[১]

একবিংশ শতাব্দীর এমন একটা সময় আমরা অতিক্রম করছি যখন কমবেশি সকল পরিবারেই কেমন যেন একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। অথচ একটা সময় দীর্ঘদিন পর্যন্ত যৌথ পরিবারে থেকেও এসব অস্থিরতা এখনকার নিউক্লিয়ার পরিবারের তুলনায় কমই ছিল (কিছু ব্যতিক্রম ছিল না তা নয়)। আমরা যদি বর্তমান সময়ে আমাদের পরিবারগুলোতে হারিয়ে যাওয়া Harmony ফিরিয়ে আনতে চাই তবে পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে নিজের জায়গা থেকে নিজের দায়িত্ব নিয়ে অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে পরিবারের ‘ছেলে’টিকেও।

বর্তমানে পরিবারের বিবাহিত ছেলেরা যে বিষয়গুলি নিয়ে মানসিক কষ্টে আছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কমন আর অস্বস্তিদায়ক হল মা ও স্ত্রীর মাঝে টানাপোড়েন। অনেক অবিবাহিত ছেলেরাও বিষয়টা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে। বিষয়টা খুব ক্রিটিকাল, তদপেক্ষা ক্রিটিকাল হল এই অবস্থায় পরিবারের ‘ছেলেটা’র ভূমিকা কেমন হবে তা। প্রথম পর্বেই এমন ক্রিটিকাল কিছু লিখব কিনা তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। শেষমেষ ভাবলাম লিখেই ফেলি।

বিয়ের পর ছেলেদের সাধারণত দুই রকম এপ্রোচ দেখা যায়—কেউ তার স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠে সংসার পাতেন, কেউবা আবার স্ত্রীকেই বাবা-মার বাসায় নিয়ে আসেন। দ্বিতীয় অবস্থায় ছেলের ভূমিকাটা একটু বেশি Crucial হলেও প্রথম অবস্থাও একেবারে কম নাজুক নয়। চাই স্ত্রী আলাদা বাসায়ই উঠুক আর শ্বশুর-শাশুড়ীর সাথেই উঠুক একজন ছেলেকে তখন অবতীর্ণ হতে হয় দ্বৈত ভূমিকায়।

বাস্তবতা হল বিয়ের পরেও আমাদের সমাজের অধিকাংশ মায়েরা শুধু ছেলে হিসেবেই সন্তানের কাছে প্রত্যাশা রাখে আর অধিকাংশ স্ত্রীরাই শুধু স্বামী হিসেবে নিজের মত করে তাকে পেতে চায়। আমাদের উপমহাদেশের পারিবারিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংস্কৃতির দিকে তাকালে বোঝা যায় যে এই টানাপোড়েন খুবই বাস্তব ও স্বাভাবিক এবং তা উপেক্ষা করার কোন উপায় নেই। তাই এমন পরিস্থিতিতে ছেলেটির জন্য প্রথম করণীয় হল—‘দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা।’ জ্বী, আবারও বলছি—‘দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা।’ এই টানাপোড়েনের সমাধান করার জন্য প্রথমেই আপনাকে উভয় পক্ষের (মা ও স্ত্রী) দিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকাতে হবে।

মনে রাখবেন—একজন ভাল লেখক যেমন ভাল রাজনীতিক নাও হতে পারেন, একজন ভাল কবি যেমন ভাল অভিনেতা নাও হতে পারেন তেমনি একজন ভাল ‘মা’ একজন ভাল ‘শ্বাশুড়ি’ নাও হতে পারেন। ‘মা’ এবং ‘শ্বাশুড়ি’ দুটো ভিন্ন Role এবং এই রোল দুটি Successfully Play করার জন্য প্রয়োজন সম্পূর্ণ আলাদা কৌশল। হতে পারে আপনার মা একজন আদর্শ ‘মা’ হওয়ার যাবতীয় কৌশল খুব দক্ষতার সাথে রপ্ত করতে পেরেছেন কিন্তু তার মানে এই নয় যে By default তিনি এর মাধ্যমে একজন আদর্শ ‘শ্বাশুড়ি’ও হয়ে গেছেন। তাই মায়ের ব্যাপারে স্ত্রীর কাছে অভিযোগ শুনলে প্রথমেই চোখ কপালে তুলে ভাববেন না যে, “আমার মমতাময়ী-স্নেহময়ী মা এমনটা করতেই পারেন না, Totally impossible.” এই সত্য যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবেন সাংসারিক জীবনে তত ভাল Game Player হতে পারবেন।

একইভাবে, একজন আদর্শ ‘স্ত্রী’ একজন আদর্শ ‘বউমা’ নাও হতে পারেন। কিন্তু তাই বলে স্ত্রী হিসেবে তার গুণ ও যোগ্যতাকে অস্বীকার করলে সেটা হবে অন্যায়। তাই আপনার মায়ের কাছে স্ত্রীর ব্যাপারে অভিযোগ শুনলেই মাথায় হাত দিয়ে এই ভেবে বসে পড়বেন না যে—“এমন বউকি আমি চেয়েছিলাম?”

আপনার মা ও স্ত্রীর মাঝে কোন বিষয়ে টানাপোড়েন সৃষ্টি হলে কখনও এইটা বের করতে যাবেন না যে, “কে ঠিক?” আসলে এই বিষয়টাই ‘ঠিক-বেঠিক’ এর নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় দুজনেই নিজের নিজের Point of view থেকে চিন্তা করে থাকেন। আর যদি তাদের কারও অন্যের জুতায় হাঁটার অভ্যাস না থাকে তবে দ্রুত সমস্যার সূত্রপাত হয়। তাই মা ও স্ত্রীর টানাপোড়েনে আপনি Coach এর ভূমিকা পালন করুন, Referee-র ভূমিকা নয়। স্ত্রীর মুখে অভিযোগ শুনলেই মায়ের সাথে কুরুক্ষেত্রে বাধিয়ে দিবেন না আবার অভিযোগ অস্বীকারও করবেন না। তেমনি মায়ের মুখে অভিযোগ শুনেই স্ত্রীর উপর চড়াও হবেন না আবার অভিযোগ অস্বীকারও করবেন না। উভয়পক্ষের অভিযোগ তৎক্ষণাৎ অস্বীকার করলে আপনার কপালে ‘Blind Son’ কিংবা ‘Blind Husband’ এর তকমা লেগে যাওয়াটা মোটামুটি নিশ্চিত। উভয় পক্ষের সাথে পৃথক পৃথকভাবে বসুন, উভয়ের কথাই এমনভাবে শুনুন যেন সে Convinced হয় যে আপনি তার সাথেই আছেন এবং সমস্যা সমাধানে আপনি আন্তরিক। এটুকু অন্তত করতে পারলেও ধরে নিন আপনার সমস্যা অর্ধেক মিটে গেছে। কিন্তু অধিকাংশ ছেলেরাই এই জায়গায় ভুলটা করে। হয় কোন একজনের কথা শুনে আগামাথা না ভেবেই আরেকজনের উপর চড়াও হয় আর নয়ত এমন ভাব ধরে থাকে যে “কই কিছুইতো হয়নি।” এই উভয় এপ্রোচই আত্মঘাতী।

যে মা তার সারাটাজীবন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তিলে তিলে তার সন্তানকে মানুষ করেছেন এবং যে সন্তানের উপর এতদিন তার একচ্ছত্র অধিকারবোধ ছিল সেই সন্তানের উপর রাতারাতি একজন New comer এর অধিকারবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়াটা মেনে নেওয়া যেকোন মায়ের জন্যই কষ্টের। আদর্শ মা তিনিই যিনি এই কষ্টটুকু মেনে নেন এবং ছেলের বউকে তার প্রাপ্য Space টুকু হাসিমুখে দিয়ে দেন। কিন্তু অনেক মা-ই এমনটা পারেন না। আজন্ম লালিত অধিকারবোধ আর Ego যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তখন সেই মা নিজ হাতেই সন্তানের অশান্তির বীজ বপন করেন। তাই প্রতিটি মায়ের উচিত বিবাহিত সন্তানের উপর নিজের অধিকারবোধের সীমাটুকু চিনে নেওয়া এবং সন্তানের সুখের স্বার্থেই সেই সীমার মধ্যে বিচরণ করা। এতে সন্তান যেমন মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকবে তেমনি সংসারও রক্ষা পাবে একটা Never Ending টানাপোড়েন থেকে।

