আচ্ছালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।

প্রিয় আব্বু ও আম্মু কেমন আছো তোমরা?

জানি ভালো আছো তাই জিজ্ঞেস করা হয়না কখনও, কারণ সন্তানের ভালো থাকাই প্রত্যেক পিতা মাতার ভালো থাকার কারণ। আর আমি তোমাদের মত মা বাবা পেয়ে সত্যিই খুব গর্বিত, ধন্য। তাই আমাকে এই অশেষ নেয়ামত দান করায় মহা প্রতিপালক আল্লাহ সুবহান ওয়াতা'আলার নিকট শুক্রিয়া জ্ঞাপন করছি, আলহামদুলিল্লাহ্‌। হে আমার রব, আমার শিশুকালে আমার পিতা মাতা যে কষ্ট সহ্য করে আমাকে লালন পালন করেছে, আমার অতি বিপদসংকুল সময়েও আমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্য কোথাও যায়নি, অসহায় এই আমাকে সকল বাধার পথেও কোলে আগলে রেখেছে প্রতিটি মুহূর্ত, তাদের বৃদ্ধকালে তুমিও তাদের সেভাবেই লালন পালন করো। তাদের সকল গোনাহ মাফ করে জান্নাতে একত্রিত করো যেখানে চিরস্থায়ী শান্তি আর নহর প্রবাহিত হয় অমৃত পিপাস্যের।

হয়তো এভাবে কোন সন্তান তার পিতামাতার জন্য দোয়া করেনা, কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ্‌ আমি তোমাদের কাছ থেকে ছোট বেলা থেকেই এমনই এক পরিবেশ পেয়েছি যা আমাকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা হওয়ার পরম উৎসাহ জুগিয়েছে। যাবতীয় অশ্লীলতা আর অবৈধ কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকার সাহস ও শিক্ষা দিয়েছে। এটা আল্লাহর রহমত যে তোমরা আমাকে সেই শিক্ষাই দিয়েছো পরিবারে। সেই শিক্ষাকে সামনে রেখেই আমি আজ তোমাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে অবগত করার উদ্দেশ্যে এই বার্তা প্রেরণ করছি।

প্রত্যেক পিতামাতাই তাদের সন্তানদের ভালবাসেন। হয়তো তোমাদের মত এতো বেশি নয়, তবে কম হলেও ভালবাসেন। সন্তান পিতামাতার কাছে নিজের জীবনের চেয়েও মুল্যবান। সন্তানের খুশির জন্য মায়ের দীর্ঘদিন গর্ভের ঋণ শোধ করা যেমন অসম্ভব তেমনি পিতার অক্লান্ত পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থে যে জীবন অতিবাহিত করা হয় তার ঋণ শোধ করাও অসম্ভব। পিতা মাতা হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে বড় নিয়ামাত। সন্তানের সামান্য জ্বর মায়ের সারারাতের ঘুম কেড়ে নেয়, খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে সামান্য আঘাত যেন বিধে যায় বাবার কলিজায়। খাওয়া, পোশাক থেকে শুরু করে সন্তানের সবকিছুতেই চলে বাবা মায়ের চুড়ান্ত বাছাই ও বিচার। বেড়ে ওঠার জন্য হরলিক্স কমপ্লেইন থেকে শুরু করে নিয়মিত টিকাদান, ভাইটামিন সেবন সবই পিতামাতা সময়ের সাথে সাথেই করে থাকেন। অন্য পিতামাতাদের সাথে রীতিমত প্রতিযোগিতা করেই আগে টিকাদানের জন্য সন্তানকে নিয়ে হাজির হয়ে যান স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাতে কোন রোগ ব্যাধি সন্তানকে স্পর্শ করতে না পারে। সন্তানকে রোগ থেকে বাঁচার জন্য পিতামাতার কত চেষ্টা। শিশু হাসপাতালে গেলে বোঝা যায় মানুষের কাছে সন্তানেরা কত প্রিয় হয়ে থাকে। সন্তানের রোগে মায়ের কষ্ট, সন্তানের কষ্টে বাবার চোখে জল…।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে এইসব পিতামাতার দৃষ্টিভঙ্গি খুব বেশি দূরে নয়, সীমাবদ্ধতার আড়ালেই রয়ে যায়।

সন্তানের রোগ-মুসিবত, স্বাস্থ্য, লেখাপড়া, ক্যারিয়ার, ভবিষ্যৎ নিয়ে পিতামাতারা খুব চিন্তিত।

কিন্তু সন্তানের পরকাল নিয়ে পিতামাতারা চিন্তিত নয়…

কেন?

