ব্যাপারটা এতদূর গড়াবে কে জানতো।

সামান্য একটা বিষয় নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। তর্কের একপর্যায়ে স্বামীর কন্ঠ চড়তে থাকে। স্ত্রীকে ধমক দিয়ে বসেন। স্বামীর এ আচরণ স্ত্রীর কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। তার দুচোখ অশ্রুতে টলমল করে উঠে। দৌড়ে নিজের মহলে ছুটে আসেন তিনি। হতভম্ব স্বামী স্ত্রীর পিছু নেন। স্ত্রী মহলে পৌঁছে দরজা আটকে দেন। স্বামী বেচারা দাঁড়িয়ে থাকেন দরজার ওপাশে। স্বামী অনুনয় বিনয় করেন, মাফ চান, বারবার বলেন দরজা খুলতে, কিন্তু স্ত্রী কোনো জবাব দেন না।

স্বামী আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান, ৫ম উমাইয়া খলিফা, ইবনে খালদুন যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তিনি দরজার বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন। সময় গড়ায়, স্ত্রী দরজা আটকে বসে থাকেন। খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের কাছে প্রতিটি মুহূর্ত অসহ্য মনে হয়। দ্রুত নিজের কক্ষে এসে ডেকে পাঠান উমর বিন বেলাল আসাদিকে। উমর বিন বেলাল আসাদি বনু উমাইয়ার নেতৃস্থানীয়দের একজন। হজরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু ও ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়ার দরবারেও তাকে সমীহ করা হতো। উমর বিন বেলাল আসাদি খলিফার ডাক পেয়ে ছুটে এলেন।

‘আমার স্ত্রী আমার উপর অভিমান করেছে। সে নিজের মহলে ঢুকে দরজা আটকে দিয়েছে। আমি অনেক বলেছি, সে কিছুতেই দরজা খুলছে না’—বললেন খলিফা।

‘অভিমান তো। একটু পরেই কেটে যাবে। আপনি পেরেশান হবেন না’—বললেন উমর বিন বেলাল আসাদি।

‘নাহ, তাকে ছাড়া প্রতিটি মুহূর্ত অসহ্য মনে হচ্ছে। আমি আর থাকতে পারছি না। আপনি যেভাবে পারেন তাকে বুঝান’—অনুনয়ের স্বরে বললেন খলিফা। মুসলিম বিশ্বের প্রতাপশালী এই খলিফার এমন চেহারা আগে দেখেনি কেউ।

‘আচ্ছা আমি দেখছি কী করা যায়’—এই বলে উঠে এলেন উমর বিন বেলাল আসাদি।—উমর বিন বেলাল আসাদি এলেন রানীর মহলের সামনে। দরজার সামনে বসে তিনি কান্না শুরু করলেন। রানী দাসীদের পাঠালেন খবর জানতে। দাসীরা এসে উমর বিন বেলাল আসাদিকে দেখে চমকে গেল। যে মানুষটিকে বনু উমাইয়ার ছোট-বড় নির্বিশেষে সবাই শ্রদ্ধা করে তিনি কান্না করছেন।

‘আপনি কান্না করছেন কেন?’—দাসীরা প্রশ্ন করে।

‘আমার দুই ছেলে। আজ তাদের একজন অপরজনকে হত্যা করে। আমি খলিফাকে বললাম, আমি যেহেতু নিহত ব্যক্তির অভিভাবক তাই আমি খুনীকে মাফ করে দিলাম। খলিফা আমার কথা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, খুনীকেও হত্যা করা হবে। যেন তা অন্য খুনীদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।

আমি তা হতে দিতে পারি না। আমি চাইনা আমার দুই ছেলেই নিহত হোক। তোমরা যাও, রানীকে একটু বলো আমার কথা। শুধু তিনিই পারেন খলীফাকে বোঝাতে। তিনি খলীফাকে একটু বোঝালেই আমার ছেলের জীবন রক্ষা পাবে’—কাঁদতে কাঁদতে বললেন উমর বিন বেলাল। দাসীরা এসে রানীকে সব জানালো।

‘আমি এখন কী করবো? আমি তো রাগ করে খলীফার সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছি’—রানী অসহায় কন্ঠে বললেন।

‘সমস্যা নেই। খলিফা নিজেও আপনার সাথে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে আছেন। তিনি তো দরজার পাশে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছেন’—দাসীদের একজন বলে।

