জানিনা দীনী কমিউনিটির সাথে আলাপের জন্য উদাহরণটা ‘যায়’ কি না। একবার মনে হচ্ছে ‘যায় না’। আবার এর চেয়ে সুন্দর উদাহরণ মনেও আসছে না। শাহরুখ খানের ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ ফিল্মটা দেখেছিলাম, খুব সংক্ষেপে কাহিনীটুকু বলে মূল সীনে চলে যাচ্ছি। কবির খান একসময়ের ডাকসাইটে হকি প্লেয়ার। ইন্ডিয়ান হকি টীমের কাপ্তান। পাকিস্তানের সাথে কোনো ইম্পর্টেন্ট ম্যাচে কোনো এক ভুল সিদ্ধান্তে ভারত হেরে যায়। দোষ এসে পড়ে কাপ্তানের উপর। মুসলিম কাপ্তানকে গাদ্দারি, পাকিস্তানের সাথে আঁতাতের অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়। বহু বছর বাদে সেই কবির খান ফিরে আসে। ভারতীয় মহিলা হকি টীমের সংকটকালে এসে সে দায়িত্ব নেয়। নিজের দেশপ্রেম প্রমাণে ঝাঁপিয়ে পড়ে কবির খান, টীমকে তৈরি করতে, সামনে মহিলা হকি বিশ্বকাপ…

দায়িত্ব নেবার পর প্রথম ট্রেনিং ক্যাম্প, প্রথম দিন। লেট-কামারদের পুরো মাঠ চক্কর দেয়ানো হল, ইস্পাতদৃঢ় কোচ। এরপর পরিচয় পর্ব। সবাই এক লাইনে দাঁড়ানো, এক কদম সামনে আসবে, আর নিজের পরিচয় দেবে… নিজের পরিচয়। ‘আমি অমুক কাউর, পাঞ্জাব’। ‘আমি অমুক, নাগাল্যাণ্ড’। ‘আমি প্রীতি সাবারওয়াল, গুজরাট’। কেবল পশ্চিমবঙ্গের মেয়েটা, যে টীমের গোলকিপার; বলল: ‘আমি বিদ্যা, ইন্ডিয়া’। তখন কবির খান বলল: আমাদের আজকের এই করুণ দশার পিছে এই ‘পরিচয় দেয়া’টাই দায়ী। আমরা এতদিন কেউ ইন্ডিয়ার জন্য খেলিনি। কেউ পাঞ্জাবের জন্য, কেউ গুজরাটের জন্য খেলেছি। এখন থেকে আমরা আমাদের আর সব পরিচয় ভুলে যাব। আমরা ইন্ডিয়ার জন্য খেলব, আমাদের পরিচয়, স্রেফ ইন্ডিয়া, আর কিচ্ছু না। দাও, আবার সবাই সবার পরিচয় দাও। এবার মেয়েরা নিজেদের পরিচয় দিল: প্রীতি, ইন্ডিয়া। অমুক, ইন্ডিয়া। তমুক, ইন্ডিয়া। এটা ছিল টীমওয়ার্কের পয়লা ছবক। ফিল্মের শেষে ইন্ডিয়ান উইমেন্স হকি টীমকে কবির খান কাপ জেতান।