খুব খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা ভাইয়েরা প্রায়ই ভুল করেন সেটা হল স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্যের ঘটনা বাবা-মার সাথে শেয়ার করা। এর চেয়েও এক কাঠি বড় অপরাধ হল স্ত্রীর সাথে বিরোধে বাবা-মাকে বিচারকের আসনে বসানো। এই আত্মঘাতী কাজটির কিছু নেতিবাচক Outcome আছে। যেমন—

# স্ত্রীর সাথে আপনার বিরোধ একসময় ঠিকই মিটে যাবে কিন্তু আপনি যাদের কলিজার টুকরা সেই বাবা-মায়ের মনে আজীবন এই ছাপ থেকে যাবে। আপনাকে নিজের সন্তান হিসেবে Benefit of doubt দিলেও আপনার স্ত্রীর ব্যাপারে এমনটা করার সম্ভাবনা খুবই কম। এটা তাদের দোষ নয়, মানবীয় সীমাবদ্ধতা। সকল বাবা-মায়ের কাছেই নিজের সন্তান তুলনামূলক কম দোষী কিংবা অনেকের কাছে নির্দোষও। তাই, পক্ষান্তরে আপনি বাবা-মার কাছে অভিযোগ করে আপনার স্ত্রীর পিঠেই ছুরি বসালেন।

# আপনার বাবা-মা ধরে নেবে আপনি সাংসারিক জীবনে অশান্তিতে ভুগছেন অথচ হয়ত পরদিনই আপনাদের বিরোধ মিটে গেছে। যদি আপনি বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করে থাকেন তবে খুব সম্ভাবনা আছে এমন কথা শোনার—“আগেই বলেছিলাম বাপু এখানে বিয়েটা কোরো না, মুরুব্বিদের কথাতো ভালো লাগে না। এখন বোঝো ঠ্যালা।” আপনিই বলুন, আপনার প্রিয়তমা স্ত্রীর নামে এমন কথা শুনতে কি আপনার ভাল লাগবে?

আরেকটা ভুল হল স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্যের ঘটনায় শ্বশুর-শাশুড়ীর কাছে অভিযোগ দেওয়া। এই কাজটা যারা করে তারা নিরেট কাপুরুষ ছাড়া আর কিছু নয়। এর প্রভাব উপরোক্ত তৃতীয় পয়েন্টের চেয়েও মারাত্মক। কারণ, আপনার স্ত্রী আপনার সংসারে আপনার অধীনস্থ এবং আপনি তার উপর কর্তৃত্বশীল। তাই আপনার দ্বারা তারা তাদের আদরের দুলালী উপর কোন যুলুমের আশঙ্কা করলে সেটা মোটেও অমূলক নয়। বিশেষত বর্তমান সমাজ বাস্তবতার দিকে তাকালেই একথার সত্যতা টের পাওয়া যায়। অপরপক্ষে, আপনি আপনার বাবা-মার আদরের দুলাল হলেও তারা এই ভয় পান না যে, আপনি স্ত্রীর হাতে নির্যাতিত হবেন কিন্তু এই ভয়টা আপনার স্ত্রীর বাবা-মা পেতেই পারেন।

মায়ের সাথে স্ত্রীর ব্যাপারে সাফাই গেয়ে ঝগড়া করবেন না। অর্থাৎ এই ধরণের কথা বলবেন না যে, “তুমি আমার স্ত্রীর সাথে এমন এমন করেছো কেন?” কিংবা “আমার স্ত্রীকে অমুক অমুক কাজ দিয়েছ কেন?” অথবা এই ধরণের কোন উচ্চবাচ্য মায়ের সাথে করবেন না বরং বিষয়টা Indirectly solve করার চেষ্টা করুন। অনেক সময় দেখা যায়, অনেক ভাই আগ বেড়ে অতি উৎসাহী হয়ে স্ত্রীর পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে মায়ের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়। এতে হয়ত বেচারী স্ত্রীর কোন হাতই ছিল না। এতে কী হয়? আপনি যেহেতু আপনার মায়ের আদরের দুলাল তাই আপনার উপরে বেশিদিন তিনি অভিমান রাখতে পারেন না। বরং সবটুকু রাগ আর অভিমান আপনার স্ত্রীর উপরে গিয়ে পড়ে এবং তা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতেও অনেক সময় বিলম্ব হয় না। মাঝখান থেকে আপনি দুধে ধোয়া তুলসীপাতাই থেকে গেলেন কিন্তু আপনার স্ত্রীকে কালপ্রিট বানিয়ে দিলেন মায়ের কাছে। আপনার স্ত্রীকে আপনার মায়ের খেদমত করতে দেখলে তাকে এপ্রিশিয়েট করুন, আরও খেদমত করতে উৎসাহ দিন। সম্ভব হলে মায়ের সামনেই তাকে উৎসাহ দিন। চাইলে আগে থেকে নিজেরা ঠিক করেও রাখতে পারেন যে, আপনি তাকে মায়ের সামনে উৎসাহ দিবেন। অর্থাৎ অনেকটা নাটক করলেন আর কি। কিন্তু এই নাটক করে যদি আপনার মা আপনাদের দুজনের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যায় তাতে মন্দ কী? সকল শ্বাশুড়িরাই চায় এই বয়সে বউমার একটু খেদমত পেতে আর এই চাওয়াটা অন্যায় কিছু নয়। তাই স্বামী-স্ত্রী মিলে আপোসে মায়ের এই চাওয়া সাধ্যমত পূরণ করার চেষ্টা করুন। তবে এক্ষেত্রে মা-দেরকেও সেই আপন সীমানার মধ্যেই প্রত্যাশার পারদ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। লাগামহীন প্রত্যাশা তার ছেলে ও বউমার জন্যই অশান্তির কারণ হবে।

কখনই মায়ের সামনে বউকে এবং বউ এর সামনে মাকে নসীহত করবেন না। এতে তাদের আত্মসম্মানে লাগবে। উভয়ের সাথে আলাদা আলাদাভাবে বসে বুঝানোর ও সংশোধনের চেষ্টা করবেন।

যৌথ পরিবারে থাকলে খুব সম্ভাবনা আছে ঘন ঘন আপনার স্ত্রীর কাছে থেকে মায়ের ব্যাপারে অভিযোগ শোনার এবং মায়ের কাছ থেকে স্ত্রীর ব্যাপারে অভিযোগ শোনার। উপরে বলেছি যে এসব ক্ষেত্রে Instant React না করে ঘটনা অনুসন্ধান করে প্রয়োজনে উভয়পক্ষের সাথে আলাদাভাবে বসবেন। কিন্তু এটাও মাথায় রাখবেন যে, সব অভিযোগই অনুসন্ধানযোগ্য হয় না। যেহেতু আপনার মা এবং স্ত্রী দুজনই নারী আর নারীরা স্বাভাবিকভাবেই অধিক আবেগ ও অভিযোগপ্রবণ হয়ে থাকে তাই আগে ভাল করে বুঝে নিন যে ঘটনা আসলেই তদন্তযোগ্য নাকি সাময়িক রাগের বিস্ফোরণ মাত্র। দ্বিতীয়টা হলে মা/স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিন, অভিযোগ এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিন। অযথা মাথা ভারী করবেন না।

আপনার বাবা-মার কাছে Better Half এর ভাল গুণগুলি বেশি বেশি বর্ণনা করুন, দোষ/Shortcomings গুলি গোপন করুন। আপনার বাবা-মাকে বুঝতে দিন যে, আপনারা একে অপরকে নিয়ে ততটাই সুখী আছেন যতটা সুখী তারা আপনাদেরকে দেখতে চান। তবে এখানে ভাইদেরকে মাথায় রাখতে হবে—আপনারা আপনাদের বাবার সামনে স্ত্রীর লাগামছাড়া প্রশংসা করতে পারেন তবে মায়ের সামনে একটু বুঝেশুনে করবেন। অনেক সময় দেখা যায়, স্ত্রীর অতিরিক্ত প্রশংসা শুনলে অনেক মা (সকল মা নয় কখনই) দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেবে বসেন, “আমার ছেলেটা মা-পাগল থেকে একেবারে বউপাগল হয়ে গিয়েছে!” আর নারীদের প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবেই... (জানেনইতো)। তাই মায়ের সামনে যখন স্ত্রীর প্রশংসা করবেন তখন সাথে সাথে মায়েরও প্রশংসা করুন।