সন্তানের সামান্য জ্বর হলে মা সারারাত ঘুমাতে পারেন না, অথচ সেই সন্তান যখন কবরের কঠিন আজাবের দিকে এগিয়ে যায় তখন মায়ের কোন অস্থিরতা দেখা যায়না। খাবার সামান্য গরম হলেও ছেলের মুখে তুলে দিতে সাহস করেন না মা, অথচ সেই ছেলে জাহান্নামের কঠিন আগুনের দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মায়ের কোন চিন্তা নেই কিভাবে সে তা সহ্য করবে?

সন্তানের সামান্য স্বাস্থ্য খারাপ হলে, কিংবা পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে বাবা খাওয়া ঘুম ছেড়ে দিয়ে চিকিৎসার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে যান অথচ সেই বাবাই সন্তানকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। টিকার জন্য হাসপাতালে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা সেই পিতার কোন উদ্যোগ নেই যখন সন্তান ভুল পথে পা বাড়িয়ে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছে…।

পিতামাতারা শুধু দেখেন সন্তান ইহজগতে কতটা সুখী হয়েছে, কিন্তু দেখেন না সন্তান পরজগতে কতটা সুখী হবে…

কেন এই সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি…?

ঈমানের পরেই মানুষের সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদ হলো চরিত্র। চারিত্রিক পবিত্রতা ঈমানেরই অংশ। বর্তমান বেশির ভাগ পিতামাতাই তাদের সন্তানদের চরিত্র সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন। ছেলে-মেয়ে কখন কোথায় যায় কার সাথে কি করে এসবের কিছুই খেয়াল করেন না পিতামাতা। কেননা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেবল দুনিয়াকেন্দ্রিক, আল আখিরাহ কেন্দ্রিক নয়। যার কারণে চারিত্রিক গুণাবলীর কোন অংশই অর্জন করতে পারেনা এইসব সন্তান। হয়তো তারা লেখাপড়ায় ভালো কিংবা স্বাস্থ্যবান কিন্তু চরিত্রের বেলায় চারিত্রিক সার্টিফিকেট নিতে ঘুরতে হয় মানুষের দ্বারে দ্বারে…।

ইসলামের একটি মূল মিশন হলো চরিত্র হেফাজত করা। ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বের অশ্লীলতা, ব্যভিচার আর অবাধ যৌনতাকে কেন্দ্র করেই আল কুরআনে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে অনেক আয়াতে। এই চরিত্রকে হেফাজতের জন্য ইসলামিক শারিয়াহর একটি ফরজ বিধান হচ্ছে বিবাহ। বিবাহের মাধ্যমে মুসলিমরা নিজেদের চরিত্র হেফাজত করে থাকে।

কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, এই বিবাহ এখন আর ইবাদাত হিসেবে পালন করা হয়না, এটা আমাদের পরিচিত হয়ে গেছে সামাজিক অবস্থান পাকাপোক্ত করার একটি প্রথা হিসেবে। বিবাহ এখন শুধুই একজন পুরুষ আর একজন নারীর অবাধ যৌনতার লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই বিবাহ নিয়েও চলছে রমরমা ব্যবসা, চলছে তাগুতি আইনের ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র আর চলছে শিরকের মত জঘন্য অপরাধ। নাউজুবিল্লাহ।

বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী ১৮ বছর বয়সে নারী-পুরুষ নাগরিকত্বের অধিকার পায়। ভোটদানের সুযোগ পায় তথা একটি রাষ্ট্রের সরকার চয়নের মত বুদ্ধিমান হিসেবেই তাদের গণ্য করা হয়। কিন্তু বিবাহের ক্ষেত্রে নারীরা ১৮ বছর হলেও পুরুষদের ২১ বছর বয়সে বিবাহযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। ১৮ বছর বয়সে আমরা রাষ্ট্রের সরকার চয়নের যোগ্য হই কিন্তু জীবন সঙ্গী চয়নের যোগ্য হইনা! বাহ!