আমার এই বদদীনী উদাহরণ টানার উদ্দেশ্য এই টীমওয়ার্কের পহেলা ছবকটা। ভাষা-শব্দ অনেক বিরাট একটা জিনিস। কত বড়, এটা এক লেখায় বুঝানো অসম্ভব। আপনি যখন একটা শব্দ ব্যবহার করছেন, আপনার অজান্তেই সেই শব্দটা আপনাকে ব্যবহার করে নিচ্ছে। আপনি ইচ্ছে করে করছেন তা নয়। এজন্যই ভাষা একটা বিরাট জিনিস। এটা জলজ্যান্ত একজন মানুষের আস্ত একটা মনকে গঠন করে, আর মনটাই তো মানুষ। একটা সমাজ গঠন করে। সমাজমানস তৈরি করে। একটা জাতিকে গড়ে তোলে ভাষা, জাতিটার সংস্কৃতি কেমন হবে তা ভাষাই ঠিক করে দেয়। বায়ান্নতে কেবল রাষ্ট্রভাষাটা উর্দু করে ফেলতে পারলেই আর একাত্তর আসত না। এটা আবেগের কথা না, ভাষা আলাদা মানে আমি-তুমি আলাদা। ভাষা এক, মানে আমি-তুমি এক। এক করে ফেলা, ঐক্য তৈরির মাধ্যম ভাষা। এরপর শাসকের ভাষা রয়ে যাবে, শাসিতের ভাষা বিলুপ্ত হবে। দাসত্বের বাঁধনে বাঁধার অদৃশ্য শিকল এই ভাষা। উপনিবেশিক ভাষাকে যারা ঝেড়ে ফেলতে পেরেছে তারা দাসত্বকেও ঝেড়ে ফেলতে পেরেছে। মালয়েশিয়া একটা উদাহরণ। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ইংরেজদের গোলামি করেনি, এমন লোক খুব কম কিন্তু। যারা নেয়নি, তারা পাশ্চাত্য দর্শনও নেয়নি। যেমন হিন্দুস্তানের উলামায়ে কিরাম। হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে তামিল-তেলেগুওয়ালাদের সংগ্রামের খবর আমাদের জানাই হয়নি কোনোদিন। স্বাধীনতার আগে সেই ১৯৩৭ থেকে শুরু করে বার বার (১৯৩৭-৪০, ১৯৪৬-৫০, ১৯৬৩-৬৫, ১৯৬৮, ১৯৮৬, ২০১৪) তামিলনাড়ু আর কর্ণাটকে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। সব দখলদারেরাই ভাষাকে চাপিয়ে দিতে চায় প্রথমে। দাপ্তরিক ভাষা চেঞ্জ করে, শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে দিয়ে। ভাষাটা গিলিয়ে দিতে পারলে স্বাতন্ত্র্যবোধটা ডিলিট করা যাবে, তার সেটা হলেই যুগ যুগ গোলামি করবে, স্বাধীন হয়ে গেলেও গোলামি ছাড়তে পারবে না। তুর্কী সেকুলারায়নের একটা শক্ত হাতিয়ার ছিল তুর্কি ভাষাকে আরবি হরফ থেকে রোমান হরফে লেখা চালু করা। 1929 এ সোভিয়েতে ঢুকার আগে কাজাখ, উজবেক, তুর্কমেন, কিরগিজ, তাজিক ভাষা আরবি হরফেই লেখা হত, এরপর থেকে আরবি হরফের বদলে রুশ বর্ণমালায় লেখা হয়। পাকিস্তানীরা বাংলাকে আরবি হরফে লেখার প্রস্তাবও দিয়েছিল। আমি এখানে কাউকে দোষারোপ করছি না। কেবল বাস্তবতাটা বলেছি, এমন করে ব্যাপারগুলো ঘটে। যেমন আরবি ভাষার বাঁধনে মরক্কো থেকে ইরাক পর্যন্ত, যারা সবাই একসময় ছিল অনারব। সব দখলদার আর উপনিবেশী শক্তির সাথে সাহাবাদের মূল পার্থক্য হল, সাহাবাদের অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল ‘দীন দেয়া’। আর দখলদারদের উদ্দেশ্য থাকে ‘সম্পদ চোষা’। এটা অন্য টপিক, অন্য আলোচনা। সব সামনে নিয়ে আমার বলার উদ্দেশ্য এটাই ভাষা-বর্ণমালা নিছক লেখ্য কোনো মাধ্যম না, ভাষা-বর্ণমালা এগুলো সংস্কৃতি ও সভ্যতার বাহন। ভাষা বদলে গেলে বদলে যায় সমাজমানস। শব্দের প্রচলনে বদলে যায় ব্যক্তিমানস।

