একবার একটা গল্প পড়ছিলাম, যেটার মূল থিম ছিলো যে নায়ক নায়িকা ‘পবিত্র’ এক ভালোবাসার বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারে ভেসে গেছে, তারপর যা হবার তাই হয়েছে।

নায়িকাটা যখন উপলব্ধি করলো যে এই ভালোবাসার ‘দায়’ শুধু একা তাকেই নিতে হচ্ছে, ছেলেটা ‘সুখের ভাগ’টুকু নিয়েই খালাস, তখন তার ‘প্রকৃতির’ উপর খুব রাগ হলো, এই ‘জরায়ু’ নামক অঙ্গটাই তো সব সর্বনাশের কারণ, এটার জন্যই তো ছেলেরা দিব্বি ছলাকলা করতে পারে, করে ছেঁড়া কাঁথার মত ফেলে যেতে পারে।

লেখাটা পড়ে হঠাৎ করেই আমি যেন উপলব্ধি করলাম যে জীবনের একটা সুদীর্ঘ সময় আমি নিজেই এমন চিন্তা পোষণ করতাম। অথচ সেটার মাঝে এক ধরণের বৈপরীত্য ছিলো যা আমাকে ভিতরে ভিতরে অস্থির করে তুলেছিল। আমাকে বিকল্প কোনো আদর্শ খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেই অনুভূতিটাই আজকের লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

এক কথায় বলতে গেলে সেই উপলব্ধিটার নাম ছিলো 'অনিচ্ছাকৃত দাসত্ব’।

আস্তিক, নাস্তিক, সংশয়বাদী......ইসলাম প্র্যাক্টিস করেন কিংবা ইসলামের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করেন, আমরা সবাই একটা শক্তির দাস, অনিচ্ছাকৃত ভাবে। তাই নাস্তিক কিংবা কুরআনে হাফিয এমন মেয়েকে যদি বলা হয় যে প্রতি মাসে মেয়েদেরকে একটা বিশেষ সময়ের মাঝ দিয়ে যেতে হয়, এটা তোমার কেমন লাগে? আমার মনে হয় ২জনই বলবে তাদের ভালো লাগে না, বিরক্ত লাগে, কিন্তু দেখুন এই ২জনেরই এটা নিয়ে করার কিছু নাই। আমার কাছে এটাই হচ্ছে ‘অনিচ্ছাকৃত দাসত্বের’ ক্লাসিক্যাল উদাহরণ। আমি যেহেতু মেয়ে, তাই মেয়ে সংক্রান্ত উদাহরণই মাথায় আসে বেশি। অধিকাংশ মেয়েরই মা হতে ভালো লাগলেও, মা হওয়ার তীব্র ইচ্ছা থাকলেও যে প্রক্রিয়ায় একটা মানব শিশু দুনিয়াতে আসে, সেই কষ্টকর অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে আমার মনে হয় কোন মেয়েই যেতে চায় না। But do they have options? If the answer is NO—then that is ‘অনিচ্ছাকৃত দাসত্ব’।

কোনো নাস্তিকের পক্ষে চাইলেও বাথরুম চেপে একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি থাকা সম্ভব না। মানুষ যে কী অসহায় একটা প্রাণী সেটা বিছানায় বাথরুম করতে বাধ্য হওয়া অসুস্থ মানুষ দেখলেই বোঝা যায়, কিংবা ছোট্ট বাচ্চাকে কিংবা একদম বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া মানুষকে।

আজকাল ইসলামে সমকামীতার কন্সেপ্ট নিয়ে অনেক কথা হয়। এটাকে একটা স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে পশ্চিমারা। আমার কাছে এগুলোর সাইন্টিফিক ব্যাখ্যা বা ধর্মীয় ব্যাখ্যা কেমন যেন অর্থহীন লাগে। মনে হয় যে এটা খুব সিম্পল একটা ফ্যাক্ট যে এটা ন্যাচারাল হতে পারে না, কারণ ‘ন্যাচার’ বা ওদের ভাষায় ‘প্রকৃতি’ এই পদ্ধতিতে বংশ বিস্তারের কোনো সুযোগ রাখে নি, শারীরিকভাবে ভালোবাসা প্রকাশেরও কোনো স্বাভাবিক উপায় রাখেনি।

তারপরও দেখবেন এই শ্রেণীর মাঝে কেউ নিজেকে হাজব্যান্ড, কেউ ওয়াইফ দাবী করে। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে মানুষ যা করে, সেই সেটের বাইরে তারা চিন্তা করতে পারে না। ওই উপরে, নিচের কন্সেপ্টের মাঝেই ঘুরপাক খায়।