[যদিও সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ছেলে মেয়েদের বিবাহের ন্যূনতম বয়সসীমা কমিয়েছে। এই চিঠি বয়সসীমা কমানোর পূর্বে লেখা হয়েছে এজন্য এখানে এই তথ্যটি সংশোধন করা সম্ভব হয়নি বলে দুঃখিত।]

ইসলামের শারিয়াহগত বিধান অনুযায়ী একজন পুরুষ বা নারী তাদের জীবনের প্রথমে যৌবনেই বিবাহের উপযুক্ত হয়ে যায়। তাদের উপর বিয়ে ফরজ হয়ে যায়। হাদিসে বর্ণিত তথ্যানুযায়ী কোন পুরুষের স্বপ্নদোষ আর নারীর ঋতুস্রাবই তাদের বিবাহের জন্য উপযুক্ত প্রমাণ করে। অর্থাৎ প্রথম যৌবনে পদার্পণ করার সাথে সাথেই ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে নারী কিংবা পুরুষ উভয়েই বিবাহযোগ্য হয়ে যায়।

ইসলামের শারিয়াহ এর উপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিকভাবে হিসেব করে দেখা যায় বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশে পুরুষরা ১৭ বছর বয়সে পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে যায় আর নারীরা ১৫ বছর বয়সে পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে যায়।

অর্থাৎ ইসলাম বলছে, বাংলাদেশের ছেলেরা বিয়ে করবে ১৭ বছর বয়সে আর মেয়েরা ১৫ বছর বয়সে।

কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বলছে ছেলেরা ২১ আর মেয়েরা ১৮ বছরের আগে বিয়ে করতে পারবেনা! এটাকে তারা 'বাল্যবিবাহ' নাম দিয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি কারণ হিসেবে উল্ল্যেখ করে থাকে।

কি হাস্যকর! অথচ জনসংখ্যা বৃদ্ধির একমাত্র কারণ হচ্ছে অবৈধ সম্পর্ক আর অবাধ যৌনতা। এগুলোকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত না করে বিবাহের মত ফরজ ইবাদাতকে কলুষিত করেছে সংবিধান।

১৭ বছর বয়সী ছেলেকে বাধ্য করা হয় ২১ বছর পর্যন্ত আর ১৫ বছরের মেয়েকে ১৮ বছর পর্যন্ত। ছেলেরা ৪ আর মেয়েরা ৩ বছর পিছিয়ে পড়ে। শিক্ষাব্যবস্থাকে আবার এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে বিয়ের জন্য উপযুক্ত হলেও ঐ বয়সে বিয়ে করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা, ফলে ছেলে মেয়ে পিছিয়ে যায় আরও ৪ বছর। এরপর সমাজে তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগে আরও ২/৩বছর। এভাবে তাদের বয়স দাঁড়ায় ছেলেদের ২৭/২৮ আর মেয়েদের ২৪/২৫।

অথচ তাদের উপর বিয়ে ফরজ হয়েছিল অনেক আগেই। যে সময় তাদের একজন সঙ্গীর খুব প্রয়োজন ছিল সেসময় তারা তা পায়নি। মাঝখানে পড়ে রইলো দীর্ঘ এক সময়, ৭/৮ বছর।

কিন্তু এই মাঝখানের ৭/৮ বছর তারা কিভাবে কাটিয়েছে?

এই সময়গুলো তারা কিভাবে পার করেছে? সেই খবর কি পিতামাতা রাখে? পিতামাতা কি জানে তাদের আদরের সন্তান কখন কোথায় কার সাথে যায়, কী করে?

