উৎসর্গ

সব গল্প উপন্যাসে উৎসর্গ বিষয়টা থাকে। আমার এই গল্পেও থাকা উচিত। গল্পকাররা তাদের প্রিয়জনকে উৎসর্গ করেন, প্রিয়জন খুশিতে আটখানা হন। তবে সবসময় খুশির ব্যাপারটা ঘটেনা। হুমায়ুন আজাদ একবার একটি বই হুমায়ুন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলন কে উৎসর্গ করলেন, বইয়ের নাম সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। যাদেরকে উৎসর্গ করা হলো তারা খুশি হননি, কারণ এতে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে। বিপরীতে ইমদাদুল হক মিলন হুমায়ুন আজাদকে একটা বই উৎসর্গ করলেন, নামঃ বনমানুষ। পাঠক কি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ধরতে পেরেছেন?

উৎসর্গ নিয়ে কুর’আনে একটা লাইন আছে, “বল, নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ’র জন্য।” [সূরা আল-আন’আম (৬): ১৬২]

মূল কাহিনী শুরু করা যাক, ৪, ৩, ২, ১ …

রাত সম্ভবত ১২ টা কি এর চেয়ে কয়েক মিনিট বেশি। ভাইয়া সচরাচর ঘুমিয়ে যান ১০ টার মধ্যে। কয়েকমাস আগে আমার আর ভাইয়ার রুম আলাদা হল, রুম আলাদা করার তাগিদটা দিয়েছেন ভাইয়া। একটা নির্দিষ্ট বয়স পরে বাবা মার উচিত সন্তানদের জন্য পৃথক রুমের ব্যবস্থা করে দেয়া। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি আমার জন্য আলাদা একটা রুমের ব্যবস্থা করিয়েছেন। একলা রুমে থাকার উপকার ও অপকার দু’টোই আছে।

আমার ক্ষেত্রে অপকারটা বেশি মনে হচ্ছে। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় এই বুঝি সাদা আস্কান পরা ভূত এসে হাজির হল। কয়েকদিন আগে তো সারারাত জেগে ছিলাম, পাশের বাসায় জিন নামানোর কাজ হচ্ছিল। কাজ শুরু হয়েছিল সন্ধ্যা থেকেই। কী যে বিশ্রী গন্ধ। জিন আসার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। ছোট বেলায় কুকুরকে আগ্রহ সহকারে মানুষের মল খেতে দেখেছি, জিনও কি মানুষের মল খায়? ভাইয়ার সাথে এই বিষয়ে কথা বলার দরকার ছিল, কিন্তু এখন আর সম্ভব না। উনি মিন্টু রোডের ডিবি অফিসে। ডিবি অফিসে কীভাবে গেল তা পরে বলি, আগে আমাদের পরিবারের সদস্যদের বিবরণ দেই।

ভাইয়া

অতি সুদর্শন যুবক। দাড়ি রাখার আগে তাকে পিচ্ছি বাচ্ছা ছেলে মনে হত, দাড়ি রেখে যুবক হয়েছেন। মেয়েদের পটল চেরা চোখ হয়, ইরিনার পটল চেরা চোখ। আমার ভাইয়ারও পটল চেরা চোখ। তার চুল দাড়ি উভয়ই সোনালি রঙের। ভাইয়া আমার মা বাবা কারো মতোই হননি। আমরা দু’ভাই একসাথে দাড়ালে বোঝার উপায় নেই যে আমরা সহোদর। ভাইয়া আমার মা বাবার ৩য় সন্তান, ১ম জন জন্মের দু ঘন্টার মধ্যে মারা গেছেন, ২য় জন দুমাস পরে। ভাইয়ার জন্ম হল ঈদের দিন, কোরবানির ঈদ এর সকালে। আত্মীয়-স্বজনরা সব দেখতে এলেন, রনির নাকি ছেলে হয়েছে। রনি আমার মায়ের নাম, সঠিক উচ্চারণ রানু। নাম বিকৃতি করার একটা সংস্কৃতি এই দেশে লালন করা হয়, তার সুবাদে রনি। ছেলেকে দেখে সবার অনুভূতি দু’টো লাইনে শেষ হচ্ছিল। এক: ছেলেতো এক্কেবারে রাজপুত্তুর। দুই: বাবা মা কারো মতোই ছেলে হয়নি। ২য় মন্তব্যটি শুনে মা বিব্রত হতো। এখনো হন। ভাইয়ার নাম রাখা নিয়ে শুরু হলো ২য় পর্ব। বাড়ির মুরুব্বিরদের থেকে বলা হলো, নাম রাহো ফকীর। যাদের সন্তান মারা যায় তারা সাধারণত সন্তানের নাম ফকির রাখে। এই বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে ফকির-মিসকিন নাম রাখলে আর মারা যাবেনা।

