আজকাল কোনো যুবক যদি আয়নায় তাকিয়ে চেহারায় সামান্য একটা পিম্পল কিংবা কোনো দাগও দেখে—সে আঁতকে উঠে। নিমিষেই তার মন খারাপ হয়ে যায়—হতাশ হয়ে পড়ে। অথচ আমার বন্ধু বাসিতের কাছে এটা হয়তো এমন কিছু যা নিয়ে তার ভাবারও সময় নেই। বাসিত EB (Epidermolysis Bullosa) নামের একটা রোগে ভুগছে, যার ফলে তার শরীরজুড়ে ঘা এবং চামড়ায় ফোস্কা তৈরি হয়। এই ঘা সহজে শুকায়ও না, তাই বাসিতকে এই ঘা সবসময় ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। এই রোগের আরেকটি নাম হলো "Butterfly Baby"। কারণ এই রোগের ফলে সারা শরীরে ঘা হতে থাকে, ফলে পুরো শরীর ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়—যা অনেকটা রেশমের গুটির মতো দেখায়।

এই অবস্থায় বেঁচে থাকা কতটা কষ্টের এমন প্রশ্নের জবাবে বাসিত বলেছে,

"এটা কঠিন, কারণ আমার শরীরের বেশিরভাগ অংশই মূলত অচল। ফলে সারাদিন আমাকে বিছানাতেই পড়ে থাকতে হয়। আমি সেভাবে কোনো কাজকর্মও করতে পারি না। মানুষ যেভাবে স্বাভাবিক হাঁটাচলা করে, দৌড়ায়—এসবের কিছুই আমি করতে পারি না। আমি শুধু দেখি আর ভাবি—ইশ! যদি আমিও এভাবে হাঁটাচলা করতে পারতাম!"

বাসিতের মুখে এই কথাগুলো খুব কষ্টের। এই রোগের জন্য যে চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে বাসিতকে যেতে হয় সেটা আরও কষ্টের। এটা তার জন্য আরেকটি পরীক্ষা। ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে কাটাতে হয় ব্যান্ডেজ কাটা, শরীরে মোড়ানো, ঘা এর স্থানে মলম লাগানোর কাজে। এ ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। এটাই তার নিত্যদিনের রুটিন। বাসিতের ভাষায়,

"আমাকে এভাবেই প্রতিটা দিন কাটাতে হয়। যদি আমি প্রতিদিন এটা না করি তাহলে ঘা পচে পুঁজ বের হয়, দুর্গন্ধ ছড়ায়। যেদিন আমি গোসল করি সেদিন এই কাজে আমার ছয় ঘণ্টায় মতো ব্যয় হয়। আর অন্যান্য দিনে সেটা চার ঘণ্টার মতো লাগে।"

বাসিত এভাবে প্রতিটি দিন কেমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায় সেটা সত্যি বলতে আমাদের কারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। আমি চিন্তাও করতে পারি না একটা মানুষকে প্রতিদিন এভাবে ঘন্টার পর ঘণ্টা বিছানায় পড়ে থাকতে হয়, তার শরীরে পচন ধরছে, তার হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে গেছে! অকল্পনীয়! বাসিতের এই দুর্বিশহ জীবন আমাকে নবি আইয়ুব আলাইহিসসালামের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনিও এমন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন—যার ফলে শরীরে পচন ধরেছিল। তাঁকে এভাবেই বিছানায় পড়ে থাকতে হতো, সমাজ থেকে তিনি আলাদা হয়ে পড়েছিলেন। এতকিছুর পরও তিনি ধৈর্যের উপর অটল ছিলেন, আশা হারাননি। এমন এক ধৈর্যের পরীক্ষায় আমাদের ভাই বাসিতকেও যেতে হয়, প্রতিদিন, প্রতিটি সময়।