উদাহরণের পালা। এটুকু খুব বুঝতে হবে। নাহলে আমি আসলে যেটা বলতে যাচ্ছি সেটা বুঝে আসবে না। একেকটা শব্দ স্রেফ কয়েকটা নিরীহ বর্ণ না। একটা শব্দে লুকোনো থাকে একটা দর্শন, একটা ইতিহাস। পুঁজিবাদের একমাত্র শত্রু ইসলাম। ইসলামের উপর যত ধরনের হামলা (সামরিক/বুদ্ধিবৃত্তিক/আবেগিক/সামাজিক), তার একটা হাতিয়ার হল: শব্দ আক্রমণ, পরিভাষাগত হামলা। ওরা আমাদের উপর কিছু শব্দ বা পরিভাষা ব্যবহার করে। আমাদের আকিদাহ-আদর্শকে ডিমোনাইয (ভিলেন বানায়) করে নেয় আর ওদের আগ্রাসনগুলোকে জাস্টিফাই করিয়ে নেয়। যেমন: সন্ত্রাসী (পশ্চিম যাদের ভয় পায়), জঙ্গি (পশ্চিমা ফরম্যাটের বাইরে ইসলামী ফরম্যাট ধারণকারী), নারী অধিকার (পশ্চিমের সংজ্ঞায়), নারীশিক্ষা (পশ্চিমা), নারী স্বাধীনতা (পশ্চিমা ফরম্যাটের), গণতন্ত্র (পশ্চিমের হস্তক্ষেপের সুবিধাজনক), সুশাসন (পশ্চিম যেভাবে চায়), বৈষম্যদূরীকরণ (পশ্চিমের নিজস্ব শো-অফ ধারণা), আধুনিকতা (পশ্চিমের মত হওয়া) ইত্যাদি ইত্যাদি। একেকটা শব্দ প্রতিনিধিত্ব করে পশ্চিমা সভ্যতা ও দর্শনের। এই প্রতিটা পরিভাষার পিছনে আছে প্রতারণা/ফাঁকি/শ্রমিক বানিয়ে রাখা/ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। বার বার বিভিন্ন মিডিয়ায় এই শব্দগুলো তারা ব্যবহার করে নিজেদের সুপিরিয়রিটি ও আমাদের ইনফিরিওর প্রমাণের জন্য। এবং আমরা যারা ওদের সুরে সুর মেলাই, শব্দগুলো ব্যবহার করতে করতে একসময় দেহমন দিয়ে স্বীকার করে নিই ওদের শ্রেষ্ঠত্ব ও আমাদের নীচুত্ব। হীনম্মন্যতায় মাথা নিচু করে সিজদা করি শ্বেত সভ্যতাকে। এটা সোশাল ইনজিনিয়ারিং ও সাইকোলজিকাল ইনভেশন। বিস্তারিত জানতে পড়ুন আসিফ আদনানের ‘চিন্তাপরাধ’ বইটি।

আবার, যেমন ধরেন: ‘বাংলাদেশী’ মানে ‘আমি বাংলাদেশে বাস করি’ কিংবা ‘বাংলাদেশে আমার জন্ম’, তাই তো? আবার দেখেন, তাই কি? ভালো করে দেখেন তো।

১. আমি বাংলাদেশী।

২. আমি বাংলাদেশে বাস করি।

কিছু টের পান? আমি কাশ্মিরী, আমি ফিলিস্তিনি, আমি ইন্ডিয়ান, আমি আমেরিকান, আমি সৌদি। আর আমি কাশ্মিরে থাকি, ফিলিস্তিনে থাকি, ইন্ডিয়াতে থাকি, আমেরিকায় থাকি, সৌদিতে থাকি। ব্যাপারগুলো কি এক? ‘আমি আমেরিকায় থাকি’ বা ‘আমি বাংলাদেশে থাকি’ যেমন একটা নিরীহ বিবৃতি নিজের অবস্থান সম্পর্কে। ‘আমি বাংলাদেশী’ কেবল অবস্থান না। ‘আমি বাংলাদেশী’র মধ্যে যে কথাগুলো লুকোনো সেগুলো হল: আমি বাংলাদেশী মানে তুমি নন-বাংলাদেশী, আমি তোমার থেকে আলাদা, এবং আমি বাংলাদেশিত্ব নিয়ে গর্বিত। একটা স্বাতন্ত্র্য, একটা সীমানা, একটা দূরত্ব, একটা আড়, একটা আইল। ‘আমি চিটাগাইঙ্গা’ মানে ‘তোমরা সব বইঙ্গা’। এর মানে আমি চিটাগাঙে বাস করি, শুধু এতটুকু না। জানি না বুঝাতে পারলাম কি না।

