স্পর্ধা ৪: অশ্লীলতা

পূর্ববর্তী জাতিগুলোর প্রতি আল্লাহর আযাবের প্যাটার্নটা যদি লক্ষ্য করি। সব জাতিকেই আল্লাহ একটা আযাবে ধ্বংস করেছেন, সিঙ্গেল।

• কওমে নূহ-কে মহাপ্লাবন
• আদ জাতিকে প্রবল ঝড়
• সামুদ জাতিকে ফেরেশতার প্রচণ্ড আওয়াজ
• আসহাবুল আইকা-কে মন্দা-খরা
• কওমে সাবাকে বাঁধ ধ্বসে প্লাবন

শুধু একটা জাতিকে ধ্বংস করেছেন ৫টা আযাব একসাথে দিয়ে, করুণভাবে। কওমে লূত। (বাকি দুটো মাও: তারিক জামিল বলেছিলেন; কোনো হাদিসে আছে বোধ হয়)

  • দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয়া (সূরা ক্বমার ৫৪: ৩৭)
  • প্রচণ্ড নিনাদ
  • নগরকে উলটে দেয়া (সূরা হুদ : আয়াত ৬৯-৮৩)
  • ভূমিকম্প
  • পাথর-বর্ষণ (সূরা আল আ’রাফ : আয়াত ৮৩-৮৪)

স্পর্ধা তো সবার কমন কারণ। তাহলে কওমে লূত কেন ভাগে এতোগুলো পেল। কারণ আমরা সবাই জানি। বিরল প্রজাতির অশ্লীলতার প্রসার। মূলত: সমকামিতা ছিল তাদের অশ্লীলতার চরমতম পর্যায়। এর আগের পর্যায়গুলোতে ছিল তাদের কাছে পানিভাত। স্বাভাবিক যৌনতা যখন সয়লাব, তখন মানুষ আরও বৈচিত্র্য খোঁজে। ‘মানসাঙ্ক’ বইতে বহু আলোচনা করেছি যৌনমনোবিজ্ঞান নিয়ে। সুতরাং, অশ্লীলতার সয়লাব আল্লাহর ক্রোধকে বাড়িয়ে তোলে। এবং অশ্লীলতা বিষয়টি চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ে, মানুষ চিত্ত-বিনোদনের জন্য নতুন নতুন অশ্লীলতা খুঁজে নেয়। অলরেডি পশ্চিমে সমকামিতা গ্রহণযোগ্য হয়ে গেছে, ফলে আওয়াজ উঠেছে ড্র্যাগকুইনের নামে বালক-কামের। নেদারল্যান্ডে শিশুকামীদের ম্যাগাজিন আছে PAIDIKA নামে। ডার্ক-ওয়েবে টেরাবাইট টেরাবাইট শিশুপর্ন, মৃতদেহের সাথে পর্ন। জার্মানিতে পশুকামীদের সংগঠন নিজেদের অধিকারের জন্য আইনী লড়াই চালাচ্ছে।

লিবারেলদের কথাবার্তার মূল ভিত্তি হল ‘সম্মতি’। সম্মতি থাকলে সব বৈধ, ধর্মটর্ম গোনার টাইম নাই। এখন কানাডার আদালত বলছে, 'সম্মতির ব্যাপারটা যেহেতু নেই, অতএব যৌনাঙ্গে প্রবেশ ছাড়া পশুর সাথে সবকিছু করা বৈধ'। পশুকামীরা বলছে, পশুরাও এক বিশেষ ধরনের সম্মতি দেয়, অতএব পশুকাম বৈধ। ‘জেন্ডার আইডেনটিটি’র পুরোধা মনোবিদ জন মানি এক সাক্ষাতকারে শিশুকামী ম্যাগাজিনকে বলেন: 'বালক যদি সম্মতি দেয়, তবে বালক-কাম হতে পারে দুই প্রজন্মের এক অপূর্ব সম্মিলন'। অথচ, সম্মতি ছাড়া স্বামী কিচ্ছু করতে পারবে না— ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ হবে সেটা। এই হল সোকল্ড ‘সম্মতি’র বাস্তব চেহারা। অন্য কোনোদিনের জন্য সে আলাপ তোলা থাক।

ইসলামী মুআশারাত (ধরে নেন কালচার) এর একদম বেসিক এসেন্স হল ‘হায়া’ বা লজ্জাশীলতা। ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক হিন্দু সমাজের অংশ হওয়ায় উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রেতাত্মা সওয়ার রয়ে গেছে। শূদ্র-বৌদ্ধ-বৈশ্য-নারী কেউ-ই বাদ যায়নি ব্রাহ্মণবাদের জুলুম থেকে, কেবল অস্ত্রধারী রাষ্ট্রকর্তা ক্ষত্রিয়রা ছাড়া। নারীর প্রতি হিন্দু সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের আজও ছাড়েনি। সেজন্য ইসলাম যখন ‘হায়া’র কথা বলে তখন আমাদের চোখেও লজ্জাশীলা নারীর ব্রীড়ানত লাজনম্র দৃষ্টি-টাই চোখে ভাসে। আমাদের বুলিই হয়ে গেছে ‘লজ্জা নারীর ভূষণ, পুরুষের দূষণ’। যেন পুরুষের লজ্জা থাকতে নেই, পুরুষ হবে বেহায়া-নির্লজ্জ।