আপনি যদি আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার মায়ের Bonding গড়তে চান তবে আপনার শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে আপনি নিজে ভাল Bonding তৈরী করুন। মেয়েরা যা পায় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ফেরত দেয়। তাই, আপনার সাথে আপনার শ্বশুর-শাশুড়ির সম্পর্ক যত ভাল হবে আপনার বাবা-মার সাথে আপনার স্ত্রীর সম্পর্ক তার সমান কিংবা তার চেয়েও ভাল হবে। তাই নিয়মিত শ্বশুর-শাশুড়ির খোঁজ নিন, কাছে থাকলে স্ত্রীকে নিয়ে দেখতে যান। দূরে থাকলে ফোনে খবর নিন, উপহার পাঠান। অসুস্থ হলে প্রয়োজনে নিজের কাছে এনে রাখুন, সাধ্যমত দেখভাল করুন। এর সবই বহু বহুগুণ বর্ধিত হয়ে আপনার কাছে ফিরে আসবে ইনশা আল্লাহ।

আমরা ছেলেরা যদি অন্তত এই কাজগুলি ঠিকমত করতে পারি তবে ছেলে ও স্বামীর দ্বৈত ভূমিকা পালন করা আমাদের জন্য অনেকটা সহজ হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।

[২]

আমাদের বঙ্গদেশীয় মুসলিম সমাজে সংসারের পুরুষদের প্রায়ই দেখা যায় ধর্মের দোহাই দিয়ে স্ত্রীকে খাটো করে তারা এক ধরণের পৈশাচিক আনন্দ পান। যদি স্ত্রীর কাছে আত্মসম্মানবোধ নিয়ে থাকতে চান তবে কোরআন হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে স্ত্রীকে খোঁটা দিবেন না প্লিজ। যে সব কাপুরুষ স্ত্রীর সাথে আলোচনা সাপেক্ষে নিজেদের সমস্যা মিটিয়ে নিতে পারে না তারাই ঢাল হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে। আমি সবসময়ই বলি এই বঙ্গদেশে ফেমিনিজমের উত্থানের পেছনে অন্যতম কারণ আমরা পুরুষরাই। আমাদের কথা, কাজ ও আচরণের জন্যই তারা অনেকাংশে ইসলামকে নারীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে নিয়েছে। তাদের উপর নানাবিধ জুলুম তো আছেই এমনকি কথায় কথায় ইসলামের নামে খোঁটা দেওয়া অনেক পুরুষের স্বভাব। “নারীদেরকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে”, “জাহান্নামের অধিকাংশ নারী”, “নারীরা স্বামীর প্রতি অধিক অকৃতজ্ঞতা পোষণ করে”—এই ধরনের কথাগুলো স্ত্রীকে বলে কখনো খোঁটা দিবেন না, রাগের মাথায় আরো কঠিন ভাবে এগুলো বর্জন করুন। এগুলোর মাধ্যমে নারীদের সৃষ্টিগত প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে মাত্র যেন আমরা পুরুষেরা তাদের সাথে কিভাবে সুন্দরভাবে Deal করতে হয় তা বুঝতে পারি, ভালবেসে মিলেমিশে থাকার স্ট্র্যাটিজি ঠিক করতে পারি। তাদেরকে খোঁটা দেওয়ার জন্য কিংবা তাদের ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করার জন্য এগুলো শেখানো হয়নি।

এই সংক্রান্ত হাদিস গুলি যিনি আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন সেই রাসূলুল্লাহ (সা) কে দেখুন। তাঁর সমগ্র জীবনে একটিও নজির নেই স্ত্রীকে এসব বলে খোঁটা দেওয়ার। মৃত্যুর সময় তিনি ৯ জন স্ত্রী রেখে গেছেন। কোন একজনও তাঁর ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অভিযোগ করেননি বরং আয়েশা (রা) তো সাক্ষ্যই দিয়েছেন যে—“কুরআনই ছিল তাঁর চরিত্র।” আমাদের চরিত্র কি ? আমাদের মৃত্যুর পর আমাদের স্ত্রীগণ কী সাক্ষ্য দিবে ? আমাদের মা-খালা-চাচী-মামীদের জেনারেশনের অনেকের মধ্যেই একটা কমন কথা শুনবেন—“তোর আব্বার সাথে বনিবনাটা কোনদিন হোল না” কিংবা “তোদের দিকে তাকিয়েই এক সংসারে জীবনটা পার করলাম” ইত্যাদি। আমাদের জীবদ্দশাতেই যদি আমাদের স্ত্রীদের কথা এমন হয় তবে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগে না।

উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো সমগ্র নারী জাতির সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য (এমন কিছু সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য ছেলেদেরও রয়েছে যেগুলো নারীদের পছন্দ নয়, যেমন—একাধিক নারীর প্রতি সৃষ্টিগত আকর্ষণ। তাই বলে এজন্য কি পুরুষেরা নিন্দার পাত্র হবে? যদি না হয় তবে নারীরাও তাদের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের জন্য নিন্দিত হবে না) এগুলো কারো মাঝে কম থাকে, কারো বেশি। এসব উপেক্ষা করুন, দেখেও না দেখার ভান করুন। আপনার কাছে সামান্য ভাল আচরণ পেলেই আপনার স্ত্রী সমস্ত রাগ অভিযোগ ভুলে যাবে—নিশ্চিত থাকুন। তবে শরীয়তের সীমালংঘন করতে দেখলে অবশ্যই উত্তম ও যৌক্তিক উপায়ে বোঝাবেন।

আপনার স্ত্রী যদি আপনার দেওয়া হাত খরচের মুখাপেক্ষী হয় তবে তার এই মুখাপেক্ষীতার হক আদায় করুন। প্রতি মাসের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তার হাত খরচ দিয়ে দিন। বিশেষ দিবসে অথবা মাসে নির্ধারিত হাত খরচের চেয়ে কিছুটা বাড়িয়ে দিন। যেমন—তার বই পড়ার অভ্যাস থাকলে ফেব্রুয়ারি মাসে অতিরিক্ত কিছু টাকা তার হাতে তুলে দেন। যদি আপনার স্ত্রী গৃহিণী হয় তবে মনে রাখবেন সে আপনার সংসার ও সন্তানের জন্যই তার ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস করেছে। এর উপযুক্ত সম্মান ও মূল্য তাকে দিন। কখনোই এই বলে খোঁটা দিবেন না যে—“বাইরে গিয়ে টাকা কামালে টের পাইতা কত ধানে কত চাল।” বাস্তবতা হলো একদিনের পুরোটা না অন্তত আধা দিন সন্তান-সংসার সামলাতে হলেও কত ধানে কত চাল তা আপনি দ্বিগুণ টের পাবেন।

কারণে অকারণে স্ত্রীর প্রশংসা করুন। সে সাজলেও প্রশংসা করুন, ঘর্মাক্ত থাকলেও করুন। তাকে ভালো লাগলেও করুন, না লাগলেও করুন। মেয়েরা স্বভাবগতভাবেই প্রশংসা পেতে চায়। কতটা পেতে চায় তা অধিকাংশ পুরুষের ধারণারও বাইরে। সব সময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশক কথা বলুন। যেমন—“তুমি না থাকলে সংসারটা এত সুন্দর হতো না”, “তুমি আমার জন্য, বাচ্চাদের জন্য এত করো যে আমি আসলে তোমার কাছে ঋণী”—এই ধরনের কথা দৈনিক একবার হলেও বলুন। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলবেন না, একেবারে ডিরেক্ট বলুন। আর প্রতিদিন কমপক্ষে একবার বলবেন যে আপনি তাকে ভালবাসেন। সরাসরি বলতে বলতে না পারলে কিছুক্ষণ হাতটা ধরে বসে থাকুন। তাকে নিশ্চিতভাবে বুঝতে দিন যে আপনি সত্যিই তাকে ভালবাসেন। তবে মৌখিক এক্সপ্রেশন অনেক বড় কাজে দেয়। অনেক সময় ছেলেরা ভাবে—“আরে ও তো জানেই যে আমি কতটা…”—জ্বী না। তারা জানলেও সেভাবে ফিল করে না unless you mention it.