আমার বাবা অনেকটা নাস্তিক টাইপ মানুষ, তিনি কুসংস্কারে বিশ্বাসী না বলে ২য় সন্তানের নাম রেখেছিলেন শুভ্র। মূল নাম, ডাকনাম একটাই শুভ্র। ৩য় সন্তান এর ব্যাপারে বাবা কোন মতামত দিলেন না। বাধা হয়ে দাড়ালেন আমার মা, এতো সুন্দর ছেলের নাম হবে ফকির তা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। ভাইয়া ফকির মিসকিন হলেন না, হলেন আরিফ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খ-ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে অর্থনীতি নিয়েছেন। ভর্তি পরীক্ষায় যারা প্রথম হয়, তারা শেষে ক্লাসের সর্বনিম্ন পজিশন নিয়ে শেষ করে। ভাইয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে ব্যতিক্রম। ভাইয়া আলবত প্রথম আছেন। কিছুদিনের মধ্যে তার মাস্টার্সও শেষ হওয়ার কথা।

এতক্ষণ যা বললাম, তা হলো ভাইয়া সম্পর্কে প্রি-ইন্ট্রোডাকশান। এখন মূল পরিচয়। ভাইয়া অতি ধার্মিক। ভাইয়ার অতি ধার্মিক হওয়ার আরম্ভ হয় অনেক আগে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির আগে। আমি আর ভাইয়া একই রুমে থাকার সুবিধার্থে ব্যাপারটা আমার দৃষ্টিগোচর হয়। আমার বাবা মায়ের দৃষ্টিগোচর হয় একটু দেরিতে, যখন ভাইয়া দাড়ি রেখে দেয়েছিল তখন। মা বিষয়টা খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছেন, বাবা শুরুতে একটু চিন্তায় ছিলেন। বাবার চিন্তা আরো বেড়ে গেল সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায়। আলু পটলের পাশাপাশি দেশে জঙ্গিবাদের বাম্পার ফলন হচ্ছে। বাবার চিন্তা বেশি দিন স্থায়ী হলোনা, ছেলে নিয়মিত পরীক্ষায় ফার্স্ট হচ্ছে, যে ছেলে ভালো রেজাল্ট করে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করা যায়না। ভাইয়ার অতি ধার্মিকতার কিছু পরিচয় দেই। প্রতিরাতে না হলেও বেশিরভাগ রাতেই ভাইয়া তাহাজ্জুদ পরেন। প্রায়ই নফল রোজা রাখেন। আমাদের দেশে যেখানে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পরলেই ধার্মিকতার সর্বোচ্চ লেভেল মনে করা হয়, সেখানে তাহাজ্জুদ আর নফল রোজাকে ‘অতি ধার্মিকতা’ বলা যুক্তিযুক্ত।

