আল্লাহর গযব/আযাব প্রাথমিকভাবে সতর্ক করার জন্য আসে। কী কী দিয়ে দুনিয়াতে আযাব দেয়া হয়। আযাবের জন্য আল্লাহ কী কী ব্যবহার করেন।

★ আদ জাতিকে প্রবল ঝড় দিয়ে। আজকের যুগে একে 'প্রাকৃতিক দুর্যোগ' বলে চালিয়ে দেয়া যায়। বায়ুচাপের তারতম্যের কারণে উচ্চচাপের এলাকা থেকে নিম্নচাপের এলাকায় বায়ু প্রবাহিত হয়ে ঝড় হয়। এটুকু বিজ্ঞান আপনাকে বলবে। বস্তুজগতের বাইরে কোনো ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারে না। কোন পিয়ার রিভিউ জার্নাল কখনোই বলবেনা, 'আমরা এর কারণ খুঁজে পেতে ব্যর্থ', অতএব এটা একটা অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা। বরং প্রতিটি ঘটনার কোনো না কোনো বস্তুগত ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে চেষ্টা করে। কেননা এটাই তার কাজ। 'প্রকৃতিবাদ'কে নিজের চালকের আসনে বসিয়ে বিজ্ঞান অতিপ্রাকৃত কিছুকে কীভাবে মেনে নিতে পারে? বিজ্ঞান নামক tool-টার সাথে ইসলামের বিরোধ নেই। কিন্তু প্রকৃতিবাদের সাথে ইসলামের ১৮০ ডিগ্রী বিরোধ।

ইসলামের দর্শন হল: আল্লাহ সৃষ্টিজগতে কারণ (cause) ও ঘটনা (effect) কে ওতপ্রোতভাবে রেখেছেন। 'কারণ'-এর পর্দা না থাকলে সকলেই আল্লাহর কুদরত (শক্তি-রহস্য) জেনে ঈমান এনে ফেলত। তখন দুনিয়া যে 'পরীক্ষাগার', সেই বিষয়টা আর থাকতো না। সবাই এ-প্লাস। বাহ্যদর্শী মানুষ (সেক্যুলার/বিজ্ঞানান্ধ) 'কারণ'-এর বেড়াজালে আটকে যায়। 'ঘটনা'র পিছনে 'কারণ'কেই দায়ী মনে করতে থাকে। ফলে 'কারণ'-এর আড়ালে যে আসল শক্তি (আল্লাহ) কারণ ও ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তার দিকে তার দৃষ্টি যায় না। 'পশ্চিমা বিজ্ঞান' এই কারণ পর্যন্ত যায়, এবং কারণের পরে আর যাবে না সেই সংকল্প করেই সে রাস্তায় নামে। 'পশ্চিমা বিজ্ঞান' কেন বললাম, কারণ বিজ্ঞান একসময় মুসলিমদের tool ছিল। কুরআন থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঈমানের ইন্দ্রিয় সাথে নিয়ে তারা বিজ্ঞানচর্চা করত। ফলে আবিষ্কার হিসেবে আল্লাহকে তারা আরও বেশি করে চিনত। 'কারণ' তো বের করতেনই, কারণের পিছনে 'আল্লাহর শক্তি'কেও তাঁরা বুঝতে পারতেন। পশ্চিমা বিজ্ঞান আর মুসলিম যুগের বিজ্ঞান নিয়ে একটা লেখা আছে আমার। একটু আইডিয়া পেতে পারেন। ফলে বিজ্ঞানকে কে চালাচ্ছে তার উপর নির্ভর করবে ফল কী পাচ্ছেন।

★ সামুদ জাতিকে ফেরেশতার প্রচণ্ড আওয়াজের দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছে। এখানেও কোনো বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। কেনো ম্যাগনেটিক ইভেন্ট বা কসমিক ইভেন্ট বলে চালিয়ে দেয়া যায়।

