বান্ধবী শিমু বলত বিয়ের পর সে ছেলের মা হতে চায় যেন সে দেখিয়ে দিতে পারে ছেলেদের কত ভালোভাবে মানুষ করা যায়। অন্যরা বলত তারা মেয়ে সন্তান চায় কারণ মেয়েরা বাবা-মাকে জ্বালায় না। আর আমি বলতাম আমি বিয়েই করবনা!

কিন্তু অদৃষ্টের লিখন যায় না খন্ডন। বিয়ে হোল। বাচ্চাও হোল। তখন বাচ্চা “মানুষ” করার প্রশ্নও এলো।

এক্ষেত্রে আমার তিনটা বিশেষ সুবিধা ছিল। প্রথমত, আমার অভিজ্ঞতা। ছোট ভাই দু’টি যথাক্রমে আমার ছয় এবং বারো বছরের ছোট ছিল। বিশেষ করে বিদেশে থাকায় ছোটটির প্রায় সার্বিক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে বারো বছর বয়স থেকেই মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার সুযোগ হয়েছে। তাছাড়া বাবা অল্প বয়সে বিয়ে করাতে বাবার বন্ধুদের ছেলেমেয়েরাও ছিল আমার অনেক অনেক ছোট। তাঁরা বিভিন্ন সময় আমার কাছে বাচ্চা রেখে যেতেন, এতে করে বিভিন্ন ধরণের শিশুদের দেখার এবং নিয়ন্ত্রণ করার অভ্যাস হয়ে গেছিল অল্প বয়সেই। দ্বিতীয়ত, আমি সর্বভূক। ছোটবেলা থেকেই যেখানে যা পেতাম, বুঝি না বুঝি, পড়তাম। পরে এই টুকরো টুকরো তথ্যগুলো অনেক কাজে লেগে যায়। তৃতীয়ত, আমার বাবামার পাশাপাশি অন্যান্যদের বাবামাকে পর্যবেক্ষণ করে অনেক কিছু শেখার এবং বোঝার সুযোগ পেয়েছি।


আমি খুব ভালো মা নই। আদর্শ মায়েদের মত সন্তানদের খাওয়া দাওয়া, পোশাক আশাক নিয়ে আদিখ্যেতা আমাকে দিয়ে হয়না, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার ব্যাপারেও আমার বাচ্চাদের ওপর কোন জোর নেই। তবে ছোটবেলা থেকেই তাদের আল্লাহর সাথে বন্ধুত্ব করিয়ে দিয়েছি। পড়তে শেখার সাথে সাথে হাতে অর্থসহ কুর’আন ধরিয়ে দিয়েছি। তাদের বলেছি, “তোমাদের আমাকে বা আব্বুকে বা আর কাউকে খুশী করার কোন প্রয়োজন নেই, কিন্তু আল্লাহ তোমাদের ওপর অসন্তুষ্ট হতে পারেন এমন কোন কাজ তোমরা কখনো কোরনা। তোমরা যদি লুকিয়ে কিছু কর আমি দেখবনা, আব্বু দেখবেনা, হয়ত কেউই দেখবেনা, কিন্তু আল্লাহ দেখবেন। তাহলে আল্লাহ তোমাদের আগুনে শিক কাবাব বানাবেন। আর ওনার কথা শুনলে তোমরা যা চাও সব উনি তোমাদের দেবেন”। আমি চাইনা আমার সন্তানেরা রূপকথা শিখুক। আ্মাদের অধিকাংশেই ইসলাম সম্পর্কে ধারণা রূপকথার মতই। বিভিন্নজনের কাছে টুকটাক শোনা বা চটিবই পড়াতেই আমাদের ধর্মীয় জ্ঞান সীমাবদ্ধ। ফলে আমাদের মধ্যে জন্ম নেয় নানানরকম ভুল ধারণা, অনেক ভুল আচরণ। আসলে যে কি করতে বলা হয়েছে, কি মানা করা হয়েছে বা কেন এ’ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। তাই আমরা নামসর্বস্ব মুসলিম হিসেবে বেড়ে উঠি। কুর’আনের কোন অংশ শুনলে “নিজের যুক্তি” দিয়ে বিচার করি। অথচ আমাদের মানদন্ড হওয়া উচিত কুর’আন এবং “যুক্তি” হওয়া উচিত সেই মানদন্ডের প্রেক্ষিতে। তাই আমি চাই ওরা নিজে পড়ে জেনে বুঝে “মানুষ” হোক। তাছাড়া এই বইটিতে যেভাবে আদর্শ আচরণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা যদি কোন মানুষ অনুসরণ করে তবে সে শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাবা বা মা, বন্ধু, প্রতিবেশী, মালিক বা কর্মচারী সবই হতে পারবে। ব্যাস, আমার কাজ হয়ে গেল!


