ঘর সংসার সব সামলিয়ে, হিজাব মেনে, শরিয়া মেনে বাইরেও কাজ করা যাবে কিনা, নিজের ক্যারিয়ার build up করা যাবে কিনা এইধরনের “উভয়কূল balance করা” যাবে কি যাবে কি যাবেনা এটা যুক্তিতর্ক আর সামাজিক বাস্তবতার দোহাই দেওয়ার চেয়ে অনেক বেশি একজন মুসলিমাহর উপলব্ধির বিষয়। আমিও কোন যুক্তিতে যাবনা। আমি শুধু অনেক অনেক বছর আগের মধ্যযুগীয়, আধুনিক শিক্ষাবঞ্চিত, দামি দামি ডিগ্রীবিহীন কয়জন নারীর কথা আপনাদের বলতে চাই।

হযরত সাওদা (রাঃ) এর স্বামীর মৃত্যুর পর পাঁচ অথবা ছয়টি সন্তান নিয়ে মুসিবতের সময় রাসুল (সঃ) তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। সাওদা (রাঃ) একটু সংকোচ করছিলেন। রাসূল (সঃ) বললেন, আমার প্রস্তাবে রাজি হতে তোমার বাধা কিসের? সাওদা বললেনঃ আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর নবী! সৃষ্টিজগতের মধ্যে আপনি আমার সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি। আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করতে আমার কোন বাধা নেই কিন্তু আমার ভয় আমার এই সন্তানগুলি সকাল সন্ধ্যা সর্বক্ষণ আপনাকে বিরক্ত করবে, আপনার সেবা থেকে আমাকে বিরত রাখবে। রাসূল (সঃ) বললেনঃ এছাড়া আর কোন বাধা আছে? সাওদা বললেনঃ না, আর কোন বাধা নেই। রাসুল (সঃ) বললেনঃ আল্লাহ তোমাকে করুণা করুন। সর্বোত্তম নারী তারা যারা উটের পিঠে পিছন দিকে চড়ে। কুরাইশদের সৎকর্মশীল নারী তারা যারা তাদের শিশু সন্তানের প্রতি মমতাময়ী এবং স্বামীদের প্রতি যত্নশীল।

হিজাব ফরয হওয়ার আগে সে সময় মক্কার কোন গৃহে পায়খানার ব্যবস্থা ছিলনা। পায়খানা থাকাটা তারা শোভন মনে করতো না। সে সময় মেয়েরাও প্রাকৃতিক কর্ম সমাধানের জন্য রাতের বেলা বাড়ীর বাইরে যেত। একবার রাসূল (সঃ) এর স্ত্রী বাইরে যাচ্ছেন। পথে উমারের দৃষ্টিতে পড়েন। তিনি বলে উঠেন, আপনাকে আমি চিনে ফেলেছি। উমারের এমন কথায় সাওদা রেগে যান এবং তার বিরুদ্ধে রাসূল (সঃ) কাছে নালিশ করেন। এই ঘটনার পরিপেক্ষিতে হিজাবের আয়াত নাযিল হয়। সুবাহানাল্লাহ একজন পরপুরুষ রাত্রিবেলা একজন মহিলাকে পথে চিনে ফেলেছে সেই ঘটনায় হিজাবের আদেশ। আল্লাহু আকবর। এছাড়া হিজাবের মহত্ব বোঝা যায় কুরআনে সূরা আহযাবের অন্য একটা আয়াতে যেখানে আল্লাহ বলছেন,

“হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে।” [৩৩:৩২]

