[ক]

১) এক বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলাম। শাড়ি পরা সুসজ্জিত এক মেয়ে একজন হ্যান্ডসাম পুরুষের সাথে গা ঘেষে সেলফি তুলছে। পরিচয় হবার পর চোখ কপালে তুললাম, মেয়েটা এতক্ষণ তার কলিগের সাথে ছবি তুলছিল, একটু দূরেই তার গর্বিত স্বামী দাঁত কেলিয়ে হাসছে। মনে মনে স্বামীটাকে গালি দিলাম, বলদ কোথাকার!

২) মিরপুর থেকে আশুলিয়ায় যাব, লেগুনা ছাড়া উপায় নাই। দুই সিট ভাড়া নিয়ে উঠলাম যেন পাশের পুরুষ আমার গায়ে এসে না পড়ে।

লেগুনার একদম কিনারে একজন মহিলা বসা, তিনি তার পাশে বসতে দিলেন, আমার ডানে একজন পুরুষ। লেগুনা চলতে শুরু করল, আমার বাম পাশের মহিলা আর ডান পাশের পুরুষ দুইজন গল্প করতে লাগল।

লেগুনা রাফ চলছে, ধাক্কায় পুরুষটি বার বার আমার দিকে সরে আসছিল।

আমি ঝাড়ি দিলাম, "বিশ টাকা বেশি দিয়ে দুই সিট নিয়েছি যাতে কেউ গায়ে এসে না পড়ে, আপনি ওদিকে চেপে বসেন।"

এবার বামের মহিলা অবাক হয়ে বললেন, 'আপনি এই জন্য দুই সিট নিয়েছেন? আপনি আমার সাথে জায়গা পাল্টে একেবারে কিনারায় বসেন। উনি আমার স্বামী, ভালো মানুষ। '

আমি আকাশ থেকে পড়লাম, 'আপনার স্বামী! তাইলে বেডি এতক্ষণ আমাকে তার পাশে বসতে দিছিস ক্যান? আমাকে তো কিনারে বসতে দিলেই পারতি। আক্কেলজ্ঞান নাই, নিজের স্বামীর পাশে অন্য মহিলাকে কেউ বসতে দেয়, বলদি কোথাকার!

এই মহিলাকেও মনে মনে গালি দিলাম আর কিছু কথাও শুনিয়েছিলাম।

এরকম বলদ আর বলদিতে দেশ ভরে গেছে, এদের মধ্যে কোনো গীরাহ বোধ নাই। নিজের স্পাউজ কার সাথে কোথায় যাচ্ছে, ছবি তুলছে, পাশাপাশি বসছে, আড্ডা দিচ্ছে এগুলোতে তাদের কিছুই মনে হয় না।

আসুন, গীরাহ বোধ সম্পর্কে জানি যা প্রত্যেক স্পাউজের থাকা উচিত।


গীরাহ বোধ (প্রটেকটিভ জেলাসি)

সাদ বিন উবাদা (রাঃ) একবার বলেন, আমি যদি আমার স্ত্রীর সাথে কোনো পুরুষকে দেখি তবে আমি তার শিরচ্ছেদ করে ফেলবো।

একথা সাহাবারা রাসুল (সাঃ) কে জানালে তিনি বলেনঃ তোমরা কি সাদের আত্মমর্যাদাবোধ দেখে বিস্মিত হচ্ছ? আল্লাহর শপথ! আমি তার চেয়েও অধিক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। আর আল্লাহ্ আমার চেয়েও অধিক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। আল্লাহ্ আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন হবার কারণে প্রকাশ্য ও গোপনীয় (যাবতীয়) অশ্লীলতাকে হারাম করে দিয়েছেন। [৬৮৪৬; মুসলিম পর্ব ১৯/হাঃ ১৪৯৯, আহমাদ ১৮১৯২১]

[খ]

আজকাল অনেকে নারীদের বিপথে যাওয়া নিয়ে কথা তোলেন। দেখুন ভাই, মেয়েরা কীভাবে বিপথে যাচ্ছে, পর্দা ছেড়ে দিচ্ছে, ফাহেশা কাজে লিপ্ত হচ্ছে! কিন্তু এটা একদিনে হয়নি। যেসব নারীরা বিপথে যাচ্ছে, তাদের আগে তাদের পুরুষরা বিপথে গেছে। বিপথে যাওয়া নারীরা হায়া হারানোর আগে, এসব নারীদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা পুরুষেরা তাদের হায়া, গীরাহ, পৌরুষ হারিয়েছে।

যে ভাইগুলো বলছে নারীরা বিপথে চলে যাচ্ছে, সেই একই ভাইয়েরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি আপলোড দিচ্ছে। সেই ছবি তার হোয়াটসএপের প্রফাইল পিকচার দিচ্ছে। তাই যাদের কাছেই তার ফোন নম্বর আছে, তাদের কাছে এখন তার স্ত্রীর ছবিও আছে। প্রতিদিন তার স্ত্রীর ছবি অন্যরা দেখছে।

এক ভাই একদিন আমার কাছে এলেন তার স্ত্রীকে নিয়ে। হাসতে হাসতে নিজের স্ত্রীকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। আমি বিব্রত হয়ে কোনোমতে সালাম দিলাম। কিন্তু সেই মহিলা হাসতে হাসতে আমার দিকে হ্যান্ডসেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। আর পাশে তার স্বামী নির্লজ্জের মতো তখনো হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাকে দোষ দেব, পৌরুষহীন এই ভাইকে, নাকি তার স্ত্রীকে?