এই অবস্থায় তোমার কাছে বিশ্বাসের গুরুত্ব কতটুকু? বাসিত বলেন,

"সত্যি বলতে বিশ্বাস ছাড়া এই জীবনের অর্থই বা কী? কী উদ্দেশ্য হতে পারে এই জীবনের? অন্তরে বিশ্বাস না থাকলে হয়তো কবেই আত্মহত্যা করে বসতাম! এভাবে প্রতিনিয়ত কষ্টের মধ্য দিয়ে যাওয়া, নিজের কষ্ট, আমার জন্য পরিবারের অন্যদের কষ্ট—এসবকিছু ভোগ করার পর যদি আখিরাতে আমার জন্য কিছু নাই থাকে তাহলে তো সবকিছু অর্থহীন। তাই বিশ্বাসই আমাকে টিকিয়ে রেখেছে। আমার এই সীমাহীন কষ্ট আর দুর্ভোগকেও অর্থবহ করেছে।"

ইসলাম দুনিয়াতে আমাদের এই দুঃখকষ্ট, বিপদাপদের সত্যিকারের উদ্দেশ্য বুঝতে সাহায্য করে, যা অন্য কোনোভাবে বোঝা সম্ভব নয়। দুনিয়াতে আজকের এই পরীক্ষায় ধৈর্যধারণ করো—আগামীকাল আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার বুঝে নাও। এই বিশ্বাসের উপর দৃঢ মনোবলই আমাদেরকে দুনিয়ার এই কষ্ট, পরীক্ষার সময় ধৈর্য ধরতে সাহায্য করে। আল্লাহ বান্দারা এই আশাতেই দাঁতে দাঁত চেপে টিকে থাকে। বাসিতের ভাষায়,

"যখন আমি আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে শুনি, আল্লাহর ওয়াদা সম্পর্কে জানি, তখন আল্লাহর সেই ওয়াদার জন্য এই কষ্ট, সংগ্রাম আমার কাছে সহজ হয়ে যায়। আমার বিশ্বাস আমাকে আশাবাদী করে তোলে। আমার এই বিশ্বাস কোনো কল্পনারাজ্য নয় অবশ্যই, আমি ইয়াকিনের সাথে বিশ্বাস করি। কিন্তু আল্লাহর পথে টিকে থাকার এই সংগ্রামে আপনাকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। ইনশাআল্লাহ রোজ হাশরের দিনে আমরা দুনিয়াতে আমাদের এই ধৈর্যের ফল পাব। এই বিশ্বাসটুকুই বলে দেয়—আমার এই জীবনের একটি উদ্দেশ্য আছে।"

জীবনের পথে বাসিতের এই অধ্যবসায় সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ী। সে জানে দুনিয়ার এই জীবনটা তার জন্য পরীক্ষা, আর এই পথে তাকে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে হবে।

দুই বছর আগে বাসিতের বড় ভাই মিলাদও এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এবং আল্লাহর ইচ্ছায় জীবনের এই কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে সে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। বাসিতের মতো তার ভাই মিলাদও একই রোগে ভুগছিল (EB), কিন্তু মিলাদের রোগের অবস্থা ছিল আরও খারাপ।

নিজের ভাইকে হারানো কতটা কষ্টের, এমন প্রশ্নের জবাবে বাসিত বলেন,

"এটা কঠিন। এ যেন নিজেরই একটা অংশ হারিয়ে ফেলা। আমি তার কাছ থেকে অনেককিছু শিখেছি। আমার চেয়ে তার অবস্থা আরও খারাপ ছিল। সত্যি বলতে আজকে আমার যা কিছু সহ্য ক্ষমতা আর ধৈর্য শক্তি তা আমার ভাইকে দেখেই হয়েছে। যখন আমি আমাদের দুজনের সীমাহীন কষ্ট আর দুর্দশার কথা মনে করি, আমি অনুভব করি যেন আল্লাহ আমাদের দুজনকে তার সমগ্র সৃষ্টি থেকে আলাদাভাবে বেছে নিয়েছেন। এ যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য বোনাস পয়েন্ট। আমার ভাইয়ের যে ধৈর্য আমি দেখেছি, ইনশাআল্লাহ আমি আশা করি আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তাকে জান্নাতে উঁচু মর্যাদা দান করবেন। যখন আমি তার কবরের কাছে যাই আমার মনে হয় তার জন্য আমরা কাঁদব কী, সেই যেন আমাদের জন্য কাঁদছে, কারণ এখনও আমরা দুনিয়ার এই পরীক্ষার শিকলে বাঁধা পড়ে আছি!"