বিদায় হজ্জে রাসূল (সঃ) উম্মাহাতুল মুমিনীনদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমার পরে তোমরা ঘরে অবস্থান করবে। হযরত সাওদা (রাঃ) এই নির্দেশের উপর এত কঠোরভাবে আমল করেন যে, হজ্জের উদ্দেশ্যেও আর কখনো ঘর থেকে বের হননি। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সঃ) এর ওফাতের পর তার সহধর্মিণীগণ হজ্জ করতেন; কিন্তু সাওদা ও জয়নব বিনত জাহাশ রাসূল (সঃ) এর আদেশ কঠোরভাবে পালন করতেন। ঘর থেকে বের হতেন না। সাওদা (রাঃ) বলতেন, আমি হজ্জ ও উমরা দুটোই করেছি। এখন আল্লাহর নির্দেশমত ঘরে বসে থাকব।

একজন নারী তার মৃত্যুর আগে আরেকজন মহিলার কাছে ওসিয়ত করে গিয়েছিলেন তার জানাজা যেন রাতের অন্ধকারে হয় এবং রাতের অন্ধকারেই যেন তাকে কবর দেওয়া হয়। এর কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “পর্দা ফরজ হওয়ার পর আমি কোন পরপুরুষের সামনে যাইনি, কোন পরপুরুষও আমাকে দেখেনি! আমি চাইনা দিনের আলোতে জানাজা আর কবর হলে কাফন পরা অবস্থায় কোন পরপুরুষ আমার শরীরের গঠন দেখে ফেলুক।” আল্লাহু আকবর! এই মহীয়সী নারীর নাম হযরত ফাতেমা (রাঃ) আমাদের মুসলিমদের ঘরে ঘরে ফাতেমারা জন্ম গ্রহণ করুক…আমীন।

আর আর্থিক স্বচ্ছলতা, পরিবারের আয়ে অংশগ্রহণ করা, পরিবারের সদস্যদের ভরণ পোষণের ভার নেওয়া কিংবা “এত পড়াশুনা করছি কি ঘরে বসে থাকার জন্য” যুক্তির বোনদের জন্যও আমার কোন পাল্টা যুক্তি নেই। তবে এক্ষেত্রেও আমার মধ্যযুগের আরেক মহীয়সী নারী মা আইশা (রাঃ) এর কথা মনে পড়ে গেল। রাসূল (সঃ) এর সহধর্মিণী থাকা অবস্থায় যার ঘর গৃহস্থালীর গোছগাছ ও পরিপাটির বিশেষ কোন প্রয়োজন পড়ত না। না না তাদের বাড়িতে দশ বিশ জন কাজের লোক ছিলনা যে বাড়ির সব কাজ করে দিবে! আসলে মা আইশা (রাঃ) এর রান্নাবান্নার সুযোগ খুব কমই আসতো! তিনি বলতেন, কখনো একাধারে তিন দিন এমন যায়নি যখন নবী পরিবারের লোকেরা পেট ভরে খেয়েছেন। মাসের পর মাস ঘরে আগুন জ্বলতো না। এ সময় খেজুর ও পানির উপরই কাটতো। অনেক সময় এমন হতো রাসূল (সঃ) বাইরে থেকে এসে জিজ্ঞেস করতেন, “আইশা! কিছু আছে কি?” তিনি জবাব দিতেন, "ইয়া রাসুলুল্লাহ কিছুই নেই!" তারপর সবাই মিলে রোজা রাখতেন। এত কঠিন সময়েও মা আইশা (রাঃ) উপার্জনের খোঁজে বেরিয়েছেন সেরকম কিছু আমি উনার দেড়শ পৃষ্ঠার জীবনীর কোথাও পাইনি।