রাসুল (সা.) বলেছেন, “এমন তিনজন ব্যক্তি আছে, যাদের দিকে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল কিয়ামাতের দিন তাকাবেন না। তারা হচ্ছে

(১) যে পিতামাতার অবাধ্য,
(২) যে নারী বেশভূষায় পুরুষদের অনুকরণ করে
(৩) দাইয়ুস ব্যক্তি।” (নাসাঈ: ২৫৬২)

এখানে দাইয়ুস হলো সেই পুরুষ, যে তার অধীনস্ত নারীদের (মা, বোন, স্ত্রী) ব্যভিচার, ফাহেশা কাজে বাধা দেয় না। তারা পর্দা করছে না, এটা তার গায়ে লাগে না। তার স্ত্রী পরপুরুষের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে, এতে তার গা জ্বলে না। সে এমন ব্যক্তি, যে তার পৌরুষ হারিয়েছে।

বই: এপিটাফ, পৃ ৪৬

[গ]

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তিন ব্যক্তির জন্যে আল্লাহ তা’আলা জান্নাত হারাম করেছেন, "নেশাদার দ্রব্যে আসক্ত ব্যক্তি, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, এবং দাইয়ুস।" (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ৫৮৩৯)

দাইয়ুস সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “ঐ ব্যক্তিকে দাইয়ুস বলা হয় যে তার পরিবারের অশ্লীলতা ও কুকর্মকে মেনে নেয়।” (মুসনাদ আহমদ, নাসাঈ)

অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-কন্যা সহ পরিবারের অধীনস্ত অন্য সদস্যদের বেপর্দা চলাফেরা ও অশ্লীল কাজকর্ম বা ব্যভিচারকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে অথবা কোনরূপ বাধা না দিয়ে মৌনতা অবলম্বন করে।

ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেছেন, ‘দাইয়ুস’ সে ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর ফাহেশা কাজ সম্পর্কে অবগত। কিন্তু তার প্রতি ভালোবাসার কারণে এ ব্যাপারে সে উদাসীন থাকে। অথবা তার উপর তার স্ত্রীর বৃহৎ ঋণ বা মোহরানার ভয়ে কিংবা ছোট ছেলে-মেয়েদের কারণে সে স্ত্রীকে কিছুই বলে না এবং যার আত্ম-সম্মানবোধ বলতে কিছুই নেই’। (যাহাবী, কিতাবুল কাবায়ের - ১/৫০)

হাদিসটির ব্যখ্যা বিস্তারিত। তবে এখানে মূল বিষয় হল ফাহেশা বা অশ্লীলতা। যে তার নিজ পরিবারে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতে শিথিলতা প্রদর্শন করে, স্ত্রী-কন্যাদেরকে পর্দার আদেশ করে না, পর্দাপালনে উৎসাহিতও করে না, ঘরে নিষিদ্ধ গান-বাদ্য দিব্যি চলে, এর কোন প্রতিবাদ করে না; এ রকম সকল শরীয়াহ বিরোধী অশ্লীলতাকে মেনে নেয় – সে ব্যক্তি 'দাইয়ুস'।

এ ব্যক্তি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “দাইয়ুস কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (নাসায়ীঃ ২৫৬২, মিশকাতঃ ৩৬৫৫)

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, “জেনে রাখো, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং নিজ নিজ অধীনস্থের বিষয়ে তোমাদের প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে। অতঃপর দেশের শাসক জনগণের উপর দায়িত্বশীল। সে তার দায়িত্বশীলতার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। পুরুষ তার পরিবারের উপর দায়িত্বশীল। অতএব, সে তার দায়িত্বশীলতার বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীগৃহের উপর দায়িত্বশীলা। কাজেই সে তার দায়িত্বশীলতা বিষয়ে জিজ্ঞাসিতা হবে। দাস তার প্রভুর সম্পদের দায়িত্বশীল। সেও এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধীনস্থের দায়িত্বশীলতার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী : ৮৯৩; মুসলিম : ১৮২৯)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন, “হে বিশ্বাসী বান্দাগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয় ও কঠোর স্বভাবের ফেরেশতাগণ। তারা আল্লাহ তা’আলা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং তারা তা-ই করে যা করতে তাদের আদেশ করা হয়।” (সূরা তাহরিম-৬)

দাইয়ুস ও এর পরিণতি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সা. এর হাদিসের ভাষ্য তো স্পষ্ট। এবং আল্লাহর রাসুল বলেও দিলেন আমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং অধীনস্থদের সম্পর্কে আমরা অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবো। উপরন্তু আল্লাহ তা’আলা আদেশও করেছেন বান্দা যেন নিজেদেরকে এবং পরিবার-পরিজনদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায়। তাই সাধারণভাবে সমস্ত অধীনস্থদেরকে এবং বিশেষভাবে পরিবার-পরিজনদেরকে যাবতীয় বেহায়াপনা, অশ্লীলতা-অন্যায়-পাপাচার এবং বে-পর্দা চলাফেরা করা থেকে বিরত রাখা এবং তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো আমাদের উপর ফরয।

এখন নিজেকে প্রশ্ন করা উচিৎ, আমি আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব কতটুকু নিষ্ঠার সাথে পালন করছি? অথবা আদৌ পালন করছি কি? বা এই দায়িত্বের অনুভূতিটুকুও কি আমার মাঝে আছে? তাহলে কি আমি দাইয়ুসদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছি? আমি কি প্রস্তুত সেই জাহান্নামের জন্য যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর?

[ক] Dr. Umme Bushra Sumona
[খ] Bookmark Publication
[গ] ---