আমরা কোন বিষয়কে কতটুকু গুরুত্ব দেই সেটা আমাদের ব্যক্তিত্ব এবং পরিচয়কে সংজ্ঞায়িত করে। কোন ব্যক্তি কিভাবে বিভিন্ন বিষয়কে অ্যাপ্রোচ করেন সেটা থেকে আপনি তাঁর ধ্যানধারণা এসব সম্পর্কে মোটামুটি স্বচ্ছ একটা ধারণা পাবেন। শার্লক হোমস একবার এক মহিলার বাসায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল একটি মূল্যবান ডকুমেন্ট ঐ ঘরের কোথায় লুকোনো আছে সেটা জানা। হোমসের যুক্তি হল, বাসায় আগুন লাগলে মরিয়া হয়ে ঘর থেকে বের হতে চাওয়া ব্যক্তি শুধুমাত্র ঐ জিনিসই বাঁচানোর চেষ্টা করবে যা তাঁর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। হোমসের যুক্তি সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। আগুন লেগেছে বুঝতে পারার পর মহিলা প্রথমে ঐ ডকুমেন্ট বাঁচাতে গিয়েছিলেন।

ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও এরকম প্রমাণ পেয়েছি, তবে একটু ভিন্ন ভাবে। আগের চাকরিতে, আমার কাজের একটা অংশ ছিল দেশের অর্থনীতি, মার্কেটের অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে অনলাইন ফাইন্যানশিয়াল বুলেটীনের মতো একটা জিনিস তৈরি করা। এই জন্য বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের প্রকাশিত বিভিন্ন সার্কুলারগুলোর মূল বক্তব্য ইংরেজীতে অনুবাদ করতে হত। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের দাঁতভাঙ্গা বাংলার মর্মোদ্ধার করে, তারপর অনুবাদ করতে গিয়ে আমি পড়লাম বিপদে। পিডিএফ খুলে বসে আছি আধা ঘন্টা ধরে, সেই কখন পড়েই যাচ্ছি তো পড়েই যাচ্ছি, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারি না। আজব অবস্থা। যে ভাষা পড়ছি সেটা বাংলা। যেই শব্দগুলো পড়ছি সেগুলোও চেনা, চেষ্টা করলে এগুলো দিয়ে বাক্যরচনাও মনে হয় করতে পারবো। কিন্তু এই সব শব্দ এক সাথে মিলে এক্স্যাক্ট কী অর্থ প্রকাশ করছে কোনভাবেই তার কূলকিনারা করতে পারছি না। আবার যদি কোনভাবে এক লাইন বুঝেও ফেলি, ইংরেজী করতে গিয়ে পড়তে হচ্ছে আরেক ডিলেমায়। ফাইন্যানশিয়াল টার্মগুলোর যে বাংলা ব্যবহৃত হয়েছে সেটা দেখে বুঝতে পারছি না এগুলোর ইংলিশ কি হবে। আমি নিজে ফাইন্যান্স কিম্বা অ্যাকাউন্টিং এর ছাত্র না। তখন সবে এসব ব্যাঙ্কিং টার্ম চেনা জানার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক আবার কোনক্রমেই ইংলিশ টার্ম ব্যবহার করবে না। যতো র‍্যান্ডম, দুর্লভ, দুর্বোধ্য এবং দুর্বিষহ রকমের কঠিন বাংলা শব্দ আছে তারা ব্যবহার করবে, কিন্তু ইংলিশ ব্যবহার করা যাবে না। শুধু ব্যাঙ্ক শব্দটা ছাড়া। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের বাংলা ভাষার প্রতি এমন পিউরিট্যানিক্যাল এবং কিছুটা গোঁয়ারের মতো ভালোবাসার চাপে পড়ে আমার তখন পুরোপুরি পাকিস্তানে চলে যাবার মতো অবস্থা। আমরা কি এমন বাংলা চেয়েছিলাম? আমরা কি এমন বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক চেয়েছিলাম?