‘আমার যাওয়া উচিত। উমর বিন বেলালকে আমার বাবা ও দাদা খুব সম্মান করতেন। আমি চাইনা এই মানুষটা শেষ বয়সে এসে এতবড় আঘাত পাক’—এই বলে রানী নতুন কাপড় পরলেন, সুগন্ধী মাখলেন। দাসীদের বললেন, মহলের দরজা খুলে দাও। আমি খলীফার কক্ষে যাবো।

নিজের কক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান। রানী কক্ষে প্রবেশ করে সালাম দিলেন। খলীফা কোনো জবাব দিলেন না। তিনি তাকিয়ে আছেন অন্যদিকে। তার বুকেও জমে আছে চাপা অভিমান।

‘আমি নিজের জন্য আপনার কাছে আসিনি। এসেছি উমর বিন বেলালের পক্ষ হয়ে’—রানী বললেন।

‘বলো, শুনছি’—খলিফা নির্বিকার কন্ঠে বললেন।

‘আপনি তার ছেলেকে কতল করতে চান, অথচ তিনি নিজেই সেই ছেলেকে মাফ করে দিয়েছেন। আপনিও তাকে মাফ করে দিন’—রানী মৃদু কন্ঠে বললেন।

‘নাহ, আমি মাফ করবো না। আমি চাই এই ঘটনা সবার জন্য শিক্ষা হয়ে থাকুক। আর কেউ যেন কাউকে হত্যা করার সাহস না করে’—খলীফা দৃঢ় কন্ঠে বললেন।

একবারও তিনি রানীর দিকে তাকাননি। রানী এগিয়ে এসে খলীফার হাত ধরে ফেললেন। দুচোখে আকুলতা। খলীফা বাধ্য হলেন রানীর চোখে চোখ রাখতে।

‘আমার কথাটা রাখুন। আপনি জানেন আমার বাবা ও দাদার দরবারে উমর বিন বেলালকে কতটা সম্মান করা হতো। এই দিকটা ভেবে হলেও আপনি তার ছেলেকে মাফ করে দিন’—রানী কন্ঠের সবটুকু আকুলতা মিশিয়ে বললেন।

খলীফার ভেতরের অভিমানের বাধ হুড়মুড় করে ভেংগে গেল। চোখে জমা হলো দুফোটা অশ্রু।

‘শুনো, উমর বিন বেলালের কিচ্ছু হয়নি। আমি তাকে বলেছি যেভাবে পারে তোমাকে মহল থেকে বের করতে। তাই সে এই অভিনয় করেছে’—এই বলে খলীফা স্ত্রীকে কাছে টেনে নিলেন। দুজনে গল্প শুরু করলেন। ভুলে গেলেন আগের রাগ, অভিমান, সবকিছু।

#

খলীফার প্রিয়তমা এই রানীর নাম আতিকা বিনতে ইয়াযিদ। যার সারাজীবন কেটেছে রাজপ্রাসাদে। তার আত্মীয়দের মধ্যে অন্তত বারোজন খলিফা হয়েছেন, যাদের সাথে তার পর্দা করা আবশ্যক ছিল না। দাদা মুয়াবিয়া বিন আবি সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন প্রথম উমাইয়া খলিফা। পিতা ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়া, বিতর্কিত এক খলিফা। ভাই মুয়াবিয়া বিন ইয়াযিদ, তিনিও খলিফা। স্বামী আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান, ৫ম উমাইয়া খলীফা। শ্বশুর মারওয়ান বিন হাকাম, তিনিও খলিফা।

আতিকা বিনতে ইয়াযিদের জন্ম সিরিয়ায়। সেখানেই বেড়ে উঠেন। পিতা তার জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। শীঘ্রই তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। বিশেষ করে হাদীসশাস্ত্রে তার পান্ডিত্য ছিল সর্বজনবিদিত। দানশীলতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। নিজের সব সম্পদ আবু সুফিয়ানের পরিবারের গরিবদের দান করে দিয়েছিলেন। আতিকা বিনতে ইয়াযিদ ইন্তেকাল করেন দামেশকে, ১২৬ হিজরীতে (৭৪৪ খ্রিস্টাব্দ)। সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।

(সূত্র: নিসাউন ফি কুসুরিল উমারা—আহমদ খলিল জুমআ)