এটাকে জাতীয়তাবাদ বলে। আমি এই জাতির লোক। এই জাতির সব লোক আমার সেলফ, বাকিরা সবাই নন-সেলফ। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদও একই ব্যাপার। জাতীয়তাবাদ হল এই সেলফ-ননসেলফ, ‘আপন-পর’ এর শিক্ষা। জাতীয়তাবাদকে আরও স্পেসিফাই করে দেয়া হয় আরও কিছু জিনিসকে বার বার আপনার সামনে এনে। সেগুলোর কথা আমরা কখনো ভাবিওনি। আমার অজান্তেই জিনিসগুলো বার বার আমার সামনে আসে, আমার জাতীয়তাবাদকে শানিয়ে দিয়ে যায় একটু একটু করে। আমাকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয়, তুমি আলাদা, তোমার সাথে ওদের কোনো সম্পর্ক নেই, ওরা তোমার নন-সেলফ। বলব কী সেটা? জাতীয় পশু, জাতীয় পাখি, জাতীয় ফুল, প্রতীক, জাতীয় এটা-সেটা। এরকম প্রতিটা জিনিস প্রতিনিয়ত আপনাকে নিয়ে যায় পুরো দুনিয়া থেকে দূরে, আরও দূরে। আপনাকে করে দেয় আরো আলাদা। জাতীয়তার সীমার বাইরে গিয়ে সম্বোধন করুন। আমার আরাকানের ভাই (নট আরাকানীরা), আমাদের সিরিয়ার বোন (নট সিরিয়ান), আমাদের ভারতের সন্তানরা (নট ভারতীয়)।

ঠিক এর বিপরীত শিক্ষাটা আমাদের রাসূল দিয়ে গিয়েছেন— উম্মাহ। জাতীয়তাবাদের বিপরীত শব্দ হল ‘উম্মাহ’। ভাষা-সংস্কৃতি-জন্মস্থানের মত ফিক্সড ধ্রুবক ঐক্যের প্লাটফর্ম হতে পারে না। এরকম যে জিনিসের জন্য আমি দায়ী না সেটা আমার হীনম্মন্যতার কারণও হতে পারে না। আর যেটা আমার অর্জন না, সেটার জন্য আমি গর্বও করতে পারি না। জাতীয়তা-ভাষা এগুলো আমার অর্জন না। বরং ঐক্যের প্লাটফর্ম হবে দীন, আকিদাহ। এক আল্লাহর কর্তৃত্ব ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতে সাক্ষ্য দানকারী যে ভাষারই, যে লোকেশনেরই, যে বংশেরই হোক না কেন; সে উম্মাহর অন্তর্গত। এই ঐক্যের কোন সীমানা নেই, এই বন্ধনের কোন বাধা নেই, এই সম্পর্কের কোনো ছেদ নেই। দেশ-ভাষা- সভ্যতা- শিক্ষা-সম্পদ নির্বিশেষে যে-ই কালিমা কবুল করে নেবে, সে আমার ভাই, সে-ই আমার সেলফ, আমার আপন। এই অর্জিত কৃতিত্বের বুনিয়াদে হবে ঐক্য, কোনো অনৈচ্ছিক ধ্রুবকের ভিত্তিতে না। পুরো উম্মাহ এক দেহের মত, এক কোণে আমার কোনো এক ভাই কষ্টে মানে আরেক কোণে ভিন্ন ভাষার ভিন্ন গোষ্ঠীর আরেক কালিমাওয়ালার কলিজা পুড়বে, পুড়তে হবে। নাহলে তুমিই দেহের বাইরে। যদি দেহের ভিতরেই হতে তবে হাতের ব্যথায় চোখে পানি আসতো, পুরো দেহে আসত জ্বর। যদি তা না আসে তবে হয় হাতটা দেহের বাইরে, না হলে চোখটা দেহের বাইরে। উম্মাহর কারো কষ্টে আমার কষ্ট না হওয়াটা একটা ঘোর অশনি সংকেত ঈমানের লালবাতি জ্বলার।

