঁর দয়া ও করুনা চাও। ব্যস, এইতো। আল্লাহ্‌ আমাদেরকে তাঁর জন্য জীবন দিয়ে দিতে বলেননি।

আমরা নামাজ পড়িনা। দিনে ৫টা বার আমরা আল্লাহর সামনে দাড়াই পর্যন্ত না। আমি মুসলিমদের কথা বলছি ভাই, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান অমুসলিম ভাইবোনদের কথা না। আমরা মুসলিম, আমরা দাড়ি রাখিনা। দাড়ি রাখা লিটারেলী একটা “অসম্ভব” হয়ে গেছে এখনকার সমাজে। দাড়ি রাখব? কি বলেন ভাই এগুলা? কেমনে কি?

আপনি মুসলিম। আপনি খুব ভাল করেই জানেন দাড়ি রাখতে হয় মুসলিমদের। আমি আপনাকে দলিল দিতে চাচ্ছি না, কারন আপনার ইস্যুটা দলিল না। আমি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, রমজানে কুর’আন খতম করা মুসলিমের সাথে কথা বলেছি। তিনি ক্লিন-শেভড, বয়স তৃতীয় দশক। আমি তাকে দাড়ির ব্যাপারে বলেছি। তিনি বিনা দ্বিধায় জানিয়েছেন যে হ্যা, এটা অবশ্যই দরকার আছে। ঐ পর্যন্তই। আপনি যদি এরকমটাই করে থাকেন এখনো, তাহলে আপনার যুক্তিগুলো এরকম-

– আপনি ঠিক করেছেন আপনি দাড়ি রাখবেন না। জীবনেও না। যে যাই বলুক। দুনিয়া উলটে যাক। ইম্পসিবল। যুবক বয়সে কেউ দাড়ি রাখে নাকি? যতসব ইসলামিস্ট কোথাকার !

– যারা দাড়ি রাখেনা তারা নরমাল মুসলিম। যারা রাখে তারা একটূ “বেশি” মুসলিম। অতটুকু বেশি না হলেও চলে। না ভাই, ব্যাপারটা সেরকম না। আপনি যত নাবিদের নাম জানেন সবার ইতিহাস সার্চ করে দেখেন, প্রত্যেকের দাড়ি আছে। কি ছবি আসল, কাদের ছবি দেখাল, এটা ব্যাপার না। যেটা ব্যাপার সেটা হচ্ছে প্রত্যেকের দাড়ি আছে। শুধুই নাবি মুহাম্মাদ(স) এর সুন্নাহ হলে বাকি নাবিদের দাড়ি থাকত না। আপনি বাইবেল খুলে দেখেন, বাইবেলে চিত্র আছে। সব মেসেঞ্জারের দাড়ি আছে। এটা আল্লাহর আদেশ। এটা কোন ফাজলামি না। দাড়ি রাখা নিজেকে আল্লাহর ইচ্ছার সামনে সমর্পন করার একটি বহিঃপ্রকাশ। আপনি মানবেন না মানে আপনি আল্লাহর কথা শুনবেন না। চিন্তা করে দেখুন। আপনি পড়েন আর না পড়েন আমি আপনাকে লিঙ্ক দিয়ে রাখলাম, হেদায়েত একমাত্র আল্লাহ্‌ দেন। [ sunnah.com/search/beard ]

– আপনার ধারনা আপনার এখনো বয়স হয়নি। আপনি ঠিক করেছেন ঠিক ৬০ বছর থেকে দাড়ি রাখবেন। কে আপনাকে ততদিন গ্যারান্টি দিচ্ছে ভাই? আপনি কি সেলফ-ডিলিউশনের স্বীকার নন? আপনি যেদিন থেকে সাবালক হয়েছেন সেদিন থেকে আপনি অ্যাডাল্ট। আপনার হিসাব হবে একজন অ্যাডাল্ট এর মতন। কাকে ফাকি দিচ্ছেন আপনি? নিজেকে? আল্লাহকে?

