আমি জানি আমাকে নিয়ে তুই খুব হতাশ। খুব বিরক্ত। কেমন জানি হয়ে গেছি আমি। কেমন যেন। অস্বাভাবিক। আমি জানি তুই আমাকে দেখলে, আমার কথা শুনলে, আমার কথা মনে পড়লেই ফিরে যাস পেছনের দিনগুলিতে। যখন আমরা একসাথে গান শুনতাম। একসাথে মুভি দেখতাম। দল বেঁধে পাঁজি পোলাপান সব এখানে ওখানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতাম। কি ছিলনা সেই আড্ডায়? নাটক, সিনেমা, খেলা, তারকা, পরস্পরকে পচানো, গালাগালি, গান, মিউসিক, গার্ল ফ্রেন্ড, মেয়ে… কি ছিলনা? কত মজাই না করেছি।

আমি জানি তুই এখনো ভাবনায় ডুবে যাস সেইসব দিনের কথা মনে করে, যখন আমরা একসাথে গলা মিলিয়ে বলতাম, “কি আছে জীবনে? একটাই তো জীবন!” যখন জীবন মানেই ছিল সিজিপিএ নিয়ে হা-হুতাশ আর বিনোদনের সাগরে সাঁতরে বেড়ানো।

আমি জানি তুই এখনো ভেবে পাসনা কি হতে কি হয়ে গেলো। তোর পাগলা বন্ধুটা কেন এমন হয়ে গেল। রসকষহীন। মলিন। ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট।


বন্ধু! তোকে অনেক কিছু শেয়ার করেছি জীবনে। কিন্তু একটা জিনিস শেয়ার করা হয়নি। তোর সেই বন্ধুটির আরেকটি পরিচয় ছিল। সে ছিল ভীতু। সে মৃত্যুকে ভয় করতো। খুব। তোকে কখনো বলা হয়নি বন্ধু। এত আনন্দ, এত ফান, এত বিনোদন, এত চাকচিক্যের মাঝেও যখন আমি একা হয়ে পড়তাম, মৃত্যুভয় আমাকে গ্রাস করতো। যখনই শুনতাম কেউ মারা গেছে, বা কারো লাশ দেখতাম, জানাজায় যেতাম, কবরে শায়িত করার দৃশ্য দেখতাম, আমি প্রচন্ড ভয় পেতাম। সত্যি বন্ধু। আমি মন থেকে চাইতাম যাতে আমার মৃত্যু না হয়। একদম মন থেকে। আমি মরতে চাইতাম না। মৃত্যুর কাছ থেকে আমি পালাতে চাইতাম। পরিচিত কেউ মারা গেলে আমি সপ্তাখানেক শান্তিতে ঘুমুতে পারতাম না। আমি চোখের সামনে কবরের অন্ধকার ঘরটা দেখতাম। দেখতাম আমি কাফনে মোড়ানো। আমি একা। একদম একা। ঘুটঘুটে অন্ধকার মাটির ঘরে।

আপাতদৃষ্টিতে বেশ সাহসী দেখতে এই আমি ছিলাম এমন মৃত্যুভয়ে কাতর।

বন্ধু! এই মৃত্যুভয় আমাকে কেমন করে জানি বদলে দিতে লাগলো। একদম ধীরে ধীরে। আমি ভাবতে লাগলাম এমন একটা দিনের কথা, যেদিন আমি সত্যিই মরে যাবো। ভাবতে লাগলাম কি হবে আমি যদি মারা যাই?

