কলেজের সেই দুরন্ত সময়ে বিপ্লবের এক শিহরণ নিয়ে 'থ্রি ইডিয়টস" মুভিটা দেখেছিলাম। তুখোড় মেধাবি এক ছেলে রানচোড় দাস একের পর এক সমাজ, শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের চিন্তাচেতনার ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু একসময় আমি আবিষ্কার করলাম, এর সবকিছুই বাস্তবতা বিবর্জিত একটি গল্পের স্ক্রিপ্ট মাত্র। ছবির স্ক্রিপ্ট যিনি লিখেছেন তিনি এমন একজনকে দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের গল্প সাজিয়েছেন যে অনাথ, তার বাবা-মা নেই, পরিবার নেই, পিছুটান নেই, দায়িত্ব নেই, পরিবারের হাল ধরার টেনশন নেই। লেখক কেন সমাজ পরিবর্তনের জন্য রাজু দাস্তগির কিংবা ফারহান কোরেশিকে বেছে নেননি? কারণ এদেরকে বেছে নিলে ছবির স্ক্রিপ্টটা হতো না, তাহলে আমাদেরকে ফেস করতে হতো বাস্তবতা। কারণ এদের পরিবার আছে, ঘরে অসুস্থ বাবা আছে, অবিবাহিত বোন আছে, দায়িত্ব আছে, পিছুটান আছে।

কলেজের সেই সময়টাতে, যখন মনে হতো হাওয়ায় ভাসছি, আর দশজনের মত আমারও মনে হতো, রানচোড় দাসের মত জীবনই আমাদের বেছে নিতে হবে। কিন্তু যতই সময় গেছে আমি উপলব্ধি করেছি রানচোড় দাস বাস্তবে এক্সিস্ট করে না। সারারাত হাসপাতালে ঘুমিয়ে হঠাৎ মনে পড়ল আজ সকালে ফাইনাল এক্সাম, দৌড়ে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এসে প্রথম হওয়া বাস্তবে যায় না। আমি আরও বুঝেছি দায়িত্ব কর্তব্য, পিছুটানহীন রানচোড় দাসদের দিয়ে সমাজ পরিবর্তন হয় না। ছবিতে হয়, বাস্তবে না।

খালি পায়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কল্পনার হিমু বাস্তবে এক্সিস্ট করে না। এখানে সবকিছু এত দুইয়ে দুইয়ে মিলে যায় না। শুধু বড় বড় কোটিপতি, পুলিশ, ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা কালতালীয়ভাবে হিমুদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয় না, হিমুদের জন্য অসম্ভব রুপবতী রুপারা কখনোই অপেক্ষা করে থাকে না। বরং প্রতিটা মানুষের একটি কপ্পনার জগৎ থাকে। বাস্তব জীবনের অপ্রাপ্তি, ইচ্ছে, শখ, বাসনা, কামনা এসবকিছু সে কল্পনার সেই অবাস্তব জগতে পূরণ করতে চায়, সেখানে সে তার ইচ্ছেমত চরিত্র তৈরি করে, যারা ভালো লেখে, তারা সেই জগতটাকে বইয়ের পাতায় নিয়ে আসতে পারে, আর মানুষ বোকার মত সেই কল্পনার জগতে ঢুকে পড়ে, যেটা অন্যের কামনা বাসনায় ভরপুর। নিজের বাস্তব জগত ফেলে তখন সে অন্যের তৈরি করা সেই মোহের জগতকেই আসল ভেবে বসে।