– আপনার এখন যতটুকু তাকওয়া আছে তাতে দাড়িটা ঠিক আসেনা। আরেকটু তাকওয়া হোক। তাকওয়া রাতারাতি গজিয়ে যাবেনা ভাই। আপনার কাজই আপনার তাকওয়া এনে দিবে। আপনি দাড়ি রাখবেন না, আচ্ছা ঠিক আছে, আপনাকে দাড়ি রাখতে হবে না। আপনি দাড়ি কাটা বরং বন্ধ করে দিন। দেখেন তাকওয়া আসে কিনা। দাড়ি কাটা নিয়ে কি কি কঠোর সাবধানবানী আছে দয়া করে পড়ে দেখুন।

– আপনি আসলে রাখতেই চান। কিন্তু লোকে কি বলবে? আপনার বাসায় তোলপাড় হয়ে যাবে। আপনার ডিভোর্স হয়ে যাবে। আপনি একজন চরম স্মার্ট থেকে গ্রাম্য ক্ষ্যাত হুজুরে পরিনত হবেন। সমাজের চোখে আপনি তাবলীগ, শিবির, হিযবুত তাহরি, আল-কায়দা, জঙ্গী, সন্ত্রাসী, এলিয়েন হয়ে যাবেন। এগুলো ভাবলেই আপনার বুক শুকিয়ে যায়, আপনি আবার একটা রেজর কিনে আনেন পরদিন। আপনি চিন্তা করুন আপনি আসলে কার দাস, আল্লাহর, নাকি সমাজের। আপনি “লোকে কি বলবে” সেটা নিয়ে লজ্জায় মরে যাচ্ছেন, আর আপনি আল্লাহকে গ্রাহ্যও করছেন না। কার কতটুকু ক্ষমতা আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন? আপনি কার সামনে দাঁড়াবেন একদিন? কে বাচাবে আপনাকে সেদিন? কে আপনাকে কি বলল তাতে আপনার কি? আল্লাহ্‌ কি এখনো আপনাকে মাফ করে দিচ্ছেন না? আপনি কি বুঝেন না সেটা? যে আপনাকে হুজুর বলে সেটা তার মানসিক সমস্যা, আশ্চর্য ! আপনি তাকে করুনা করুন, তাঁর জন্য দোয়া করুন। আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি, আপনি দাড়ি রাখেন, আপনার জীবন পালটে যাবে। আল্লাহ্‌ আপনাকে সরাসরি সাহায্য করবেন। কিভাবে করবেন আপনার কোন ধারনাও নাই। মনে রাখবেন- There are only two kind of people without beard, women and children !

– এসব কথা শুনতে আসলে আপনার ভাল লাগেনা। আপনি এমনিই না জেনে আর্টিকেলটা পড়া শুরু করেছিলেন, এখন আপনার চরম মেজাজ খারাপ। কতবড় সাহস ফালতু লোকজনের, আপনাকে উপদেশ দেয়? ভাই, আমি কেউ না আপনাকে উপদেশ দেওয়ার। আমার কোন যোগ্যতা নাই। ইসলাম পারফেক্ট, আমি না। আমি ইসলামকে রিপ্রেজেন্ট করি না। ইসলামকে যিনি রিপ্রেজেন্ট করেন তাঁর নাম মুহাম্মাদ(স). আপনি নিজেও জানেন। আপনি একটু চিন্তা করেন আরো। আপনি চাইলে একদিন আল্লাহকে দেখতে পারবেন। এটা কি আপনাকে শিহরিত করেনা? সামান্য কয়েকটা দাড়ির জন্য আপনি কেন রিস্ক নিবেন? যদি এটাও আপনাকে শিহরিত না করে, তাহলে আপনার জন্য আমার দুঃখের কোন সীমা নেই। আমি দু’আ করি আপনার জন্য।

– আপনি খুবই চালাক। দাড়ি রেখেছেন, কারন আপনার ঈমান আছে। কিন্তু ওদিকে যে চক্ষুলজ্জাও আছে। তাই আপনার দাড়িটা হচ্ছে ডেভিড বেকহ্যামের খোচাখোচা দাড়ি আর চাপদাড়ির মাঝামাঝি। কেউ যখন জিজ্ঞেস করে- কি মিয়া, দাড়ি কি স্টাইল নাকি সুন্নতি দাড়ি ? তখন আপনি তাড়াতাড়ি বলেন- “আরে না না কি যে বলেন না, জাস্ট স্টাইল।"