বন্ধু! তোর মতই আমি স্রষ্টায় বিশ্বাসী ছিলাম। আল্লাহকে বিশ্বাস করতাম। পরকালকে বিশ্বাস করতাম। যদিও তা শুধু বিশ্বাস পর্যায়েই আটকে রেখেছিলাম। বাইরে যা দেখা যাবার, তা সেই শুক্রবারেই যা একটু দেখা মিলতো। এস এস সি তে ফোর্থ একটা সাবজেক্ট ছিল। মেইন সাবজেক্টগুলোর তুলনায় যার কোন ভ্যালু ছিলনা। আমার জীবনেও এই আল্লাহর বিশ্বাসকে আমি কেমন জানি ফোর্থ সাবজেক্ট বানিয়ে রেখেছিলাম।

অদ্ভুত হলেও সত্যি, এই ফোর্থ সাবজেক্টটাই আমার সেই মৃত্যুর প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলো। এই ফোর্থ সাবজেক্টই আমাকে জানাতে লাগলো, এই মৃত্যু আমাকে দুটি পথের যেকোন একটির দিকে নিয়ে যাবে। চিরশান্তি অথবা অসহনীয় যন্ত্রনা। আমার ভেতরের ভীতু সত্তা বেশ ঝাঁকি খেয়ে উঠলো। সেই ভীতু সত্তা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগলো প্রস্তুত হতে। যে কোন একটির জন্যে।


মনে আছে স্কুলে টিফিন আওয়ারের পরের ক্লাসগুলোতে আমরা ব্রয়লার মুরগীর মত ঝিমুতাম? তখন হঠাৎ যদি স্যার তা খেয়াল করতে পারতেন, তাহলে সপাং করে বেত চালাতেন পিঠে, আর আমরা একেবারে মিলিটারি কায়দায় পিঠ টান টান করে ঝপাং করে সোজা হয়ে যেতাম। আমার ভেতরের ভীতু সত্তার সেই ধাক্কা যেন আমাকে তেমনই একটা কিছু করলো। আমি ঝপাং করে নামায ধরে ফেললাম। ভাবলাম আর যাই করি, নামায বাদ দেয়া যাবেনা। মরলে কবরে কি নিয়ে যাব?

আমি নামায পড়া শুরু করলাম। বেশ আত্মতৃপ্তি কাজ করতে শুরু করলো। প্যাড, গ্লাভস পড়ে ব্যাটিং করতে নামার মত আমিও যেন জাহান্নাম থেকে রেহাই পাবার প্যাড-গ্লাভস পড়ে ফেললাম। আর চিন্তা নেই। তাই সমান তালে নামায চলছে, সাথে চলছে সেই পুরোনো মুভি, গান, অশালীন আড্ডা, এদিক সেদিক উঁকি ঝুঁকি, জীবনকে কালার করার প্রচেষ্টা।

বন্ধু! সব ঠিকই ছিল। কিন্তু আমার ভেতরের ঐ অদ্ভুত ভীতু প্রাণীটা আমাকে আবার প্রশ্ন করতে লাগলো। আমাকে একা পেলেই একটা প্রশ্ন করতো সে। আমি কি দ্বিমুখী? আমি সকালে পুত পবিত্র হয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করছি, আর বিকেলে অশালীন গান, মুভি, আড্ডায়, নাচানাচি, চিন্তাধারায় ডুবে যাচ্ছি। একটা কি আরেকটার সাথে যায়? আমি উত্তর দিতে পারতাম না। মেলাতে পারতাম না কিছুই। খুব যন্ত্রণা হত। মানসিক যন্ত্রণা। লজ্জায় কুঁকড়ে যেতাম। অন্যের কাছে অপমানিত হওয়া যতটানা লজ্জার, তার চেয়ে হাজারগুণ লজ্জার ব্যাপার হল নিজের কাছে অপমানিত হওয়া। আমি প্রতিনিয়ত নিজেকে নিজেই অপমান করে যাচ্ছিলাম।

আমি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাইতে লাগলাম। শুরু করলাম জীবনের উদ্দেশ্যকে জানার। বোঝার। আল্লাহর কাছে লাখো শুকর, আল্লাহ আমার জন্যে পথ সোজা করে দিয়েছেন। আমি ধীরে ধীরে এই জীবনকে, তার উদ্দেশ্যকে বুঝতে লাগলাম। নিজের ত্রুটিগুলো শুধরাতে লাগলাম। নিজেকে বদলাতে লাগলাম।