এরকম কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়েও বাসিত দৃঢ়তার সাথে টিকে আছে, ভেঙে পড়েনি। শুধুমাত্র মানসিক দৃঢ়তাই নয়, তার প্রতিদিনের জীবনেও। এই অবস্থাতেও সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে, বন্ধুবান্ধব তৈরি করেছে, এমনকি উমরাহ সম্পন্ন করেছে। তবে তার এই কঠিন অধ্যবসায়ের আরও একটি গোপন রহস্য আছে। তার ভাষায়,

"দ্বীন অবশ্যই আমার এই জীবনের সবচেয়ে মজবুত ভিত্তি, কিন্তু আমার পিতামাতার ভূমিকাও এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আলহামদুলিল্লাহ আমার পিতামাতার জন্য, তাদের জন্য আমি শুধু এতটুকু বলতে পারি। কারণ তারাই আমার জীবনটাকে সহজ করেছে। তারা আছে বলেই আমাকে কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত হতে হয় না। আমাকে শুধু আমার নিজেকে নিয়ে, আমার এই রোগ আর এর আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়েই চিন্তা করতে হয়, এর বাইরে অন্য কোনোকিছু নিয়ে, এমনকি আমার পিতামাতাকে নিয়েও আমাকে ভাবতে হয় না। তারা কখনও অভিযোগ করেন না। যেন এসবকিছু খুবই স্বাভাবিক, তারা সবকিছুকে স্বাভাবিক বানিয়ে নিয়েছে। এজন্য আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।"

যদি তুমি তাদেরকে কিছু দিতে চাও, তাহলে কী দেবে? বাসিত বলেন,

"আমি সবসময় আমার পিতামাতার জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করি। আমার কারণে যদি আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত দেন, যদি জান্নাতে আমরা সবাই একত্রিত হতে পারি, এটাই হবে সবচেয়ে বড় পাওয়া, এটাই আমার পিতামাতার জন্য সবচেয়ে বড় গিফট।

আমি জানি এই দুনিয়ার জীবনটা একটি পরীক্ষা। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ, কারণ তিনি আমাকে এই সত্যটুকু বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন। আর সত্যিকারের জীবন তো শুরু হবে তখনই, যখন আমি আমার পরিবারের সাথে জান্নাতে মিলিত হবো।"

বাসিতের এই জীবনের গল্প আমাদের আধুনিক, যান্ত্রিক জীবনে সত্যিকারের ধৈর্যের উদাহরণ, যেখান থেকে আমাদের অনেককিছু শেখার আছে। আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করি, আল্লাহ যেন বাসিতকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত করেন, তাকে এমন দলে শামিল করে যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন, এবং তাকে রহমতের চাদরে ঢেকে রাখেন আমৃত্যু। আর দুনিয়ার ওপারে যে জীবনটা আছে, সেই আখিরাতে আল্লাহ যেন তাকে তার পরিবারের সাথে জান্নাতে একত্রিত করেন। আমীন।

"বলুন, হে আমার বিশ্বাসী বান্দাগণ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। যারা এ দুনিয়াতে সৎকাজ করে, তাদের জন্যে রয়েছে পুণ্য। আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। যারা সবরকারী, তারাই তাদের পুরস্কার পায় অগণিত।" (সূরাহ আয যুমার ৩৯: ১০)