ভাইয়ার কাছে একগাদা ধর্মীয় বই। কুর’আন হাদীসের বাইরে যে এতো ধর্মীয় বই আছে তা আমি জানলাম ভাইয়ার সাথে থেকে। ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি ভাইয়ার আরেকটি বিষয়েও অগাধ জানাশোনা, তা হলো এস্ট্রনোমি। এস্ট্রনোমিকে অবশ্য ভাইয়া ধর্মের সাথে লিংক করে নিয়েছেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা যতো জানবো ততোই বুঝব আমরা আল্লাহ’র সৃষ্টির সামনে কিছুইনা, একটা বিন্দুও না। প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভাইয়ার সাথে এই গল্প হতো, মহাবিশ্বের গল্প। ভাইয়া বক্তা, আমি শ্রোতা। মহাবিশ্ব নিয়ে আমার জ্ঞান শূন্যের কিছু ওপরে। শূন্যের কিছু ওপরে উঠেছে ভাইয়ার বক্তৃতা শুনে। একদিন ভাইয়া বললো, ‘আচ্ছা বলতো চাঁদটা যদি না থাকতো তবে কি হতো?’

আমরা চাঁদকে দেখতে পেতাম না। চাঁদ মামা নিয়ে যেসব ছড়া কবিতা লেখা হয়েছে তা হতোনা। পূর্ণিমা, আমাবস্যা বলে কিছু থাকতো না।

সেটাতো অবশ্যই। তবে আমার খুব খারাপ লাগতো কারণ সমুদ্রের জোয়ার দেখতে পেতাম না। তবে একেবারেই যে জোয়ার হতোনা তা না, কিন্তু এর শক্তি অনেক কম থাকতো। পৃথিবীতে জোয়ার ভাটা হয় মূলত চাঁদের কারণে, সূর্যের ভূমিকা খুবই কম। চাঁদ, পৃথিবী, আর সূর্যের অবস্থান এমন দূরত্বে যাতে আমরা সমুদ্রের জোয়ার উপভোগ করতে পারি, পূর্ণিমা দেখতে পারি, চন্দ্রগ্রহণ দেখতে পারি, সূর্য গ্রহণ দেখতে পারি। চাঁদ আর সূর্য গুলো নিশ্চয়ই নিজে নিজে এসে এমন দূরত্বে বসেনি যাতে মানুষ সমুদ্রের জোয়ারের ঢেউতে খেলা করতে পারে!

অবশ্যই না।

একজন মহাপ্রতাপশালী স্রষ্টা এগুলো এইভাবে সৃষ্টি করেছেন, দূরত্বে বসিয়েছেন। সুনিপুণ কারিগর তিনি।

এই হতো ভাইয়ার সাথে আমার ঘুমপূর্বক কথোপকথন। কথোপকথন যদিও সবসময় একবিন্দুতে এসে শেষ হতো, কিন্তু বিরক্তি উদ্রেককর হতোনা।

মা

আগেই বলেছি, আমার মায়ের নাম, রানু। নানাবাড়ির লোকরা বলে রনি। সেই সুবাদে দাদাবাড়ির লোকরাও অনেকে রনি বলে। অতি সুন্দরি মহিলা বলা যাবেনা। তবে বিশ্রীও বলা যাবেনা। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ। পড়াশোনা ক্লাস নাইন পর্যন্ত। বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পড়াশোনা করতে পারেননি। বর্তমানে দুইজন জীবিত ছেলের জননী। একজন হবু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আরেকজন হবু ব্যাংকার। বাবা’র একবন্ধু কোন এক ব্যাংকের উপরের পদে। পদটির নাম ভুলে গেছে। S দিয়ে শুরু, SVP অথবা SVEP টাইপ কিছু হবে। প্রথম অক্ষর মানে সিনিয়র তা বুঝলাম, পরেরগুলোর অর্থ জানিনা। বাবা আমার জন্য টাকা জমানো শুরু করেছেন, আনুমানিক ১০ লক্ষের মতো টাকা লাগবে। অন্য কেউ হলে ১৫ দিয়েও হতোনা, বন্ধুর ছেলে হিসেবে আমার জন্য ৫ লক্ষ ছাড়। এতেই বাবা খুশি, ছেলের একটা গতি হবে, আর কি চাই!