শেষ বেলায় একটা কথা বলে বিদায় নিই। সংসার জীবনে একটু খুনসুঁটি, মনোমালিন্য হবেই। তাই বলে রাগের মাথায় ঝগড়ার সময়/পরে আপনার বান্ধবী বা পরিচিত মহলে স্বামীর গীবত করবেন না। বাবা-মার কাছে তো একেবারেই করবেন না। স্বামীর নেগেটিভ দিকগুলো, হোক তা সত্য অথবা মিথ্যা, কাউকে বলে বেড়াবেন না কারণ আপনি যেটাকে ‘বদগুণ’ ভাবছেন সেটা হয়তো তার ক্ষণিকের দুর্বলতা মাত্র। একটা সময় যখন রাগ পড়ে যাবে তখন দেখবেন মানুষটা আসলে অতটা খারাপ নয়। এই কথা ছেলে এবং মেয়ে উভয়কেই বলছি। আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা এই কাজটা করবেন না। কিছু মন্দ গুণ তো সব মানুষেরই আছে, আপনাদেরও আছে। কথাটা বিশেষভাবে বোনদের মাথায় রাখা দরকার কারণ তারা সাধারণত অধৈর্য হয়ে স্বামীর গীবত করে বেশি। কথাগুলো শুনলে কষ্ট লাগতে পারে। আপনার মনে হতে পারে—“কই আমি তো এমন না”। হতে পারে আপনি এমন না আবার কিছুটা এমন হতেও পারেন। আর তা না হলেও অন্তত নারীদের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য এমনই। তবে কথাগুলো ভাইদের জন্যও বলব। আপনি স্বামী-স্ত্রী যাই হোন, আপনার বেটার হাফের সম্মান আপনার আমানত। এই আমানতের খিয়ানত করার আগে একটিবারও কি আমরা ভাবতে পারি না ?

[৩]

আজ যে বিষয়টা নিয়ে লিখব সেটা হল স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ‘Mutual Trust’ বা পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস। অনেকে এটুকু শুনেই নাক সিঁটকাতে পারেন যে ‘এ আর নতুন কী? এতো সবাই-ই বলে।’ আসলে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সুসম্পর্কের রসায়নে নতুন কোন সূত্র/ম্যাজিক নেই। সুখী দাম্পত্যের তত্ত্বগুলো আমরা কম-বেশি সকলেই জানি আর এই গুগল-ইউটিউবের যুগে তো সেগুলো জানা আগের যেকোন সময়ের চেয়ে সহজ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কয়জন সেগুলো মেনে চলি? তো এই ‘বাস্তবে মেনে চলা’টাই আমাদের জন্য প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ তাই কথা বলব মূলত বাস্তবে কীভাবে আমরা নিজেদের মাঝে আস্থা-বিশ্বাস গড়ে তুলতে পারি কিংবা হারিয়ে যাওয়া সেই পুরনো আস্থা-বিশ্বাসের গাঁথুনি আরেকটু মজবুত করে তুলতে পারি তা নিয়ে।

যেহেতু আমাদের সমাজে বিয়ের মাধ্যমে একটি মেয়ে একেবারে নতুন পরিবেশে গিয়ে উপস্থিত হয় এবং নতুন জীবনের নানাবিধ অঙ্ক মেলাতে গিয়ে হিমশিম খায় তাই এই সময় তারা বড় নাজুক অবস্থায় থাকে। এই সময় তারা খুব বেশি করে চায় তাদের স্বামীদের পক্ষ থেকে একটু আশ্বাস-একটু সহযোগীতা। তাই বিবাহিত জীবনের একেবারে শুরুটাই হল আস্থা-বিশ্বাস গড়ে তোলার যথার্থ সময় এবং এজন্য আমাদেরকে সচেতনভাবে কাজ শুরু করতে হবে বিবাহিত জীবনের একেবারে প্রথম দিন থেকেই।

# যেসব ‘স্বামী’দেরকে তাদের বাবা-মা, ভাই-বোনদের ভরণপোষণ দিতে হয় তারা অনেক সময় বিয়ের পর বেমালুম বেখেয়াল থাকেন যে এখন তার ঘরে আরেকটি ‘নারী’ রয়েছে যারও রয়েছে তার স্বামীর উপর অধিকার। অথচ এই অধিকারটা অনেক স্বামীদের কাছে উপেক্ষিত থেকে যায়, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। তাইতো দেখা যায় (এক প্রজন্ম আগেও খুব বেশি দেখা যেত) ঈদে কিংবা অন্য যেকোন উপলক্ষে কেউ তার বাবা-মা, ভাই-বোনদের জন্য যে ‘মান’ এবং ‘পরিমাণ’ এর বাজার করেছে নিজ স্ত্রীর জন্য তার অর্ধেকও করেনি। শুধু উপলক্ষে নয় বরং বছরের বিভিন্ন সময়েও এই অসমতা অনেক ‘স্বামী’ করে থাকে। অথবা করলেও তার Attitude এমন ছিল যে ‘নিছক দায়িত্ব পালন করলাম।’ অনেকে আবার নিজ বাবা-মা, ভাই-বোনদের জন্য যা খরচ করে এবং যতটুকু করে সেগুলো নিজ স্ত্রীর কাছে লুকোতে চায়। তারা ভাবে ‘আমার স্ত্রী জানলে হয়ত আমাকে এভাবে খরচ করতে দিবে না’ কিন্তু আসলে এতে ফল হয় উল্টো। স্ত্রী ভেবে বসে তার উপর তার স্বামীর ‘এতটুকু আস্থা নেই!’ এতে কিন্তু স্ত্রীর আত্মসম্মানে খুব আঘাত লাগে।

আমার জানামতে, নিজ অধিকারটুকু ঠিকমত পেলে কোন স্ত্রী-ই তার স্বামীকে স্বামীর বাবা-মা, ভাই-বোনদের পেছনে খরচ করতে বাধা দিবে না কিন্তু স্বামী যখন নিজ বাবা-মা, ভাই-বোনদের পেছনে খরচ করতে গিয়ে নিজ স্ত্রীর হক ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নষ্ট করে/লুকোতে চায় তখন এটা দাম্পত্য সম্পর্কের আস্থা-বিশ্বাস শুধু নষ্ট করে দেয় না বরং বলা যায় একেবারে শিকড় কেটে ফেলে, যদি স্বামী এই ভুল বুঝে ফিরে আসতে না পারে। এজন্যই আমাদের খালা-চাচীদের জেনারেশনে অনেক মহিলার কাছে শুনবেন—“ওর বাপতো সারাজীবন নিজের ভাই-বোনদেরই দেখে গেল, আমার দিকে তাকানোর সময় ছিলো তার?” আরেকটু আবেগপ্রবণ মহিলারা আপনজন/নিকটজনের কাছেতো সুযোগ পেলেই যুগ যুগের জমানো কষ্টের ডালা মেলে দিয়ে গল্প করে কীভাবে উনাদের ‘স্বামীগণ’ নিজ বাবা-মা, ভাই-বোনদের ‘পালতে’ গিয়ে উনার দিকে ‘ফিরেও তাকায়নি।’ হ্যাঁ, এসব ‘কষ্টের কিচ্ছায়’ হয়ত আবেগের বশে কিছু অতিরঞ্জন থাকে তবে অবহেলার বিষয়টিতো আর মিথ্যা নয়, নাহলে একটি প্রজন্মের সিংহভাগ ‘অর্ধাঙ্গিনী’-র এসব গল্পের উৎপত্তির হেতু কী?