কি অবস্থা! ইকোনোমিক্সে মাস্টার্স করার পর একটা ব্যাঙ্ক সার্কুলার অনুবাদ করতে পারছি না! আমার “রাজাকারী”-সম বাংলাভাষার দক্ষতা নিয়ে দুঃক্ষ-কষ্ট হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাবার প্রস্তুতি নেয়ার সময় হঠাৎ খেয়াল করলাম ফাইন্যানশিয়াল এক্সপ্রেসের মতো কিছু পেইপারে কিছু সার্কুলারের মূলভাষ্য ইংরেজিতে দিয়ে দেয়া হয়। সুন্দর কপি করে, কিছুটা রিরাইট করে কাজ চালিয়ে দেয়া যায়। আমি তো মহা খুশি। আলহামদুলিল্লাহ! সুন্দর কাজ গুছিয়ে সিইও-র কাছে নিয়ে গেলাম। ..বেশিরভাগ সময় দেখা যায় যেই ব্যাপার নিয়ে আপনি চিন্তা করতে করতে অস্থির হয়ে গেছেন, সেটা নিয়ে কোন সমস্যা হয় না। আমারো হল না। সমস্যা হল অন্য জায়গায়। আমি সব জায়গায় রেফারেন্স দিয়েছি সেকেন্ডারী সোর্স থেকে। উনি বললেন সব প্রাইমারী সোর্সের রেফারেন্স হতে হবে। ভেরিফায়েবল প্রাইমারী সোর্স। মেজাজ খারাপ হবার মতো ব্যাপার। ব্যাঙ্ক সার্কুলারের লিঙ্ক না হয় ওয়েবসাইট থেকে নিয়ে নিলাম, কিন্তু বাকি সবকিছুর কি হবে? তিন মাসের পুরো ইকোনমির ডেইটা, মার্কেট স্পেসিফিক ট্রেন্ড অ্যানালাইসিস, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ডেইটা সব কিছু নেয়া সেকেন্ডারী সোর্স থেকে, অর্থাৎ বিভিন্ন পেইপার, সাইট, ব্লগ এসব থেকে। বেশিসরভাগ ক্ষেত্রেই আবার সেকেন্ডারী সোর্সে প্রাইমারী সোর্সের রেফারেন্স দেয়া নেই। শুধু “আজকে বিকেলে এক বিজ্ঞপিতে…”, “…এক প্রেস বার্তায়”, “বাংলাদেশ আমদানী রফতানী ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী…” —দিয়ে কাজ সেরে ফেলা হয়েছে। এখন এই সব কিছু ব্যাকট্র্যাক করে কিভাবে প্রাইমারী সোর্স খুঁজে বের করা সম্ভব! যতোই চিন্তা করছি মেজাজ ততো খারাপ হচ্ছে। ভেরিফায়েবল প্রাইমারী সোর্সের এমন কিইবা দরকার?

মেজাজ খারাপ হত থাকলে চিন্তা বন্ধ করে দেয়া ভালো। নইলে চিন্তা করতে করতে রাগ একটা সময় অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। অন্তত আমার ক্ষেত্রে। তাই চিন্তা করা বন্ধ করে দিলাম। কাজ বন্ধ করে নেট ঘাটাঘাটি শুরু করলাম। মেজাজ ঠান্ডা হবার পর মনে হল, সিইও-র কথার পেছনে যুক্তি আছে। শক্ত যুক্তি। প্রথমত, বুলেটীনের মাধ্যমে তথ্য যেহেতু তার প্রতিষ্ঠানের নামে প্রকাশ করা হচ্ছে, তাই এটার সাথে কিছু রেসপন্সিবিলিটি, কিছু দায়বদ্ধতা সংযুক্ত থাকে। এখানে নিখুঁত থাকার চেষ্টা করাই উচিত। দ্বিতীয়ত, এবং এটাই প্রধান যুক্তি, এই তথ্যগুলো উপস্থাপন করা হবে ব্যবসায়ীদের কাছে। তারা এর উপর ভিত্তি করে, ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যেগুলোর ফলাফলও গুরুত্বপূর্ণ। এমন সব সিদ্ধান্ত যেগুলোর সাথে অনেক মানুষের আর অনেক অনেক টাকার প্রশ্ন জড়িত। অবশ্যই এরকম একটা ক্ষেত্রে আপনি কারো মুখের কথা মেনে নেবেন না। সে পেইপার কাটিং নিয়ে আসলেও আপনি আরও প্রমাণ চাইবেন। যতো ভালো পেইপার-ই হোক তাঁদের ভুল হতেই পারে। আপনি চাইবেন প্রাইমারী সোর্স থেকে নিশ্চিত ভাবে জানতে। যখন প্রশ্নটা আপনার সারা জীবনের সঞ্চয়ের অথবা কোটি কোটি টাকার অথবা হাজারো মানুষের জীবন ও জীবিকার, তখন অবশ্যই আপনি চাইবেন যেকোন পদক্ষেপ নেয়ার আগে ১০০% নিশ্চিত হতে।

