বাংলাভাষায় ‘চর দখল করা’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। এছাড়াও আমরা দেখি নদীর পাড় দখল, রেল লাইনের দু’পাশের জমি দখল, রাস্তার পাশের ‘সি এন্ড বি’র [আসলে সড়ক ও জনপথের] জায়গা দখলের খবরাখবর বা কিস্সা-কাহিনী প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় ওঠে। রাজনৈতিক পেশী-শক্তির বলে গুন্ডাবাহিনী নিয়ে বুক ফুলিয়ে গিয়ে কোন স্থান বা বাড়ী দখলের ঘটনার খবর প্রায়ই ফলাও করে খবরের কাগজে ওঠে। এছাড়া প্রভাবশালীরা বন-জঙ্গল বা খাস জমি কিভাবে দখল করে থাকেন – বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে আমরা তা জানতে পেরেছি। তবে সাধারণ মানুষের সাধারণ দখলগুলো খুব সন্তর্পণে এবং ‘ট্রায়াল এন্ড এররের’ মাধ্যমে ঘটে থাকে। উদাহরণস্বরূপ কখনো দেখা গেলো যে, কেউ রাস্তার পাশে সরকারের জমিতে গুটিকয়েক ইট বিছিয়ে তার উপর চা-বানানোর কিছু সরঞ্জাম ও বিস্কুটের কৌটা নিয়ে চা বিক্রি করতে শুরু করলো। এভাবে কিছুদিন চলার পর, যখন সে আশপাশের মানুষের ‘চোখ-সওয়া’ হয়ে গেল, তখন হয়তো সে ঐ একই স্থানে একটা ছাপড়া ঘর তুলে দিয়ে একটা ‘অস্থায়ী-দেখতে’ চায়ের স্টল চালু করে দিল। আবার বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর, যদি সে একটা পাকা ঘর তুলে বেশ জমজমাট ‘হোটেল ব্যবসা’ চালু করে দেয়, তবু হয়তো মানুষের চোখে আর লাগে না – তারা ভুলেই যায় যে, তার পুরা স্থাপনাটাই অবৈধ। এভাবেই আমাদের দেশের গ্রাম অঞ্চলে জমির সীমানা নির্ধারক ‘আইল’ সন্তর্পণে এবং ধীরে ধীরে স্থানান্তর করে, অন্যের জমি আত্মসাৎ করা হয় – চলিত ভাষায় যেটাকে ‘আইল ঠেলা’ বলা হয়। ভূ-জ্যামিতিক ক্ষেত্র ছাড়াও কিছু অদৃশ্য ক্ষেত্রেও, খুব ধীর গতিতে ও সন্তর্পণে এমন দখলদারি চলে। তার একটি হচ্ছে নৈতিকতার জগত


আপনি খেয়াল করে দেখবেন যে, অনৈতিক কাজগুলো কোন সমাজে হঠাৎ একদিনে শুরু হয়ে যায় না। ফিলিপিন্সের দক্ষিণাঞ্চলের মুসলিম প্রধান মিন্দানাও প্রদেশে, একটু প্র্যাক্টিসিং মুসলিম যারা, তাদের লোকালয়ে [বিশেষত গ্রামাঞ্চলে] কোন খৃষ্টানকে এসে বসতি স্থাপন করতে দিতে চান না। কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন যে, “তাদের মুসলিম লোকালয়ে এসে বসবাস করতে দিলে, তারা প্রথমেই একটা গ্রোসারী খুলবে, যেখানে কোমল পানীয়ের পাশাপাশি বিয়ার পাওয়া যাবে। তারপর ব্যাপারটা সয়ে গেলে সেখানে একটা পানশালা বা নাইটক্লাব বা ডিসকোথেক টাইপের ব্যাবস্থা গড়ে উঠবে – যা কিনা অচিরেই একটা আধা-পেশাদার পতিতালয়ে পরিণত হবে। এভাবে তারা তাদের (মুসলিমদের) ছেলেমেয়েদের একেবারে গোল্লায় যাবার ব্যবস্থা করবে।”