তবে এখানে বোনদেরকেও বলব—আপনারা আপনাদের স্বামীদেরকে তাদের বাবা-মা, ভাই-বোনদের পেছনে খরচ করতে দিতে দ্বিধা করবেন না। বিয়ের পরেও স্বামীর বাবা-মার দেখভাল করার দায়িত্ব কিন্তু স্বামীর উপরেই থাকে। এই দায়িত্ব পালনে আপনি সদা সর্বদা তাকে সাহায্য করুন, উৎসাহ দিন, তার মাঝে কোন গাফেলতি দেখলে আপনিই বরং আগ বাড়িয়ে আপনার স্বামীকে তার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিন। ইনশা আল্লাহ আপনার প্রতি আপনার স্বামীর ভালবাসা বাড়বে বৈ কমবে না।

তাই ভাইদেরকে বলি—আপনি বাবা-মা, ভাই-বোনদের পেছনে খরচ করুন, কোন কৃপণতা করবেন না। যতটুকু লাগে করুন কিন্তু এগুলো আপনার স্ত্রীর কাছে Hide করবেন না কিংবা অন্যদের পেছনে খরচ করতে গিয়ে স্ত্রীর প্রাপ্যটুকু কমিয়ে দেবেন না। তবে কোন বিশেষ প্রয়োজনে/সময়ে শার’ঈভাবে কিংবা বাস্তব প্রয়োজনের খাতিরে প্রাধান্যের বিষয়টি সামনে চলে আসলে বাবা-মা, ভাই-বোনদের খরচে প্রাধান্য দিতে পারেন, তবে অবশ্যই স্ত্রীকে কারণটি বুঝিয়ে বলবেন। আর এই সময় স্ত্রী অযৌক্তিকভাবে বাধা দিলেও আপনি সেই বাধার কাছে নত হবেন না। তাকে যৌক্তিকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করুন আপনার কর্মের কারণ। এই একটি বিষয় আমাদের সমাজে ‘স্বামীগণ’ মেনে চলতে পারলে পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস কত উন্নত পর্যায়ে উপনীত হতে পারে তা হয়ত আমরা ভাবতেও পারছি না। আল্লাহ সহায়!

# পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য একেবারে বাসর রাতেই আপনি প্রথম পদক্ষেপটি নিতে পারেন। এটি আমাকে আমার এক উস্তাদ বলেছিলেন আর তা হল—বাসর রাতেই স্ত্রীকে সারাজীবনের জন্য নিজ বাবার বাসায় বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দেওয়া। অনেকে হয়ত ভাবছেন—‘এতে অনুমতির কী আছে? যখন ইচ্ছা যাবে…’ আসলে শার’ঈভাবে চিন্তা করলে বিষয়টা একটু অন্যরকম। বিয়ের পর একজন স্ত্রী তার স্বামীর অনুমতি ছাড়া নিজ বাবার কাছে যখন ইচ্ছা তখনই যেতে পারে না। কারণ, বিয়ের পর স্বামীর হকের বিষয়টা সামনে এসে যায়। তাই দ্বীনদার বোনেরা অনেকেই বিষয়টা নিয়ে কিছুটা পেরেশানির মধ্যে থাকেন যে, যে প্রাণপ্রিয় বাবার ঘরের আদরের দুলালী হয়ে ছিলেন এতদিন সেই বাবার কাছে ‘যখন মন চাইবে তখনই’ আসতে পারবে তো? তাই, আপনি বিয়ের রাতেই এই বিষয়ে তাকে সাধারণ অনুমতি দিয়ে দিন। দেখুন এতে কি কাজ হয়!

এক্ষেত্রে, শুধু এক্ষেত্রে নয় বরং বিবাহিত জীবনের সকল ক্ষেত্রেই, চিন্তার ভারসাম্যটা খুব জরুরী। আপনি বাসর রাতে স্ত্রীকে অনুমতি দিয়ে দিলেন মানেই এই নয় যে, আপনি পরবর্তীতে তাকে কখনো নিষেধ করতে পারবেন না। বাস্তবতার নিরিখে এবং প্রয়োজনের সাপেক্ষে যেকোন মানের বুঝদার স্ত্রী-ই বুঝে নেবেন যে কখন তার বাবার কাছে যাওয়ার উপযুক্ত সময়। কেউ আবার একে ‘মিথ্যা আশ্বাস’ বলে ভুল বুঝবেন না। আসলে বোঝাতে চাইছি, স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই প্রতিটি বিষয়েই বাস্তবতার চাহিদা ও চিন্তার ভারসাম্য মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

# পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস অর্জনের জন্য আমরা আরেকটি কাজটি করব আর তা হল—পরস্পরকে পরস্পরের ‘অতীত’ নিয়ে কোন প্রশ্ন করব না। যে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি তাতে বিবাহপূর্ব কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াটা বলা যেতে পারে আমাদের সমাজে এক প্রকার ‘Norm’ হয়ে গিয়েছে। তবে আলহামদুলিল্লাহ, এখনও এমন অনেক ভাই-বোন রয়েছেন যাদেরকে সমাজের এই ব্যাধি স্পর্শ করতে পারে নি। তো, আমাদের কারোরই উচিত নয় বিয়ের পর spouse কে এই নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা কিংবা সন্দেহ পোষণ করা। কারণ, সে স্বীকার করুক আর না-ই করুক, তার সম্পর্ক থাকুক আর না-ই থাকুক, বিয়ের পর এগুলো জেনে আপনার অশান্তি ব্যতীত কোন ফায়দা নাই। এমন অনেকের কথা শুনেছি যারা ভাবত তার স্বামী/স্ত্রীর বিবাহপূর্ব সম্পর্ক থেকে থাকলেও তার এমন কিছু খারাপ লাগবে না। কিন্তু সম্পর্কের কথা জানার পরই সংসারে সন্দেহ-সংশয় আর অশান্তির আগুন জ্বলে উঠেছে। শয়তানের কী সূক্ষ্ম চাল!

কেউ কেউ আবার একটু বেশি ‘সাধু’ সেজে আগ বাড়িয়ে নিজে বিয়ের আগে কী কী ‘আকাম’ করেছে spouse এর কাছে সেগুলোর বিবরণ দেয়। এটা হল মূর্খতার উপর মূর্খতা। আপনি বিয়ের আগে কী করেছেন সেগুলো কখনও আগ বাড়িয়ে বলতে যাবেন না, এমনকি রসিকতার ছলেও না। ঠিক তেমনি আপনার spouse বিয়ের আগে কী করেছে সেগুলোও কখনও আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করতে যাবেন না, এমনকি রসিকতার ছলেও না।

# স্বামী-স্ত্রী পরস্পর পরস্পরের মোবাইল নিয়ে ‘গবেষণা’ (!) কিংবা ‘গোয়েন্দাগিরি’ করবেন না। যদিও স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোন পর্দা নেই কিন্তু স্বামী/স্ত্রীর মোবাইলে এমন কিছু থাকতে পারে যা পর্দার কারণে স্ত্রী/স্বামীর জন্য দেখা জায়েয নয়। আমি শার’ঈভাবে হালাল জিনিসের কথাই বলছি আর হারামতো সর্বাবস্থায় উভয়ের জন্যই পরিত্যাজ্যা। এছাড়াও শয়তানের ওয়াসওয়াসায় spouse এর মোবাইলে-ম্যাসেঞ্জারে-ই-মেইলে দেখা/পড়া ম্যাসেজ বা অন্য কিছু থেকেও অনর্থক সন্দেহ মনে দানা বাঁধতে পারে। তাই spouse এর মোবাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা আজ থেকে সম্পূর্ণ বন্ধ!

# পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস নষ্টের জন্য দায়ী আরেকটি ‘আপাত নিরীহ’ অস্ত্র হল—স্বামী কর্তৃক দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে রসিকতা। এই রসিকতা সরাসরি স্ত্রীর সাথেই হোক কিংবা নিজ বন্ধুমহলেই হোক (যদি স্ত্রী জানতে পারে)—এটি আপনার প্রতি আপনার স্ত্রীর আস্থা একেবারে চুরমার করে দিবে যদি আপনি এই রসিকতাকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেন। পাশাপাশি আপনি যা করবেন না তা নিয়ে স্ত্রীকে দিনের পর দিন মানসিক কষ্টে ও চাপের মধ্যে রাখাটা কতটা মানবীয় আচরণ ? আপনি হয়ত রাতের বেলা রসিকতা করে ঘুমিয়ে যাবেন, ঘুম থেকে উঠেই আবার সবকিছু ভুলে যাবেন। কিন্তু আপনার স্ত্রীর ক্ষেত্রে এমনটা হবে না। আপনার ঐ রসিকতাই দিনের পর দিন সূঁচের মত সন্দেহের খোঁচা দিতে থাকবে তাকে। এটি কি আপনার জন্য খুব সুখনীয় কিছু? আপনি সত্যিকার অর্থেই দ্বিতীয় বিয়ে করতে আগ্রহী হলে এবং নিছক আবেগ না দিয়ে বরং বাস্তবতা ও প্রয়োজনের তাগিদে দ্বিতীয় বিয়ে করার সুস্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারলে ‘ফালতু রসিকতা’ না করে দ্বিতীয় বিয়েটা করে ফেলুন। কিন্তু এই বিষয়টা নিয়ে রসিকতা করে অনেক ‘দ্বীনি ভাই’ও ইসলামের একটি বিধানকে তাচ্ছিল্যের বস্তু বানিয়ে দিচ্ছেন। এটি কি গুনাহের কাজ নয় ভাইয়েরা?

[৪]

আমার যখন বিয়ে ঠিকঠাক হয় তখন একদিন আব্বা আমাকে ঘটা করে ডাকলেন কথা বলার জন্য। আমাদের মাঝে সব কথাতো দৈনন্দিন জীবনের ফাঁক-ফোকরেই হোত তাই সাধারণত ছোটবেলায় পাটিগণিত করানো ছাড়া আমাকে ঘটা করে ডেকে কথা বলা তেমন তার হয়ে ওঠেনি। এজন্যই সেদিন আন্দাজ করেছিলাম তিনি হয়ত ‘বিশেষ কিছু’ বলতে চাচ্ছেন। যাই হোক, সেদিন আব্বা বলেছিলেন—“সবসময় নিজের উপার্জনের ওজন অনুযায়ী চলবা আর নিয়মিত সঞ্চয় করবা ভবিষ্যতের জন্য। Cut your coat according to your cloth কথাটাতো আর এমনি এমনি আসেনি। মনে রাখবা, মানুষ অভাবে পড়ে তার উপার্জনের কমতির জন্য না বরং বেহিসাবী ব্যয়ের জন্য। আর ঋণমুক্ত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করো, কখনও মানুষের কাছে ঋণগ্রস্থ হয়ো না।”

কথাগুলো আমি আমার ‘দাম্পত্য ডায়েরি’ তে লিখে রেখেছিলাম। এই কথাগুলোর কোনো মূল্যমান কোন মানুষের পক্ষে নির্ণয় করা অসম্ভব। কথাগুলো আমার মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে, খুব সম্ভবত আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই কথাগুলো ভুলব না এবং আমার সন্তানদেরকেও আমি একই নাসীহা দিয়ে যাব ইনশা আল্লাহ। এই কথাগুলোকে দাম্পত্য জীবনে সুখে থাকার ‘Golden Rule’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। অযোগ্য সন্তান হিসেবে আব্বা-আম্মার অনেক কথা মানতে না পারলেও সেদিন আব্বার বলা এই কথাটা আমি আমার দাম্পত্য জীবনে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি আলহামদুলিল্লাহ এবং এর ফলও আমি পেয়েছি। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাকে কখনও কারো কাছে ঋণ নেওয়াতো দূরের কথা, মাসের শেষে গিয়ে হাতখরচের সামান্য টাকাও ধার করতে হয়নি। এ শুধু আল্লাহরই প্রশংসা যিনি তার এক বান্দাকে অভাবমুক্ত রেখেছেন আরেক বান্দার উসীলায়। তাই আমি married/going to be married ভাই-বোনদেরকে বলব, আমার বাবার কথাগুলো আপনারাও আপনাদের দাম্পত্য জীবনে মেনে চলুন, দেখবেন সংসার কতটা মধুর হয়। আপনার মাসিক আয় যত কমই হোক না কেন, অবশ্যই অবশ্যই সামান্য পরিমাণ টাকা হলেও নিয়মিত সঞ্চয়ের চেষ্টা করুন। আয়ের কমতি যেন আপনার সঞ্চয়ের ব্যর্থতার কারণ না হয়। আর ‘বাধ্যতামূলক’ সঞ্চয়টুকু করার পর আপনি যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে (স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে আর বিলাসীতার সাথে-দুটো বিষয় এক নয়) চলতে পারেন সেভাবেই চলুন। আপনার যদি সহজে স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য না থাকে তবে শুধু মানুষকে দেখানোর জন্য জোর করে টাকা ধার করে বা নিজের উপর চাপ নিয়ে তা কিনতে যাবেন না, অফিসের কলিগদের মত ‘ব্র্যাণ্ডের কাপড়’ পরার সামর্থ্য না থাকলে মার্জিত ও রুচিশীল স্বল্প দামের কাপড়ই পরুন। আপনার সৌন্দর্য কাপড় কিংবা মোবাইলের ব্র্যাণ্ডে নয়, আপনার সৌন্দর্য আপনার রুচিশীলতা ও মানসিকতায়। এগুলো উদাহরণ মাত্র। একই ধরণের ভুল আমরা অহরহ করে থাকি। সামর্থ্য নাই ইচ্ছামত জিনিস কেনার, ব্যস—একটা ক্রেডিট কার্ড নিয়ে নিই আর ইচ্ছামত ‘শপিং’ করে টাকা উড়াই। সেখানেও লিমিট শেষ হয়ে গেলে তখন মানুষের কাছে হাত পাতি ক্রেডিট কার্ডের বিল দেওয়ার জন্য। সাথে যুক্ত হয় মানুষের পাওনা পরিশোধের অতিরিক্ত মানসিক চাপ।

ঋণগ্রস্থতা এমন এক অভিশাপ যা আপনার দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তিকে নিমিষেই তছনছ করে দিতে পারে। ইসলামী শরীয়া মোতাবেক স্বামী তার পরিবারের ভরণ-পোষণ দিতে বাধ্য। এই দায়িত্ব পালনে স্বামী যখন ‘নিজ দোষেই’ অক্ষম হয়ে পড়ে তখন স্ত্রী-সন্তানদের শাসন করার জন্য প্রয়োজনীয় ‘জোর’টুকু সে হারিয়ে ফেলে। একজন বিবাহিত পুরুষের স্ত্রীকে যদি তার বাবার ঘর থেকে টাকা এনে স্বামীর সংসারের অভাব মেটাতে দিতে হয় তবে সেই স্বামীর জন্য এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছু হতে পারে না। আর এ ধরণের অভাবের মুখোমুখি হয়েই অনেক পরিবারের মেয়েরা বাইরে আসে চাকরি-বাকরি করে সংসারে ‘সাপোর্ট’ দেওয়ার জন্য। এসব ভাইদেরকে বলি, কী দরকার ছিল শুরুতে সেই ‘ঠাটবাট’ বজায় রাখার জন্য ঋণগ্রস্থ হওয়ার? সেদিন সমাজের চোখে তথাকথিত ‘লেভেল’ বজায় রাখার চিন্তাটুকু বাদ দিলে আজ আপনার স্ত্রীকে জীবন ও সম্ভ্রমের ঝুঁকি নিয়ে বাইরে কাজ করতে হোত না।

তবে এখানে ভুল বোঝাবুঝির কোন অবকাশ নেই। অনেক ভাই আছেন যারা তাক্বদীরের নির্ধারণে এবং নিজেরা ঋণ থেকে বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরও পরিস্থিতির খাতিরে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। আমি নিশ্চয়ই তাদের কথা বলছি না। এ ধরণের ভাইদেরকে সাহায্য করতে ইসলাম আমাদেরকে নির্দেশ দেয় বলেই সুদবিহীন ঋণকে (কর্জে হাসানা) অনেক বড় সাওয়াবের কাজ হিসেবে ইসলাম চিহ্নিত করেছে। আবার অনেক মা-বোনদেরকেও পরিস্থিতি ও বাস্তবতার খাতিরে কাজে নামতে হয়, তারাও আমার উপরোক্ত আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নন।