অনেকে আবার বলবেন, সাহাবীদের মাঝেও তো এমন ছিল: সালমান ফারসী, সুহাইব রুমী, বিলাল হাবশী রা.। আনসারী, আশআরী, গিফারী। অলরেডি ঐক্য হয়ে গেছে এমন ক্ষেত্রে এগুলো স্রেফ লোকেশান বা বংশ নির্দেশ করে। কিন্তু যাদের এখনও ঐক্য হয়নি, তাদের ঐক্য সৃষ্টিতে এটা অন্তরায়। জানিনা বুঝাতে পারলাম কি না। যেমন, বাংলাদেশ একটা একতাবদ্ধ দেশ। এখানে আপনি যদি পরিচয় দেন আমি চাঁটগাইয়া, আমি বরিশাইলা, আমি ঢাকাইয়া, আমি সিলোটি, আমি উত্তরবঙ্গের। যেমন চাঁটগাইয়া কাউকে সিলোটি কেউ সহীহ বাংলাদেশীই বলবে, অন্যকিছু বলবে না। আমি বাংলাদেশি নাকি ঢাকাইয়া, এটা কোনো কনফ্লিক্ট না। এটা ‘বাংলাদেশি’ জাতীয়তাবাদে প্রভাব ফেলে না। অলরেডি একতাবদ্ধ কনসেপ্টে নিজেকে স্পেসিফাই করাটা ক্ষতিকর হয় না। সেটা থাকে কেবলই লোকেশন। কিন্তু বিভক্ত কনসেপ্টে সেটা আর লোকেশান থাকে না, সেটা হয়ে যায় টোটাল একটা আত্মপরিচয়। যেমনটা: আরাকানী, ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশি, কাশ্মিরী, সৌদি, রাশিয়ান, আমেরিকান।

একবার একজন আনসার ও মুহাজির সাহাবার মাঝে কী যেন কী নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। তো মুহাজির সাহাবী 'হে মুহাজিরদের জামাত' এবং আনসারী সাহাবী আনসারদের নিজ সাহায্যের জন্য ডাকলেন। বেশ শোরগোল শুরু হয়ে গেল। এই ডাক নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কানে পৌঁছলো। তিনি বেরিয়ে এসে বললেন: তোমাদের এই ডাক থেকে জাহেলিয়াতের দুর্গন্ধ আসছে। আগে থেকেই একতা যেখানে আছে, সেখানে এই সম্বোধন এই পরিচয় সামনে আনা ক্ষতিকর না। নবীজী নিজেই একসময় মুহাজির আনসার নামে ডেকেছেন। কিন্তু এখন এই ডাককে অপছন্দ করলেন। মতবিরোধের সময় এই খণ্ডিত পরিচয়গুলো আসাবিয়াতের জন্ম দিতে পারে। মুসলিম উম্মাহ এখন বিভক্ত। রাজনৈতিকভাবে এবং ধর্মতাত্ত্বিকভাবেও। এখন হানাফী-মালেকী-শাফেঈ-আহলে হাদিস- সালাফি-দেওবন্দী-তাবলীগী-আযহারী প্রভৃতি ধর্মতাত্ত্বিক পরিচয়গুলোর প্রভাবও তেমনই যেমনটা ভৌগোলিক বিভক্তির। দেখুন একটা শব্দ কত দূরে নিয়ে যায় আমাদেরকে বাকি অংশ থেকে।

১. আমি দেওবন্দী।

২. আমি দেওবন্দ আন্দোলনের আদর্শ বুকে ধারণ করি।

এ দুটো লাইন কি একই? নাকি প্রথমটা দূরে সরিয়ে দেয় বাকিদের? এবার এদুটো দেখেন। এই দুটো বাক্যের অর্থ কি এক?