আমি যখন জানলাম তিনমাস বয়স থেকে গর্ভস্থ শিশুর হৃৎপিন্ড চালু হয়ে যায় এবং পাঁচমাস বয়স থেকে সে শুনতে পায় তখন একটা প্ল্যান করলাম। তিনমাসের সময় চুপি চুপি পড়ার পরিবর্তে জোরেজোরে কুর’আন হাদি্স বইপত্র পড়তে শুরু করলাম, রাগ কমিয়ে হাসিখুশী থাকার চেষ্টা করতে শুরু করলাম, মানুষের সাথে আরো বেশী ভালো আচরণ করতে শুরু করলাম। পাঁচমাসের সময় আমি আমার সন্তানদের সাথে কথা বলতে শুরু করতাম, ভালো খারাপ বোঝাতাম। অনেকে এটাকে পাগলামী মনে করে। কিন্তু একটা সাধারন পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন এতে পাগলামীর কিছু নেই। ভূমিষ্ঠ হবার পর শিশু তার বাবাকে দেখে পিটপিট করে তাকায়, তার গলার স্বরে সাড়া দেয়। সে কি করে বোঝে এটা তার বাবা? কারণ সে আগে থেকেই বাবাকে চেনে!

আমি আমার সন্তানদের সাথে তাদের জন্মের সাথে সাথেই কথাবার্তা চালিয়ে যেতাম। Baby talk না, adult talk. তাদের রূপকথার গল্প না বলে বিভিন্ন নবীরাসূল এবং বড়বড় মানুষের কথা বলতাম। আমার ননদরা হাসত। একদিনের বাচ্চাকে গল্প বলে! কিন্তু আমার মেয়ে আড়াই বছর বয়সে সবাইকে বুঝিয়ে দিল যে সে সব শোনে এবং বোঝে যখন ওর বাবা ওকে দুষ্টুমী করে বল্ল, “যাও, তুমি গোসল করে আস, তোমাকে কোরবানী দেব”। সে বল্ল, “আব্বু, আপনি কিছু জানেন না। শুধু ইব্রাহীম (আ) ইসমাইল(আ) কে কোরবানী করতে পারে। অন্য আব্বুরা শুধু গরুছাগল কোরবানী করতে পারে!” আমার এক বোন কর্ণেলিয়া আজ ফেসবুকে লিখেছেঃ “Jasmine was in a forbidden relationship with Aladin, Snow White lived alone with seven men, Pinocchio was a liar, Robin Hood was a thief, Tarzan walked without clothes on, a stranger kissed Sleeping Beauty and she married him, Cinderella lied and sneaked out at night to attend a party. These are the stories our families raised us with and then they complain our present generation is messed up!” আমরা আমাদের সন্তানদের যে আদর্শ দিয়ে বড় করব তাই তো তারা শিখবে!