আমি একথাগুলো এটা বোঝাতে আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম যে, নৈতিকতার জগতেও এরকম ‘আইল ঠেলাঠেলি’ ধরনের একটা ব্যাপার চলে। আমাদের দেশেও ‘পাবলিক কতটুকু খায়’ অর্থাৎ সাধারণ মানুষের সহ্য ক্ষমতা বা threshold value কতটুকু তা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চলছে। বোলিং, জিম, পুল বা বিলিয়ার্ড ইত্যাদি নানা নামের আড়ালে যে তরুণ-তরুনীদের অবাধ মেলামেশো এবং পার্টিং-এর ব্যবস্থা চালুর মহড়া চলছে তা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি চলছে ‘এনার্জি ড্রিংক’-এর নামে বিয়ার-সদৃশ পানীয় গিলিয়ে মানুষকে বিয়ারের স্বাদে অভ্যস্ত ও আসক্ত করে তোলার মহড়া। আপনারা হয়তো জানেন যে, এসব 'এনার্জি ড্রিংক'-এর অনেকগুলোর ব্র্যান্ড-নামে বাইরে বিয়ার বাজারজাত করা হয়। এভাবেই ৮৭% মুসলিম অধ্যুষিত দেশের নৈতিকতার জগত দখল করে নিচ্ছে অনৈতিকতার পৃষ্ঠপোষক বহুজাতিক কোম্পানীগুলো ও তাদের দেশী দালালরা – বদলে যাচ্ছে দেশের পরিবার ও সমাজের চেহারা সন্তর্পণে – একটু একটু করে। আপনারা বলতে পারেন মানুষ প্রতিবাদ করছে না কেন? এর নানাবিধ কারণ রয়েছেঃ

১) দুর্নীতি তথা সাধারণ মানুষের সম্পদ লুটপাট করে রাতারাতি ‘আঙ্গুল ফুলে বটগাছ’ হওয়া ধনীদের ইয়াবাসেবী সন্তানদের জন্য এসব কোন সমস্যা হবার কথা নয়, বরং প্রাচুর্য্য ও অতিরিক্ত সম্পদকে কাজে লাগানোর এক ধরনের সুযোগ।

২) সচেতনতা বা আপডেটিং-এর অভাবে অনেক গৃহকর্তা বাবাই হয়তো জানেন না যে, তাদের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেটি/মেয়েটি হয়তো লাইব্রেরী ওয়ার্কের নাম করে, কোন সাইবার ক্যাফের ঘুপচিতে গার্লফ্রেন্ড/ বয়ফ্রেন্ডের সাথে সারাদিন বসে থেকে জীবনের নিষিদ্ধ রসাস্বাদন করে বাড়ী ফিরছে। আর জিম, বোলিং বা বিলিয়ার্ডের আয়োজন করা ‘মিলনকেন্দ্র’ গুলোতে কি চলতে পারে তা হয়তো তার কাল্পনিক দুঃস্বপ্নেরও বাইরে।

৩) আরো যাদের সবচেয়ে বেশী প্রতিবাদ করার কথা, তাদের তো ঐ সব বিনোদন পল্লীতে প্রবেশাধিকারই নেই। ‘হুজুররা’ যেহেতু ‘নুন এবং পান্তা’ এক সাথে যোগাড় করা যায় কিনা, সেই চেষ্টায় প্রাণান্তকর জীবন যুদ্ধে লিপ্ত, সেহেতু তাদের অধিকাংশই দারিদ্র্যসীমার নীচে জীবনযাপন করে থাকেন। তাদের জরাজীর্ণ জোব্বা এবং টুপিদাড়িওয়ালা চেহারা একদিকে যেমন কোন সাইবার ক্যাফে বা বিলিয়ার্ড জয়েন্টে তাদের প্রবেশাধিকার কেড়ে নেয় – তেমনি জীবনে ভাববার অবকাশের বিলাসিতাও তাদের কাছে বিরল। সুতরাং খুব বিশাল কোন ‘ইসলাম অবমাননার’ ব্যাপার না ঘটলে, তাদের বোধোদয় হওয়া মুশকিল।

