গত ৬ পর্বের আলোচনায় আমি এটুকু দেখাতে চেয়েছি, এই করোনা আল্লাহর গযব এবং আযাবুল আদনা (ছোট আযাব)। আল্লাহর সমস্ত গযবই বস্তু দিয়ে হয়, যার ফলে সবকিছুরই বস্তুবাদী ব্যাখ্যা হয়। কোনো কিছুর বস্তুবাদী ব্যাখ্যা জানি বলে তা আল্লাহর আযাব নয়, এই ধারণা ঠিক নয়। করোনা তো একটা জীবাণু, একটা ভাইরাস। এটা আল্লাহর আযাব হবে কেন? এটা অজ্ঞতাপ্রসূত প্রশ্ন। আল্লাহ তাঁর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে যেকোন কিছুকেই ব্যবহার করতে পারেন। মশা, পঙ্গপাল, উকুন, দাবানল, অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্প যেকোনো কিছু। যেমন এক হাদিসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যখন ব্যভিচার ব্যাপক হবে, তখন আল্লাহ তোমাদের উপর এমন সব রোগ আপতিত করবেন, যা তোমাদের পূর্বে হতো না। অর্থাৎ এই যে নতুন নতুন রোগ, এগুলো আমাদের কৃতকর্মের দরুণ আল্লাহর ক্রোধের প্রকাশ।

এবং আমরা আরও দেখলাম, আল্লাহর গযব একটা ব্যাপক বিষয়। তাঁর রহমত যেমন একটা ব্যাপক বিষয়। আল্লাহকে যে গালি দেয়, তাকেও আল্লাহ একটা নির্দিষ্ট সময় অব্দি অবকাশ দেন। তাকেও রিজক দেন, পায়খানা আটকে দেন না, সন্তান দেন। তেমনি তাঁর গযবও ব্যাপক। যে এলাকায় আসে সে এলাকায় কাফির-মুমিন সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আযাবে গ্রেপ্তার হয়। এই কমন আযাবটাই কাফিরের জন্য 'ফাইনাল ধরা' হয়, মুমিনের জন্য আশীর্বাদ হয়ে যায়।

মহামারিতে দুজন মরলো, কাফিরের জাহান্নামের জীবন শুরু হল। মুমিনের শহীদের মর্যাদা শুরু হল। আযাবটা মুমিনের জন্য পুরস্কার।

আর জীবিত উদাসীন মুমিনদের জন্য ওয়ার্নিং। কেউ কেউ শুদ্ধ হল।

আর কেউ কেউ গুনাহে হঠকারিতা করতেই থাকলো। ক্রমাগত গুনাহ করতে থাকা বা গুনাহের ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে যাওয়া এই মুমিনটির ঈমান চলে যাওয়ার কারণ হবে। যেমন 'সালাত হল পার্থক্য ঈমান ও কুফরের মাঝে' এই হাদিসের ব্যাখ্যায় হানবালী আলিমগণ বলেন, বেনামাযী কাফির। আর অধিকাংশ উলামাগণ বলেন, বেনামাযী নগদে কাফির হবে না, তবে তার নামায ত্যাগ মৃত্যুর আগে তাকে কাফির বানাবে।

আমরা প্রত্যেকে মৃত্যুকালে শয়তানের চূড়ান্ত প্রচেষ্টার সম্মুখীন হব, ফিতনাতুল মামাত (মৃত্যুকালীন পরীক্ষা)। শয়তান তার সর্বশক্তি দিয়ে শেষ চেষ্টা করবে ঈমানহরণের। যে জীবিতকালে শয়তানের সামান্য ইন্ধনেই কাত হত, সে সর্বশক্তি নিয়োগে ঈমান ত্যাগ করবে। হয়ত সে মারা গেল, দাফন হল, জানাযা হল, কুরআন খতম হল। কিন্তু সে কাফির হয়ে মরেছে। মৃত্যুর মুহূর্তে সে ঈমান ত্যাগ করে মরেছে। সুতরাং 'মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া'টা আপনাকে জান্নাতের গ্যারান্টি দেয় না। বরং 'ঈমান নিয়ে মৃত্যু' আপনাকে জান্নাতে পৌঁছবে। আর ঈমান নিয়ে মৃত্যু তখনই গ্যারান্টেড যখন আপনি পুরোটা জীবন ঈমানের উপর চলে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরি করবেন, তাওবার মাধ্যমে ফিরে আসবেন আল্লাহর দিকে।