★ ফিরআউনের কিবতী সম্প্রদায়কে কয়েকটা আযাব দেয়া হয়েছিল পরপর, যাতে তারা ফিরে আসে। প্রথমে দেয়া হল অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ। "তারপর আমি পাকড়াও করেছি-ফেরাউনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে এবং ফল ফসলের ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে যাতে করে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। অতঃপর যখন শুভদিন ফিরে আসে, তখন তারা বলতে আরম্ভ করে যে, এটাই আমাদের জন্য উপযোগী"। অর্থাৎ ছোট যে সতর্কীকরণ আযাব আসে তা এজন্য আসে না যে, সবাইকে শেষ করে না দেয়া অব্দি চলবে। বরং সেটা এসে আবার চলে যায়। শুভদিন ফিরে আসে। এই করোনাও একদিন চলে যাবে। শুধু পার্থক্য হবে: কেউ একে আল্লাহর আযাব চিনে জীবনযাপনে সংযত হবে। ফিরে আসবে আল্লাহর দিকে। আর কেউ বলবে: করোনা চলে গেছে, এটাই আমাদের উপযোগী। আমাদের জ্ঞানবিজ্ঞান যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে করোনাকে আমরা পরাজিত করব, এটাই স্বাভাবিক। দেখবেন, আজকেও এটাই বলবে যা ফিরআউনের কওম বলেছিল। 'এটাই তো হবার কথা যে আমরা নিজেরা এর মোকাবেলা করলাম' এই স্পর্ধা ও আযাবকে চিনতে ব্যর্থ হলো তারা। এরপর-

"সুতরাং আমি তাদের উপর পাঠিয়ে দিলাম তুফান (বন্যা), পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত প্রভৃতি বহুবিধ নিদর্শন একের পর এক। তারপরেও তারা গর্ব করতে থাকল। বস্তুতঃ তারা ছিল অপরাধপ্রবণ" [সূরা আরাফ:১৩৩]। আপনি চাইলে এই সবগুলোরই জাগতিক ব্যাখ্যা দিয়ে আল্লাহ, তাঁর সতর্কীকরণ এসব বাইপাস করতে পারবেন। তারা এগুলো মূসা আ. এর জাদু-ভেলকিবাজি বলে বাইপাস করেছিল। আপনি বিজ্ঞানের যুগে প্রাকৃতিক ঘটনা, স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, টেকটোনিক প্লেট নড়ে গেছে বলে সুনামি হইসিলো, মাটিতে আয়রন বেশি হয়ে গিয়েছিল বলে পানি রক্তবর্ণ হয়ে গেছলো, ইত্যাদি বলে অস্বীকার করবেন। এই যা।

পরপর সতর্কবার্তা বুঝতে ব্যর্থ হওয়া, বারবার আল্লাহকে অস্বীকার করা, মুসলিমদের উপর অত্যাচার অব্যাহত রাখা, ফিরাআউনের নিজেকে 'আল্লাহ' দাবি করা এবং তার কওমের মেনে নেয়া। এরপর ফাইনাল পাকড়াও এল। তাহলে যেহেতু পিয়ার রিভিউড রিসার্চ জার্নাল এটাকে অতিপ্রাকৃত কিছু বলছে না, তাহলে আমরাও অপেক্ষা করি ফাইনাল খেলার জন্য।

এই পর্বে আমি এটুকু বুঝাতে চেষ্টা করলাম, সকল আসমানী/জমিনী আযাব কিংবা আল্লাহর ক্রোধ বস্তু দিয়েই দেয়া হয়, ফলে চাইলেই এর বস্তুগত ব্যাখ্যা দেয়া যায়, যা বিজ্ঞান দিয়ে থাকে। কিন্তু বস্তুগত পর্দার আড়ালে বা বস্তুগত কারণের আড়ালে এর মূল উৎস যে আল্লাহর শক্তি এবং মূল কারণ যে আমাদের আমল, সেটা কেবল গায়েবে বিশ্বাসীর ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়বে।