– এটাই আমার শেষ পয়েন্ট। এটাও আমাদের জন্মগত মুসলিম পুরুষদের জন্যই। গোড়ালির উপর প্যান্ট না পরা। এটার যুক্তিগুলোও হুবহু উপরের মতন। আপনি দেখুন কোনটা আপনার জীবনে উপস্থিত। কেন আপনি এমন করেন নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করেন। আল্লাহ্‌ ছেলেদের বলেছেন গোড়ালির উপরে কাপড় পড়তে, আর মেয়েদেরকে বলেছেন গোড়ালি ঢেকে রাখতে। এমনই দিন পড়েছে, ছেলেদের প্যান্ট মাটিতে লুটায় আর মেয়েদের প্যান্ট দিন দিন ছোট হচ্ছেই। আমি মুসলিমদের কথা বলছি ভাই। আমরা প্যান্টটা দুইটা ভাজ দিতে শরমে মরে যাই, আর বুক ফুলিয়ে নাইকি আর অ্যাডিডাসের থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট পরে বলি- Just do it.

– আপনি কি আল্লাহর দাস হিসেবে নিজেকে মেনে নিয়েছেন? পুরোপুরি নাকি আংশিক? যদি উত্তর হ্যা হয়, তাহলে কোন সমস্যা হবার কথা না। যদি আপনার মনে হয়, এগুলো আপনার ভাল লাগে না, এগুলো আপনার ইচ্ছার বিরূদ্ধে, তাহলে আমি আপনাকে মনে করিয়ে দেই যে, দাসের কোন ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকেনা, সে প্রভুর হুকুমে চলে। আপনি আল্লাহর সৃষ্টি। ঘোড়াও আল্লাহর সৃষ্টি। ঘোড়াকে দানাপানি দেওয়া ছাড়া আপনি বেশি কিছু করেন না। এর বিনিময়েই সে আপনার জন্য মারা যেতে প্রস্তুত। এবার আপনি চিন্তা করুন আল্লাহ্‌ আপনাকে কত অগনিত নিয়ামত দিয়েছেন, আর তার বিনিময়ে তিনি কত সামান্য জিনিস চেয়েছেন। কত সামান্য। আপনি কি কৃতজ্ঞ? নিজেক জিগেশ করুন। আমরা সবাই অকৃতজ্ঞ ভাই। আপনি, আমি, আমরা সবাই। আসেন আমরা চেষ্টা করি। আপনি কৃতজ্ঞতা বাড়ান, আপনি একবার না, একশবার দাড়ি রাখবেন।

আমি আপনাকে রিমাইন্ডার দিলাম। লিঙ্ক দিলাম। ভয়ঙ্কর সাবধানবানী আছে। পড়ে দেখেন। কি করবেন আপনার সিদ্ধান্ত। আপনার জীবন আপনার। আমারটা আমার। আমি জুয়া খেলব না ভাই। [ sunnah.com/search/ankle ]

আমরা মানুষরা কত অকৃতজ্ঞ এটা নিয়ে আপনি একটা জরিপ করেন। দেখেন কেমন রেজাল্ট পান। ১০ জন র‍্যান্ডম মুসলিম নিবেন আশেপাশে থেকে। দেখেন কে কোন প্যারামিটার এ পড়ে। এই ক্রাইটেরিয়া গুলোর পাশে নম্বর/পারসেন্ট বসাবেন।

– নামধারি মুসলিম। বিসমিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ বাদে প্র্যাকটিস লেভেল শূন্য= ___ %

– নামাজ পড়ে। শুধু জুম্মা=

– নামাজ পড়ে। টুকটাক। ১/২/৩ ওয়াক্ত। ইচ্ছামতন। =

– নামাজ পড়ে। ৫ ওয়াক্ত। ভালই কাজা করে। মাসজিদে যায়না। =

– নামাজ পড়ে। রেগুলার ৫ ওয়াক্ত। কাজা করে না। মাসজিদে মোটামুটি যায়। =

– সবই ঠিক আছে। দাড়ি নাই, প্যান্ট ও ঠিক নাই। =

– নামাজ ঠিক আছে সব। দাড়ি আছে, প্যান্ট ঠিক আছে। বয়স ৪০ এর উপর।=

– নামাজ ঠিক আছে সব। দাড়ি আছে, প্যান্ট ঠিক আছে। বয়স ৪০ এর নিচে। টীন এজার, তরুন, যুবক। =


 এরপর আল্লাহ্‌ বলেছেন-

وَإِنَّهُ ۥ لِحُبِّ ٱلۡخَيۡرِ لَشَدِيدٌ (٨

أَفَلَا يَعۡلَمُ إِذَا بُعۡثِرَ مَا فِى ٱلۡقُبُورِ (٩

 وَحُصِّلَ مَا فِى ٱلصُّدُورِ (١٠

 إِنَّ رَبَّہُم بِہِمۡ يَوۡمَٮِٕذٍ۬ لَّخَبِيرُۢ (١١

Wa Innahu lihubbil Khayri Lashadeed.