প্রাইমারী সোর্সের রেফারেন্স দিতে বলা ছিল উনার বিচক্ষণতা এবং কেন দিতে হবে এটা বুঝতে না পারা আমার অজ্ঞতা। আমি বিভিন্ন সময় এই মানুষটার ব্যবসায়িক বুদ্ধি এবং বিচক্ষণতা পরিচয় পেয়েছি। মার্কেট অ্যানালাইসিস খুব সহজ কিছু না। হ্যাঁ, গৎবাধা, ধরা-বাঁধা কিছু কথাকে অ্যানালাইসিস বলে চালিয়ে দিলে অন্য কথা। কিন্তু প্রপার অ্যানালাইসিস, যার অর্থ হল কোন একটা সেক্টরে বর্তমান এবং অতীত পারফরমেন্সের উপর ভিত্তি করে, সরকারের পলিসি ডিসিশানের জন্য অ্যাডজাস্ট করে আরও নানা পেরিফেরাল ভ্যারিয়েবল আমলে নিয়ে সেই সেক্টরের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা পূর্বাভাস দেয়া—এটা কঠিন কাজ। এই ধরণের অ্যানালাইসিসের জন্য মাথা খাটাতে হয়, বিবেচ্য বিষয় সম্পর্কে ভালো রকমের জানাশুনা থাকতে হয় এবং প্রাপ্য তথ্য উপাত্ত যাচাইবাছাই এর মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার ক্ষমতা থাকতে হয়।। মোট কথা গভীর এবং সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করার সক্ষমতা ছাড়া এই কাজটা করা সম্ভব না।


এই সূক্ষ্ম চিন্তা করার সক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিই আমাকে একবার ডেকে পাঠালেন আমি কেন নামাযের পর সবার সাথে একসাথে হাত তুলে মুনাজাত করি না এবং “ওহাবী-আহলে হাদীস”দের মতো নামায পড়ি সেটা জানতে। সবাই মুনাজাত করছে আমি করছি না, এটা দৃষ্টিকটু, ব্যাপারটা শোভনীয় না – ইত্যাদি বলার এক পর্যায়ে উনি বলে বসলেন “দেখো মুনাজাতটা হল নামাযের আসল জিনিস, মূল জিনিস…এটা না করলে কিভাবে হবে?” সম্মিলিত ভাবে প্রতি জামাতের পর মুনাজাত করা নামাযের মূল বিষয়! কুর’আন হাদীস, সালাফ সালেহীন থেকে যার ওয়াজিব-সুন্নাত-নাফল কোনটা হবার প্রমাণ নেই উনি সেটাকে নামাযের ফরয বিষয় বানিয়ে দিলেন! এটা শুধু একটা উদাহরণ। বিভিন্ন সময়ে ইসলাম এবং ইবাদাত সম্পর্কে কুর’আন সুন্নাহ-র সাথে সাংঘর্ষিক উনার অদ্ভুত, ভিত্তিহীন, ভ্রান্ত বিশ্বাসের অন্যান্য আরো উদাহরণ আমি পেয়েছি।


