বাগদাদ, ১৮৭ হিজরী।

দিনের শুরুটা হলো আর দশটা দিনের মতই। সারারাত একটানা দখিনা বাতাস বয়ে চলেছে বাবুয যাহাবের শীর্ষদেশ ছুয়ে। নৈশ প্রহরীরা মৃদু শব্দ তুলে টহল দিয়েছে বৃত্তাকার শহরের অলিগলিতে। কুফা থেকে সিল্কের কাপড় নিয়ে আসা বানিজ্যিক কাফেলা সারারাত বিশ্রাম করেছে কুফা ফটকের সামনে, রাগী কোতোয়ালকে জাগানোর সাহস হয়নি কারো। দজলার তীরে সারারাত ঢেউয়েরা এসে আছড়ে পড়েছে, ছন্দময় শব্দ তুলে ঘাটে বাধা নৌকাগুলো নড়ে উঠেছে। কসরুল খুলদে খলিফা হারুনুর রশিদ ঘুমিয়েছেন প্রশান্তির নিদ্রা, মাঝরাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন টুরস পর্বত অতিক্রম করছেন সেনাবাহিনীর সাথে। পুরোটা রাত যুবাইদার দাসীরা একটানা কোরআন তিলাওয়াত করে গেছে, অন্য দাসীরা তখন ঘুমিয়েছে, সকালে আসবে তাদের পালা।

শেষরাতে জামে মানসুরের ফটক খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন বৃদ্ধ মুয়াজ্জিন। প্রতিবারের মত অদ্ভুত প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল দেহ-মন। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন হাউজের দিকে। হাউজের পানি ঠান্ডা হয়ে আছে।
-
ফজরের আজান শোনা গেল আবু জাফর মানসুরের বৃত্তাকার শহরে। কিয়ামুল লাইল আদায় করা পুরুষরা ডেকে তুললেন পরিবারের সদস্যদের। হাই তুলে আড়মোড়া কাটলো সদ্য বালেগ হওয়া কিশোররা, দুবছর ধরে নিয়মিত মসজিদে উপস্থিত হচ্ছে তারা। দীর্ঘ পাগড়ি পরিহিত বৃদ্ধরা ধীর পায়ে পাশ কাটালেন ছোট ছোট অলিগলি, এগিয়ে চললেন মসজিদের দিকে। কসরুল খুলদে খলিফা হারুনুর রশিদ তাকালেন প্রিয়তমা স্ত্রী যুবাইদার দিকে। আস্তে করে ডেকে দিলেন তাকে। স্বামীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন যুবাইদা। অজু শেষে হারুনুর রশিদ দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেলেন। দেয়ালে ঝুলছে পাগড়ি। কিছুদিন আগে হজ্বের সফরে তিনি এই পাগড়িটি কিনেছিলেন। পাগড়ি মাথায় প্যাঁচানো শেষে খলিফা দেখলেন যুবাইদা অযু করে এসেছে। বারান্দায় দাসীদের ত্রস্তপদের শব্দ শোনা যাচ্ছে। খলিফা প্রাসাদ থেকে বের হতেই দুজন দেহরক্ষী তার পিছু নিলেন। খলিফা ধীরে ধীরে এগুলেন মসজিদের দিকে। তিনি কিছু একটা ভাবছেন, চিন্তিত।

-
দিনের শুরুতে কারখের বাজারে শুরু হলো কর্মচাঞ্চল্য। রুটির দোকান থেকে তাজা খাবারের সুঘ্রান ভেসে এল। ভারী দেহের পাচকরা বড় চুলার পাশে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে রান্নায় মনোযোগ দিল। দিনের আলো বাড়তেই লোকজন ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হল। শিশুরা ছড়িয়ে পড়লো খেলার মাঠে, কেউ গেল দজলার তীরে, ওখানে অপেক্ষা করছে শীতল বাতাস। ফজরের নামাজ শেষ হতেই মাছধরা নৌকাগুলো পাল তুললো গন্তব্যের দিকে। কুফা থেকে আসা বানিজ্যিক কাফেলাকে সামান্য জিজ্ঞাসাবাদের পর শহরে ঢোকার অনুমতি দিল কোতোয়াল। ব্যবসায়ীরা প্রথমে সরাইখানা খুঁজে নিল। রসদবাহী উটগুলোকে বেধে রাখা হল সরাইখানার সামনে। ওগুলোকে খাওয়ানের দায়িত্ব কর্মচারীদের। ব্যবসায়ীরা ছুটলেন হাম্মামের দিকে। সফরের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার জন্য গোসল দরকার এখন।

বসরা থেকে খেজুর এসেছে নৌকায় করে। তারা এসেছে উবাল্লা নহর ধরে। দুপাশে ছিল মনোরোম বাগান। দজলার তীরে নৌকা ভীড়তেই খেজুর তুলে দেয়া হল উটের পিঠে। এবার বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের হাতে বিক্রি করার পালা।
ধীরে ধীরে বাজারে কোলাহল বাড়লো। ভারতীয় বণিক, নিশাপুরের সুগন্ধী ব্যবসায়ী, আন্দালুসের গায়ক, আফ্রিকান হাতির দাঁত ব্যবসায়ী, আর্মেনিয়ান দাস বিক্রেতা, মার্ভের শিক্ষানবীস ছাত্র, ফারগানার ফল ব্যবসায়ী সবাইকেই দেখা গেল। দুয়েকজন উদাস বৃদ্ধ দামাদামি করছেন ফলের দোকানের সামনে। আসলে কেনার ইচ্ছে নেই তাদের, স্রেফ অভ্যাসের বশে কাজটা করছেন। ওয়াররাকের দোকান খুলে গেল। বৃদ্ধ বিক্রেতা ব্যস্ত হলো বইপত্রে জমে থাকা ধূলো সরাতে।

মসজিদে মসজিদে তইলাসান পরা আলেমরা তৈরী হলেন দরস দিতে। তারা বসলেন মসজিদের প্রশস্ত চত্বরে, বৃত্তাকার খিলানের পাশে। তালিবুল ইলমরা বসে পড়লো উস্তাদের সামনে। আনুষ্ঠানিক ভাবে কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হবে দরস।
-
পেশাজীবি মানুষরা ঘর থেকে বের হলো নিজেদের কাজের উদ্দেশ্যে। ধীরে ধীরে জেগে উঠলো শহর। নতুন দিনের জন্য তৈরী হলো বাগদাদ, আব্বাসিদের রাজধানী। একইসাথে পৃথিবীর রাজধানীও বটে।

(...... )