গোটা আরব উপদ্বীপ এবং এর আশপাশ থেকে মানুষ ইমাম মুহাম্মাদ এর কাছে ইলম শেখার জন্য ছুটে আসতে লাগল। এসময় এক অবাক কান্ড ঘটল। যদিও এটা খুব সামান্য ব্যাপার, তারপরও আমার মনে হয় আল্লাহ এধরণের ঘটনার মাধ্যমে মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন। এক মহিলা ইমাম মুহাম্মাদের কাছে এসে বললেন, আমি যিনা করেছি। তখন ইমাম মুহাম্মাদ ঠিক তাই করলেন যা রাসুল (ﷺ) আল গ্বামিদিয়ার সাথে করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, তুমি কি পাগল? তোমার মাথায় কি কোন সমস্যা আছে? কিন্তু সেই মহিলাটি গ্বামিদীয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) এর মতো অনবরত বলেই চলছিলো, আমি গুনাহ করেছি, আমি গুনাহ থেকে মুক্ত হতে চাই।

তারপর মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাব শরীয়াহর বিধান অনুযায়ী তাঁকে পাথর মেরে হত্যার নির্দেশ দিলেন। এ নির্দেশ দেয়ার অধিকার তার ছিলো কারণ তিনি ছিলেন সেই শহরের বিচারক। মহিলাটির জোরাজুরির পরই তিনি তাকে পাথর মেরে হত্যার আদেশ দিলেন। কিন্তু এই ঘটনার পর শহরের গভর্নর যিনি সবসময় তাকে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন তিনিও তার বিরুদ্ধে চলে গেলেন। চিন্তা করে দেখুন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কত সংকীর্ণ!

পার্শ্ববর্তী আল আহসা শহরের অধিপতি উয়াইনার গভর্নরের কাছে খবর পাঠালো, ঐ মহিলাকে যে হত্যা করেছে তাকে হত্যা কর নতুবা আমরা তোমাদের বছরবছর যে আর্থিক সাহায্য পাঠাই তা বন্ধ করে দেয়া হবে। আহসা থেকে উয়াইনাতে প্রতি বছর টাকা পাঠানো হত, উয়াইনার জনগণ সেই অর্থের উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই তারা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্‌হাবকে হত্যার শর্ত জুড়ে দিল।

উয়াইনার গভর্নরের ক্ষমতাচ্যুত হবার কোন ইচ্ছা ছিলোনা। মুহাম্মাদ ইবুনল ওয়াহ্‌হাব তাই বাধ্য হলেন শহর ত্যাগ করতে।

গভর্নর বলেছিলেন আহসার গভর্নর আপনাকে নিহত দেখতে চায়, কিন্তু আমি আপনাকে হত্যা করতে চাইনা। আমি শুধু চাই আপনি এ শহর ছেড়ে চলে যান। তিনি এটা যথেষ্ট সম্মানের সাথেই বলেছিলেন। মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাব বলেছিলেন আল্লাহ আমাদের পক্ষে আছেন। আমরা কোন ভুল করিনি। আমরা সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করছি। আর যদি আল্লাহ কাউকে ধ্বংস করতে চান তাহলে কোন কিছুই তাঁর সামনে দাড়াতে পারবে না।

আহসার গভর্নরের অনবরত চাপের মুখে মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাব সেই শহর ছেড়ে কাছাকাছি আরেকটা শহরে নিজের ঘাঁটি গড়লেন। এই শহরের গভর্নর ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনু সাউদ। আজকের অযোগ্য কলুষিত সৌদি শাসকদের পূর্বপুরুষ। আল্লাহই ভালো জানেন কিন্তু মুহাম্মাদ ইবনু সাউদকে আমার একনিষ্ঠই মনে হয়। মনে রাখতে হবে আমরা বাদশা ফাহাদ, আব্দুল্লাহ, সালমান বা তাদের ভাইদের মতো কারো কথা বলছিনা। তাদের চার-পাঁচ পুরুষ আগের কথা বলছি। মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব শহরে ঢোকার পর বিন সউদ তাকে সাদরে গ্রহন করলেন।