বন্ধু! তোকে হয়তো কয়েকটা লাইনে আমি বোঝাতে পারবোনা আমি কি জানতে পেরেছি। কি বুঝেছি। শুধু এতটুকুই বলব, আমাদের এই ক্ষণিকের জীবনটা কিছুই না দোস্ত। কিছুই না। একটা বিশাল পরীক্ষা কেন্দ্র। তুই, আমি, আমরা সবাই দিনে রাতে এই পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদের প্রতিটা নিঃশ্বাস পরীক্ষা দিচ্ছে। আমাদের প্রতিটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজ রেকর্ড করা হচ্ছে। প্রত্যেকটা কাজের হিসেব দিতে হবে একদিন। বন্ধু, এই পৃথিবীর জীবন কতটা ছোট তোকে আমি হয়তো বোঝাতে পারবোনা। এই পৃথিবীর বিশালতা দেখে হয়তো তুই বুঝতেও চাইবিনা। তবে আমাদের রাসূল [সাঃ] বলে গেছেন, যদি কেউ বিশাল মহাসাগরে তার একটা আঙ্গুল ডুবিয়ে আবার উঠিয়ে নেয়, তবে আঙ্গুলটির অগ্রভাবে যেই পানি জমে থাকবে, সেটি হল এই দুনিয়া। আর সমগ্র মহাসাগর হল পরকাল। তুই কি বুঝতে পারছিস বন্ধু? আমরা কতটা ধোঁকার মাঝে আছি? কীসে আমাদের ভুলিয়ে রাখছে এই নির্মম সত্যটি থেকে?

এই মহাপরীক্ষা কেন্দ্রের মহাপরীক্ষক হলেন আল্লাহ্‌। তিনিই আমাদের এই মহাপরীক্ষা নিচ্ছেন। তিনি হলেন রব। রব মানে কি জানিস বন্ধু? তিনিই সবকিছুর মালিক। অর্থাৎ দাবিদার। শুধু আমাদের নামায রোজা নয়। আমাদের প্রতিটা কথা, প্রতিটা পদক্ষেপ, প্রতিটা ভাবনার, প্রতিটা দৃষ্টিপাতের ওপর তার দাবি। আমরা স্রেফ তাঁর আজ্ঞাবাহী দাস। দাস। শুধুই দাস। এই দাসের কাজ কেবল ৫ ওয়াক্ত নামায পড়া কিংবা রমজানে রোজা রাখা নয়। এই দাসত্ব ২৪ ঘণ্টার। ৩০ দিনের। ১২ মাসের। সারাটা জীবনের। এই দাস তার প্রতিটা নিঃশ্বাস ব্যয় করবে আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করার জন্যে। এটাকে বলে ইবাদাত। দাসত্ব। কি অদ্ভুত না? আমরা ইবাদাত মানে নামাযই বুঝতাম। তুই বল, দাসত্ব কি শুধু দুই একটা কাজে আটকা থাকে? একজন দাস তার মালিকের আদেশ বিনা প্রশ্নে সাথে সাথেই পালন করে। আমরা ঠিক তেমনই দাস। আল্লাহর দাস। আল্লাহ্‌ যা যা আদেশ করেছেন, তা তা বিনা প্রশ্নে মানতে আমরা বাধ্য। কারণ আমরা দাস। তুই কি বুঝতে পারছিস এই দাসত্বের ব্যাপকতা?