দাম্পত্য সুখের দ্বিতীয় আরেকটি Golden Rule হল—‘সাদাক্বাহ’। স্বামী একাই যদি উপার্জনক্ষম হয়ে থাকে তবে স্বামীর উচিত নিয়মিত ভিত্তিতে সাদাক্বাহ করা। আর স্ত্রী উপার্জনক্ষম হয়ে থাকলে কিংবা স্বামীর কাছ থেকে হাতখরচ নিলে তারও উচিত তার সম্পদ থেকে সামান্য পরিমাণ হলেও নিয়মিত ভিত্তিতে (সাপ্তাহিক/মাসিক) সাদাক্বাহ করা। এতে যে একটা সংসারে কী পরিমাণ বরকত আসে তা বলে/লিখে বোঝানো অসম্ভব। খুব ভাল হয় যদি স্বামী-স্ত্রী একত্রে অন্তত একজন ইয়াতিমের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে পারেন। আমার পরিচিত এক বোন ও তাঁর স্বামী এই কাজটি করে থাকেন। তাঁরা আমাকে জানিয়েছেন সেই ইয়াতিমের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তাঁদের সংসারে শুধু বরকত আর বরকত আসতেই আছে! সুবহানাল্লাহ! ফালিল্লাহিল হামদ!

স্বামী-স্ত্রীর উচিত সাধারণ সাদাক্বাহ-র পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট কোন সাদাক্বাহ করা। হতে পারে কোন ইয়াতিমের নিয়মিত সকল খরচ বহন করা কিংবা কোন মসজিদ/মাদ্রাসায় প্রতি মাসে কিছু টাকা সাদাক্বাহ করা। অনেকে হয়ত ভাবছেন—‘এত সাদাক্বাহ করার টাকা কোথায় পাব?’ এটা একটা অমূলক আশঙ্কা। কারণ, সাদাক্বাহ-র পরিমাণের চেয়ে মুখ্য হল ইখলাস। দূর্বল ইখলাস নিয়ে লক্ষ টাকা দান করার চেয়েও খাঁটি ইখলাস নিয়ে একশ টাকা দান করা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। তাই অতি সামান্য পরিমাণ হলেও নিয়মিত দিন, এমনকি মাসে পঞ্চাশ টাকা বা তার কম হলেও।

নিয়মিত আমলের অন্যতম একটা ফযীলত হল, যতদিন সামর্থ্য আছে ততদিন সাদাক্বাহ করে গেলে যদি আল্লাহ আপনাকে ভবিষ্যতে এই সাদাক্বাহ করা থেকে অক্ষম করে দেন কিন্তু আপনার অন্তরে ঐ সাদাক্বাহ করার তামান্না থাকে তাহলেও আপনি নিয়মিত ঐ সাদাক্বাহ করার সাওয়াব পেতে থাকবেন। সুবহানাল্লাহ! এর চেয়ে বেশি আর কি চাই!

দাম্পত্য সুখের ৩য় Golden Rule হল—‘জিহ্বাকে সংযত রাখা এবং কানকে সজাগ রাখা।’ আগে প্রথম অংশটুকু ব্যাখ্যা করি। অর্থাৎ অনর্থক কথাবার্তা পরিহার করা এবং বিশেষত মনোমালিন্যের সময় যথাসম্ভব চুপ থাকা সংসারে শান্তি রক্ষার্থে অপরিহার্য। এইদিক দিয়ে মেয়েরা অনেকটা দূর্বল বলে ছেলেদেরকেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুপ থাকার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে অবশ্যই স্ত্রীদেরও উচিত এই চুপ থাকার গুণ অর্জনে যথাসম্ভব চেষ্টা করা এবং এটিকে শুধুমাত্র ‘স্বামীর দায়িত্ব’ বলে ভুলে না যাওয়া। হয়ত মেয়েরা এই বিষয়ে সৃষ্টিগতভাবেই দূর্বল আর তাই এই নিয়ে তাদেরকে খোঁটা না দিয়ে আমাদের উচিত তারা যখন ভাল মুডে থাকে তখন তাদেরকে Reminder দেওয়া। আর যদি স্বামী-স্ত্রী একটা পারস্পরিক সিদ্ধান্তে আসতে ও মেনে চলতে পারেন যে—‘যখন একজন চেঁচামেচি শুরু করবে তখনই আরেকজন চুপ হয়ে যাবে’ তবে দাম্পত্য কলহ এবং অশান্তি অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব।

এবার আসি দ্বিতীয় অংশের ব্যাখ্যায়। ‘কানকে সজাগ রাখা’ অর্থ হল—আপনার স্ত্রী যখন আপনাকে কিছু বলবে তখন মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনবেন। যদি একান্ত ব্যস্ততার কারণে শুনতে না পারেন তবে প্রথমেই জানিয়ে দিন যে আপনি এখন ব্যস্ত আছেন এবং ফ্রী হলে তার কথা শুনবেন। একদিকে আপনার স্ত্রী কথা বলেই যাচ্ছে আর আপনি মোবাইল/টিভি/ল্যাপটপ স্ক্রীনে বুঁদ হয়ে আছেন—এমন দৃশ্য মেয়েদের জন্য খুব সুখকর নয়। আবার শুধু হুঁ হাঁ করে দায়সারাভাবে শুনে পার করে দিলেও সমস্যা যাবে না বরং আরো বাড়তে পারে। তাই স্ত্রীর কথা শুনে বুঝতে চেষ্টা করুন সে আসলে কী চায়? আপনার কাছে কোন পরামর্শ চায় নাকি শুধুই তার মনের আবেগটুকু প্রকাশ করতে চায়। সে পরামর্শ চাইলে আপনি পরামর্শ দিন আর শুধু আবেগের প্রকাশ ঘটালে আপনিও তাকে বুঝতে দিন যে, আপনার কাছে তার আবেগের মূল্য আছে। অযাচিত পরামর্শ কিংবা পেরেশানির মুহূর্তে রোমান্স—কোনটাই সুখকর অভিজ্ঞতা নয়!

[৫]

দাম্পত্য রসায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ Catalyst হল স্বামীর প্রতি স্ত্রীর শ্রদ্ধাবোধ। শুধুমাত্র এটুকু পড়ে আপনি নাক সিঁটকাতে পারেন যে, এই কথা কি স্ট্যাটাস দিয়ে বলা লাগে? আসলে আমি শ্রদ্ধাবোধ বলতে কী বুঝাচ্ছি সেটা খোলাসা করা দরকার। এই ‘শ্রদ্ধাবোধ’ এর অর্থ হল—স্বামীর সিদ্ধান্ত, পছন্দ ও জ্ঞানের উপর পূর্ণ আস্থা রাখা। বাস্তবতা এটাই যে আল্লাহ স্বামীদেরকে সংসারের কর্তা হিসেবে নির্ধারণ করেছেন এবং এই দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ যোগ্যতার বীজ তাদের মাঝে বুনে দিয়েছেন। কেউ এই বীজকে মহীরুহে পরিণত করে আদর্শ স্বামী হতে পারে আবার কেউবা এই বীজকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে স্বামীত্বের মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ঐ বীজের পরিণতি যাই হোক না কেন, আল্লাহ যে তাদেরকে Authority-র জন্য নির্ধারণ করেছেন এতো ধ্রুব সত্য।