আল্লাহ বলছেন: যারা বলে আল্লাহ আমার রব্ব (প্রতিপালক+অধিকারী Master), এবং এই কথার উপরেই অটল থাকে, লেগে থাকে। তার জন্য (মৃত্যুকালে) নাযিল করব ফেরেশতা। যারা বলবে, ভয় পেওনা, দুঃখ করোনা, কাঙ্ক্ষিত জান্নাতের সুসংবাদ নাও। মৃত্যুকালে আল্লাহ ফেরেশতা পাঠিয়ে আপনার ঈমান নিশ্চিত করে, আপনাকে কমফোর্ট করে জান্নাত নিশ্চিত করবেন। শর্ত হল আল্লাহকে তাঁর অধিকার দিতে হবে, রব্ব হিসেবে, আপনার মালিক হিসেবে, আপনার পালনকর্তা হিসেবে তাঁর যে স্থান আপনার জীবনযাত্রায় তাঁর প্রাপ্য, সেটা তাঁকে দিতে হবে। এবং মৃত্যু তক সেই জীবনের উপর আপনাকে অটল থাকার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এটা আপনারই কাজ। নয়ত আল্লাহর নিজস্ব কোনো ঠেকা নেই যে, মুসলিম পরিবারে জন্ম বলে আমাকে জান্নাত দিতেই হবে।

তো, করোনা আল্লাহর ক্রোধের প্রকাশ। আপনার ঈমানের এন্টেনায় এটুকু ধরা পড়তে হবে। নাহলে প্রবলেম। যদিও এই পোস্টগুলোতে শুরুতে লিখেই দিয়েছিলাম, এগুলো শুধু মুসলিমদের জন্য। এখানে কেবল মুসলিমদের জন্য কিছু বিশ্বাসের কথা হচ্ছে, কোনো যুক্তিতর্ক নয়। এরপরও আরবি নামের কিছু 'বাঙলা কথা বুঝেনা এমন' লোকেরা এবং কিছু দাদা-দিদিরা মন্তব্য করে গেছেন। একজন প্রশ্ন করেছেন: তাহলে আল্লাহর গজব ঠেকানোর জন্য এই যে মাস্ক-পিপিই-ভ্যাক্সিন এগুলো তো বেয়াদবি হচ্ছে, রাগকে কাউন্টার দেয়া কি ঠিক? দেখুন:

- গযব এসেছে রোগের সুরতে

- নবীজী বলছেন: আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার আরোগ্য সৃষ্টি না করেছেন। এই হাদিসের উপর ভিত্তি করে মুসলিম সভ্যতায় চিকিৎসাবিজ্ঞান সাধন করেছিল অভূতপূর্ব উন্নতি। বিভিন্ন সভ্যতার গ্রন্থ অনুবাদ- বিশ্লেষণ, নতুন ওষুধ সন্ধান, ফার্মাকোলজি ডেভলপ করেছিল, যার উপর ভিত্তি করে আধুনিক ইউরোপীয় মেডিসিন গড়ে উঠেছে। সার্জারি যন্ত্রপাতি ডেভলপ, সার্জারি প্রক্রিয়া গঠন হয়েছিল যার অনেককিছু আজও আমরা ব্যবহার করি। সুতরাং রোগ নিয়ে গবেষণা, এটাও ইসলামের বিধান থেকে উৎসারিত ও উৎসাহিত।