সামাজিক কারণেই এই সময়ে মানুষের একজন সঙ্গীর খুব প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন তারা হারাম সম্পর্কগুলোকে ঘিরে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। তারা তখন মোবাইল, ইন্টারনেটে প্রেম করে। গার্লফ্রেন্ড বানায়, বয়ফ্রেন্ড বানায়। বাবার কষ্টার্জিত টাকা উড়িয়ে দেয় তাদের পেছনে। বিলাসিতার ছোঁয়া পেয়ে যায় তাদের। পার্কে গিয়ে ডিস্কোতে গিয়ে নিজেদের উপভোগ করতে থাকে। ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি ও গল্পের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, এক পর্যায়ে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তারা। যিনা ব্যভিচারের চরম মাত্রায় পৌঁছে গিয়েও তারা ক্ষান্ত হয়না। এসব নিত্যনতুন সম্পর্ক আর প্রেম ভালবাসা নামক অশ্লীলতা নেশার মত গ্রহণ করতে থাকা তারা। সম্পর্ক ভাঙ্গলে ছেলেরা নেশা করতে শুরু করে, শারীরিক সম্পর্কের স্বাদ পেয়ে যায় তারা। তাই নিত্যনতুন সম্পর্কে জড়িয়ে নিত্যনতুন দেহের স্বাদ উপভোগ করতে থাকে। এভাবে তারা হয়ে ওঠে সভ্য সমাজের সুপ্ত পতিতা।

এইসব ছেলে মেয়েরা যখন বেশি বয়সে বিয়ে করে তখন তাদের আগের মতই 'ধরা ছাড়া' স্বভাব থেকে যায়। যার ফল আমরা দেখতে পাই পরকীয়ারূপে কেননা তারা একজনের প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে পারেনা। আবার অনেকের দাম্পত্যজীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ কেননা তারা বিয়ের আগেই কোথাও বিলিয়ে দিয়ে আসে নিজেকে ফলে এখন তাদের অক্ষমতা প্রকাশ পেয়ে যায় সমাজে। ফলশ্রুতিতে হারবাল কোম্পানিগুলো হুহু করে গজে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মত। কোনমত দাম্পত্য জীবনে কাটিয়ে উঠতে পারলেও তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয় কলোহ বিবাদ আর এই কুপ্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সন্তানেরা জড়িয়ে পড়ে অসামাজিক কার্যকলাপে।

এই সমস্যার একমাত্র সমাধান ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত সঠিক বয়সে বিবাহ দেওয়া। তাহলে মাঝের এই সময়ে সন্তানদের চরিত্র নষ্ট হওয়ার কোন সুযোগ থাকবেনা।

আমাদের সমাজের পিতামাতাদের দৃষ্টিভঙ্গী কতই না নিম্নস্তরে! সামান্য দুনিয়াবী রোগ-বালাই যাতে স্পর্শ করতে না পারে এজন্য সবার সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকাদানের জন্য এগিয়ে যেতে পারেন তারা, কিন্তু জাহান্নামের আগুন যাতে সন্তানকে স্পর্শ না করে এজন্য সবার সাথে প্রতিযোগিতা করে সঠিক সময়ে সন্তানদের বিবাহ দিতে পারেন না। কারণ আমাদের পিতামাতার দৃষ্টিভঙ্গি কেবল দুনিয়াকেন্দ্রিক। তারা শুধু সন্তানের পড়ে গিয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখে কাতর হতে পারেন কিন্তু সন্তানের ভেতরের চিৎকার, চরিত্র রক্ষার ব্যথাতুর আকুল আবেদন তাদের কানে পৌঁছে না। সন্তানের সামান্য জ্বর হলে তারা ঘুমাতে পারেন না কিন্তু সন্তানকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিয়ে তারা ঘুমন্ত রয়েছেন নির্বিঘ্নে।

আসলেই কি পিতামাতা সন্তানদের ভালবাসেন?

যদি সন্তানদের ভালোই বাসতেন তাহলে সন্তান নিশ্চিত জাহান্নামে যাচ্ছে জেনেও তারা পদক্ষেপ গ্রহণ না করে বসে থাকতে পারেন কিভাবে?