Afala ya’lamu itha bu’thira maa fil Quboor ?

Wa hussila maa fis-sudur.

Inaa Rabaahum bihim Yawma ithin lakhabeer.

“And no doubt his love of wealth is truly intense.

But does he not know that when the contents of the graves are scattered?

And whatever is in the chest, will be revealed?

Indeed, that day, their Lord is fully Knowledgeable with them. “

“কোন সন্দেহ নেই যে সম্পদের প্রতি তার লোভ ও ভালবাসা অত্যন্ত তীব্র ও প্রখর। কিন্তু সে কি জানে না যে, কবর থেকে সবকিছুকে বের করা হবে? আর হৃদয়ের মাঝে যা কিছু আছে, সেটাও বের করা হবে ? আর অবশ্যই সেদিন তাদের প্রভু তাদের সম্পর্কে সম্পূর্ন জ্ঞাত থাকবেন। “

আল্লাহ্‌ বলছেন, সম্পদের প্রতি মানুষের ভালবাসা [Hub = Love] অত্যন্ত তীব্র। এতই তীব্র যে, সে এটার প্রতি Shadeed (Ashadda = দড়ি দিয়ে বাঁধা), গাধার নাকের সামনে মূলোর মত আমাদের সবার সামনে একটা অদৃশ্য মূলো আছে। গাধা তো গাধাই, তাই সে মূলো পেয়েই খুশি। কিন্তু আমরা? সম্পদ, টাকা, আরো টাকা, বাড়ি-গাড়ি-ফ্ল্যাট-জমি, ক্যারিয়ার, বিদেশে সেটলমেন্ট, ভালো থাকা-খাওয়া-পরা-বিনোদন…এরকম অগনিত জিনিস নিয়ে আমাদের মূলো তৈরী। আর সেটার পিছে আমরা দৌড়াতেই থাকি। একদিন থামি। যেদিন আমরা কবরে যাই। এর আগে আমরা থামিনা।

আমাদেরকে কবর থেকে বের করা হবে একদিন, সেটাই আল্লাহ্‌ আমাদেরকে জিজ্ঞেস করছেন এরপর। কুর’আন এত শক্তিশালী যে বুকের মধ্যে ধাক্কা দেয়। আল্লাহ্‌ বলেছেন, সেদিন আমাদেরকে Bu’thira করে কবর থেকে বের করা হবে। আপনার টুলবক্সে কোন এক কোনায় একটা স্ক্রুড্রাইভার আছে, সেটা আপনার দরকার। কিন্তু সেটা অনেক ভিতরে, তাই আপনি টুলবক্স থেকে টেনে টেনে জিনিস বের করা শুরু করলেন, সেটাকে উপুড় করে ঝাঁকালেন। এটা হচ্ছে বা’সারা। আল্লাহ্‌ বলেছেন, আমরা যেন মনে রাখি আমাদেরকে এইভাবেই একদিন কবর থেকে বের করে তাঁর সামনে দাড় করানো হবে।

আগের সূরায় আল্লাহ্‌ বলেছিলেন, কেউ একটা অনু পরিমান কাজ করলেও সেটা সেদিন দেখানো হবে। এই সূরায় আল্লাহ্‌ আরো ডিটেইল বলে দিচ্ছেন। সেদিন আমাদের হৃদয়কে আল্লাহ্‌ Hussila করবেন। কোন কিছুর আবরন/ছাল ছাড়ানোকে হুসসিলা বলে। যেমন কলার ছিলকে ছাড়ান। সেদিন আমাদের হৃদয়ের যাবতীয় আবরন কে ছাড়িয়ে আমাদের প্রতিটি অকৃতজ্ঞতা দেখানো হবে। আর সেদিন আমাদের প্রত্যেকের ব্যাপারে এমন একটা বিষয়ও নেই যা সম্পর্কে আল্লাহ্‌ জ্ঞাত থাকবেন না।

...