ইমাম মুহাম্মাদ সেখানে যাবার পর একজনের বাসায় অতিথি হিসেবে উঠলেন। ইবনু সাউদের স্ত্রী জানতে পারলেন যে মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাব শহরে এসেছেন, এবং তিনি জানতেন যে ইমাম মুহাম্মাদ সঠিক পথের উপর আছেন। তিনি তার স্বামীকে বললেন অমুক বাড়িতে একজন লোক এসেছেন। আমাদের উচিৎ তাঁকে আশ্রয় দেয়া, তাঁকে রক্ষা করা এবং তাঁকে লোকদের শিক্ষা দেয়ার সুযোগ করে দেয়া যাতে উম্মাহর পুনর্জাগরণ ঘটানো যায়। মুহাম্মাদ ইবনু সাউদ তাই করলেন। ফলে মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাব সুযোগ পেলেন স্বাধীনভাবে দাওয়াতী কাজ করার। আবার বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক এসে জড়ো হতে লাগল তার কাছ থেকে ইলম শেখার জন্য। তিনি আবারো শেখাতে শুরু করলেন। পাশাপাশি চললো মূর্তি আর কুব্বা ধ্বংস, শিরক বিদআতের মুলোৎপাটন করার কাজ।

মুহাম্মাদ ইবনু সাউদ বললেন, ইন শা আল্লাহ আমরা বিজয়ী হবো, কিন্তু আমার ভয় হলো আপনি হয়তো বিজয়ের পর আমাদেরকে ফেলে আবার অন্য কোন শহরে চলে যাবেন। ইমাম মুহাম্মাদ বললেন, না আমি ওয়াদা করছি আমি এখানে থাকবো। এটা ছিলো মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহাবের স্থায়ী দাওয়াতের সূচনা, এখানে তিনি দীর্ঘদিন অবস্থান করেছিলেন। তিনি বেঁচে ছিলেন প্রায় ৯১ বছর। তাঁর জন্ম ১১১৫ হিজরীতে এবং মৃত্যু ১২০৬ হিজরীতে। দীর্ঘকাল তিনি দাওয়াতী ময়দানে কাটান।

ইবনু সাউদের মৃত্যুর পর, তাঁর আত্মীয় স্বজনরা ক্ষমতায় আসে, তারাও ইবনুল ওয়াহ্‌হাবের প্রতি সমর্থন জারী রাখে। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে তাদের শক্তি। বিভিন্ন দিক থেকে লোকজন এসে তাদের সাথে যোগ দেয়। শক্তি সঞ্চয় করে অন্যান্য শহরেও তাঁরা তাওহীদের বাণী ছড়িয়ে দেয়া শুরু করেন। যেখানেই তারা শিরকের নামগন্ধ পেতেন, ছুটে যেতেন এবং বিশুদ্ধ তাওহীদের বাণী প্রচার করতেন। প্রথমেই তারা যেটা করতেন তা হল কুব্বাগুলো ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া। এভাবে মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাবের দাওয়াত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বর্তমানে সবাই তাকে চেনে।

আমি এতোক্ষন যা বললাম, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাব তার গোটা জীবনজুড়ে এ কাজগুলোই করেছেন। ১১৫৮ হিজরীর আগে তিনি সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেননি। তার মৃত্যুর পর তার সঙ্গীরা মক্কা দখল করে, তারপর তায়েফ অবরোধ করে রাখে, তায়েফের পর মদীনা বিজয় হয় শান্তিপূর্ণভাবে অবরোধের পর। এটা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহাবের মৃত্যুর পর হয়।

তাঁর সময়ের পরে পৃথিবীতে এমন কোন দাওয়াতী মিশন ছিলনা বললেই চলে যা এই মানুষটির দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। পাকিস্তানে আমাদের ভাইরা আছেন যাদের নাম উল্লেখ করতে চাচ্ছিনা, যাদের দাদা পরদাদারা এই মানুষটির দাওয়াত ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। আসলে এটা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাবের দাওয়াত নয়, বরং রাসুল (ﷺ) এর দাওয়াহ। ইয়েমেনে আশ-শাওকানী, আস-সামআনী, এরা কারা? এরা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্‌হাবের শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত। কিংবা আলজেরিয়ার কথাই ধরুন, তাঁর পদাংক অনুসরণ করা আলেমগণ সারা বিশ্বেই আছেন।

কেন?

কারণ তিনি এমন ব্যক্তি যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত হিদায়াত ও সত্য গ্রহন করেছিলেন। পাশাপাশি কুরআন সুন্নাহ ও ফিতরাতের প্রতি কাজ করে মানুষের সহজাত আকর্ষণ। তিনি পুরো উম্মাহকে পুনর্জীবিত করেছিলেন।