মা, তোমার কি মনে আছে? আমি যখন ছোট ছিলাম তখন জুমুয়ার দিনে আমাকে পাঞ্জাবী পরিয়ে সাজিয়ে দিতে। আমি তখন আব্বুর হাত ধরে মসজিদে যেতাম। তুমি বলতে '১০ বছর হলে নিয়মিত নামাজ পড়তে হবে।'

সেদিন আধো আধো বুলিতে আমি বললাম, 'কেন মা? তখন কেন?'

তুমি শুধু বলেছিলে 'বাবা, এটা ইসলামের হুকুম।'

আচ্ছা মা আমি কত বছর বয়সে নামাজ পড়বো এটা কে নির্ধারণ করে দেয়? বাংলাদেশ সরকার নাকি ইসলাম?

তাহলে আমি কত বছর বয়সে বিয়ে করবো এটা কে নির্ধারণ করবে? বাংলাদেশ সরকার নাকি ইসলাম?

নামাজের বেলায় আল্লাহর হুকুম মানবো আর বিবাহের বেলায় মানবো সরকারের হুকুম? ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন রবের ইবাদাত কেন করবো আমরা? কত বছর বয়সে বিয়ে করা ফরজ হবে এটা কি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআসসাল্লাম এর বাংলাদেশের আইনজীবীরাই বেশি বোঝে?

সেদিন যেভাবে শুধু 'এটা ইসলাম ইসলামের হুকুম' বলে নামাজের তাগিদ দিয়েছিলে সেভাবে ইসলামের আরেক ফরজ ইবাদাত বিবাহের তাগিদ তোমরা কেন দাওনা?

এক ইবাদাতের প্রতি বেশি গুরুত্ব আর আরেকটির কথা ভুলে গেলে? তাহলে আমিও একটি ভুলে যাওয়া আয়াত তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই,

"তোমরা এই কিতাবের একটি অংশের ওপর ঈমান আনছো এবং অন্য অংশের সাথে কুফরী করছো? তারপর তোমাদের মধ্য থেকে যারাই এমনটি করবে তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হবে এবং আখেরাতে তাদেরকে কঠিনতম শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে? তোমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আল্লাহ বেখবর নন।" [সুরা বাকারাহ, ৮৫]

আচ্ছা বাবা, তুমি কি জানো পিতামাতার প্রতি সন্তানের যেরকম কর্তব্য ও দায়িত্ব রয়েছে ঠিক তেমনি সন্তানের প্রতিও পিতামাতার কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।

হযরত ইবনে আব্বাস রাদি'আল্লাহু তাআলা আনহু ও আবু সাঈদ রাদি'আল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম বলেছেন, যার সন্তান জন্মগ্রহণ করবে যে যেন সন্তানের সুন্দর নাম রাখে, দ্বীনের সুশিক্ষা দেয় এবং প্রাপ্তবয়স্ক হলে বিয়ে দেয়। প্রাপ্তবয়সেও সন্তানের বিয়ে দেওয়া না হলে এই সন্তানের দ্বারা কৃত সকল পাপের শাস্তি পিতামাতাও ভোগ করবে। (বায়হাকী)।

অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম বলেছেন সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য ৪টি। সন্তান জন্মের পর কানে আজান দেওয়া, সুন্দর একটি নাম রেখে আকিকাহ দেওয়া, দ্বীনের সুশিক্ষা দেওয়া এবং প্রাপ্তবয়সে বিবাহ দেওয়া।

অথচ আমাদের সমাজের পিতামাতার কাছে সন্তানের প্রতি দায়িত্ব মনে হয় 'জন্মের পরই নিজের ওজনের চেয়ে বেশি ওজনের স্কুল ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে দেওয়া, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানানো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।' অথচ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম দেওয়া বিধানকে মানতে তোমাদের আপত্তি কেন?