এই যে মানুষটা, তিনি কিন্তু মূর্খ নন। বোকা বা চিন্তা করতে পারেন না, বিবেক-বুদ্ধি নেই, এমনটা না। অথচ একটা ব্যাঙ্ক সার্কুলার কিম্বা অর্থনীতির ডেইটার ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশানের যেই প্রিন্সিপাল উনি অ্যাপ্লাই করছেন বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সেটা করছেন না। আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষ করছে না। যখন ব্যাপারটা টাকাপয়সার সাথে জড়িত, আর্থিক লাভক্ষতির সাথে জড়িত, বিয়ের সাথে জড়িত, সংসারের সাথে জড়িত তখন সঠিক ভাবে জানা, বোঝা, যাচাই-বাছাই করার গুরুত্ব আমরা বুঝি বুঝছেন, কিন্তু যখন এটা আখিরাতের প্রশ্ন, অনন্তকাল আগুনের খোরাক হওয়া আর জান্নাতে প্রবেশ করার প্রশ্ন, তখন আমরা প্রাইমারী সোর্স থেকে যাচাই-বাছাই করা, জানা এবং বোঝার প্রয়োজন অনুভব করছেন না।...আশ্চর্য একটা ব্যাপার! চিন্তা করার সক্ষমতা কিন্তু একটা সুইচের মতো না। ইচ্ছেমতো অন-অফ করা সম্ভব না। একবার শেখার পর এই সুইচ অন-ই থাকে। ব্যাপারটা কিন্তু এমন না যে আমি ব্যবসা নিয়ে চিন্তা করার সময় এই সুইচ অন করে দিলাম, আর কুর’আন নিয়ে যখন বসলাম তখন বন্ধ করে দিলাম। অথচ কোন একটা কারণে ইসলামের ব্যাপারে আমরা আমাদের চিন্তা করার সুইচ অফ করে দিচ্ছি। আল্লাহ বলেছেন কুর’আনে চিন্তাশীলদের নিদর্শন রাখা হয়েছে। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন কুর’আন নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করার জন্য। যেই বিষয়টা নিয়ে আমাদের সবচাইতে বেশি চিন্তা করা উচিত, সবচেয়ে বেশি লাভক্ষতির হিসেব করা উচিত সেটা নিয়েই আমরা সব চাইতে বেশি উদাসীন।


একটা মানুষ এক্সপোর্ট ডেইটা, কোন ঐতিহাসিক তথ্য, কন্সপিরেসি থিওরী, কোন খেলোয়াড়ের ব্যক্তি জীবন, গিটার বাজানোর কোন একটা টেকনিক, সিনেমাটোগ্রাফির কোন ট্রিক, নতুন কোন সিনেমা কিম্বা টিভি সিরিজ, এসব নিয়ে জানার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন নানা রিসোর্স ঘাটছে, তথ্য সংগ্রহ আর সেই তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাছাই করা চেষ্টা করছে। সেই একই মানুষের ইসলাম নিয়ে জানার চেষ্টা করার সময় হয় না। সময় হয় না একটু কুর’আনের অর্থসহ বুঝে পড়ার। সময় হয় না রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সীরাহ পড়ার। সময় হয় না রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদীস পড়ার। সময় হয় না আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে আসলে কি চান সেটা নিয়ে একটু চিন্তা করার। কি অদ্ভুত বৈপরীত্য! এই বৈপরীত্যের কারণ কি? কারণ হল আমরা এই বিষয়গুলোকে যতোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি, যতোটা দরকারী মনে করছি ইসলামকে ততোটা গুরুত্বপূর্ণ বা দরকারী মনে করছি না। কারণ ইসলাম আমাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ না। আল্লাহ কি চান সেটা আমাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ না। আমাদের প্রায়োরিটি লিস্টের উপরের দিকটা পুরোপুরি বুকড, শেষের দিকে খালি কিছু স্লট আছে, ওগুলোর কোন একটা আমরা বরাদ্দ করি ইসলামের জন্য। হয়তো “বছরে একবার গ্রামে যাওয়া”-র উপরের বা নিচের স্লটটা।