বাবা

৮০’র দশকে বিএ পাশ চাট্টি খানি কথা না। বাবা বিএ পাশ করার পর দাদা লংকাকান্ড করেছেন। আস্ত একটা গরু জবাই করে সবাইকে খাইয়েছেন। দাদা যদি জানতেন বাবা একসময় পরিবার নিয়ে ঢাকা এসে উঠবেন, গ্রামে রেখে আসা বাবা মার জন্য মাঝে মধ্যে কিছু হাত খরচ পাঠিয়েই ছেলের দায়িত্ব শেষ করবেন, তবে গরু জবাই করতেন কিনা কে জানে। বিএ পাশ করার পর তার ব্যাংকে চাকরি হয়েছে। বাবা নিজেকে প্রগতিশীল হিসেবে ভাবতে ভালোবাসেন। টেলিভিশনে খবর দেখতে দেখতে মাঝে মধ্যে ভ্রু কুঁচকে ফেলেন, দেশটা এই বুঝি রসাতলে গেল। বাবা কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না। তবে মনের অজান্তেই কিছু ধারণা পোষণ করেন বলে আমার ধারণা। প্রথম ধারণা: তার পিতার অভিশাপে তার প্রথম দু’সন্তান অকালে মারা গেছে। ২য় ধারণা: ফকীর মিসকিন নাম এর বোধহয় কোন অদৃশ্য শক্তি আছে। আরেকটি বিষয় বাবার মধ্যে প্রবল তা হলো ভূতের ভয়। বাবার ধারণা আমাদের ঘরে একটা ভুত আছে। সাদা আসকান পরা ভূত। গত কয়েকবছর ভূতটাকে আর দেখা যাচ্ছেনা, মানে বাবা দেখতে পাচ্ছেন না। ভাইয়া অতি ধার্মিক হওয়ার পর ভূত পালিয়েছে। সাদা আসকান মনে হয়ে ভাইয়াকে দিয়ে গেছেন। ভাইয়া সাদা আসকান টাইপ জুব্বা মাঝে মধ্যে পরেন। ভাইয়া’র অতিধার্মিক হওয়ার সাথে সম্পর্কিত এই একটা বিষয়েই বাবা খুশি। সাদা আসকান পরা ভুত বাড়ি ছেড়েছে।

আমি

আমার সম্পর্কে এতক্ষণে অনেক কথা বলে ফেলেছি। যেইটা বলিনি তা হচ্ছে, আমি দু’বার পরীক্ষা দিয়ে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করেছি। বাবা অনেক কষ্ট করে ঢাকার একটা কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। কিছু দিন আগে তৃতীয় বর্ষ শেষ করেছি। আমি আমাদের পরিবারের একমাত্র শ্রোতা। ভাইয়া, বাবা এবং মা তিনজনই বক্তা। তবে ভাইয়া আমাকে কথা বলার ফ্লোর দেন, বাবা একদমই দেননা। মায়ের কথার টপিক তার বাবা বাড়ির কিচ্ছা কাহিনী, ইচ্ছা করেই আমি ফ্লোর নেইনা। ভাইয়ার রুমে থাকতে চার ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম, এখন তিন ওয়াক্ত। ধর্ম বিষয়ে আমার পড়াশোনা ‘ইসলাম শিক্ষা’ নামক বই পর্যন্ত। অতি সম্প্রতি একটা বই পড়ছি, বইয়ের নাম Qadar: The Predestination, ইংরেজী বই, ফিলসপি টাইপের বই, লেখকের নামও ঐরকম, ডঃ ফিলিপ্স। ভাইয়া বলেছেন এই বই প্রথমবার পড়ে তুই তেমন কিছু বুঝবিনা। কয়েকবার পড়বি। আমার এখন ২য় বার চলছে। আমার ধারণা আরো ৫ বার পড়তে হবে।

