জাহিল সময়ে যখন মুভি দেখতাম তখন রোমান্টিক ধাঁচের কিছু মুভি থাকতো যেখানে ট্র্যাজিক এন্ডিং হতো। নায়ক, নায়িকা দুইজনই মারা যায়। এধরণের মুভিগুলোতে প্রায়ই শেষে একটা দৃশ্য দেখা যেত... শুভ্র সাদা কাপড়ে নায়ক নায়িকা হেঁটে যাচ্ছে, সবুজ মাঠ কিংবা সুন্দর ফুলের বাগান, তাদের মাঝে ছোট একটা বাচ্চা দৌড়ে যাচ্ছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে ইমুশনাল মিউজিক বাজছে...

পরিচালক এখানে দর্শককে যে মেসেজটা দেওয়ার চেষ্টা করেন সেটা অনেকটা এমন যে, এই পৃথিবীতে তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি, তারা এখন পরপারে জান্নাতে মিলিত হয়েছে... সেখানে তাদের সুখের পৃথিবী। যদি ভালোভাবে খোঁজ নেন তাহলে দেখবেন যারা এই ছবিগুলো বানায় তাদের বেশিরভাগই ধর্মকর্ম, আখিরাতের ধার ধারে না। কিন্তু মানুষের সেন্টিমেন্ট ধরে রাখার জন্য হোক কিংবা ফিতরাতগত বৈশিষ্ট্যের কারণে হোক দিনশেষে এই জাহিল মানুষগুলোও বোঝাতে চায় এই দুনিয়ায় আসলে সবকিছু পূর্ণতা পায়না, এখানে কোনকিছু পার্ফেক্ট নয়, স্থায়ী নয়, জীবনের এই অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতা সবকিছুর জন্য এই জীবনের পরেও কিছু একটা আছে।

আমরা যখন শুনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আমাদের মুসলিম ভাই বোনেরা খুব কষ্টে আছে, অত্যাচারিত হচ্ছে, গণহত্যা চলছে, মায়ের সামনে ছোট ছোট বাচ্চাকে আগুনে পোড়ানো হচ্ছে, বোনেদের ধর্ষণ করা করা হচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের খারাপ লাগে। যখন শুনি কোন শহর জালিমরা দখল করে নিয়েছে, কিংবা আল্লাহর বান্দারা সেখানে বিপদে আছে অবশ্যই আমাদের হৃদয়েও রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু সে সাথে মুসলিম হিসেবে আমাদের এটাও স্মরণে রাখা উচিত সফলতা মানে কী, বিজয় মানে কী?

আরশিল আযীম, মালিকী ইয়াউমিদ্দীন, আর রাহমানের কাছে বিজয় মানে সবসময় সবকিছু দখল করে ফেলা, শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ের পর বিজয় অর্জন করা নয়। সফলতার, বিজয়ের অনেক ক্ষেত্র আছে, অনেক সময় দুনিয়াবি সবকিছু হারিয়েও নিঃস্ব অবস্থায় আল্লাহ আযযা ওয়া যালের কাছে উপস্থিত হলেও সেটা বিজয় হতে পারে।

সাহাবী হারাম বিন মিলহাম (রাঃ) কে যখন ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল, তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছিলেন আর বলছিলেন, কা'বার রবের শপথ! আমি সফল হয়ে গেছি।

কুরআনে আসহাবুল উখদুদের কথা আছে। অত্যাচারী জালিম রাজা বিশাল পরিখা খনন করে ঘোষণা দিলেন হয় দ্বীন ত্যাগ করো নয়তো আগুনে ঝাপ দিয়ে মরো। মুমিনরা সেদিন আগুনে ঝাপ দেওয়াটাই বেছে নিয়েছিল/ সেদিন ঈমানদাররা তাদের ঈমানের দাবিতে অটল ছিল, আগুনের লেলিহান শিখার ভয়াবহ এক ফিতনা সামনে থাকার পরও। বাচ্চা কোলে এক মা ঝাপ দিতে ইতস্তত করছিল, তাঁর কোলের বাচ্চা সেদিন কথা বলে উঠেছিল, ঝাপ দাও মা! ঝাপ দাও! তুমি নিশ্চিন্ত থাকো! আল্লাহ সুবহানু ওয়া তায়ালা এই ঘটনার স্বীকৃতি দিয়েছেন কুরআনের সূরা বুরুজে। তিনি বলেছেন,

ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْكَبِيرُ

"...এটাই মহাসাফল্য" [৮৫ঃ১১]

মুমিনরা সব আগুনে পুড়ে কয়লা হয়েছে, তারপরও আল্লাহ বলেছেন এটাই মহাসাফল্য! কারণ তারা ঈমানের দাবীতে অটল ছিল।