পিতামাতার সামান্য অসচেতনতায় সন্তান তো বটেই সাথে পিতামাতাও জাহান্নামী হচ্ছে, এটা পিতামাতারা ভেবে দেখেনা। আল্লাহ বলেন,

'হে ইমানদারগণ, তোমরা ও তোমাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও যার ইন্ধন বা জ্বালানী হবে মানুষ এবং পাথর।' [সুরা আত-তাহরীম : ৬]

ব্যভিচারের শাস্তি কি?

ইসলামী শারিয়াহ অনুযায়ী ব্যভিচারের শাস্তি ইহকাল ও পরকালে দুই জায়গাতেই নির্ধারিত করা হয়েছে। শারিয়াহ বোর্ডের আওতায় বিবাহিত পুরুষ বা নারীকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করতে হবে আর অবিবাহিতদের দোররা বা ১০০ বেত্রাঘাত করতে হবে। আর এই শাস্তি প্রয়োগে কোন অনুকম্পা প্রদর্শন করতেও কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন আল্লাহ সুবহান ওয়াতা'আলা।

যে ব্যক্তি লজ্জাস্থানের নিশ্চয়তা দিবে আলাহ্‌র নবী সাঃ তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দিবেন।

ব্যভিচারের শাস্তি কি শুধুই ব্যভিচারী কিংবা ব্যভিচারিণী পাবে? —না। বিয়ের বয়স হওয়ার পরেও কোন পিতা মাতা যদি সন্তানদের বিয়ে না দেয়, আর ঐ সন্তান যদি ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তবে এর সকল দায় পিতামাতার। ঐ একই পাপের ভার বহন করতে হবে পিতামাতাকে, এবং তাদের জন্য আল্লাহ কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। নাউজুবিল্লাহ।

হয়তো বুঝতে পারছো কি বোঝাতে চাইছি এই চিঠিতে। এর আগেও অনেকবার বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, সময় পরিস্থিতি কিংবা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে বলা সম্ভব হয়নি। আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি। আর একথা বলতে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই কেননা আমি জানি আমি কোন হারাম কাজ করছিনা। আমার বয়স এখন ১৯, এই বয়সী কোন ছেলে যদি গার্লফ্রেন্ড নিয়ে রিকশায় চাপাচাপি করে ঘোরে তখন সমাজ বাহবা দেয়, বলে 'আধুনিক ছেলে মেয়ে তো!' এতে সমাজের কোন বাধা নেই, পিতামাতাদের কোন লজ্জা নেই। অথচ আমার বয়সী কোন ছেলে যদি হালালভাবে বিয়ে করে তাহলে এই সমাজের মানুষ তাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখে। পিতামাতারা লজ্জায় সমাজে মুখ দেখান না। সবার একটা খারাপ ধারণা থাকে 'এই ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে', অনেকে ভাবে 'মনে হয় কারও সাথে ধরা পরেছে এজন্য দ্রুত বিয়ে দিয়েছে!' বাল্যবিবাহ নামক ইসলামবিরোধী একটি আইন তৈরি করে তারা মুসলিম তরুণদের চরিত্র নষ্ট করার কার্যে লিপ্ত।

বাহবা এমন এক সমাজে বাস করছি যেখানে হারাম কাজের জন্য পুরস্কার আর হালাল কাজের জন্য জবাবদিহিতা করতে হয়। আমি যখন জীবনের প্রথম দাড়ি রেখে দিই তখন সমাজ থেকে অনেক বাধা এসেছে, সমাজের চোখে আমি হয়ে গেছি 'খারাপ'। কিন্তু আল্লাহ সুবঃ যার ইজ্জত বাঁচাতে চান তাকে আর কে বেজ্জতি করতে পারে? আল্লাহ চাহে তো বিবাহের ক্ষেত্রেও সেটাই হবে।

বাবা, মা মনে রেখো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদাত, সমাজের মানুষের সন্তুষ্টির জন্য নয়। সমাজের মানুষ কখনই সঠিক সিদ্ধান্তের কথা বলেনা।

এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

'হে নবী, যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কথার অনুসরণ করেন তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা তো কেবল অনুমান নির্ভর কাজ করে ও অনুমান নির্ভর কথা বলে।' [সুরা আন'আম:১১৬ ]

আচ্ছা বাবা তুমি কি এই ভেবে চিন্তিত যে আমি বিয়ে করে কি খাওয়াবো?