বন্ধু! তুই যতদিন বুঝতে পারছিস না তুই আল্লাহর একজন দাস, ততদিন তোর মনে হবে আমি কেমন জানি হয়ে গেছি। কেমন জানি বদলে গেছি। গোঁড়া হয়ে গেছি। অদ্ভুত হয়ে গেছি। কিন্তু বন্ধু! যখনই তুই অনুভব করবি এই ছোট্ট জীবনটা কিসের জন্যে পেয়েছিস, তখন দেখবি সময় কিভাবে দ্রুত দৌড়াচ্ছে। আমার ভয় হয়, ততদিনে না দেরি হয়ে যায়।

বন্ধু! মরীচিকার লোভে পড়ে যেমন মরুভূমির পথিক পথ হারিয়ে ধোঁকা খেয়ে যায়, তেমনি আমরাও এই পৃথিবীর মরীচিকার পিছে ছুটে ছুটে ধোঁকাই খেয়ে যাচ্ছি। এই দুনিয়ার মরীচিকার কোন শেষ নেই। যত ধরতে যাবি, ততই বেড়ে যাবে তার সংখ্যা। এভাবে শুধু ছুটতেই থাকবি। কোনদিন তোর ছোটা শেষ হবেনা।

বন্ধু! পৃথিবীতে যারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, তারা কেউই মেনে নিতে পারেনি যে তাদের আশপাশের এত আনন্দ, এত মজা, এত বিনোদন, এত কালার – এইসব Deceiving elements. এ সবই ধোঁকা। এই জিনিসটা মেনে নিতে পারা আসলেই অনেক কষ্ট। আমি তা ভালো করেই জানি বন্ধু। কিন্তু এটাই সত্য। এটাই বাস্তব।


বন্ধু! ইসলামকে জানার চেষ্টা কর। বোঝার চেষ্টা কর। আমাকে তুই খুব বিশ্বাস করতি। আমি জানি। তাই তোকে বলছি। ইসলামই হল একমাত্র সত্য। চির জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে ইসলাম ছাড়া আর একটা অপশন ও নেই। একটাও না। এটা কোন ধর্ম না বন্ধু। এটা একটা জীবন ধারণা। একটা আদর্শ। একটা চিন্তাধারা। একটা দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ্বাস কর, ইসলাম মানে কেবল নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত না। এগুলো ইসলামের অংশ মাত্র। ইসলাম একটা সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এই জীবন ব্যবস্থায় আমরা তাই করতে পারি, যা কুরআন আর সুন্নাহ সমর্থন করে। আর কুরআন সুন্নাহ যা নিষেধ করে, এই জীবন ব্যবস্থায় তা কিছুতেই করা যায়না।

বন্ধু মৃত্যুর পরে তো আমরা আল্লাহ্‌র কাছেই ফিরে যাবো। এটা তো অন্তত তুই জানিস। তবে জেনে রাখ, আল্লাহ্‌ বলেছেন, আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যজীবন জীবন ব্যবস্থা হল একটাই। সেটা হল ইসলাম। বাকি সব বাতিল। বাতিল। বাতিল। বাতিল। বাকি সব চিন্তাধারা আর লাইফ স্ট্যাইল আল্লাহ্‌ সেদিন ছুঁড়ে ফেলে দেবেন।

আমি স্বার্থপর নই। আমি চাইনা আমি নিজেই শুধু পরকাল গোছাই। আমি চাই তুইও থাকবি আমার সাথে। আমরা একসাথেই পরকাল গোছাবো। হয়তো কোন মানবিক বাধার কারণে কিংবা আমার অযোগ্যতার কারণে তোকে সবকিছু বলতে পারিনি। দেখাতে পারিনি সত্যের পথ। জানিনা আল্লাহ্‌ আমাকে এর জন্যে ক্ষমা করবেন কিনা। তবুও এই এলোমেলো চিঠিটা দিয়ে সেই বাধাটাই কিছুটা হলেও টপকে যাবার সামান্য চেষ্টা করলাম মাত্র।

তোকেও ‘কেমন যেন হয়ে গেছিস’ দেখার প্রত্যাশায়

তোর সেই বন্ধু,
যে তোকে দুনিয়ার চাইতে পরকালেই সফলতর দেখতে চায়