আমি জানি যে জিনিসগুলা খুব বমি উদ্রেককারী, পড়ে খুব খারাপ লাগতেই পারে, কিন্তু আজকাল এটা সমাজের এমন একটা দুঃখজনক বাস্তবতা হয়ে গেছে যে এগুলো নিয়ে ন্যূনতম পড়াশোনা থাকাটা সবার দরকার, বাচ্চা পালার জন্য।

এই যে অনিচ্ছাকৃত দাসত্বের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলছি, এটার কথা কিন্তু কুরআনে সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে—

"আল্লাহকে সেজদা করে যা কিছু নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে আছে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় এবং তাদের প্রতিচ্ছায়াও সকাল-সন্ধ্যায়।" [১৩:১৫]

ইদানিং আমি এই অনিচ্ছাকৃত দাসত্বের ব্যাপারটা নিয়ে খুব চিন্তা করছি। আমরা মুসলিমরা যদি এই ব্যাপারটাকে ইচ্ছাকৃত দাসত্বে পরিণত করতে পারতাম তাহলে মনে হয় আমাদের জীবনে যে শান্তির আশায় আমরা ছুটে চলেছি, সেটা পেয়ে যেতাম। এ ব্যাপারে কুরআনের নিচের আয়াতটা আমার কাছে খুব গভীর মনে হয়—

অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন যা ছিল ধুম্রকুঞ্জ, অতঃপর তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে আস ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা স্বেচ্ছায় আসলাম। [৪১:১১]

এখানে দেখুন যে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকে ‘অপশন’ দিয়েছিলেন ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত দাসত্বের। তারা বেছে নিয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে। একটু চিন্তা করলে দেখবো যে আল্লাহ আমাদেরকেও এই অপশন দিয়েছেন, কিন্তু মানুষই মনে হয় সেই বোকা সৃষ্টি যারা এই অনিচ্ছাকৃত দাসত্বের ব্যাপারটা বোঝে না, নিজেদের মহাজ্ঞানী ভাবে।

মানুষকে আল্লাহ একটা সীমার মাঝে স্বাধীনতা দিয়েছেন—ব্যাপারটা অনেকটা MCQ প্রশ্নের মত, অপশন আল্লাহ ঠিক করে দিয়েছেন, আমাদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছেন অপশন থেকে বেছে নেয়ার।

এই যে অপশন ঠিক করার স্বাধীনতা আল্লাহ আমাদেরকে দেন নাই, এটা হচ্ছে অনিচ্ছাকৃত দাসত্বের আরেকটা উদাহরণ যেটা আমরা অনেকেই বুঝি না, বুঝলেও মেনে নিতে পারি না। আমরা এটাও ভুলে যাই যে অপশনগুলো প্রতিটা মানুষের জন্য আলাদা। এজন্য আল্লাহর ন্যায় বিচারের যে দিকটা আমার সব থেকে ভালো লাগে, সেটা হল বিচারটা হবে customized. মানে আল্লাহ আমাকে বিচার করবেন আমার জীবনের কষ্ট, আমার জীবনের নিয়ামতগুলোর নিরীখে। অন্য কারোটা না। সেজন্যই বিচারটা হবে Just, ইনশাআল্লাহ।


নিজের ব্যক্তিগত জীবন থেকে একটা উদাহরণ দেই—সপ্তাহ খানেক আগে আমার পিএইচডি কোয়ালিফাইং পরীক্ষা শেষ হল। এই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার মত হাতে সময় থাকে ১.৫ মাসের মত, ৮টা কোর্সের উপর পরীক্ষা, ২ দিনে মোট ৯ ঘণ্টার পরীক্ষা। পড়া মোটামুটি গুছিয়ে এনেছিলাম, পরীক্ষার ঠিক ২০-২২ দিন আগে বিছানায় পড়ার মত অসুস্থ হয়ে গেলাম। শেষ মুহূর্তের যে প্রস্তুতি সেটাই নিতে পারলাম না, পরীক্ষা দিলাম মারাত্মক অসুস্থতার মধ্যেই, কারণ Attend না করার কোনো অপশন ছিলো না। এখন আমি এটা নিয়ে হাউকাউ করতে পারি যে কেন এই সময়েই এভাবে অসুস্থ হতে গেলাম ইত্যাদি অনেক কিছুই। কিন্তু আমি শান্ত ছিলাম আলহামদুলিল্লাহ। একবারের জন্যও এই ‘টাইমিং’ নিয়ে প্রশ্ন তুলি নি। কারণ আল্লাহ অনেক ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাকে শিখিয়েছেন যে উনার Timing is the best.