বাবা যদি তোমার একটি সন্তান বেশি থাকতো তাহলে কি তুমি তার ভরণ পোষণ করাতে পারতেনা? সকল জীবের রিজিকের দরজা কেবল আল্লাহ সুবহান ওয়াতা'আলার নিকটই। বিবাহের মত পবিত্র একটি ইবাদাতে আজ পর্যন্ত কারও রিজিক বন্ধ হয়নি, হবেও না ইনশাআল্লাহ্‌।

বাবা তুমি কি সেই আয়াতের কথা ভুলে গেছো, যে আয়াতে আল্লাহ নিজে বিবাহিতদের জন্য তাঁর দয়ার ভান্ডার খুলে দিতে চেয়েছেন?

"আর বিয়ে দিয়ে দাও তোমাদের মধ্যের যারা অবিবাহিত, আর তোমাদের দাসদের ও তোমাদের দাসীদের মধ্যের সচ্চরিত্রদের। যদি তারা অভাবগ্রস্ত হয় তবে আল্লাহ্ তাঁর করুণাভান্ডার থেকে তাদের সম্পদ দান করবেন। আর আল্লাহ্ মহাবদান্য, সর্বজ্ঞাতা।" [সুরা আন-নুর: ৩২]

বাবা, ওয়াদা পালনে আল্লাহ সুবহান ওয়াতা'আলার চাইতে কে বেশি নির্ভরযোগ্য? কে বেশি দায়িত্বশীল? আল্লাহ নিজে যেখানে বিবাহিতদের জন্য দান করতে চান সেখানে আমরা কেন ভয় করবো? বিবাহের পর একজন স্ত্রীর দায়িত্ব একজন স্বামীর কাধে চলে আসে, তখন আল্লাহ তাদের উভয়ের রিযক এর বরকত বাড়িয়ে দেন। এটা আল্লাহর সাহায্য, যেমনভাবে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।

"হযরত আবু হুরাইরা রাদি'আল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম বলেছেন, তিন ব্যক্তিকে আল্লাহ সুবহান ওয়াতা'আলা নিজে সাহায্য করেন। এক ব্যক্তি হচ্ছে যে, যে নিজের চরিত্র হেফাজত করার জন্য বিবাহ করে, দ্বিতীয় ব্যক্তি হচ্ছে সে যে গোলাম মুক্তিলাভের জন্য লিখিত আবেদন করে আর তৃতীয় ব্যক্তি সে যে আল্লাহর পথে জ্বিহাদের জন্য বের হয়।" [সুনানে আত-তিরমিযী, সুনানে আন-নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমাদ, হাদিসটি সহিহ)]

মা, তুমি কি তোমার সন্তানের কম বয়সে বিবাহ দিতে লজ্জা পাচ্ছো? এখন আমার বিয়ে দিলে তোমাদের লজ্জায় নাক কান কাটা যাবে?

আচ্ছা মা সবার সন্তান তো স্বাভাবিক ভাবে জন্ম লাভ করেনা। কেউ কেউ অস্বাভাবিক হয়ে জন্মায়, প্রতিবন্ধী কিংবা মানসিক রোগী হয়ে। অনেকের সন্তান কঠিন দুরারোগ্যে ভোগে।

তখন কি সেই পিতামাতা সন্তানের কারণে সমাজে মুখ দেখাতে লজ্জা পান? কেন পাননা?

তাহলে আমার মত সুস্থ সন্তানের জন্য তোমরা কেন লজ্জা পাচ্ছো? আমি তো মানসিক বিকারগ্রস্তও নই আলহামদুলিল্লাহ্‌। লজ্জা তো তাদের পাওয়া উচিৎ যারা সন্তানদের বিবাহ দিতে পারেনি, এই সময় তাদের সন্তান ব্যভিচারে লিপ্ত হবে হারাবে চরিত্র। লজ্জা তো তাদের পাওয়া উচিৎ যাদের সন্তান দ্বীনের আলো না পেয়ে অন্ধকারে নিজেদের ধ্বংস করছে।

চরিত্র হেফাজতের মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি। কেননা অধিকাংশ মানুষই বদ চরিত্রের কারণে জাহান্নামী হবে। চারিত্রিক পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ আর আল্লাহ পবিত্রতা ভালবাসেন।

তোমরা হয়তো ভাবছো সমাজ কি বলবে?