ইরিনা

ইরিনা আমাদের পরিবারের কেউ না। কিন্তু তার পরিচয় দিতে আমি অতি ইচ্ছুক। অতি বড়লোকের আদুরে মেয়ে। তার সাথে পরিচয়টা আমার বাংলা ছবির নায়কের মতো। শাহাবাগে আন্দোলন করছি, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন। ছেলেপুলেরা গাড়ির লাইসেন্স চেক করছে। লাইসেন্স পাওয়া না গেলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। একেক জনের জন্য একেক ব্যবস্থা। ইরিনা তার গাড়ি নিয়ে পড়েছে বিপদে, লাইসেন্স পাওয়া গেলনা। কিছু অতি উৎসাহী ছেলে পুলে গাড়ি ভাঙ্গতে উদ্যত হলো, সব আন্দোলনেই অতি উৎসাহী পাবলিক থাকে। এদের প্রথম কাজ গাড়ির গ্লাস ভেঙ্গে দেয়া। ইরিনার গাড়ির পিছনের কাচ ভাঙ্গা হয়েছে। গাড়ি না বলে প্রাইভেট কার বলা উচিত, গাড়ি শব্দটা বাস ট্রাক এর জন্য। আমি নায়কের মতো আবির্ভূত হলাম। বাংলা ছবির নায়কঃ সাকিব খান। সাকিব খান দু’হাত তুলে বলবে থাম! অমনিতেই সাইড এক্টররা থেমে যাবো। বাস্তবে তা হলোনা। আমার দিকে কয়েকজন তেড়ে এলো। আমার পক্ষেও দাঁড়িয়ে গেল কয়েকজন। দু’দল তৈরী হল। একদল গাড়ি ভাঙ্গার পক্ষে। অন্যদল পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে। গাড়ি শাহবাগ থানায় রাখার মাধ্যমে কার্য সমাধা হল। আন্দোলন শেষে নিরাপদ সড়ক পাওয়া গেলনা, ব্যক্তিগতভাবে আমি পেয়েছি ইরিনার মোবাইল নম্বর।

আমি এখন ইরিনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। ইরিনা একদিন আমাদের বাসায় এলো। সবাই খুশি হলো, ভাইয়া ছাড়া। ইরিনা ব্যাপারটা বুঝতে পারলো।

আমাকে বললো, তোমার ভাইয়া কি হুজুর?

হুজুর কিনা বলতে পারবোনা। ঢাবি’তে পড়ে। শিক্ষক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। চেয়ারম্যান’কে রাজি করাতে পারলেই হবে। চেয়ারম্যান আবার দাড়িওয়ালা কাউকে দেখতে পারেননা।

ইরিনার সাথে আমার সম্পর্কের বিষয়ে ভাইয়া’র সাথে একদিন কথোপকথন হল। ভাইয়া একটা লেকচার দিলেন। এর সারমর্ম, ‘আমি যা করছি তা অশ্লীলতার শুরু। অশ্লীলতার অনেকগুলো সিড়ি আছে। আমার এখনই ফিরে আসা উচিত।‘ আমি এই কান দিয়ে শুনলাম আর ঐ কান দিয়ে বাহির করলাম। বাহির করলাম বলা ঠিক হয়নি, বাহির করতে চেষ্টা করলাম। ঘুমোতে যাওয়ার আগেও ভাইয়ার কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো। মানুষ যুক্তি তৈরি করে, আমার অজান্তেই নিজের মধ্যে যুক্তি তৈরি হতে থাকলো। আমার যুক্তির সারমর্ম হচ্ছে, ‘জীবনটাকে কি উপভোগ করবোনা?’ আর আমিতো ইরিনার সাথে অন্য কিছু করছিনা, সর্বোচ্চ মোবাইলে কথা বলা! মানুষজন কতো খারাপ কাজ করে। ইরিনার সাথে কথা বলা যদি মন্দ কাজ হিসেবেও ধরা হয়, তবুও মন্দ কাজের লেভেলে আমি খুবই নিচের দিকে থাকবো। তাছাড়া আরেকটা বিষয়ও আছে, আমি আর ইরিনা বিয়ে করবো বলেও ঠিক করেছি। আমার ব্যাংকে চাকরি হওয়ার এক বছরের মধ্যেই বিয়ে করবো।

