অনেক সময় পুস্তকনির্ভর দীর্ঘ অধ্যয়নের চেয়ে কিছু সময়ের সান্নিধ্য বেশি উপকৃত করে। আলেমদের সান্নিধ্য চিন্তার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এনে দেয়। চিন্তার বিক্ষিপ্ততা দূর করে। যেসব ভাইয়েরা নিজে নিজে পড়াশোনা করেন, বা সবসময় অনলাইন নির্ভর থাকেন, তাদের উচিত মাঝে মাঝে আলেমদের সান্নিধ্যে যাওয়া।

গত সপ্তাহে আমার এক বন্ধুসহ উস্তাদের সাথে বসা ছিলাম। উস্তাদ আলী নদভী (র) এর ‘উলামা কা মাকাম আওর উনকি যিম্মাদারিয়া’ বইটি বের করে পড়তে বললেন। বন্ধুটি পড়া শুরু করলেন। আমরা শুনছিলাম। একস্থানে আলী নদভী কোরআনের একটি আয়াত এনেছেন। বন্ধুটি আয়াতের দিকে তাকিয়ে সেটি না পড়েই সামনে এগিয়ে গেলেন। উস্তাদ সাথে সাথে থামিয়ে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আয়াতটা পড়লেন না কেন? বন্ধু নিরুত্তর রইলেন। ভেবে দেখলাম, মাঝে মাঝে আমিও এমন করি। আলোচনার মাঝখানে পরিচিত আয়াত ও হাদিস এলে স্কিপ করে যাই। উস্তাদ বললেন, এই যে আয়াত না পড়ে এগিয়ে গেলেন এর মানে হলো আপাতত আপনার কাছে আয়াতের চেয়ে আলী নদভীর ফিকিরের দাম বেশি। আলী নদভীর কথার প্রতি আপনার বেশি গুরুত্ব, এজন্য মাঝখানে আয়াত এলেও সেটা না পড়েই এগিয়ে গেলেন। এভাবে পড়ে কোনো লাভ নেই। আলী নদভী যে আয়াত থেকে একটা ফিকির গ্রহন করেছেন, আপনি সেই আয়াতের দিকেই যদি মনোযোগ না দেন, তাহলে তাঁর ফিকিরের গভীরতা অনুধাবন করবেন কীভাবে?

‘ভাই, সারাজীবনের জন্য একটা শিক্ষা পেলাম। এভাবে ভাবিনি কখনো। এই দূর্বলতা কাটিয়ে উঠবো ইনশাআল্লাহ’। বন্ধুটি পরে বলেছিলেন।

#

উস্তাদের সাথে কথা হচ্ছিল কীভাবে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়া যায় সে বিষয়ে। উস্তাদ বললেন, যুগোপযোগী মানে আমরা কী বুঝি সেটা আগে দেখতে হবে। সাধারণত আমরা দেখি সাময়িক সুবিধা। যে সিদ্ধান্ত নিলে সাময়িক সুবিধা পাব, সেটাকেই আমরা যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত বলি। এর অগ্র-পশ্চাত বিবেচনা করি না। আপনি আকাবিরে দেওবন্দকে দেখুন। দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট দেখুন। এমন এক সময়ে তারা দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যখন ইউরোপে চলছিল শিল্পবিপ্লব। ভারত উপমহাদেশে প্রশাসনের সর্বত্র ছিল হিন্দুদের জয়জয়কার। তারা ইংরেজি শিক্ষা ও ইংরেজদের সাথে সুসম্পর্ক রাখার মাধ্যমে উচ্চ বেতন ও মর্যাদার পদগুলো হাতিয়ে নিয়েছিল। তখন যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত তো এটাই ছিল যে, উলামায়ে দেওবন্দ স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করবেন। ভালো করে ইংরেজি শিখবেন। প্রশাসনের বিভিন্ন পদগ্রহন করবেন। যেমনটা করছিল আলীগড়ের ছাত্ররা। কিন্তু দেখুন উলামায়ে দেওবন্দ এই কাজ করেননি। তারা যা করেছেন তাকে আপাতদৃষ্টিতে অনেকটা জনবিচ্ছিন্নতাই মনে হবে। তারা সব ত্যাগ করে ডালিম গাছের নিচে চলে গেছেন। পুরনো এক দরসে নেজামিকে আঁকড়ে ধরে শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু দেড়শো বছর পর উপমহাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন। আলীগড় ও দেওবন্দের ছাত্রদের অবদান দেখুন। কারা এই অঞ্চলে দ্বীনকে সংরক্ষন করেছে হিসাব মেলান। দেখবেন উলামায়ে দেওবন্দ যেভাবে দ্বীনের হেফাজত করেছেন অন্য কেউ সেভাবে করতে পারেনি। উলামায়ে দেওবন্দ আমাদের বড় কোনো তত্ত্বকথা শোনাননি, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার এনে দেননি, কারন, তারা এমন কোনো দায়িত্বই নেননি। এসব দায়িত্ব নিয়েছিল আলিগড়ের ছাত্ররা, সুতরাং এসবে ব্যর্থতা দেখা গেলে তাঁর দায় তাদের উপরই বর্তায়। উলামায়ে দেওবন্দ ভারী ভারী কথা না শুনিয়ে আমাদের কাছে অবিকৃতভাবে দ্বীনের মুতাওয়ারিস ফাহাম (ধারাবাহিক বুঝ) পৌছে দিতে চেয়েছেন এবং শতভাগ সাফল্যের সাথে তারা তা পেরেছেন, এটাই তাদের সাফল্য।

'যুগোপযোগী মানে সাময়িক সুবিধা দেখে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া নয়, যুগোপযোগী মানে হলো আজ থেকে একশো বছর পরের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেয়া, যেন পরে পস্তাতে না হয়' উস্তাদ পুরো আলোচনার সার-সংক্ষেপ বললেন।