অনেক আহ্লাদী মায়েরা তাদের সন্তানদের ছোটবেলায় শাসন করতে চান না। বলেন, “ও তো এখনো ছোট, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে”। কিন্তু ছোটবেলা থেকে একটা শিশুকে ন্যায়-অন্যায়ের মানদন্ড যদি বাবা-মা না শেখায় তবে সে “ঠিক” হবে কি করে? একটা শিশু অন্যদের সাথে খেলনা শেয়ার করতে চাইবেনা, অন্যের ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করবে, রাত বারোটা বাজে কমলা খাবার আহ্লাদ করবে আর আমি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলব, “ছোটবাচ্চা, ঠিক হয়ে যাবে?- কক্ষনো নয়! আমার মেয়ের যখন দেড়বছর, সে বারবার রান্নাঘরে আগুনে হাত দিতে চাইত। এই অবস্থা দেখে আমি একদিন একহাতে বরফ নিলাম, আরেক হাতে একটা ম্যাচ জ্বালিয়ে তাকে ধরার সুযোগ দিলাম। সে ম্যাচ ধরে কেঁদে ওঠার সাথে সাথে হাতে বরফ ঠেঁসে দিলাম। ফোস্কাও পড়লোনা, হাতও পুড়লোনা- বড়জোর কিছুক্ষণ জ্বালা করল। কিন্তু সে বুঝে গেল আগুন দেখতে সুন্দর কিন্তু তা ধরলে হাত পুড়ে যায়। আর কোনদিন তাকে নিয়ে আমার ভাবতে হয়নি। মাঝে মাঝে বিপদের কাছাকাছি যেতে দিয়ে শিশুকে সচেতনতা শেখানো যায়। এতে সে বৃহত্তর বিপদ থেকে রক্ষা পায়। Responsibility এমন একটা জিনিস যা আমার মনে হয় সবাইকে ছোটবেলা থেকেই শেখানো উচিত।


একইভাবে এটাও নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন যে আমাদের শিশুরা টিভিতে কি দেখছে। সারাদিন টিভিতে নাঙ্গা নাচ চলছে আর শিশু বাবামা’র সাথে বসে তাই দেখছে, এই শিশুর লজ্জাবোধ তো ওখানেই শহীদ হয়ে যাচ্ছে! এক ভাই রাহাত আজ লিখলঃ “Almost 70 of the Tom and Jerry cartoon shows that Tom is extensively addicted to the opposite sex. And he reacts strangely when he sees anyone of the opposite sex. Guardians are not weary of what it represents but the kids are watching this very easily with family!” শিশুকে যে ধরণের রুচি দিয়ে বড় করা হবে তাই শিশুর ভালো মনে হবে। যেমন আমরা যখন ছোট ছিলাম বাবা ভালো ছবি বেছে আমাদের দেখাত, সাথে বসে বুঝিয়ে দিত। আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকে Peace TV দেখে অভ্যস্ত। ক্যানাডায় Peace TV নেই বলে সে নিজেই কম্পিউটারে Peace TV বের করে দেখে।


সবচেয়ে বড় কথা আমাদের নিজেদের সংশোধন করতে হবে। আমাদের এটা বোঝা প্রয়োজন যে আমরা শিশুদের কি বলি তার চেয়েও ওরা অনুসরণ করে আমরা কি করি। প্রত্যেক শিশুই মনে করে তার পিতামাতা আদর্শ। সুতরাং, আমরা কোন অন্যায় করলে তখন তারা মনে করে, “বাহ, আব্বু যেহেতু মিথ্যা কথা বলে, আমি বললেও নিশ্চয়ই কোন অসুবিধা নেই!” এটা খুব জরুরী যেন বাবা-মা সন্তানদের সামনে ঝগড়া না করেন বা পরস্পরের বা তাদের পরিবারের ব্যাপারে কোন বাজে মন্তব্য না করেন। কারণ একটা শিশু নিজেকে মূল্যায়ন করে তার বাবা-মা'য়ের মাধ্যমে। তার যদি নিজের বাবা-মা’র প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়ে যায় তবে সে নিজেও low self esteem এ ভুগতে শুরু করে। এ’ একই কারণে আমাদের এমন অন্যায় করা উচিত নয় যা আমরা চাই না আমাদের সন্তান করুক যদিও সেটা আমরা মনে করি আমার সন্তানের সুখের জন্য। যেমন, আমার আয়-রোজগার কম হবার কারণে যদি আমার সন্তান একবেলা না খেয়েও থাকে তাতে তার সামান্য ক্ষুধা ছাড়া আর কোন কষ্ট হবেনা। কিন্তু যদি আমি সুদঘুষের টাকায় আমার সন্তানকে একটি ভালো জীবন দেয়ার চেষ্টা করি তাতে তার ক্ষতি বই কোন লাভ হবেনা। সে টাকার মূল্য বুঝবেনা, শ্রমের মূল্য শিখবেনা এবং এই টাকা তাকে পৃথিবীর জৌলুসের প্রতি আকৃষ্ট করে মূল জিনিসগুলো থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে, ফলে সুখ তার কাছে কখনোই ধরা দেবেনা। উপরন্তু, আল্লাহ বলেছেন যার শরীরে একবিন্দু পরিমাণ হারাম প্রবেশ করবে সে কোনদিন জান্নাতে প্রবেশ করবেনা। সুতরাং, কার্যত এতে করে আমি আমার সন্তানকে কেবল দুনিয়াতেই নয় বরং আখেরাতেও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেব।