একটা সবজি কেনার সময় আপনি সেটা যাচাই-বাছাই করছেন, একটা পোষাক কেনার সময় আপনি বারবার খেয়াল করছেন কোন খুঁত আছে কিনা। কিন্তু আপনি জান্নাত কিনছেন নাকি জাহান্নাম কিনছেন সেটা যাচাই-বাছাই করছেন না। ইসলাম হল কিছু কাজ যা করতে হয় তাই করা? ধর্ম হল বাপদাদারা যা করে এসেছেন প্রশ্ন না করে সেটা করে যাওয়া? ইবাদাত হল কোন পীর আপনাকে যা বোঝালো তাই? আপনার অগ্রবর্তীরা কোন কাজ করে এসেছেন তাই সেটাকে সঠিক ধরে নেয়া—এটাই ইসলাম? জীবনের আর কোনো ক্ষেত্রে আপনি এভাবে চিন্তা করেন না। আপনার জীবিকার ব্যাপারে, আপনার পরিবারের নিরাপত্তার ব্যাপারে, টাকা-পয়সার ব্যাপারে কোনো ক্ষেত্রেই আপনি এভাবে চিন্তা করবেন না। কিন্তু অনন্ত আগুন থেকে নিজেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে আপনি উদাসীন হয়ে গেলেন? একটু কষ্ট করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) আসলে কি বলেছেন সেটা জানার চেষ্টা করলেন না? ইসলামকে কতোটা অগুরুত্বপূর্ণ মনে করলে এরকম করা সম্ভব? প্রায়োরিটি লিস্টের কত নাম্বারে ইসলাম থাকলে এরকম উদাসীন হওয়া সম্ভব?


এখন আছে কি না জানি না, আমাদের সময়ে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষায় ফোর্থ সাবজেক্ট নামক এক বস্তু ছিল। খারাপ করলে সমস্যা নাই, ভালো করলে তো ভালোই। এটা নিয়ে শিক্ষকরাও সিরিয়াস ছিলেন না, ছাত্ররাও না। ইসলামের অবস্থা আমাদের কাছে ফোর্থ সাবজেক্টের মতো হয়ে গেছে। ছেড়ে দিলে সমস্যা না, কিছু মানলে ভালো। তবে বেশি আবার মানা যাবে না, পুরোটা মানা যাবে না। ডিগ্রী, ক্যারিয়ার, সম্পদ, সম্মান, পোশাক, চেহারা, সিনেমা, গান, হ্যাং আউট, উৎসব এইসব কিছুর জন্য সময় ও শক্তি বরাদ্দ করার পর (A+ নিশ্চিত করার পর) যা সময় বেঁচে থাকবে সেইটুক হল “ধর্মকর্ম” করার জন্য। তাই আমাদের সমাজে দাড়ি রাখার, নামাজী হবার, ইসলাম পালন করার উপযুক্ত বয়স হল পঞ্চাশের পরে। তাই আমাদের সমাজে বিগতযৌবনারা ছাড়া আর কেউ পর্দা করলে আমরা ভ্রূ কুঁচকে তাকাই। আমরা দুনিয়া পাওয়াকে আমাদের জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছি। আমরা ছোটকাল থেকে শিখে আসছি আর শেখাচ্ছি কিভাবে জাগতিক সাফল্য আর আর মাইলফলকের পেছনে ছুটতে হয়। মানব জীবনের উদ্দেশ্যকে আমরা ডিগ্রী, সম্মান, সম্পদ আর ইট-কাঠের সীমানার মধ্যে বেধে ফেলেছি। তোমার যতো বেশি আছে তুমি ততো সফল। তোমার যতো সুন্দর আছে তুমি ততো সফল। তোমার যতো বড় আছে তুমি ততো সফল। কিছু জিনিস যা আপনার ছিল না, সেগুলো পাবার জন্য সারাটা জীবন ছুটলেন। আবার চলে যাবেন এগুলোর কোন কিছুই সাথে না নিয়ে। এটাই কি জীবনের অর্থ? এটা জীবনের উদ্দেশ্য? অথচ আল্লাহ আযযা ওয়া জাল পরিষ্কার বলছেনঃ