"জলে-স্থলে যে বিপর্যয়, তা মানুষের দুহাতের কামাই..." (আয়াত)

কোন পিয়ার রিভিউয়ে ঈমানদার এটা বুঝবে না। এখন আমি কোন ঈমানদার এটা আমাকে স্পষ্ট অবস্থানে যেতে হবে? ঈমান আর কুফরের মাঝে আর কোনো অবস্থান নেই। হয় আপনাকে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর সত্যবাদিতার উপর ঈমান আনতে হবে, পূর্ণ আত্মসমর্পণ। নয়তো পিয়ার রিভিউয়ের কাছে কুরআন-হাদিস-ঈমানকে সেকেণ্ডারি রাখতে হবে।

১৪০০ বছর আগের শ্রেষ্ঠ বংশে জন্ম নেয়া একজন মানুষ, যে তার ৪০ বছরের জীবনে কখনও মিথ্যা বলেছেন এমন রেকর্ড নেই, রোমসম্রাট হিরাক্লিয়াসের সামনে শত্রু আবু সুফিয়ান তাঁর নামে মিথ্যেবাদিতার অভিযোগ করতে পারেনি বাকিদের সামনে নিজে মিথ্যেবাদী সাব্যস্ত হবার ভয়ে। মিথ্যে যে যে কারণে আমরা বলি তার সবগুলো তাঁকে অফার করা হয়েছিল:

- যদি ক্ষমতা চান, আপনাকে আমরা আরবের সর্দার বানিয়ে নেব
- যদি অর্থ চান, আপনাকে সবচেয়ে ধনী বানিয়ে দেব
- যদি নারী চান, আমাদের ১০ জন সুন্দরী নারীকে আপনার সাথে বিবাহ দেব। তবু আপনি এই কুরআন প্রচার বাদ দেন।

আমরা অর্থ-সম্মান-নারী-ক্ষমতার জন্যই মিথ্যে বলি। তিনি বললেন: এক হাতে চন্দ্র, আরেক হাতে সূর্য দিলেও এই দাওয়াত বন্ধ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। অথচ তিনি তখন অভাবী, সংসার করছেন ৫৫ বছর বয়েসী বিগতযৌবনা এক নারীর সাথে। যদি মিথ্যাবাদীই হন, কেন লুফে নিলেন না সে অফার? কী তার সেই বাধ্যবাধকতা।

যাদের চোখের সামনে তিনি চন্দ্রকলার মত বড় হয়েছেন ৪০ টা বছর তারা তাঁর কাছে সম্পদ গচ্ছিত রেখেছে, আল-আমিন নামে ডেকেছে, বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আস্থা রেখেছে। সেই লোকগুলোকেই যখন আহ্বান করলেন: তোমাদের 'মনচাহি' জীবন থেকে ফিরে এসো দীন ইসলামের দিকে। মিথ্যে উপাস্য থেকে ফিরে এসো আল্লাহর দিকে। তখন এতকালের সাক্ষী সেই লোকগুলোই তাকে মিথ্যেবাদী বলে দিল, যদিও তারা জানত তাদের সাথে কাটানো ৪০টা বছর আল-আমিন কখনও মিথ্যে বলেননি। তারা জানতো তার কোনো পার্থিব উদ্দেশ্যও নেই। তারপরও তারা তাঁকে অস্বীকার করল কী কারণে? মিলিয়ে দেখি তো আমরাও সেই একই কারণে তাঁর আনীত দীনকে নিজের জীবনে আনতে অপারগ কি না। তাঁর আনীত শরীয়াহর কাছে নিজের খেয়ালখুশিকে সমর্পণ করতে অনিচ্ছুক কি না। ১৪০০ বছর পরেও কারণগুলো সেই একই।

চলবে ইনশাআল্লাহ