আমি আমার সন্তানদের সাধারন মানুষ হিসেবেই বড় করতে চাই। তারা আমার সাথে মাটিতে শুয়ে ঘুমাতে ভালোবাসে। ওরা কোনদিন ওদের বাবা-মা'কে অতিরিক্ত দামী জামাকাপড় পরতে দেখেনি, তাই যখন ওদের জন্য হকার্স মার্কেট থেকে কাপড় কেনা হয় তখন ওদের আঁতে ঘা লাগার মত কিছু ঘটেনা। ওদের ছোটবেলা থেকে needs এবং wants এর তফাত করতে শেখানোর চেষ্টা করেছি। “চাহিবামাত্র দিতে বাধ্য থাকিবে” কথাটা ওরা কোনদি্ন শোনেনি। যখন ওরা কিছু চায় তখন ওদের চিন্তা করার সুযোগ দেই আসলে এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বা এর পরিবর্তে অন্য কিছু দিলে কেমন হয়। যেমন আমি আমার সন্তানদের শেখানোর চেষ্টা করি তারা যেন নিজেদের মেধা, গুন, ব্যবহারের মাধ্যমে সুপরিচিত হবার চেষ্টা করে। আমি আমার মেয়েকে সামান্য পয়সার লিপ্সটিক কিনে দেইনি কোনদিন, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশী দাম দিয়ে মাইক্রোস্কোপ কিনে দিয়েছি। কেননা লিপ্সটিক তাকে সৌন্দর্যপ্রদর্শনের প্রতি আকৃষ্ট করে তাকে লোভী পুরুষদের দৃষ্টির খোরাকে পরিণত করবে, কিন্তু মাইক্রোস্কোপের ভেতর দিয়ে দেখা আরেকটা জগত তার অন্তঃর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করবে।


আমার বাবার কাছ থেকে আমি দু’টো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখেছি। বাবা যথাসম্ভব পরিবারকে সময় দিত এবং সবার সাথে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করত যে আমাদের কখনো মনে হয়নি এ’কথাটা বাবাকে বলা যাবেনা বা এটা লুকানো দরকার। সন্তান যখন মনে করে যে সে তার পরিবারের কাছ থেকে যথেষ্ট ভালোবাসা এবং বন্ধুত্ব পাচ্ছে তখন সে বাইরে ভালোবাসা খুঁজতে যাবার প্রয়োজন বোধ করেনা। সুতরাং, তার সুযোগসন্ধানী কারো হাতে পড়ে জীবনটা এলোমেলো করে ফেলার সম্ভাবনা থাকে কম। পাশাপাশি সে যদি মনে করে বাবা-মা'য়ের সাথে সব কথা বলা যায় তাহলে সে কোন বিপদে পড়লে বা কাউকে ভালো লাগলে নির্দ্বিধায় বলতে পারবে- ফলে বাবা-মা উত্তম পরামর্শ দিয়ে তাকে সহযোগিতা করতে পারবেন। অন্তত একজন অভিভাবকের এই দায়িত্বটা পালন করা উচিত যাতে সন্তান পিতামাতার কাছ থেকে নিজেকে distant মনে না করে, তার মনে না হয় তার পরামর্শ করা উচিত বন্ধুদের সাথে (বন্ধুদের জ্ঞানবুদ্ধি আর বাবামায়ের অভিজ্ঞতা ও বিবেচনার মধ্যে কি কোন তুলনা হয়?), সে নিজেকে চাপযুক্ত মনে না করে এবং সে বাধ্য হয়ে নয়, খুশী হয়ে বাবা-মা'য়ের আদেশ উপদেশ শোনে। পারিবারিক সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য খেলাধুলার বিকল্প নেই। আমরা বাবার সাথে স্ক্র্যাবল, মনোপলি, ফ্রিসবি থেকে শুরু করে লুডো পর্যন্ত খেলতাম- এখনো সময় পেলে খেলি। আরেকটা ব্যাপার হোল গল্পসল্প করা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলা, পছন্দ অপছন্দ আলাপ করা যাতে উভয়ে পরস্পরের মনমানসিকতা বুঝতে পারে এবং মনোমালিন্য এড়িয়ে চলতে পারে।