এরকম আরো বহু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ধরেন আল্লাহ আপনাকে সন্তান দিচ্ছেন না, কিংবা অনেক অল্প বয়সে আপনি বিধবা হয়েছেন, কিংবা কম বয়সেই কিডনী বিকল হয়ে গেছে And the list can go on and on. তখন আপনি অন্যের জীবনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারেন যে অমুকের জীবনটা কত perfect, আমার জীবনেই সব পরীক্ষা।

এমন সময়েই আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে প্রতিটা মানুষের জীবনের অপশনগুলো আলাদা। এটা নিয়ে ইবনুল কায়্যিমের একটা কথা আমার খুব ভালো লাগে—Any calamity that brings us closer to Allah are blessing in disguise, any blessing that takes us away from the remembrance of Allah are curse in disguise.

এখন জীবনের এই প্রতি পদে পদের অনিচ্ছাকৃত দাসত্বের ব্যাপারটাকে আমরা কিভাবে ইচ্ছাকৃত দাসত্বে পরিণত করতে পারি? আমার সীমিত জ্ঞান বলে যে আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ব্যাপারে সম্যক ধারণা অর্জন করা।

আমরা যত জানবো যে আল্লাহ কে, তত আমরা উনার নির্ধারণ করা ‘অপশনের’ উপর ভরসা করতে পারবো। বুঝবো যে উনি আমাকে সবচেয়ে ভালোবাসেন, যা কিছু হচ্ছে আমার সাথে, তা এক রাহমানুর রাহীমের ডিজাইন অনুযায়ী হচ্ছে। তাহলে মনে হয় বুকের ভিতর থেকে বলতে পারবো—আলহামদুলিল্লাহ :) আমরা বুঝবো যে আমি জিজ্ঞাসিত হব স্রেফ চেষ্টার জন্য, ফলাফলের মালিক আল্লাহ।

ও আর হ্যাঁ, যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম লেখাটা—কী সমস্যা ছিলো ওই নারীবাদী আদর্শে? আমার সীমিত জ্ঞানে মনে হয় যে ওরা মানুষকে এমন এক যুদ্ধের দিকে আহ্বান করে, যেই যুদ্ধে মানুষ কখনো জিততে পারবে না—কারণ আমরা অনিচ্ছাকৃত দাস।

তাই অনেক প্রথার বিরুদ্ধে গিয়েও তারা মনের শান্তিটা খুঁজে পায় না। এটা যখন আপনি বুঝবেন তখন আপনার মনে হবে না যে ছেলেরা কেন মেয়েদের দিকে তাকাবে। আপনি বুঝবেন যে ধুলা থেকে বাঁচার জন্য পুরা দুনিয়াটা চামড়া দিয়ে ঢাকার চাইতে নিজের পা জোড়াকে জুতা দিয়ে ঢেকে ফেলাটা যেমন বুদ্ধিমানের কাজ, সেরকম পুরা দুনিয়াকে চোখ নামাতে না বলে নিজেকে ঢেকে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ এবং বাস্তবসম্মত। উদাহরণটা হয়তো খুব সেকেলে হয়ে গেলো কিন্তু এই উদাহরণটা টানলাম কারণ এই পর্দা প্রথা নিয়ে নারীবাদীকে চুলকানীটা মারাত্মক রকমের বেশি। যখন একটা মেয়ে তথাকথিত স্বাধীন হতে চায় তখন এক অজ্ঞাত কারণে সেটার প্রকাশ ঘটে নিজেকে পুরুষের কাছে Available করে দেয়ার মাধ্যমে। আমরা ভুলে যাই যে যখন আমরা আল্লাহর দাসত্ব করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করি, তখন সেটা অবধারিতভাবে আমাদের সৃষ্টির দাসে পরিণত করে। তাই আমরা যখন পর্দা করি না তখন আমরা দাসত্ব করি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির। কোন ভাবে পোশাক পড়বো, শরীরের কোন অংশটা উন্মুক্ত থাকবে এটা নির্ধারণ করে ছেলেরা—তাদের যে অংশ দেখতে বেশি ভালো লাগে, সে অংশ যেন বোঝা যায়/দেখা যায়, সেভাবেই তারা পোশাক ডিজাইন করে.........এটা আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবো ততই আমাদের মঙ্গল And Allah knows the best.