১. আমি হানাফী

২. আমি ইখতিলাফী মাসয়ালায় ফিকহে হানাফী অনুসরণ করি।

কিংবা এ দুটো?

১. এটা আহলে হাদিস মসজিদ।

২. এই মসজিদে সহীহ হাদিস*গুলো আমলের সুযোগ আছে।

দেখেন, একটা শব্দই কীভাবে নিয়ে যায় দূরে, আরও দূরে। আইল দিয়ে দেয়, এটুকু আমার, এটুকু আমি। ওটুকু তুমি। আপনারা অধিকাংশই হয়তো দ্বিমত করবেন। আমার যেমন লেখার স্বাধীনতা আছে, আপনারও দ্বিমত করার স্বাধীনতা রয়েছে। পূর্ববর্তী উলামাগণ নিজ নামের সাথে হানাফী সংযুক্ত করেছেন, নকশবন্দী লাগিয়েছেন, তখন তো সমস্যা হয়নি। এখন এগুলো নিয়ে এত কথা কেন? একটা লজিক দেয়া হয়, নোয়াখাইল্যা বলে কি আমি বাংলাদেশী না? বাংলাদেশ একটা ঐক্যবদ্ধ কনসেপ্ট এবং বাস্তবতা। এখানে এই পরিচয় ক্ষতিকর না। পূর্ববর্তী উলামাগণ যাঁরা লাগিয়েছেন, তাঁদের সময় মুসলিম বিশ্ব একটা ঐক্যবদ্ধ বাস্তবতা ছিল, যেটা আজ নেই। ‘বাংলাদেশের মাঝে সিলোটি’র মতই, ‘খিলাফতের মাঝে হানাফী-মালেকি’ পরিচয়গুলোর প্রভাব এতটুকুই ছিল। লোকেশানের মতই সেটা একটা ইলমী পরিচয় বহন করত। কিন্তু অনৈক্যের এই নাট্যমঞ্চে এগুলো নিছক ইলমী পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নেই। এগুলো আজ সাম্প্রদায়িকতার নাম, আসাবিয়াতের নাম। আবেগ আর ডিকশনারী রেখে বাস্তবতা দেখেন। আজ যখন আপনি নিজেকে সালাফী বলছেন, আপনি নিজেকে উম্মাহর একটা ‘অংশের’ প্রতিনিধি বলছেন, যাকে আরেকটা অংশ ‘ইহুদীদের দালাল’ নামে ট্যাগ দিচ্ছে। আবার আপনি নিজেকে যখন ‘দেওবন্দী’ হিসেবে অভিহিত করছেন, তখন একটা অংশ শুরুতেই ধরে নিচ্ছে আপনি ‘বিদআতি’। খুব দুঃখের বিষয়, মাযহাবের রাজেহ-মারজুহ বিষয়গুলোকে রাজেহ-মারজুহ অবস্থানে না রেখে ফরজ-ওয়াজিব বা ঈমান-কুফর লেভেলে নিয়ে আসা হয়েছে। সবাই নিজ রাজেহ মতকে ‘ইসলাম কী বলে’ হিসেবে সাব্যস্ত করতে চাচ্ছে। কেউ বলছে না, ‘ওটাও ইসলামের মত। আমাদের হানাফী উসুলের দলিল মোতাবেক এই মতটাই প্রাধান্য পায়’। এভাবে কেউ বলছে না। সবাই আরেকজনকে পরাজিত করতে চাচ্ছে। নিজ মাযহাবকে নিজ মাসলাককে শ্রেষ্ঠ প্রমাণে আমাদের সব ব্যস্ততা, এটাই দীন, এটাই ইলমের মাকসাদ। এমন পরিস্থিতিতে এসব ইলমী পরিচয় নিছক ইলমী নেই, আরেকটু প্রশস্ত করে দেখুন, এগুলো এখন আসাবিয়াত। স্রেফ আসাবিয়াত। জানিনা আমি যা দেখি, আপনারা তা দেখেন কি না। না দেখলে আমার চোখই খারাপ, ডাক্তার দেখাবো শিগগিরই।