ছোটবেলায়, যখন পুরোপুরি সব কথা বুঝতামনা তখন বিচিত্রায় একটা জরীপ পড়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর (লুকিয়ে লুকিয়ে অবশ্যই!)। এতে বলা হয়েছিল, যারা দূরবর্তী অঞ্চল থেকে এখানে পড়তে আসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই নানাপ্রকার প্রেমঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে, যেহেতু দীর্ঘদিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে তাদের মন প্রায়ই খারাপ থাকে। আমার সেই ছোট্ট মাথায় তখন এটাই এসেছিল, এত লেখাপড়া করে কি হবে যদি একটা মানুষ তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, তার চরিত্রই হারিয়ে ফেলে? একটা মানুষের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা মাস্টার্স হওয়াটাই কি জীবনের মূল লক্ষ্য? সবার আগে কি তার একজন ভালো মানুষ হবার চেষ্টা করা উচিত নয়?

এখন বড় হয়েছি (মনে হয়, যদিও মনটা এখনো ছোটদের মতই রয়ে গেল এবং সেভাবেই তাকে রাখতে চাই)। এখন বুঝি মানুষের সঠিক বয়সে বিয়ে করা উচিত। এটা লেখাপড়া বা আর কোন ব্যাপারে প্রতিবন্ধক নয়। জীবনে কোন কিছুকে আর কোনকিছুর জন্য ঠেকিয়ে রেখে দেয়াটা একটা চরম বোকামী। মানুষের রয়েছে অসীম সম্ভাবনা আর প্রচন্ড চাপ নেবার ক্ষমতা যদি সে নিজের মনোবলকে উন্নীত করতে পারে। তাই মানুষ বিয়ে, সন্তান, সংসার, লেখাপড়া, চাকরী সব একসাথে চালাতে পারে যদি বাবা-মা সহযোগিতাপূর্ণ হন। আমাদের বাবা-মা'দের উচিত সন্তানের পার্থিব উন্নতির পাশাপাশি তাদের পারলৌকিক জীবনে ঠেকে না যাওয়া নিশ্চিত করার জন্য তাদের সময়মত বিয়ে দেয়া। আমরা বিয়ে নামক সামাজিক অনুষ্ঠানে নানারকম বিদ’আত যোগ করে একে একপ্রকার বিভিষিকায় রূপান্তরিত করে ফেলেছি। অথচ এগুলো বাদ দিলে এটা খুব একটা কঠিন কিছু নয়।

ধরুন আমার বিয়ে। বাবা হাফিজ সাহেবকে বল্ল, “তোমার নতুন চাকরী, এখন গোল্ড দেয়া জরুরী নয়। পরে তুমি যখন পারো তখন তুমি তোমার বৌকে ইচ্ছেমত কিনে দিয়ো”। হাফিজ সাহেব বললেন, “আমি যৌতুক নেবনা, দিলে বিয়েই করবনা”। আমি বললাম, “গায়ে হলুদ বিদ’আত, সুতরাং গায়ে হলুদ করা, বাড়ীতে বা বিয়ে বাড়ীতে লাইট লাগানো যাবেনা। বরং ঐ পরিমাণ টাকা তুমি কোন গরীব মেয়ের বিয়ে দিতে খরচ কোর। এতে হয়ত আমাদের বিয়েতে আল্লাহ বরকত দেবেন”। ব্যাস, অল্প সংখ্যক আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব খাইয়ে, এক অনুষ্ঠানে বিয়ে হয়ে গেল! হাফিজ সাহেব ওনার বাবার একমাত্র ছেলে আর আমি বাবার একমাত্র মেয়ে। দুই পরিবারেরই সামর্থ্য ছিল জাঁকজমক করে বিয়ের অনুষ্ঠান করার। কিন্তু আমরা আনন্দিত যে আমরা আমাদের বাবামাকে আমাদের বিয়ে উপলক্ষ্যে কোন কষ্ট ভোগ করতে দেইনি।