৪) বাকী রইলো আপামর জনসাধারণ। এদের অবস্থা বিপ্লবের আগের, ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা পড়া চীনের আফিমাসক্ত সাধারণ মানুষের মত। ভারত তথা পশ্চিমা জগতের ‘শরীরী-বিনোদনসামগ্রীরূপ’ ভোগ্যপণ্য ভোগ করতে করতে এরা নেশায় চূর হয়ে ঝিমাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্র দেশের একটি আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমির প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষও এখন চায়ের দোকানে বসে সকাল ১১টায় ‘ডিশের’ সিনেমা দেখতে দেখতে চা খায়। তারা কি বুঝতে পারছে যে, আসলে তাদের চক্ষু তথা অন্ধ জ্ঞান-চক্ষুর আড়ালে সন্তর্পণে কি ঘটে চলছে? নিশ্চয়ই না! তাহলে প্রতিবাদ করবে কারা? কঠিন প্রশ্ন! হয়তো যারা সবকিছুতেই দোষ দেখে, ‘প্রগতির’ যে কোন প্রচেষ্টাতেই যারা অশনিসংকেত দেখতে পায়, যারা আল্লাহকে একমাত্র Paradigm বা বিধানদাতা মনে করে, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও যারা নৈতিকতার অর্থ বোঝে, নৈতিকতার অদৃশ্য জগতের ‘আইল ঠেলা’ দেখলে যারা বোঝে যে গোবেচারা শ্রেণীর সরল গণসাধারণের ‘মস্তিষ্কের’ জমিন তথা ফসল, দু’টোকেই একত্রে নষ্ট করে দেবার জন্য তাদের মস্তিষ্কে GM বীজের মত নষ্ট বীজ বপন করা হচ্ছে – এরাই হয়তো প্রতিবাদের কথা ভাবে বা ভাষা খোঁজে, এদেরই হয়তো সংস্কৃতমনারা ‘মৌলবাদী’ বলে গালি দিতে পছন্দ করেন।


এমনই একটা ছেলে আমাকে নৈতিকতার অদৃশ্য জগতের অবৈধ জমি দখলের এক নির্লজ্জ প্রচেষ্টা, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে, নতুন চালু হওয়া ল্যাব-এইডের সামনে, মেইন রোডের উপর ‘ড্রেস-লাইন বাংলাদেশ’ বলে কোন কোম্পানীর একটা বিলবোর্ড সদ্য স্থাপিত হয়েছে। ছবিটা যেন, ‘রমযানের পবিত্রতা রক্ষা করুন’ ব্যানার -অথবা- রাজকীয় ইফতার মাহফিলে নীতিকথা কপচানো বিগ-শটদের দিকে তাকিয়ে ভেংচিকাটা ‘মৃত নৈতিকতার কোন কংকাল’। বিলবোর্ডের দুপাশে দু’জন রমণীর ছবি। দুটো ছবিই একাধারে অশ্লীল, অশোভন এবং ঘৃণা উদ্রেককারী – তবে একটা অত্যন্ত আপত্তিকর। যারা নগ্ন নারীদেহকে চারুকলার আদর্শ উপজীব্য মনে করে থাকেন, আমার ধারনা তাদেরও বমি আসবে ছবিটা দেখলে। রবীন্দ্রনাথের ‘নহ মাতা নহ কন্যা, নহ বধূ সুন্দরী রূপসী’ – এই বর্ণনার আলোকে আমি ভাবতে চেষ্টা করেছি, ছবিটি দিয়ে বিজ্ঞাপনদাতা ঠিক কোন শ্রেণীর রমণীকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। কেবল শরীর বিক্রি করে বা শরীরের ছবি বিক্রি করে উপার্জন করা উচ্চ শ্রেণীর প্রমোদবালা [বা courtesan] ছাড়া, আর কারো চিন্তা মাথায় আসলো না। তবে কি ‘ড্রেস-লাইনের’ সকল আয়োজন, আমাদের এই ঢাকা মহানগরীর courtesan দের জন্য? ইয়াবা সমেত কারো বাহু সংলগ্ন অবস্থায়, যাদের ধরা পড়ার ছবি আমরা কালেভদ্রে খবরের কাগজে দেখে থাকি??