"আমি মানুষ ও জিনকে সৃষ্টি করেছি **শুধুমাত্র** আমার ইবাদাতের জন্যই।" [সূরা আয যারিয়াত, ৫৬]


রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের বলেছেন দুনিয়াতে মুসাফিরের মতো সময় কাঁটাতে। ব্যাগ গোছানো আছে, আপনি প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছেন। ডাক আসলেই উঠে পড়বেন চলে যাবার জন্য। কিন্তু আমরা তো গন্তব্যকে বাদ দিয়ে সফরকেই আমাদের মূল লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছি। আমি মাঝে মাঝে অবাক হবার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলি। কিছুদিন আগে আমি একটা খবর দেখলাম জাপানের এক ছেলে একটা পুতুলের মত হবার জন্য অপারেশান করে তার পাজড়ের দুটো হাড় সরিয়ে ফেলেছে। এই ছেলের গার্লফ্রেন্ড এবং তার জীবনের লক্ষ্য হল বার্বি এবং কেন [as in Barbie and Ken from the Barbie Doll franchise] এর মতো হওয়া। এই জন্য তারা লাখ লাখ ডলার খরচ করে অপারেশান করে নিজেদের চেহারা, শরীর, চামড়া বদলে ফেলেছে। পুতুল বার্বি আর তার বয়ফ্রেন্ডের শারীরিক গঠনের অনুপাত বাস্তবসম্মত না। এজন্য মানুষ বার্বি আর তার বয়ফ্রেন্ড নিজেদের শরীর থেকে হাড় সরিয়ে ফেলছে যাতে করে সেই অনুপাতের এবং মাপের শরীর পাওয়া যায়। সুবহান’আল্লাহ! এই মানুষগুলোর জীবনের উদ্দেশ্য পুতুলের মতো হওয়া!

আপনি যদি একটু মেকাপ, ফিটনেস, কাপড়, লাইফস্টাইল এ ধরণের ব্লগ, ওয়েবসাইট একটু খুঁজে দেখেন, আপনি অবাক হয়ে যাবেন। কত হাজার লাখ সাইট আছে তার হিসেব নেই। আপনি পেইপার দেখুন, বা টিভির দিকে তাকান। সব জায়গায় শুধু এই মন্ত্র, কিভাবে আরো বেশি জিনিস কেনা যায়, কিভাবে আরো বেশি জিনিসের মালিক হওয়া যায়, কিভাবে নিজেকে সুন্দর করা যায়, কিভাবে নিজেকে আরো আকর্ষণীয় করা যায়, কিভাবে আরো বেশি মানুষের সাথে শোয়া যায়, কিভাবে মানুষকে নিজের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলা যায়। ব্যস এটাই মানব জীবনের লক্ষ্য? আমাদের শুরু এক ফোঁটা বীর্য থেকে আর শেষ হল পচে-গলে মাটিতে মিশে যাওয়ায়। আর এই দুইয়ের মাঝামাঝি সময়টা আমরা কাঁটিয়ে দেই আমাদের শরীরের ভেতর মলমূত্র বহন করে। তাহলে কিসের জন্য আমরা ছুটছি?

“আমি মানুষ ও জিনকে সৃষ্টি করেছি **শুধুমাত্র** আমার ইবাদাতের জন্যই।”