এমনই মন চাইল বলে লেখলাম। যখন তাতারেরা খাওয়ারিজম মুলকে গণহত্যা চালাচ্ছিল, তখন বাগদাদে যা হচ্ছিল। আন্দালুসের বাকি শহরগুলো যখন খ্রিস্টানেরা রক্তের নদী বইয়ে দিচ্ছিল, তখন গ্রানাডায় যা চলছিল। আজ সারা দুনিয়ার আগুন ধেয়ে আসছে বাঙ্গাল মুলুকের দিকে, এখানেও আমি তাই দেখতে পাচ্ছি যা বাগদাদে-গ্রানাডায় চলছিল। তাকিয়ে দেখেন। একটা শব্দ নিছক জন্মস্থানের বা ইলমী পরিচয় নয়। একটা শব্দ অনেক বড় বিষয়। একটা শব্দই একটা অস্ত্র। একটা শব্দই একটা ইতিহাস, একটা ভবিষ্যত। একটা শব্দই একটা বিপ্লব। ফিরে যাচ্ছি ‘চাক দে ইন্ডিয়া’র সেই সীনে। একটা শব্দে একটা আত্মপরিচয় মেয়ে হকি প্লেয়ারগুলো গেঁথে নিয়েছিল— ‘ইন্ডিয়া’, আমি ইন্ডিয়ান। আমি পাঞ্জাবী নই, নাগা নই, বাঙালি নই, গুজরাটি নই। আমি ইন্ডিয়ান। এই একটা শব্দ জন্ম দিয়েছিল একটা স্পিরিটের, মহিলা হকি বিশ্বকাপ জিতিয়েছিল সেই স্পিরিট, একতার স্পিরিট। এটা শব্দের শক্তি, একসাথে কিছু করতে এটা লাগবেই। আমাদের প্রিয়নবী, আমাদের নেতা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের একেলা ছেড়ে দিয়ে যাননি, একটা শব্দ শিখিয়ে গেছেন—‘উম্মাত’। এখন একসাথে খেলার সময়। এখন আমরা হানাফী, শাফেঈ, মালেকী, দেওবন্দী, সালাফী, জামাতী নই। এখন আমি উম্মাত, উম্মাতে মুসলিমা। ব্যস, আর কিচ্ছু না। আর সব ভুলে যান। সব আসাবিয়াত এখন সরিয়ে না রাখলে সামনে কঠিন দিন। আর কিচ্ছুই না, স্রেফ উম্মাত। ডা. নায়েককে অনেক দুষেছি একসময়। ‘আমি হানাফী না, শাফেঈ না, মালেকী না, হানবালি না, আহলে হাদিস না। আমি মুসলিম’। এইকথার জন্য; মনে হত তিনি এই মাযহাবের হাকীকতই বুঝেন না। এগুলো তো জাস্ট বাংলাদেশের মাঝে বরিশাল-কুষ্টিয়ার মত ছোট বিষয়। আজ বুঝি, উনি আরও বেশি বুঝেই বলেছিলেন, গভীর অন্তর্দৃষ্টি থেকেই বলেছিলেন। হাফিযাহুল্লাহ।

হানাফী, শাফেঈ, আহলে হাদিস, দেওবন্দী, রেজভী— না। আমাকে কেউ দশজন ‘উম্মাহর আলিম’ দিতে পারেন? জাহাঙ্গীর স্যার বা শায়খ আহমাদ মূসা জিবরীলের মত, আসাবিয়াতমুক্ত ‘উম্মাহর আলিম’?