ইসলামী এই ‘হায়া’ সার্বজনীন, নারী-পুরুষ সবারই। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘আল্লাহ নিজে লজ্জাশীল, তিনি লজ্জাশীলতা পছন্দ করেন’। ইসলাম তার বিভিন্ন বিধানের দ্বারা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য এই ‘হায়া’-কে প্রোমোট করে এবং বে‘হায়া’পনা-কে দমন করে। যে সমাজ ‘হায়া’ বা modesty-র ভিত্তিতে নির্মিত সে সমাজ হয় পবিত্র, সুসংহত। আজ আমাদের সমাজে অমুকের মেয়ে তমুকের সাথে ভেগে যাচ্ছে, অমুক প্রবাসীর বউয়ের ঘরে লোকের আনাগোনা, রাস্তাঘাটে ভ্রূণ-নবজাতকের লাশ পড়ে থাকা, পরকীয়ার বলি, প্রেমের বলি, ধর্ষণ, ভীড়ে-বাসে হাতাহাতি, পার্কে-রিকশায় উন্মত্ত নারী-পুরুষ এগুলো একটা সমাজে ‘হায়া’ না থাকার প্রমাণ। আর ‘হায়া’ না থাকা কোনো সমাজ/সভ্যতার আসন্ন ধ্বংসের আলামত।

আসিফ আদনান ভাই তাঁর আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই ‘চিন্তাপরাধ’-একটি রিসার্চের কথা উল্লেখ করেন। সোশ্যাল নৃতাত্ত্বিক Joseph Daniel Unwin MC (1895–1936) প্রায় ৫০০০ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে ৮৬টি আদিম গোত্র ও ৫টি বৃহৎ সভ্যতার উপর একটি পর্যালোচনা করেন। Sex and Culture (1934) বইয়ে তিনি ফলাফল তুলে ধরেন বিস্তারিত আকারে। যেকোনো সমাজ বা সভ্যতার বিকাশ তাদের যৌনসংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত। প্রতিটি সমাজে শুরুতে যৌনতা ও নৈতিকতার ব্যাপারে কঠোর থাকে, যতদিন তারা এর ব্যাপারে সংযমী থাকে ততদিন তাদের বিকাশ ও উন্নতি হতে থাকে। সমৃদ্ধির চূড়ায় পৌঁছে তাদের ভিতরে শুরু হয় অবক্ষয়। যৌনতার ব্যাপারে উদার হতে থাকে। ব্যভিচার-সমকাম-প্রকাশ্য অশ্লীলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এগুলো স্বাভাবিক প্র্যাক্টিসে পরিণত হয়। ফলে কমে যেতে থাকে সামাজিক শক্তি। অশ্লীলতার প্রসার মানে পতনের বিউগল।

ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থার বুনিয়াদ এই ‘হায়া’ বা লজ্জা। দেখুন কীভাবে ইসলাম ‘হায়া’কে বিভিন্ন বিধানাবলীর দ্বারা প্রতিষ্ঠা করে:

• বিপরীত লিঙ্গের প্রতি দৃষ্টি অবনত রাখা।
• নারীর খিমার-জিলবাব-নিকাব। পুরুষের ঢিলেঢালা পোশাক। মোদ্দাকথা ইসলামী ড্রেসকোড।
• মাহরাম ও গাইরে মাহরাম মেনে চলা। এই ফরজ বিধান তো মুসলিমরা অস্বীকারই করে বসি।
• বাবার সামনে মেয়ে, ছেলের সামনে মা, ছেলেরা ছেলেরা, মেয়েরা মেয়েরা কতটুকু খোলা রাখবে কতটুকু ঢেকে রাখবে তার বিধান।
• সতর-আউরাতের বিধান।
• একজন আরেকজনের ঘরে, আরেকজনের বাড়িতে প্রবেশের আগে অনুমতি গ্রহণের বিধান। উঁকিঝুঁকি নিষিদ্ধ।
• একটা বয়সের পর সন্তানকে পৃথক বিছানায় প্রেরণ।

‘হায়া’ প্রোমোটিং কিছু বিধান ফরজ, কিছু মুস্তাহাব। আবার কিছু আছে ব্যক্তিগত তাকওয়া। আবার এমনও কিছু আছে যা শুনতে অ্যাবসার্ড-ও মনে হতে পারে। এগুলো একটু বলি, তাহলে ‘হায়া’র কনসেপ্টটা ক্লিয়ার হবে। ‘হায়া’র বাংলাটা ঠিক লজ্জাশীলতা পরিপূর্ণতা পায়না। অপরে দেখবে বলে সংকোচ-টাকে আমরা লজ্জা বলি। কিন্তু ‘হায়া’ অর্থ এটাও, প্লাস আত্ম-লজ্জা। অনেকটা ‘আমি এমন কাজ কীভাবে করি’। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনো পর্দা নেই, তারপরও স্ত্রীর শরমগাহে না তাকানো। গুনাহ হবে, তা কিন্তু না। জাস্ট আত্ম-লজ্জা। আবার ধরেন। উসমান রা.-কে বলা হত সবচেয়ে লজ্জাশীল, তিনি নিজ লজ্জাস্থানেও কখনো তাকাতেন না আত্ম-লজ্জায়।