এই সব কিছু যার পেছনে হন্যে হয়ে আমরা ছুটছি তার কিছুই আমাদের সাথে কবরে যাবে না। এই সবকিছু, এই দুনিয়া, এই পৃথিবী, এগুলো তো ধূলোবালির রাজ্য। সমুদ্র কিনারে বানানো বালির প্রাসাদ। যতো বিশাল, যতো জাঁকজমকপূর্ণ, যতো চোখ ধাঁধানো সুন্দর হোক না কেন একটা স্রোত আসবে আর সব কিছু ভেঙ্গেচুড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এবং আপনি নিশ্চিত থাকুন যে স্রোত আসবেই। নিশ্চিতভাবেই আপনার বালির প্রাসাদ ভাঙ্গার জন্য স্রোত রওনা হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। কিন্তু আপনি উপলব্ধি করছেন না। আপনি আপনার বালির প্রাসাদ নিয়ে মগ্ন হয়ে আছেন। শামুক-ঝিনুক কুড়িয়ে আপনার বালির প্রাসাদ কে সাজাচ্ছেন। কিন্তু স্রোত আসছে। এবং এই স্রোত থামানোর কোন ক্ষমতা আমাদের নেই। যেই নির্জন আবাসে আপনাকে যেতে হবে, সেই পান্থনিবাসে আপনি এই সব কিছুই নিয়ে যেতে পারবেন না। হাতুড়িধারী দুইজন একটি শব্দও উচ্চারণ করবেন না এই দুনিয়া নিয়ে। তাঁরা শুধু জানতে চাইবেন তোমার রাব্ব কে? তোমার দ্বীন কি? তোমার নাবী কে? আল্লাহু আকবার। যদি এই জীবন থেকে একটি জিনিস আপনি নিয়ে যান তবে সেটা হল ঈমান। ঈমান ছাড়া আর কোন কিছুই আপনার সাথে যাবে না।

“আমি মানুষ ও জিনকে সৃষ্টি করেছি **শুধুমাত্র** আমার ইবাদাতের জন্যই।”

তাই আমাদের নিজেদের প্রায়োরিটি লিস্টটা নিয়ে আমাদের গভীর ভাবে চিন্তা করা উচিত। আমাদের ভাবা দরকার আমাদের লিস্টের উপরের দিকে আমরা কি রাখব। ডিগ্রী, ক্যারিয়ার, সংসার, সন্তানাদি, ব্যবসা, অর্থ, সম্পদ, সম্মান, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, এগুলো যদি আপনার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) — এর চাইতে আমাদের কাছে বেশি প্রিয় হয়—যদি পরিবারকে খুশি করা, বস-কে খুশি করা, সমাজকে খুশি করা, রাষ্ট্রকে খুশি করা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল-কে খুশি করার চাইতে আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়—যদি দুনিয়ার জন্য আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের—দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে থাকেন—যদি এই জীবনে প্রাপ্তির জন্য আপনি আল্লাহ-র বিধানকে উপেক্ষা করে থাকেন, উপহাস করে থাকেন, অবহেলা করে থাকেন—তাহলে প্রস্তুতি নিন ঐ ভয়ঙ্কর আযাবের জন্য যা কবরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রস্তুতি নিন হাতুড়িধারীদের প্রচন্ড আঘাত সহ্য করার জন্য। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন-

“তোমাদের মধ্যে কেউ পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসী হবে না যতক্ষণ না তোমার কাছে আমি তোমার নিজের চাইতেও বেশি প্রিয় হব।“ [বুখারী]

যদি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর চাইতে নিজের জীবন বেশি প্রিয় হয়ে থাকে তাহলে ঈমান অপূর্ণ থেকে যাবে। তাহলে আমাদের কি হবে যাদের কাছে ব্যবসা, জীবিকা, পরিবার, পোশাক, সম্পদ এসব কিছু আল্লাহ-র দ্বীনের চাইতে বেশি প্রিয় হয়ে গেছে? আর যদি আল্লাহ-র আদেশের চাইতে আরাম-আয়েশ-সুখ আর নিরাপত্তা আমাদের কাছে বেশি প্রিয় হয়ে থাকে তাহলে কি হবে সেটা স্বয়ং মালিকুল মূলক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের বলে দিয়েছেনঃ

বল [হে মুহাম্মাদ], তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান-যাকে তোমরা পছন্দ কর-আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান [মৃত্যু] আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। [সূরা আত-তাওবাহ, ২৪]


