আধুনিকতার কিছু ন্যারেটিভ আছে। এই রকম একটা ন্যারেটিভ হলো—প্রফেশন আর ব্যক্তিত্বকে মিলিয়ে ফেলা যাবে না।

নারীবাদীরাও যেহেতু মনেপ্রাণে আধুনিকায়নে বিশ্বাসী, তাই তাদের মুখে এই কথা বেশি শোনা যায়। বিশেষ করে নারীদের ব্যাপারে তারা এই তত্ত্ব খাটানোর জোরদার চেষ্টা চালায়। যেমন: কোনো নারী কর্মজীবনে পতিতা বলেই তাকে অসম্মান করা যাবে না। কেননা অন্যান্য সকল পেশার মতোই পতিতাবৃত্তি তার পেশা মাত্র।

কয়েকদিন আগে আমি নারীবাদিতা নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। আজকে কমেন্ট পড়তে গিয়ে একটা ইন্টারেস্টিং কমেন্ট চোখে পড়ল। বলা যায়, পুরো কমেন্ট সেকশনে একজনই মাত্র পোস্টের কিছু কথার বিরোধিতা করেছেন, আপনার জন্য শুভেচ্ছা।

তার কথা ছিল, আমি কেন বিখ্যাত অভিনেত্রী টাইপ মহিলাদের ব্যক্তিগত জীবন টেনে এনে সমালোচনা করছি। সে তার কর্মজীবনে একজন সফল অভিনেতা—এটুকুতেই আমাদের থেমে যাওয়া উচিত।

দেখুন, এটাই—ঠিক এই বিষয়টাই আমি বলতে চাই। এটাই নারীবাদিতার সমস্যা। সবকিছুকে প্রফেশন দিয়ে বিচার করা। নারীবাদিতা ঠিক এটাই শেখায়। একজন নারীকে তারা পেশার মধ্যে আটকে ফেলে। তার কাছে মোরাল, বা অন্যান্য মানবীয় দিকগুলো অর্থহীন হয়ে যায়।

একজন নারী যতই মমতাময়ী হোক না কেন, স্বামী-সংসারের জন্য নিজের জানটাও দিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকুক, কিন্তু সে যদি কোনো অর্থ উপার্জন না করে, নারীবাদীদের কাছে তার কোনো মূল্য নেই। একজন নারী যদি তার বিশ্বাসে, আদর্শে, গুণে ও চরিত্রে অতুলনীয় হয়, সমাজে তার মতো আর একটা মেয়েও খুঁজে পাওয়া না যায়, তবুও সে যদি "ঘরে-বসে-থাকাদের" একজন হয়, তবে নারীবাদীদের চোখে সে ব্যর্থ।

কোনো সাধারণ নারী যদি হয় এমন যে সে প্রচণ্ড কর্মঠ, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, অসম্ভব পরোপকারী, কিন্তু কাজের বিনিময়ে টাকার পাহাড় জমায় না বরং একজন গৃহিণী; তবুও তার চাইতে বরং নারীবাদীরা সেই নারীকে বেশি সফল ভাববে যে নিজে জানেও না কেন চাকরি করে, কিন্তু সমাজের বেধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিন নয়টা-পাঁচটা অফিস করে মাসের শেষে কিছু টাকা কামায়।

নারীবাদিতায় ক্যারিয়ারটাই ফ্যাক্টর, টাকাটাই ফ্যাক্টর, এজন্যই দেখবেন, নারীবাদীদের রোলমডেল যারা হয়, তারা ব্যক্তিজীবনে মোরালি ফলো করার মতন কোনো ক্যারেক্টার না। আর আমাদের কাছে, মানে মুসলিমদের কাছে মোরাল ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইখানেই নারীবাদিতার সাথে আমাদের একটা মৌলিক বিরোধ রচনা হয়ে যায়।

আমরা যদি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার দিকে তাকাই, দেখতে পাব, তিনি বিয়ের পর আজীবন স্বামীর খেদমত করে গেছেন। বিয়ের আগে থেকে তাঁর ব্যবসা ছিল, কিন্তু বিয়ের পর, ব্যবসা-বাণিজ্য চুলোয় যায়, ওসব নিয়ে ভেবে দেখেন নি। নিজের সমস্ত টাকা ঢেলে দিয়েছেন নবুওয়তের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য। হেরা গুহায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) যখন ধ্যানমগ্ন থাকতেন, তখন স্বামীর জন্য খাবার তৈরি করে সেই বিশাল পর্বতে বেয়ে বেয়ে উঠেছেন কেবলমাত্র স্বামীর কাজে সহায়তা করার জন্য।

আমাদের কাছে খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বিশাল মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহর চোখেও খাদিজা (রা) বিশাল মর্যাদার অধিকারী। এজন্যই তিনি দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে যান। দুনিয়াতে যেই চারজন সর্বশ্রেষ্ঠ নারী আছেন, তাদের মধ্যে খাদিজাও একজন।