আমাদের সমাজের আশে পাশে অনেকেই প্রেম নামক হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে পিতামাতাকে কষ্ট দিয়ে, পিতামাতার মান সম্মান ধুলোয়ে মিশিয়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। তাদের কাছে পিতামাতার ১৮/২০ বছরের ভালোবাসার চেয়ে সামান্য ক'দিনের পরিচয়ের নারী কিংবা পুরুষই বেশি কাছের হয়ে যায়। তখন সেইসব পিতামাতারা কি সমাজের বাহিরে চলে যান? তারা কিভাবে মুখ দেখান?

আলহামদুলিল্লাহ্‌ আমার এরকম কোন হারাম সম্পর্ক নেই কিংবা আমি এই ধরনের অনৈতিক কাজের সাথে জড়িত হবোও না ইনশাআল্লাহ। আমি আমার পিতামাতাকে আল্লাহর জন্য অনেক বেশি ভালোবাসি আর ভালোবাসি বলেই তাদের কষ্ট দিতে চাইনা। চাইনা সমাজে তাদের মাথা নিচু হয়ে যাক। সমাজে তারা যেন গর্ব করে চলতে পারে এজন্যই হারাম কাজকে দূরে সরিয়ে বিবাহের মত পবিত্র ফরজ ইবাদাতকে বেছে নিতে চাই।

একমাত্র সৎ সন্তানের দোয়াই মৃত্যুর পরও মা বাবার জন্য কাজে লাগে। আর চারিত্রিক পবিত্ররা ছাড়া ঈমান সম্পূর্ণ হয়না, দ্বীন পূর্ণ হয়না।

মা, বাবা তোমরা আমাকে ছোট থেকেই যে সুশিক্ষা দিয়েছো তা নিঃসন্দেহে কল্যাণকর। তোমরা আমার চেয়ে জ্ঞানী। আমি জানি তোমরা আমাকে ভালোবাসো আর আমাকে জাহান্নামের আগুনে দেখতে পছন্দ করবেনা। আমিও আল্লাহর জন্য তোমাদের ভালোবাসি। এই পৃথিবীতে তোমাদের চেয়ে আর কে আপন আছে? তোমাদের ছাড়া আর কাদের কাছে এই আর্জি করবো? আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমরাই আমার অভিভাবক। তাইতো আমার এই আকুল আবেদন শুধু তোমাদের কাছেই। সমাজের দিকে না তাকিয়ে বরং আমার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমার চরিত্র রক্ষার সুযোগ দাও। আমি চাই ছোটবেলা যেভাবে আমার জন্য উত্তম খাবার, পোষাক কিংবা প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাছাই করতে ঠিক তেমনি আমার চরিত্র হেফাজতের জন্য, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, আমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য তোমরাই একজন উত্তম দ্বীনি জীবনসঙ্গী বাছাই করে দাও। আমি হয়তো তোমাদের চেয়ে উত্তম কিছু বাছাই করতে পারবোনা, এজন্য আমি তোমাদের অপেক্ষায় রইলাম।

হে আল্লাহ, আমার পিতামাতা যেভাবে আমাকে ইহকালে লালন পালন করেছে, পরকালের সুখের জন্য যারা চিন্তা করেছে তাদের তুমি ইহকাল ও পরকাল উভয়কালেই উত্তম মর্যাদায় ভূষিত করো। তাদের সকল গোনাহ মাফ করে জান্নাতুল ফিরদাউসে একত্রিত করো। আমাদের সবাইকে ইসলামের সত্য সুন্দর জীবনব্যবস্থা গ্রহণের তাউফিক দাও—আমীন।