এখানেই শেষ নয়। এরই মাঝে আমার পরিবারের আরেক সদস্য বললেন যে, মানিক মিয়া এভিন্যুয়ের মোড়ে, মিরপুর রোডের উপর ঐ একই কোম্পানির বিজ্ঞাপন দিয়ে এর চেয়েও আরো জঘন্য একটি বিলবোর্ড রয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশ ঘোরা আমার পরিবারের ঐ সদস্য বললেন যে, জীবনে এর চেয়ে অশ্লীল কিছু তিনি কখনো দেখেন নি। অথচ, এরই নীচ দিয়ে রমযানের ভাব গম্ভীর পরিবেশ চিত্তে ধারণ করে যারা হেঁটে যান তাদের ৮৭%-এর মুসলিম হবার কথা। এরই নীচ দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ইফতার করতে বাড়ী ফিরেন কত মুসলিম গৃহকর্তা। তাদের তো জানার কথা যে, তাদের রাসূলের (সা.) মুখে জীবনে একটি অশ্লীল বাক্য উচ্চারিত হয়নি; একটা স্থানের নামে অশ্লীল শব্দ থাকায়, তিনি ঐ স্থানের নাম মুখে উচ্চারণ করতেন না; যিনি বলে গেছেন যে, শ্লীলতা হচ্ছে ঈমানের একটি শাখা এবং শ্লীলতা শুধু মাত্র ভালোরই জন্ম দেয় [অর্থাৎ এর সবটুকুই সুন্দর]:

It is narrated on the authority of Abu Huraira that the Prophet (may peace be upon him) said: Iman has over seventy branches, and modesty is a branch of Iman. [Muslim: Book 001, Number 0059]

It is narrated on the authority of ‘Imran b. Husain that the Prophet (may peace and blessings be upon him) said: Modesty brings forth nothing but goodness……

তাহলে আমাদের কোন বিকার নেই কেন? আমরা কি তাহলে জাবর-কাটা গবাদি পশুতে পরিণত হয়েছি, যার ইঙ্গিত আল্লাহ্ কুর’আনে দিয়েছেন:

Many are the Jinns and men We have made for Hell: they have hearts wherewith they understand not, eyes wherewith they see not, and ears wherewith they hear not. They are like cattle, nay more misguided: for they are heedless (of warning) [৭:১৭৯]

যারা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে। ঘটনা ঘটে যায় – রাজা আসে রাজা যায়, যারা শুধু কালের সাক্ষী হিসেবে চেয়ে থাকে, চেয়েই থাকে! আমাদের বুঝতে হবে যে বিলবোর্ডের ঐ ছবিগুলো বিচ্ছিন্ন কোন প্রচেষ্টা নয়। বরং সারা বছর ধরেই চলেছে একটু একটু করে বস্ত্রহরণের "ট্রায়াল এন্ড এরর" – বিভিন্ন কোম্পানীর বিলবোর্ডে এবং মডেলিং চিত্রে।

শরীরের শোভা বিক্রি করা যাদের পেশা, তারা দেখেছে একটু একটু করে তারা যে নৈতিকতার চর দখল করে চলেছে, কই, তাতে তো কোন আপত্তি বা প্রতিবাদ আসছে না! আর এর চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটলো পণ্য বাজারজাত করার সবচেয়ে মোক্ষম সময়ে – রমযান মাসের "মহা-বাণিজ্যের" মৌসুমে। একজন সাধারণ মুসলিম হিসেবে আমি এই অশ্লীললতার প্রতিবাদ জানাচ্ছি, আহ্বান জানাচ্ছি আপনাকেও প্রতিবাদ জানাতে – যার যেখানে প্রতিবাদ জানানোর অবকাশ রয়েছে সেখানে।

০৮.০৯.২০০৯