উৎসব শেষের নিস্তব্ধতাকে আমি প্রচন্ড ভয় পাই। এই সময়টা যে কী অদ্ভুত হাহাকার জাগানিয়া সেটা আমি প্রথম বুঝতে পারি এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে।

তখন খুব ছোট। হৈ হৈ করতে করতে গভীর রাত পর্যন্ত বাড়ির ছাদটা মেতে থাকলো। এরপর একটা সময় সবাই কীভাবে কীভাবে যেন হঠাৎই দুম করে গায়েব হয়ে গেলো। ঘণ্টাখানেক আগের মানুষে গমগম করা ছাদটা প্রচন্ড নৈঃশব্দের চিৎকারে কেঁদে উঠছে। আমি চুপচাপ এককোণে ডেকোরেটরের কাঠ-ফোল্ডিং চেয়ারে তীব্র মন খারাপ নিয়ে বসে আছি। বাসার লোকজন শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, বাচ্চারা সবাই শুয়ে পড়েছে, গেস্টরা সবাই বহু আগেই চলে গেছে। আমি শুধু বসে আছি হাহাকার নিয়ে। এক বুক হাহাকার।

সেদিন পূর্ণিমা ছিল কি না মনে নেই, তবে এতটুকু মনে আছে আমার চোখের সামনে জোৎস্নার অদ্ভুত সাদা আলোতে ভেসে যাচ্ছে বিশ্বচরাচর। আমি রাতের নীরবতা আর উৎসব শেষের নৃশংসতাকে বুকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে বসে আছি। কী ভয়ানক, সুতীব্র অনুভূতি আমার।

কোন দুঃখ নেই তবু মনটা হাহাকার করে কেঁদে উঠতে চাইছে অকারণেই। আমার জোৎস্না প্রীতির শুরুটা খুব সম্ভবত সে সময়টা থেকেই।

আজ একাদশীর চাঁদ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সারাদিনের ঝক্কি-ঝামেলা, গরু কাটাকুটি আর খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষ করে বারান্দায় বসেছি। বাসার সবাই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে বহু আগেই। টাইমিং বুঝে চট করে ইলেক্ট্রিসিটিটাও চলে গেলো এই মাত্র। আমার জীবন ফিকশন এর থেকে কোনো অংশেই কম না। অদ্ভুত সাদা আলোয় আমার ঝুল-বারান্দাটা ভেসে যাচ্ছে। আর আমি তলিয়ে যাচ্ছি… ধীরে… ধীরে… ক্রমশঃ

আকাশটার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত প্রতীক্ষা! কিসের তা জানি না! আমি শুধু জানি, উৎসব শেষের একাকিত্ব আমার উপর আবারও জেঁকে বসেছে। আমার এই গভীর একাকিত্ব আমাকে অদ্ভুত উদাসিন করে দেয়। আমি প্রচন্ড ভয় পাই উৎসব শেষের এই নীরবতাকে…

কী অদ্ভুত এই জীবন! এই অনুভূতিগুলো কী দিয়ে তৈরি করেছেন আল্লাহ তায়ালা, চিন্তা করতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলি। কোনো কষ্ট না থেকেও শুধু শুধু কষ্ট পাওয়া! আমার এই দুঃখ বিলাসী মনটা হয়তোবা আসলে মানসিক অসুস্থতাই। কে জানে?

তারা দেখার নেশা আমাকে পেয়ে বসেছিল লন্ডনে থাকবার সময়ে। আমার অদ্ভুত সময়ের অদ্ভুত পাগলামিতে কাউকে সাথে তেমন পাইনি বলে প্রায়ই একাকি ম্যানোর পার্কের র‍্যাবিটস রোডের শেষ মাথার বিশাল মাঠটাতে শুয়ে শুয়ে তারা দেখতাম। পার্কের উলটো পাশেই বিশাল কবরস্থান। গা ছমছম করা অবস্থা। ভয়ও করতো। কিন্তু আমার তারা-প্রীতি সর্বদাই জয়ী হত ভূত-ভীতির উপরে। এক বুক হাহাকার আর পরাজিত মন নিয়ে শুয়ে থাকতাম ঘন্টার পর ঘণ্টা। আবিষ্কার করতাম কতটা ভয়ানক একা আমি এই বিশ্বচরাচরে….

অনেকেই সুযোগ পেলে অন্যের টেস্ট বুঝতে প্রশ্ন করেন—সমুদ্র না পাহাড়? আমি প্রশ্ন করি—চাঁদ না তারা? অধিকাংশ মানুষই পার্থক্যটা ধরতে পারেন না।

একটু বুঝিয়ে বলি—কালো চাদরে মোড়া বিস্তীর্ণ আকাশটাতে ফোঁটা ফোঁটা যে জোনাক পোকার মত আলোগুলো দেখা যায় তার আলো হয়তো চাঁদের মত অতটা শুভ্র কিংবা তীব্র নয়। কিন্তু সে কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবে না। পূর্ণিমা, অষ্টমী, অমাবস্যাতে চাঁদের রূপ ভিন্ন।

কিন্তু তারাগুলো?

তারারা থাকে বছরের পর বছর—একটানা। অনেক দূরে হলেও তাদের অস্তিত্ব তারা জানান দিয়ে যায়, মিটমিট করে জ্বলে থেকে। যেন একটা নির্ভরতার প্রতীক, একটা আশার নিশান। কিছু কিছু তারার যে আলোটা দেখে আমরা হাহাকারে বুক বাঁধি হতে পারে সেই তারাটার এখন আর কোনো অস্তিত্বই নেই। শত-সহস্র বছর আগে তার বিকীর্ণ করা আলোটা এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই হারিয়ে যাওয়া তারাগুলোর কথা ভাবলেও কেন যেন আমি তীব্র বিষন্নতায় ডুবে যাই। হায় অদ্ভুত জীবন!

অমাবস্যায় চাঁদ চুপ করে ডুব মেরে থাকে। পথিকেরা হয় বিভ্রান্ত। পঞ্চমীতে চাঁদ ডুবে থাকে কোথায় জানি না। চাঁদের কাজই আসলে বদলে যাওয়া, বদলে দেওয়া। সব তোলপাড় করে দেয়া তীব্র যে জোয়ার, তার আগমনও নাকি এই চাঁদেরই কারণে। তবুও কেন যেন চাঁদের চাইতে তারারাই আমার কাছে বেশি আপন। বেশি প্রিয়।

আমার ছেলেবেলায় হারানো তারাদের আমি মাঝে মাঝে চুপচাপ বসে বসে খুঁজি। কোন তারাটা এখন আর অস্তিত্বে নেই বুঝতে চেষ্টা করি খালি চোখে। বোঝা যায় না। ঠিক যেভাবে সারাটাজীবন আমি মানুষ দেখে গেছি গভীর ভালোবাসার সাথে। কিন্তু তবু তাদের বুঝে উঠতে পারিনি, কখনওই। আমার এই এলোমেলো মনটা কীসের খোঁজে কী খোঁজে সে নিজেই কি আসলে বুঝতে পারে?

পারে হয়তো…. কে জানে?