আমরা কোন বিষয়কে কতটুকু গুরুত্ব দেই সেটা আমাদের ব্যক্তিত্ব এবং পরিচয়কে সংজ্ঞায়িত করে। আমাদের প্রয়োরিটি লিস্টে কোন জিনিসটাকে আমরা কোথায় রাখছি এটা নির্ধারণ করে দেয় আমাদের পরিচয়। দুনিয়াতে এবং আখিরাতে। ব্যবসায়ী এক নম্বরে রাখবে ব্যবসাকে, প্রেমিক রাখবে প্রেমিকাকে, মধ্যবিত্ত রাখবে সম্মান আর স্বাচ্ছন্দ্যকে, কিছু মানুষ রাখবে ক্ষমতাকে আর কিছু মানুষ রাখবে খেয়াল খুশিকে। কিন্তু নিশ্চিত ভাবে এটা জেনে রাখুন মু’মীন এক নাম্বারে রাখবে দ্বীন ইসলামকে—আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাঃ) সন্তুষ্টিকে। এটাই ঈমানের দাবি এবং এটাই ঈমানের সংজ্ঞা। কবরের প্রশ্নোত্তরে মাল্টিপাল চয়েস দেয়া হবে না। ওখানে একাধিক সঠিক উত্তর থাকবে না। কোন সৃজনশীল প্রশ্ন করা হবে না, উত্তর ও গ্রহণ করা হবে না। আল্লাহ, ইসলাম এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছাড়া আর কোন উত্তর সেই ভয়ানক দিনে আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। তাই আসুন জিজ্ঞাসিত হবার আগে আমরা নিজেরা নিজেদের জিজ্ঞাসা করি। পরীক্ষিত হবার আগে নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরীক্ষা করে দেখি। আমাদের যার যার প্রায়োরিটি লিস্টে ঈমানকে আমরা কতো নাম্বারে রেখেছি সেটা একটু চিন্তা করে দেখি। যেই ধূলোবালির রাজ্যের পেছনে জীবনকে নষ্ট করছি, আসুন সেই রাজ্যের প্রকৃত রূপটা দেখার এবং স্বীকার করার চেষ্টা করি। আসুন সমুদ্র তীরে বালির প্রাসাদ গড়া বাদ দিয়ে, সেই অনন্ত উদ্যানে প্রাসাদ বানাই যার পাদদেশে প্রবাহিত হয় নদী। আসুন দুনিয়ার সাফল্যের পেছনে ছোটা বন্ধ করে সেই জিনিসের পেছনে ছুটি যাকে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল মহাসাফল্য বলে অভিহিত করেছেন, নিশ্চয় এটাই সর্বোৎকৃষ্ট লেনদেন।

মুমিনগণ, আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বাণিজ্যের সন্ধান দিব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দেবে? তা এই যে, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ও জীবনপণ করে জেহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম; যদি তোমরা বোঝ। [সূরা আস-সফ, ১০, ১১]

আল্লাহর পথে ক্বিতাল কর এবং জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছু শুনেন। এমন কে আছে যে, আল্লাহকে কার্জ দেবে, কার্জে হাসানা; অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন। আল্লাহই সংকোচিত করেন এবং তিনিই প্রশস্ততা দান করেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা সবাই ফিরে যাবে। [সূরা আল বাক্বারা, ২৪৪, ২৪৫]


নিশ্চয় আল্লাহ-র কালাম সত্য, তাঁর প্রতিশ্রুতি সত্য, তাঁর নাবী (সাঃ) সত্য , তাঁর দ্বীন সত্য, জান্নাত সত্য এবং জাহান্নাম সত্য। আমরা আল্লাহ-র কাছ থেকে এসেছি এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাবো এবং সাফল্য তো শুধু তাঁদের জন্য যারা নিজেদের জীবনকে আল্লাহ-র জন্য সস্তায় বিক্রি করে দিয়েছে। অভিনন্দন তো শুধু তাঁদেরই জন্য যারা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল কে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে। নিশ্চয় সম্মান ও মর্যাদা শুধুমাত্র আল্লাহ তাঁর রাসূল (সাঃ) এবং মুসলিমদের জন্য। এই লেখায় যদি কোন কল্যাণ থাকে তবে তা আল্লাহ-রই পক্ষ থেকে, আর যা কিছু অকল্যাণ ও ভুল এখানে আছে তা আমার পক্ষ থেকে। শান্তি বর্ষিত সকলের প্রতি যারা হিদায়েতের অনুসরণ করে।