সুতরাং আল্টিম্যাট সফলতা সেটা নয় যা তুমি দুনিয়াতে অর্জন করলে। নিরাপদে, নিশ্চিন্তে একটা নির্ঝঞ্জাট জীবন কাটিয়ে দেওয়াটাই সবসময় সফলতা নয়। সফলতা হল আল্লাহর সিদ্ধান্তের উপর দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে জমে থাকা। সফলতা হল ঈমানের দাবিতে সত্যবাদি থেকে আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হওয়া।

সুতরাং বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন শিশুগুলো সফল হয়ে গেছে। সফল হয়ে গেছে শাহাদা উচ্চারণ করতে করতে জীবন্ত পুঁতে ফেলা ঐ ভাই, সফল হয়ে গেছে ধসে পড়া দেয়ালের নিচে চাপা পড়া ঐ আপাদমস্তক হিজাবী বোন, যে চায়নি মৃত্যুর পরও তাকে কেউ বেপর্দা অবস্থায় দেখুক। সফল হয়ে গেছে আল্লাহর সেই বান্দারা যারা মুয়াজ বিন জাবালের (রাঃ) মত আল্লাহর কদরের উপর ধৈর্য ধরেছে। সফল হয়ে গেছে তারা যাঁদের তাজা রক্তে ভিজেছে এই বিবর্ণ জমিন। মুমিনদের হারানোর কিছু নেই। ভালো সময়, খারাপ সময় সবকিছুতেই আল্লাহর পক্ষ থেকে রয়েছে বরকত, রহমত। সুবহানআল্লাহ!

“মু’মিনের অবস্থা কতই না চমৎকার! তার সব অবস্থাতেই কল্যাণ থাকে। যদি তার সাথে ভালো কিছু ঘটে, সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে, যা তার জন্য কল্যাণকর। আবার যদি তার সাথে খারাপ কিছু ঘটে, সে ধৈর্যধারণ করে, যা তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। আর এটি বিশ্বাসী (ঈমানদার) ছাড়া কারো সাথেই ঘটে না।" [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৯৯]

তাই আমরা যখন দেখি আমাদের মুসলিম ভাই বোনেদের আল্লাহ পরীক্ষা নিচ্ছেন, ঈমানের পরীক্ষা, সত্যবাদিতার পরীক্ষা, যখন তাদের উপর জুলুম দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে, চোখের সামনে প্রিয়জনের ছিন্ন-ভিন্ন দেহ দিয়ে পরীক্ষা হচ্ছে, সম্মান ছিনিয়ে নিয়ে পরীক্ষা হচ্ছে—The first thing we should do is to go back to our deen! To prepare for the trials and tribulations that our fellow brothers and sisters are going through!

আর হ্যাঁ, সফলতা দুনিয়ার সবকিছু থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে আল্লাহর দ্বীনকে বেছে দেওয়া কিংবা এই দ্বীনকে কম্প্রমাইজ করার নাম নয়। সফলতা হল আল্লাহর দ্বীনের উপর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকা, যদিও সেজন্য দুনিয়ার সবকিছু হারাতে হয়। আমরা ইয়াকিনের সাথে বিশ্বাস করি উম্মতে মুহাম্মদীকে আল্লাহ অবশ্যই বিজয় দান করবেন তবে সেটা কোনরকম কুরবানি ব্যতিরেকেই হবে, আল্লাহর দ্বীন নিঃসন্দেহে এতটা সস্তা নয়। অবশ্যই আল্লাহ প্রতিটি বিশ্বাসী মুসলিমকে সেইসব পরিস্থিতির মধ্যে ফেলবেন যখন আমাদেরকেও অপশন দেওয়া হবে হয় ঈমান, না হয় দুনিয়া। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিবেন ঈমানের দাবীতে সত্যবাদি কারা।

أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ ﴿٢﴾ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۖ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّـهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ

“মানুষ কি মনে করে নিয়েছে যে, আমরা ঈমান এনেছি এ কথাটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তীদের সকলকেই পরীক্ষা করে নিয়েছি। আল্লাহ তা’য়ালা অবশ্যই দেখবেন কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যুক।” [২৯ঃ২-৩]

অবশ্যই ফিতনা আসবে, পরীক্ষা সন্নিকটেই। সেদিনের জন্য প্রস্তুতি আর হক্বের উপর টিকে থাকার কাকুতি মিনতিই আমাদের মূল করণীয়। কেননা নিশ্চয় ইয়াওমাল কিয়ামাহর দিনটি সত্য, আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হওয়ার দিনটি সত্য। আল্লাহর কসম, এই দিনটি সত্য।