- হাদিসের হুকুম মহামারি গযব। মহামারির সময় যথোচিত ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছেন নবীজী। নিজেকে দূরে রাখো, ঐ স্থানে যেওনা, সেখান থেকে বের হয়ো না। সুস্থ উট অসুস্থ উট মিশিও না। পবিত্রতা মেইনটেইন করো (তাহারাত)। ক্ষতিকর প্রাণী হত্যা কর।

সুতরাং বস্তুবাদ বলছে, মহামারি বস্তুগত কারণে হলো (ভাইরাস ইত্যাদি), বস্তু দিয়ে সমাধান করো (ভ্যাক্সিন ইত্যাদি)। আর ইসলাম বলছে, বস্তুগত মাধ্যমের (ভাইরাস) আড়ালে আসল উৎস আল্লাহর ক্রোধ (তোমাদের গুনাহের কারণে), ফলে আসল উৎস সামলাও (তওবা, আমল দ্বারা সন্তুষ্ট করো) এবং মাধ্যম সামলাও (ওষুধ, হাইজিন ইত্যাদি)। ইসলাম হলিস্টিক সিস্টেম, টোটাল (ইহজগত+পরজগত), উট বেঁধে তাওয়াক্কুল। শুধু বিশ্বাসে ভর করে হাত গুটিয়ে থাকা নয়, আবার বিশ্বাসহীন বস্তু-গোঁড়ামি নয়। এটাই ইসলাম আর অন্যান্য ধর্মের পার্থক্য।

এবং ভ্যাক্সিন/ওষুধ তৈরি হল, করোনা চলে গেল; তবুও এটা প্রমাণ হয় না যে এটা আযাব না। কারণ "...কতক জাতিকে এর দ্বারা শাস্তি দেয়া হয়েছে। কিছু এখনও বাকি রয়ে গেছে, তাই কখনও তা আসে, কখনও চলে যায়। তবে মুমিনদের জন্য আল্লাহ একে রহমত বানিয়েছেন..."

হাদিস বলছে: মহামারি আসবে এবং চলেও যাবে। গযব যেমন আসে বস্তুগত মাধ্যম দিয়ে। গযব চলেও যেতে পারে বস্তুগত মাধ্যম দিয়ে (ভ্যাক্সিন/ওষুধ)। মাধ্যমের পর্দার আড়ালে আল্লাহর একচ্ছত্র রাজত্ব ও ক্ষমতার প্রকাশ বিশ্বাসীর বিশ্বাসের ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়ে। গাছপালা, আকাশ, ফুল, বৃষ্টি সবকিছুর অন্তরালে সে মহাশিল্পীর নিপুণ কারিগরি দেখে, ফিজিক্সের সূত্রের খটমটে ধ্রুবক গুলোর মাঝে মহাপরিকল্পনা-প্রসূত হিসেবী টিউনিঙ অনুভব করে। জীবকোষের ভিতর এই মুহূর্তে হাজারো বিক্রিয়া একই সাথে আনইন্টেরাপ্টেড চলতে দেখে সে এক মহানিয়ন্ত্রকের অমোঘ নিয়মকে উপলব্ধি করে। বিশ্বাসী করোনার ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের পিছনে করুণাময়ের করুণা দেখে, নগণ্য মানুষকে দেয়া যোগ্যতার জন্য সে মহান দাতার বদান্যতার শোকর করে। আর বস্তুবাদী কেবল বস্তুর উপাসনা করে। বস্তুর সাফল্যে অহংকারী হয়ে ওঠে। বস্তুর ব্যর্থতায় আশাহত হয়।

অন্ধ সূর্য দেখে না, তাই বলে কি সূর্য নেই?

সামনের পর্বে আমরা আলোচনা করব, কেন আমাদের উপর করোনার আযাব এলো। কী করিনি আমরা। কী কী করতে বাকি রেখেছি আমরা।

চলবে ইনশাআল্লাহ