আবার অনেক সময় মানুষের বিয়ে করতে দেরী হয়ে যায় “প্যাকেট” খুঁজতে খুঁজতে। ছেলে কি করে, মেয়ে দেখতে ঐশ্বর্য রাইয়ের চেয়ে সুন্দরী কি’না। যেই criteria দেখে বিয়ে করা প্রয়োজন সেগুলো নিগৃহিত হয়। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয় সমস্যা। হয় তালাক, নয় অশান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান, নইলে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পরস্পরের সাথে অবস্থান করেও চারিত্রিকভাবে বিচ্যূত হয়ে পড়া। বাবামাকে নির্বাচন করতে হবে মানুষ দেখে, সন্তানকেও এ’ব্যাপারে বাবামাকে উৎসাহিত করতে হবে যে মানুষ কেমন এটাই তার মূল লক্ষ্য এবং যদি এর জন্য তাকে কিছু ছাড় দিতে হয় তাতে সে অনুৎসাহী নয়। সবচেয়ে বড় কথা আমি এখন থেকেই আমার সন্তানদের জন্য দুআ করি যেন আল্লাহ তাদের জন্য সর্বোত্তম সঙ্গী মিলিয়ে দেন এবং আমাদের মনকে তাদের জন্য এমনভাবে উন্মুক্ত করে দেন যাতে আমরা তাদের নিজেদের সন্তান থেকে পৃথকভাবে না দেখি।

সবচেয়ে বড় যে অন্যায়টি আমরা নিজের সন্তানের সাথে করি তা হোল তার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা। পক্ষপাতিত্ব যার বিরুদ্ধে করা হয় তার চেয়েও বেশী ক্ষতি করা হয় সে সন্তানটির যার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়। সাধারনত এহেন আচরণের পেছনে বাবা বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মায়ের একটা সুপ্ত উদ্দেশ্য থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে মা এই সন্তানটিকে ব্যাবহার করেন কারো বিরুদ্ধে- সেটা হতে পারে তাঁর স্বামী, শ্বাশুড়ী বা ছেলের বৌ। কখনো সন্তানের ভক্তি তাকে এই সন্তানের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল করে তোলে। কিন্তু সেই সন্তানটি যখন বুঝতে পারে যে সে ব্যবহৃত হবার বিনিময়ে কিছু বিশেষ সুবিধা আদায় করতে পারে বা কোন অন্যায় করেও scot free বেঁচে যেতে পারে, তখন সেও এই special status উপভোগ করতে শুরু করে। কিন্তু কার্যত এতে সে লেখাপড়া ফাঁকি দিতে শুরু করে, কাজের প্রতি নিস্পৃহ হয়ে পড়ে, পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে, নির্লজ্জ ও স্বার্থপর হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত পরিবারের সবার বিরক্তির কারণ হিসেবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একজন পিতা বা মাতা সন্তানের এর চেয়ে বড় আর কি ক্ষতি করতে পারেন? এক্ষেত্রে পিতামাতার পারস্পরিক পরামর্শক্রমে সন্তান লালন করা, সন্তানকে নিজেদের মধ্যে power play-র গুটি না বানানো এবং নিজেদের মধ্যকার সমস্যা সন্তানকে বুঝতে না দেয়া অত্যন্ত জরুরী।

চারপাশে দেখছি, শিখছি, ভুল করছি আবার সংশোধন করছি। সন্তানের সাথে প্রতিটি মূহূর্তই তো আসলে এক নতুন অভিজ্ঞতা কারণ প্রতিটি শিশু আলাদা স্বভাবচরিত্র নিয়ে জন্মায়, প্রত্যেককে পর্যবেক্ষণ করে তাকে বোঝার চেষ্টা করতে হয়, তারপর তাকে কিভাবে বোঝানো যায় তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। আমার অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের দেখে এবং তাদের সহযোগিতা করতে গিয়ে শেখার সুযোগ পেয়েছি অনেক, আমি কৃতজ্ঞ। চেষ্টা করছি ছেলেমেয়েদের আমার বোধ অনুযায়ী সন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। সবাই দুআ করবেন যেন সবাই সন্তানদের সর্বাগ্রে উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।