আমার ক্ষুদ্র জীবনে যতবার ইসলামের সেই গৌরবময় যুগে আমাদের এই মহীয়সী নারীদের সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে প্রতিবার আমি এসবই পেয়েছি। দেখেছি আল্লাহর দ্বীনের প্রতি, দ্বীনের বিধানের প্রতি তাদের অগাধ ভালোবাসা আর আস্থা। কিন্তু আপনি বাইরে কাজ করবেন কিনা, কর্পোরেট ক্যারিয়ার, সামাজিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবেন কিনা, শিল্প সাহিত্য তথ্য প্রযুক্তির প্রতিটা ক্ষেত্রে নিজের প্রতিভার বিস্ফোরণ ঘটাবেন কিনা এসব উচ্চমার্গীয় যুক্তিতর্কের কোনটাই আমি করব না। কেন জানেন? কারণ আমার ছোট্ট এই লেখাটা রোকেয়া প্রাচী, রুবাবা দৌলা মতিন কিংবা অগ্নিকন্যা লাকীদের জন্য নয়। আমাদের অনেক অনেক বছর আগের কয়জন মহীয়সীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি তাদের যারা আল্লাহর বিধানে সমাধান খোঁজে। আদর্শের খোঁজ করে বেড়ায় মধ্যযুগীয় সেঁকেলে সেইসব মহীয়সী নারীদের মাঝে। ঘরে বাইরে সবকিছু সামলিয়ে আপনি কতটুকু ইসলাম পালন করতে পারবেন সেই হিসেব কষতেও আমি বসিনি। শুধু বলতে চাই, আপনার সন্তানদের যেন রহিমা বুয়ার কাছে বড় হতে না হয়। আপনার প্রিয়তম স্বামীকে যেন ফোন করে জিজ্ঞেস করতে না হয় “তোমার ফিরতে কতক্ষণ late হবে?” আর সেই কঠিন দিনে যেদিন মহান রবের সামনে দাঁড়াবেন সেদিন যেন মনে আফসোস না আসে, এই দুনিয়ায় আল্লাহ আপনার জন্য কি নির্ধারণ করেছিলেন আর আপনি নিজের জন্য কি নির্ধারণ করেছিলেন! আল্লাহ আপনার জন্য কি নির্ধারণ করে দিয়েছেন এই দুনিয়ায়? ইসলামে সবচেয়ে সম্মানিত চারজন নারীর কথা আপনারা জানেন?? মনে করিয়ে দেই ১। হযরত খাদিজা (রাঃ) ২। হযরত ফাতেমা (রাঃ) ৩। হযরত আছিয়া (রাঃ) ( ফেরাউনের স্ত্রী) ৪। হযরত মারিয়াম (রাঃ) (ঈসা (আঃ) এর মা)। এরা কেউ পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতা করে জয়ী হয়নি, এরা কেউ কর্পোরেট আইডল নয়, এরা কেউ মিডিয়ার প্রিয়মুখ নয়, এরা কেউ বিদ্যা বুদ্ধির বহর নয়! ভাল করে খেয়াল করে দেখুন এরা সবাই এক একজন ভাল স্ত্রী আর ভাল মা ছিলেন! আল্লাহ সুবাহানু ওয়া তায়ালা একজন নারীর মর্যাদা নির্ধারণ করেছেন দুইটা জায়গায় যেখানে তারা সবচেয়ে সুন্দর, মানানসই— মাতৃত্ব আর স্ত্রীত্ব!

সংসার স্বামী সন্তান এসবের সাথে ক্যারিয়ার, চাকরী এসবের balance করে ইসলামটাও ঠিকঠাক রাখতে চান ঐ জান্নাতে যাওয়ার জন্যই তো! তাই না? আসুন আপনাকে জান্নাতের ঠিকানাটা লিখে দিচ্ছি, সোজা চলে যান! খামোখা ঘরে বাইরে সবকিছু এত ব্যালেন্স করার কষ্ট করবেন কেন?

আব্দুর রহমান ইবন আউফ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসুল (সঃ) বলেছেন, “মুসলিম নারী যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রামাদানের সাওম পালন করে, নিজের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে তবে তাকে বলা হবে জান্নাতের যে কোন দরোজা দিয়ে ইচ্ছে তুমি ভিতরে প্রবেশ কর।” [মুসনাদে আহমদ, ইবন হিব্বান]

ভালো থাকবেন, আল্লাহ আপনার হেফাজত করুন। জাজাকাল্লাহু খাইরান।