ভাইয়ার মিন্টু রোডে যাওয়ার কাহিনী বলা যাক। এশার নামায পড়ে বাসায় ফিরছিলেন। ভাইয়া নামায পড়েন বাড়ির পাশের একটা মসজিদেই, যেতে ৩-৪ মিনিট সময় লাগে। পথেই কালো গ্লাসের একটা মাইক্রোবাস ভাইয়াকে তুলে নিয়ে যায়। চা বিক্রেতা সুফিয়ান ঘটনাটা দেখে তাড়াতাড়ি এসে বাসায় খবর দেয়। সুফিয়ান ঘটনা বলা শেষ করার আগেই মা চিৎকার করে ঘুরে পড়ে যান। আমরা বুঝতে পারছিলাম না মাইক্রোবাসটি কাদের? ডাকাত, সন্ত্রাস না পুলিশের! ঘটনার আকস্মিকতায় আমাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। সবশেষে সুফিয়ান এর সহায়তায় আমি মাকে নিয়ে গেলাম পাশের ফার্মেসি নামক একটা হসপিটালে। এক শয্যা বিশিষ্ট হসপিটাল। মায়ের জ্ঞান ফিরল। ভাইয়ার সন্ধানও পাওয়া গেল ৫০০ টাকার দু’টো নোটের বিনিময়ে। ধানমন্ডি থানার ফারুক সাহেব নিশ্চিত করলেন, ভাইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।

বাবা তার পরিচিত, অর্ধ পরিচিত সবার কাছে সাহায্য চেয়ে বেড়াচ্ছেন, কোন গতি হচ্ছেনা। জঙ্গিবাদের মামলা শুনেই সবাই একশহাত পিছনে চলে যায়। আমার সাথে ভাইয়ার কয়েকজন বন্ধুর মোবাইল নম্বর আছে, তাদেরকেও কল দিলাম। ভাইয়ার ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়রের এর নাম্বার পেলাম, যিনি বছর দুই আগে বিসিএস দিয়ে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু আশায় গুড়ে বালি। উনার নাকি এখনও ট্রেইনিং পিরিয়ড চলছে, তার হাতে এখন কোন ক্ষমতা নাই। ক্ষমতা থাকলে কিছু করতে পারতেন বলেও আশা ব্যক্ত করেছেন।

মানুষ বিপদে পড়লে হাতের কাছে যাই পায়, তাই আকড়ে ধরে, বাবা ধরেছেন ফারুক সাহবেকে। সারাদিন থানা পুলিশ করে রাত বারোটার কয়েক মিনিট আগে বাসায় ফেরেন। বাসার দারোয়ান গেট লক করে চলে যায় এর আগে, যদিও বারোটা পর্যন্ত তার থাকার কথা। বাধ্য হয়ে আমাকে দো’তলায় মালিক থেকে চাবি আনতে হয়। প্রচন্ড জ্বরের অজুহাতে বাবা ব্যাংক থেকে ছুটি নিয়েছেন। ব্যাংকের শুধু দু’জন জানে মূল কাহিনী। মাকে নিয়মিত স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। তার সেবা শুশ্রুষার জন্য ছোট খালা এসেছেন। প্রতিরাতে বাবা কালো মুখ করে বাসায় আসেন। ক্লাস নাইন টেন পাশ করা কনস্টেবলদের আচরণে তিনি ব্যথিত। তার এখন মনে হচ্ছে ব্যাংকে না গিয়ে তার উচিত ছিল পুলিশে যাওয়া। এইসব এইট পাশ কনস্টেবলদের একটা উচিত শিক্ষা দিতেন তিনি।