বোনদেরকে বলি, “স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ” এর অন্তর্ভুক্ত হল—কথায় কথায় আপনার স্বামীর সিদ্ধান্তে/চিন্তায় ভুল ধরবেন না, তাকে পদে পদে সংশোধন করতে যাবেন না। যতক্ষণ সে শরীয়তের সীমারেখার মাঝে আছে এবং বড় কোন ক্ষতির ঝুঁকিতে না পড়ছে ততক্ষণ তাকে নিজের ভুল থেকে শুধরাতে দিন। আর স্বামীদের এই ক্ষেত্রে উচিৎ হল নিজের ভুল বুঝতে পারলে সাথে সাথে তা সংশোধন করে নেওয়া এবং ইগো-র বশে কিংবা স্ত্রীর কাছে “ছোট হওয়া”-র মত অহেতুক আশঙ্কা থেকে নিজের ভুলের উপর গোঁ ধরে বসে না থাকা। অনেক ভাইকে দেখেছি যারা নিজের ভুল জেনেও শুধুমাত্র স্ত্রীর কাছে ছোট হয়ে যাওয়ার ভয়ে চিল্লাপাল্লা করে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। স্বামীদের এমন আচরণ কিন্তু তাদের আল্লাহ প্রদত্ত ঐ সম্ভাবনার বীজকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলে।

স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এর অর্থ এটাও যে আপনি সংসারে তার Authority কে চ্যালেঞ্জ করবেন না এবং এমন কিছু বলবেন না বা করবেন না যাতে আপনার স্বামীর মনে হতে পারে যে আপনি তার কর্তৃত্বের প্রতি আস্থাশীল নন। এখন বোনদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, “তাহলে কি ও যা ইচ্ছা করবে, বলবে আর আমি শুধু মুখ বুজে শুনব?” জ্বী না, আপনি মুখ বুঝে শুনবেন না বরং এক্ষেত্রে হিকমাহ-র সাথে আপনার স্বামীকে বোঝাতে চেষ্টা করুন। দৈনন্দিন জীবনের কথা-বার্তা, হাস্য-রসের আড়ালে আপনি তাকে বুঝতে দিন যে, তার Authority নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট কিন্তু তার এই Authority আপনাদের পরিবারের জন্য আরও বেশি Fruitful হতে পারে যদি সে অমুক অমুক বিষয়গুলো এভাবে না ভেবে/করে ওভাবে ভাবে/করে। নিশ্চিত থাকুন, একেবারে কাণ্ডজ্ঞানহীন স্বামী ছাড়া আর কেউ এমন পরামর্শ উপেক্ষা করতে পারে না।

স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বলতে এও বুঝায় যে, আপনার কিংবা আপনার স্বামীর বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা বন্ধু-কলিগদের সামনে আপনার স্বামীকে ছোট করে কিছু বলবেন না, হোক তা আপনার স্বামীর সামনে বা পেছনে। অনেকে স্বামীর নামে টিটকারি দিয়ে বলে (কিংবা ভাবে)—“আরে এটাতো ভালোবাসার প্রকাশ!” আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসার প্রকাশ আপনারা অন্যভাবে করুন, স্বামীকে নিয়ে মজা করে (সত্যই হোক আর মিথ্যাই হোক) তথাকথিত ভালোবাসার প্রকাশ করবেন না। এই একই বিষয় স্বামীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আপনারাও আপনাদের স্ত্রীর শ্রদ্ধা অর্জন করতে চাইলে তার কিংবা আপনার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা বন্ধু-কলিগদের সামনে আপনার স্ত্রীকে ছোট করে কিছু বলবেন না, হোক সেটা তার সামনে বা পেছনে। মজার নামে স্পাউসকে নিয়ে ছোট করে কথা বলা কিংবা টিটকারি মারা ‘স্বামীত্ব’ এবং ‘স্ত্রীত্ব’ উভয়ের মর্যাদাই নষ্ট করে দিতে পারে চিরতরে।

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে অনেক প্যাঁচাল পাড়লাম। ভবিষ্যতেও এই প্রসঙ্গে আবার কিছু মাথায় আসলে বলব ইনশাআল্লাহ। এই বিষয়টা আসলে এমন যে, স্বামী/স্ত্রী যেই শুনুক না কেন, মনের মধ্যে কোথায় যেন একটু চোট লাগে। কিন্তু সংসার জীবনকে রঙ্গিন করে সাজাতে হলে এই চোটটুকু নিতে ও সারাতে শিখতে হবে।

যাই হোক, এবার একটু ভিন্ন কথা বলে আজকের মত বিদায় নেব ইনশাআল্লাহ। অনেক সময় স্ত্রীগণ অভিযোগ করে থাকেন যে, তাদের স্বামীগণ অফিসে/কাজে এত বেশি ব্যস্ত থাকে যে বাসায় ফেরার পর স্ত্রী-সন্তানকে দেওয়ার মত সময় তার থাকে না কিংবা দিতে চায় না। এ নিয়ে বোনদের অভিযোগের অন্ত নেই! এটা ঠিক যে, অনেক ভাই (বিশেষত যারা পুরনো বিবাহিত) পেশাগত ব্যস্ততার পর বাড়ির চেয়ে বন্ধু মহলে আড্ডা দেওয়ার মাঝেই একটু প্রশান্তি খুঁজে পান (এর কারণও কিন্তু দাম্পত্য রসায়ন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকা)। কিন্তু অনেক ভাই-ই আছেন যারা অফিসে থাকাকালীন সারাক্ষণ মুখিয়ে থাকেন কখন বাসায় ফিরে একটু বিশ্রাম নিবেন! হয়ত কাজের চাপে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক দেরিতেই তিনি বাসায় ফিরেছেন কিন্তু তাই বলেতো বাসায় ফেরার প্রতি তার যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা সেটাতো মিথ্যা নয়, সেখানে তো কোন খাদ নেই! তাহলে কীভাবে তার উপর এই অভিযোগ আরোপ করা যায় যে ‘স্ত্রী-সন্তানকে সে সময় দিতে চায় না?’ আর স্বাভাবিকভাবেই কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পর (বিশেষত ঢাকা শহরে) ছেলেরা এত ক্লান্ত থাকেন যে, বাড়ি ফিরেই স্ত্রীকে Hug দেওয়ার মত মানসিক অবস্থা তাদের থাকে না। তাই এই বিষয়টা স্ত্রীগণ খুব স্বাভাবিকভাবে নিবেন যে আপনার স্বামী কাজ থেকে বাসায় ফেরার পর একটু নিজের মত সময় কাটাতে চাইবে। এই সময়টার অধিকার শুধু তারই হাতে দিয়ে দিন আর আপনি যেটা করতে পারেন তা হল এই সময়ে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি কিংবা ঘরের কাপড় এগিয়ে দিয়ে তার ভার কিছুটা লাঘব করুন। সে যত দ্রুত Relaxed হবে তত দ্রুতই আপনাকে Miss করা শুরু করবে! বিশ্বাস না হলে এর উপর নিজে আমল করেই দেখুন না! তাই স্বামী বাসায় ফেরার পর তার কাছে দ্রুত মনোযোগ পেতে হলে দ্রুত তার ভার লাঘব করার চেষ্টা করুন এবং বাসায় ঢোকার সাথে সাথেই তার কাছে নিজের জন্য সময় চাইবেন না কিংবা সাংসারিক, ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক কোন ব্যাপারে অভিযোগ করবেন না।

স্ত্রীগণ মনে রাখবেন, প্রত্যেকটা সংসারের স্বামীদের মনে অন্যতম যে চিন্তা কাজ করে সেটা হল তার পরিবারের Financial Security. তার উপস্থিতিতে কিংবা অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী-সন্তানগণ কীভাবে চলবে এই চিন্তা প্রত্যেক স্বামীর মনে অহরহ ঘুরপাক খায়। আপনার স্বামী যে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত গাধার খাটুনি খেটে বাসায় ফিরছে তা শুধুমাত্র এই চিন্তা থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্যই! তাহলে বলুন, তার এই ভোর-রাত পর্যন্ত কাজ করা নিয়ে অভিযোগ করা কি স্ত্রীদের সাজে? হ্যাঁ, আপনাদের মনে কষ্ট লাগে আর এই কষ্ট লাগাটাই স্বামীর প্রতি আপনাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ কিন্তু এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ভালোবাসা দিয়েই হতে হবে, বিরক্তি বা অভিমান দিয়ে নয়। তবেই আপনার স্বামী আপনার ভালোবাসা অনুধাবন করতে পারবে, অন্যথা শুধু ভুল বোঝাবুঝিই বাড়বে।


দ্বিতীয় অংশ—Click here.