একজন নারীবাদীর চোখ দিয়ে চিন্তা করুন, এই কাজটি কি আপনি করতে রাজি হতেন? প্রথমেই কি আপনি বলতেন না, আমার স্বামী কাজ করবে, আমি কেন করব না? আমার স্বামী দশ ঘণ্টা ধ্যানে বসে থাকবে, আর আমি যাব তার খাওয়া বানাইতে? নো ওয়ে!! সিরিয়াসলি স্পিকিং, কোনো নারীবাদী নারীকে খাওয়া নিয়ে পাহাড় কেন, পাঁচ তলার উপর যেতে বলতেও তার স্বামী ভয় পেতো।

এই রকমই একটা ত্রুটিপূর্ণ, বিকারগ্রস্তের মতো দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয় নারীবাদ। তারা সবকিছুকেই "টাকা"র সাথে লিংক করে। কাজের মূল্যায়ন করে টাকার অংক দিয়ে, আর মানুষের মূল্যায়ন করে তার পেশাগত সাফল্য ও টাকার পরিমাণ দিয়ে। অথচ কর্মজীবন মানুষের জীবনের একটা দিক মাত্র, কখোনোই এটা তাকে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করে না।

যে লোকটা চুরি করাকে নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করে, তার অঢেল টাকা থাকতে পারে, কিন্তু সে কি কখনও আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার মতো? যে লোকটার কোটি টাকার বিজনেস আছে, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে বউ-পেটায়, কিংবা পেডোফাইল, সেই লোকটার ব্যাপারে আপনার কী মত? তাকে কি আপনি এত সহজে একজন "রোলমডেল" হিসেবে আপনার ছেলেমেয়ের কাছে উপস্থাপন করবেন? আমি নিশ্চিত, তখন কিন্তু নারীবাদীরা বলবে না যে, এই লোকের পেশা এবং ব্যক্তিজীবনকে আলাদা করে দেখা হোক।

তাহলে যে মেয়েরা অন্য কাজের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেশ্যাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে, যে নারীরা পেশার নামে, ক্যারিয়ারে উন্নতির আশায় দশজনের সাথে রাত কাটাতে মাইন্ড করে না, যে নারীরা টাকা কামাতে নিজের শরীরকে ব্যবহার করে, তাদেরকে কীভাবে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যায়? ব্যক্তিগত জীবনকে বাদ দিয়ে একজন মানুষকে "রোলমডেল" হিসেবে গ্রহণ করা কি আদৌ সম্ভব, নাকি সেটা যৌক্তিক?

খালি কর্মজীবনের সফলতার মাপকাঠিতে মানুষকে বিচার করাকে আমরা সমস্যা মনে করি। আমরা মানুষকে বিচার করতে চাই তার বিশ্বাস, চরিত্র, কাজকর্ম ও আদর্শের সমন্বয়ে। রাসূলুল্লাহ (স) কে আমরা রোলমডেল মনে করি, কেননা তিনি শুধু কর্মজীবনে না, ব্যক্তিজীবনে, সংসার জীবনে, পারিবারিক জীবনেও অনন্য সাধারণ একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ইসলামে মোরালিটি একটা কী ফ্যাক্টর। ইসলাম মানুষের মোরালিটিকে উন্নত করতে শেখায়।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আল্লাহর কাছে মানুষকে বিচার করা হবে তার তাক্বওয়ার ভিত্তিতে। সে কতটা আল্লাহকে ভয় করেছে, ইসলাম মেনে চলেছে সেই অনুযায়ী। কারো গায়ের রং, বংশ ইত্যাদি দ্বারা নয়। কিন্তু নারীবাদিতা মানুষকে বিচার করছে তার সৌন্দর্য দিয়ে, বা টাকার পরিমাণ দিয়ে! বিচারের মাপকাঠি দেখেই বোঝা যায় এই আইডলজির গ্র্যাভিটি কত লো, কত সস্তা।

পেশা জীবনকে ব্যক্তিজীবন থেকে আলাদা করে ফেলার ব্যাপারটা গা থেকে কাপড় খুলে নেওয়ার মতো। মানুষের তখন আর পেশা নিয়ে কোনো হায়াবোধ থাকে না। লিবারেলিজম বা ফেমিনিজমের এইসব ন্যারেটিভের একটাই উদ্দেশ্য। আবজাব তত্ত্ব কপচায়ে লজ্জাশরমকে ধ্বংস করে দেওয়া। কর্মজীবনকে ব্যক্তিজীবনের থেকে আলাদা করে ফেলে নারীদেরকে রাস্তায় নামায় আনবে, বিছানায় টেনে নিয়ে যাবে, যে যতটা পারে আর কি। এরপরে হাতে একটা ললিপপ ধরায় দিয়ে বলবে, তুমি বেশ্যা হলেই তো আর অপবিত্র নও। পেশাকে নিজের ব্যক্তিত্বের সাথে মিলিয়ে ফেলো না...


26/12/2019, 18:09