অশ্লীল, ইরোটিক কোনো মুভি নিয়ে সমালোচনা হলে নির্মাতারা একটা কমন ডায়লগ দেয়—"ঐ দৃশ্য তো স্ক্রিপ্ট ডিমান্ড ছিল।" শিল্প, আর্ট কপচানো আম জনতা ভাবে আরে তাইতো, স্ক্রিপ্ট তো এরকম একটা দৃশ্য ডিমান্ড করছিল! কিন্তু সেই স্ক্রিপ্ট লিখল কে, কেউ না কেউ তো লিখেছে। ডিমান্ডটা এখানে স্ক্রিপ্টের না, যে লিখেছে তার। সে তার কুৎসিত, কামনা আর লালসায় ভরা যে কল্পনার জগৎ তৈরি করেছে সেটাকেই "আর্ট" হিসেবে গ্রহণযোগ্য করেছে, নাম দিয়েছে "স্ক্রিপ্ট ডিমান্ড।" আজ আর্ট- শিল্প-সাহিত্য-জীবনমুখী ছবি-বাস্তবঘনিষ্ঠ দৃশ্য বলে যা চলছে, তার সবই কামনা আর বিকারগ্রস্থ কিছু মানুষের তৈরি করা একটি জগতমাত্র। এরকম কামনার দাস যারা আর্ট কপচাত, সম্প্রতি #মিটু আন্দোলনের বদৌলতে তাদের অনেকের আর্ট বের হয়ে এসেছে, বাস্তব জগতের নষ্টামি আর অনিয়ন্ত্রিত জীবনটাকেই যে তারা ছবির মাধ্যমে সমাজে হজমযোগ্য করানোর চেষ্টা করেন, #meToo তারই প্রমাণ।

এভাবে বিনোদন, ছবি, গান, গল্প, উপন্যাস আমাদেরকে বাস্তবতা থেকে বের করে নিয়ে একটা মোহের জগতে প্রবেশ করিয়ে দেয়। সেখানে আমাদের এই বাস্তব জগতে যে অপ্রাপ্তিগুলো, কামনা বাসনার তাড়না যা আমরা চরিতার্থ করতে পারছি না—তা সহজেই পাওয়া যায়। আর একসময় তা আমাদের এই বাস্তব জগতের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য আর করণীয় সম্পর্কে গাফেল করে দেয়।

সকল নবী-রাসূলগণকেই তাই আল্লাহ্‌ ওয়াহী দানের আগে এমন পরিস্থতিতে আর এমন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেছেন, যেখানে বাস্তবতার সবগুলো পাঠ তাঁরা পেয়েছেন। আল্লাহ্‌ চাইলে নবী রাসূলগণকে অফুরন্ত অলৌকিক ক্ষমতা আর শক্তি দিয়ে সকল বিরুদ্ধ শক্তিকে ধূলোয় মিশিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তা হলে, তাঁদের অনুসারিরা মনে করত আল্লাহর রিসালত সেটা সাধারণ মানুষের জন্য না, এটা অবাস্তব, এটা শুধু যাদের বিশেষ ক্ষমতা আছে তাঁদের জন্য। কিন্তু আমাদের সকল নবী রাসূলই আর দশজনের মত বাস্তবতার এই জগতেই ছিলেন। তাঁরা রাখাল হয়েছেন, ব্যবসা করেছেন, খাওয়া দাওয়া করছেন, তাঁদের সন্তান ছিল, তাঁদেরও দুঃখ-কষ্ট ছিল, তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।

তাই যারা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে, যারা স্বপ্ন দেখে ন্যায়-সত্য-ইনসাফের এক সমাজব্যবস্থার, তাহলে তাদের প্রথমে কল্পনার ঐ জগৎ থেকে বের হতে হবে আর বাস্তবতার এই জগতে আত্মশুদ্ধি, চারিত্রিক উৎকর্ষতার স্তরে উন্নীত হতে হবে। ঠিক যেভাবে আমাদের প্রিয় নবীজি (সাঃ) এবং তাঁর সঙ্গী সাথিরা করেছেন। আর এভাবেই সমাজ পরিবর্তন হয়, অন্যায়, অবিচার সমাজ থেকে দূর হয়। আমাদের সঠিক লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, এই দুনিয়াতে আমাদের করণীয়—তখনই সামনে স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। মোহের জগতে সাময়িক ফ্যান্টাসি হয়ত আছে, কিন্তু সেই জগতে যত বেশি উপরে উঠবেন ততই বিপদ, কারণ মাটির পৃথিবীতে নামার সময় তখন বেশি উপর থেকে আছড়ে পড়তে হয়, ব্যথাটা এতে বেশি, মৃত্যুও হতে পারে।