মেহমানরা সব চলে গেছে।

ডেকোরেটর ওয়ালাদের বিশাল পাতিল, আর প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো অতিদ্রুত ওঠানো হচ্ছে ভ্যানে। তাদের মাঝে এক অন্যরকম ব্যস্ততা। ফরিদ সাহেবের আজ আর তেমন কোন ব্যস্ততা নেই। তিনি নির্বাক চোখে গ্রিলের ফাঁকে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন। রুনু-ঝুনু তাদের একমাত্র নতুন জামাটা খুলে পরম যত্নে ভাঁজ করে টিনের ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে গম্ভীর মুখে এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে। মা তার ঘরে একমনে বসে সুর করে কাঁদছেন। কখনো কখনো একটু বিরতি দেওয়া হচ্ছে, তার ঠিক পরপরই আবার চাপা-গোঙ্গানি ভেসে আসছে। চারিদিকের নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে সে গোঙ্গানি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এদিক-ওদিক । সে প্রতিধ্বনিতে বুকের অজানা কোন এক কোণে সৃষ্টি হয় প্রবল হাহাকার।


শফিক, অকারণে ব্যস্ততা দেখিয়ে ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে গেছে।
কালো রাত।
ধু-ধু রাস্তা।

গলির অন্য প্রান্তে দুটা কুকুর গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে শফিকের দিকে। শফিক অনার্স শেষ করেছে প্রায় একবছর হতে চলল। কোন চাকরি-বাকরির বন্দোবস্ত হয়নি এখনো পর্যন্ত। গতবার তো প্রায় একটা চাকরি হয়ে-ই গিয়েছিল, বেতন, সুযোগ-সুবিধা বেশ ভালই। কিন্তু প্রতিবারের মত এবারও শেষ মুহূর্তে এসে তারা জানায় এ মুহূর্তে তাদের পক্ষে লোক নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু, হতাশ হবার কিছুই নেই। অতি দ্রুতই তারা অবশ্যই শফিককে ডেকে পাঠাবে। কিন্তু সে ডাক আর আসেনি। কখনো যে আসবেও না সেটা শফিকের খুব ভাল করে জানা হয়ে গেছে । মাথাটা ঝিমঝিম করছে শফিকের, কিছু খাওয়া দরকার। কোথাও দোকান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রয়োজনের সময় এই এক বিপদ, হাতের কাছে কোন কিছুই পাওয়া যাবে না।


আকাশ ভরা আজ উথাল-পাথাল জোছনা। জোছনা ব্যাপারটা অনেককটা জলের মত, যখন যার কাছে যায় তার আকৃতি ধারণ করে। যার মন আজ অসম্ভব ভালো সে এই জোছনা দেখে ভাববে কি সুন্দর আমার জীবনটা, অসাধারণ! তার শুধু ইচ্ছে হবে দুহাত মেলে ধরে বুক ভরে জোছনাকে টেনে নিতে নিজের মাঝে । আর যার আজ মন খারাপ, তার মাঝে প্রবল এক বিষাদের সৃষ্টি করবে এই জোছনা। সে ক্রমশ অস্থির, অসহায় হয়ে পড়বে জোছনার প্রবল টানে।


আজ নিরার অস্থির হওয়ার দিন। তার বিয়ে আবারও ভেঙ্গে গেছে। এ নিয়ে আটবারের মত বিভিন্ন ছেলেপক্ষ তাকে দেখে গেছে। প্রতিবারই সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, শেষ মুহূর্তে উঠে আসে দেনা-পাওনার হিসেব। নিরার দরিদ্র শিক্ষক পিতা প্রতিবারই এ সময়টাতে শূন্য দৃষ্টিতে মাথা নিচু করে কি যেন খুঁজতে থাকেন নিজ পায়ের নখের দিকে। এক সময় ছেলেপক্ষ চলে যায়। কিছুদিন পর হয়ত আসে অন্য কেউ। তাদেরও দেনা-পাওনার হিসেব মেলে না। তারাও চা-মিষ্টি খেয়ে চলে যান। ফরিদ সাহেব আবারও তাকিয়ে থাকেন তার নিজ পায়ের নখের দিকে। এবার ফরিদ সাহেব কিছু টাকা ধার-দেনা করে কোনমতে বিয়ের আয়োজনটা করেছিলেন। বিয়ের আগে পঞ্চাশ আর বিয়ের পরে বাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয়া হবে ছেলেপক্ষকে। এই চুক্তিতে তারা রাজি হলেও শেষ মুহূর্তে কোন এক অজানা কারণে তারা বেঁকে বসেন। ও বাড়ি থেকে খবর আসে পুরো টাকাটাই বিয়ের আগে দিতে হবে নাহলে বিয়ে বন্ধ। তাদের ছেলে কি যেন-তেন ছেলে নাকি? তাদের বংশের একটা মান-ইজ্জত আছে না? তারা কেউ আসেনি। আগত সব মেহমানরা খেয়ে-দেয়ে চলে গেছে। যাওয়ার সময় চারিদিকে ফিসফাস, "অপয়া মেয়েছেলে এমন তো হবেই।" নিরার মা ঠাস করে এক চড় লাগিয়ে নিরাকে বলে গেছে, "এত লোক মরে তুই মরিস না কেন হারামজাদি?"

নিরার মনে আছে খুব ছোটবেলায় কত বউ বউ খেলেছে নিরা। তার মায়ের পুরনো শাড়ি কেটে তাকে একটা ছোট্ট লাল শাড়ি বানিয়ে দেয়া হয়েছিল। সে শাড়ি নিরা শুধু বারবার পড়ত আর খুলত। ঠোটের এপাশ ওপাশ জুড়ে লাল টকটকে লিপস্টিক লাগিয়ে বাবার কাছে গিয়ে অভিমানি কণ্ঠে নিরা বলত, "বাবা আমার বিয়ে কবে হবে?" ফরিদ সাহেব জবাবে জোর করে নিজের বুকের সাথে নিরাকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, "রাজকুমার যেদিন আসবে, সেদিন হবে মা।"

নিরার আজ চিৎকার করে খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, রাজকুমার আসবে না বাবা। তুমি মিথ্যা বলেছ। তোমরা সবাই মিথ্যা বলেছ। নিজের ছায়ার দিকে একটাবার তাকায় নিরা। একি! ছায়াটা এত লম্বা কেন আজ? কেমন স্থির অভিমানি একটা ছায়া, যে ছায়া অনেক কিছু বলতে চায়, বলতে পারেনা। কাউকে শোনাতে পারে না তার অব্যক্ত অনুভূতিগুলো। নিজের মাঝে আটকে পরা ছায়াটা করে চলে শুধুই হাহাকার। দূরে কোথা থেকে যেন হাস্নাহেনার তীব্র ঘ্রাণ আসছে। নাক জ্বালা করতে থাকে নিরার।

আকাশের ওপার থেকে কেউ যেন ডাকতে থাকে নিরাকে, কে ডাকে? জোছনারা? ধীরে ধীরে পা বাড়ায় নিরা। রেলিঙের দিকে, আজ সে হয়ত পাখি হবে। দু'হাত মেলে দিয়ে ভেসে যাবে শূন্যে। অথবা হয়ত সে জোছনা হবে। সাড়া দেবে ওপারের জোছনাদের ডাকে। ভেসে যাবে এপার থেকে ওপারে……..


বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৩