একটা কুকুরের কথা শুনবেন? ক্যাপিটান একটা জার্মান শেফার্ড কুকুর। তার মালিক ম্যানুয়েল গুজম্যান ২০০৬ সালে মারা যায়। তারপরেই কুকুরটি বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। এক সপ্তাহ পরে ম্যানুয়েল এর পরিবার তাঁর কবরে যেয়ে আবিষ্কার করে, কুকুরটি কবরের পাশে বসে কাঁদছে। ম্যানুয়েল এর স্ত্রী ভেরোনিকা জানান- “আমরা জানিনা সে কিভাবে সেখানে গেল, কারন আমরা তাকে কবরে নিয়ে যাইনি। এটা একটা রহস্য। "এখানেই শেষ না। প্রতি রবিবার, ম্যানুয়েলের পরিবার তার কবরে যেত। ঠিক টানা ৬ বছর কুকুরটি কবরের পাশেই থাকত। মাঝে মাঝে সে বাসায় যেত বা রাস্তায় হাটাহাটি করত, কিন্তু ঠিক ৬টা বাজার সাথে সাথেই সে এসে ম্যানুয়েলের কবরের ওপর শুয়ে পড়ত। ভেরনিকা জানান- ” আমার ধারনা সে ম্যানুয়েলকে রাতে একা একা ছাড়তে চায়না।” [http://goo.gl/0RcDZp]

একটা উপমা দিয়ে শেষ করি। গভীর রাত। সবাই ঘুম। আপনি হেটে হেটে বাড়ির বাগানে গেলেন। আস্তাবলে আপনার প্রিয় ঘোড়াটা আছে, তাকে একবার দেখবেন। ঘোড়াটা শুয়ে ছিল। রাতে তার লাগাম খোলাই থাকে। আপনাকে দেখামাত্র সে উঠে দাড়ালো। মাটিতে কয়েকবার হালকা ক্ষুর ঠুকল, ফরর ফরর করে নাক দিয়ে আনন্দ প্রকাশের শব্দ করল। আপনি তার পাশে গিয়ে দাড়ালেন। ঘোড়াটি তার বিশাল মাথা আপনার গালে ঠেকাল। অবলা প্রানী, কথা বলতে পারেনা। তাও আপনি স্পষ্ট বুঝলেন সে আপনাকে বলছে- প্রিয় মালিক, প্রিয় বন্ধু। তুমি যতবারই আসবে, আমি তোমার জন্য উঠে দাড়াব। যত রাতেই তুমি আমার কাছে আসনা কেন, আমি ঠিকই তোমাকে পিঠে নিয়ে বের হব। আমরা দুইজনে ঘুরে বেড়াব মনের আনন্দে। তুমি যদি বনের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়, আমি তোমার জন্য জেগে থাকব। তুমি আমাকে ভালবাস। আমিও আমার সবটুকু দিয়ে আমি তোমাকে ভালবাসি। কখনোই তোমার পাশ ছেড়ে আমি যাবনা প্রিয় বন্ধু আমার। আমি একটা ঘোড়া, এর বেশি আমি তোমাকে আর কি-ই বা দিতে পারি। তুমি আমাকে ছেড়ে দিওনা কখনো।

আমাদের একজন প্রভু আছে। তিনি আমাদের বন্ধু। তিনি আমাদের মালিক। তিনি আমাদের ভালবাসেন। আমরা যেন তাঁর সামনে দাড়াই প্রতিদিন। আমরা যেন তাকে ভালবাসি। আমরা যেন ঘোড়ার কাছ থেকে, কুকুরের কাছ থেকে বিশ্বস্ততা শিখি। আমরা মানুষ। আমরা সবার সেরা। আমরা যেন সেটা বজায় রাখতে পারি।

"O Allah ! You’re my Master and Lord. I have only one true friend and that is you only. I disobey you everyday, and yet you forgive me every second. O Allah, make me loyal as an Arabian Horse. Give me so much loyalty and Faithfulness so that I can happily give my small life for you. And then If you give me life, I can die for you again. And then again and again. Give me this much loyalty O Allah. And please forgive this sinful slave of Yours. If you forgive me, not a single atom will go wrong in Your Kingdom. If you punish me, Your Kingdom will not increase by a single atom. You don’t need me O Allah. I do. Forgive my Disloyalty."


 02/09/2014

..

Editor Note: আংশিক সম্পাদিত